সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

নাস্তিকতার আবরণে ইসলামবিদ্বেষ


মাহমুদুর রহমান




আমাদের ছাত্রজীবনে কেউ নাস্তিক শুনলে তার দিকে কৌতূহল মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাতাম। মনে হতো ভিন গ্রহের বাসিন্দা বুঝি। তখন ডিজিটাল যুগ আসেনি, পত্রিকায় লিখেও কেউ তার নাস্তিকতার সবিস্তার জানান দিতেন না। সবকিছুই ছিল লোকমুখে শোনা। মাত্র গুটিকয়েক বিখ্যাত নাস্তিক ছিলেন। মুসলমান পরিবারের সন্তানদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. আহমদ শরীফ এবং জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের কথাই আমাদের ছাত্রজীবনের আড্ডায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতো। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম কেন, কোনো ধর্ম নিয়েই অযথা নিন্দা করতেন বলে শুনিনি, আজকের তরুণ নাস্তিকদের মতো অশ্লীল বাক্য ব্যবহার তো দূরের কথা।
তরুণ বয়সে ধর্ম সম্পর্কে আমাদের মধ্যেও যে এক ধরনের নির্বিকার মনোভাব ছিল না, এমন দাবি করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। লেনিন বলেছেন, ধর্ম নাকি আফিম—এসব কথা নিয়ে তুমুল তর্ক বেধে যেত। ইসলামের ইতিহাস চর্চার চেয়ে সেই বয়সে বিপ্লবী চে-গুয়েভারার রোমাঞ্চকর জীবন কাহিনী পড়তেই বরঞ্চ বেশি উত্সাহ পেতাম। তবে, যে যতই বাম ঘরানার হোক না কেন, আমাদের মহানবী (সা.) সম্পর্কে ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধাপোষণ করত না, এমন কোনো সহপাঠী কিংবা পাড়াতুতো বন্ধুর অস্তিত্ব ছিল না। শাহবাগের দুর্বিনীত, ইসলাম-বিদ্বেষী, বেপরোয়া ব্লগারচক্র সরকারের প্রকাশ্য মদতে ১৭ দিনব্যাপী একটানা নাটক মঞ্চস্থ করে দৃশ্যপট থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে বটে; কিন্তু যাওয়ার আগে বাংলাদেশের বর্তমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল্যবোধ সম্পর্কে আমার আস্থায় বড়সড় ফাটল তৈরি করে দিয়ে গেছে।
নাস্তিকতা বা অঃযবরংস শব্দটি গ্রিক ভাষার ধঃযবড়ং থেকে এসেছে। এর অর্থ—ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা (ঘড়হ-বীরংঃবহপব ড়ত্ রিঃযড়ঁঃ এড়ফ)। ইউরোপ ও এশিয়ায় দার্শনিক আলোচনায় এই তত্ত্বের উত্পত্তিকাল যদিও খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধারণা করা হয়, কিন্তু পশ্চিমে আধুনিককালে আঠারো শতকেই এর সর্বাধিক বিস্তারলাভ ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানের অনেক পণ্ডিত ধারণা করেন যে প্রধানত মূর্তিপূজার বিরুদ্ধেই এথিজমের দার্শনিকতার উত্পত্তি। বাংলাদেশের নাস্তিকরা অবশ্য মূর্তিপূজার প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে ইসলামকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বপ্রথম এথিজম গ্রহণ করা হলেও ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পর ১৭৯৩ সালে ঈঁষঃ ড়ভ জবধংড়হ নামে নাস্তিক্যবাদী আইন স্বল্প সময়ের জন্য জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ঋত্ধহপব গ্রহণ করেছিল। সে বছর ১০ নভেম্বর বিলটি গৃহীত হলেও মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ১৭৯৪ সালের ৭ মে সেটি বাতিল করে ধর্মভিত্তিক ঈঁষঃ ড়ভ ঃযব ঝঁঢ়ত্বসব ইবরহম গ্রহণ করা হয়। আশা করি, পাঠক এথিজম এর সঙ্গে সেক্যুলারিজমকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সেক্যুলারিজম আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনের বিষয়-বহির্ভূত বিধায় ভবিষ্যতে অন্য কোনো লেখায় এ বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রয়েছে।
পৃথিবীতে এথিস্টদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ২০১২ সালে ডওঘ/এওঅ পরিচালিত সমীক্ষায় ১৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী নিজেদেরকে এথিস্টরূপে পরিচয় দিয়েছেন। আবার অন্য এক সমীক্ষায় ২.৩ শতাংশ এথিস্ট এবং ১১.৯ শতাংশ ধর্মহীন (ঘড়হ-ত্বষরমরড়ঁং) মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। এসব সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে প্রধান পশ্চিমা দেশগুলোতে এথিস্টদের সংখ্যা নিম্নরূপ :
ফ্রান্স ৩২%
জার্মানি ২০%
গ্রেট ব্রিটেন ১৭%
স্পেন ১১%
ইটালি ৭%
যুক্তরাষ্ট্র ৪%
আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ যুক্তরাষ্ট্রকে যতই বাধা-বন্ধনহীন সমাজ মনে করুক না কেন, সমীক্ষা বলছে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিটি ধর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট রক্ষণশীল।
বাংলাদেশের সমাজে নাস্তিকতা কতখানি বিস্তার লাভ করেছে, তার কোনো সমীক্ষা কোথাও পাওয়া সম্ভব বলে আমার অন্তত জানা নেই। কেউ এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে উপকৃত হব। তবে এদের সংখ্যা নিয়ে আমি মোটেও উদ্বেগ পোষণ করি না। কেউ যদি আল্লাহ, ঈশ্বরে কিংবা ভগবানে বিশ্বাস করতে না চায়, সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। শাহবাগ পিকনিক দেখার পর এদেশের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার জায়গাটা অন্যত্র তৈরি হয়েছে। সে বিষয়ে লেখার আগে আমাদের প্রজন্মের বাল্য, কৈশোর ও প্রাকযৌবনকাল নিয়ে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করছি।
আগের অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে, আমার বাল্যকাল কেটেছে পুরনো ঢাকার নানার বাড়িতে। তিনি এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি করতেন। প্রতিদিন সকালে ক্লিন শেভ্ড হয়ে অফিসে যেতেন। পোশাক-আশাকে যথেষ্ট সৌখিন ছিলেন। হৃদরোগ ধরা না পড়া পর্যন্ত ধূমপানের প্রচণ্ড আসক্তি ছিল। বলতে গেলে চেইন স্মোকারই ছিলেন। নানার বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল। গেন্ডারিয়াতে সীমান্ত গ্রন্থাগার নামে একটি লাইব্রেরি ছিল। সদস্যরা মাসিক চাঁদার বিনিময়ে সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তেন। আমার দায়িত্ব ছিল নানার জন্য সপ্তাহে অন্তত দুটি গল্পের বই নিয়ে যাওয়া। আমার পড়াশোনার নেশাও সীমান্ত গ্রন্থাগারে সেই বই ঘাঁটাঘাঁটি থেকেই। আমার যথেষ্ট স্মার্ট সেই নানাকে জ্ঞান হওয়া অবধি কোনোদিন নামাজ রোজা কাজা করতে দেখিনি। তিনি আরবি ভাষায় তেমন দক্ষ ছিলেন না। বরং আমার নানী কোরআনে হাফেজ ছিলেন। নানার ভুল উচ্চারণে সুরা পাঠ নিয়ে নানী প্রায়ই ঠাট্টা-তামাশা করতেন। কোরআন তেলাওয়াতে ভুল-শুদ্ধ বোঝার মতো বিদ্যা আমার ছিল না। তবে প্রতি সুবেহ্ সাদেকে আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে শোনা নানার নামাজ পড়ার শব্দ এখনও কানে বাজে। তিনি ধার্মিক, উদার ও নীতিবান মানুষ ছিলেন।
আমাদের বাসার কাছে দুটি মসজিদ ছিল। কিন্তু একটা মসজিদে নানা কখনও নামাজ পড়তে যেতেন না। কারণ, যে জমির ওপর মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল, তার একটি অংশ নাকি একজন হিন্দু বিধবার ছিল। সম্ভবত তার কাছ থেকে জমি নেয়ার সময় উপযুক্ত দাম দেয়া হয়নি। নানা বলতেন, ওখানে নামাজ পড়লে নাকি শুদ্ধ হবে না। ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আমার এক শিক্ষক সপরিবারে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। যাই হোক, নানার শাসন খুব কড়া ছিল। যে কোনো পরিস্থিতিতে সূর্যাস্তের আগে বাড়িতে ফেরার কঠোর আইন ভাঙার সাহস আমাদের কোনোদিন হয়নি। সেই ষাটের দশকের একেবারে প্রথম দিকে আমার মা এবং মামা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাদের কাউকেই নানার সামনে কথা বলার খুব একটা সাহস করতে দেখিনি। সেই সময়কার শিক্ষিত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পরিবেশ বোঝানোর জন্যই এত কথার অবতারণা করেছি। আর একটি ঘটনার কথা বলেই মূল প্রসঙ্গে ফিরব।
আমি তখন ঢাকা কলেজে এইচএসসি পড়ি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বড় বোনের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গেছি। সঙ্গে অন্যান্য বন্ধুও ছিল। মা বলে দিয়েছিলেন, অবশ্যই রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে। কিন্তু, ফিরতে এগারোটা হয়ে গেল। অপরাধটা আমার ছিল না। আমাদের সব বন্ধুকে একসঙ্গে সবার শেষে খেতে দেয়া হয়েছিল। ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী, বন্ধু রফিককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখতে পেলাম, মা রাগে আগুন হয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছেন। সিঁড়ি বেয়ে দু’ পা এগোতেই তিনি আমাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেলেন। দেরির কারণ ব্যাখ্যা করার আর সুযোগ মিললো না। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমার গালে সপাটে চড়। বন্ধুর সামনে মায়ের হাতে মার, ব্যথা যত না লাগলো তার চেয়ে বেশি অপমানে চোখে পানি চলে এলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বন্ধু পেছন ফিরেই দৌড়।
রাগে-দুঃখে রাতে আর ঘুম এলো না। সারারাত জেগে পরিকল্পনা করলাম, ভোরের আগেই কেমন করে বাড়ি ছেড়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাব। এমন নিষ্ঠুর, অবিবেচক মায়ের সঙ্গে আর থাকব না। যে বন্ধুর বোনের বিয়ে খেতে গিয়ে এই বিপত্তি এবং যার সঙ্গে বাসায় ফিরেছিলাম, দুজনই পরবর্তী সময়ে যথাক্রমে বোটানি এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছে। একজন দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছে। অপরজন বোধহয় এখনও বিদেশে পড়ায়। কারও সঙ্গেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। আমারও অবশ্য বাড়ি ছেড়ে পালানো হয়নি। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার সেই কঠিন মা এখনও আমার সঙ্গেই আছেন। দীর্ঘ তিন যুগ শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন, তাও এক দশক হয়ে গেল। বয়স হয়েছে, আগের সেই তেজ আর নেই। পাকিস্তানি আমলে আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। কিন্তু, অন্যের বাসায় তিনি কোনোদিন টেলিভিশন দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেননি। আজকের শাহবাগ প্রজন্মকে দেখে পুরনো সব স্মৃতি ভিড় করে আসছে।
শাহবাগের ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। টেলিভিশনের পর্দায় দেখে যতটুকু ধারণা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে অধিকাংশই হয়তো আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই এসেছে। আমাদের যেখানে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি ছিল না, এরা কী করে শাহবাগ চত্বরে ছেলেমেয়ে মিলে সব একসঙ্গে রাতের পর রাত কাটায়, সেটা বুঝতে পারি না। নতুন প্রজন্মের এইসব তরুণ-তরুণীর পিতা-মাতার চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ কি তাহলে আমাদের পিতা-মাতার চেয়ে আলাদা? ধর্মবিশ্বাসের বিষয়টি বিবেচনা না করলেও বাঙালি সমাজের মূল্যবোধের মানদণ্ডে এই আচরণ কি সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি যুগ একেবারেই পাল্টে গেছে? এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। নিহত ব্লগার রাজীব যদি তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে খুব আশাবাদী হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, এককালের অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী একবাক্যে তাকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ প্রথম শহীদের সম্মান দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষায়, সে নাকি জাতীয় বীর। এই যদি ডিজিটাল তরুণের পরিণতি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এনালগ জামানাই বোধহয় অনেক ভালো ছিল। যে ছেলে ব্লগে ইসলাম ধর্ম এবং মহানবী (সা.) সম্পর্কে এমন কুিসত বাক্য অনায়াসে লিখতে পারে, নানা প্রকার মাদকে অভ্যস্ত হয়, সংসার জীবনে অনাচার করে বেড়ায় তাকে ডিজিটাল প্রজন্ম কীভাবে নেতার আসনে বসায় সেটা আমাদের মতো প্রাচীনপন্থীরা হয়তো বুঝতে পারব না। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে আধুনিক ছেলে-মেয়েদের স্বাধীনতার মাত্রার গল্প শুনে আতঙ্কবোধ করি।
আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও কষ্ট করে তার অভিভাবক পিসি এবং ল্যাপটপ দুটোই তাকে কিনে দিয়েছে। সেই ছেলে পড়াশোনার অজুহাতে ঘরের দরজা বন্ধ করলে নাকি বাবা-মায়ের দরজায় টোকা দেয়ার পর্যন্ত অনুমতি নেই। ঝঃঁফু ঃরসব শেষ হলে তবেই নাকি তিনি দরজা খোলেন। রাজীব এবং তার সমগোত্রীয়দের অপকর্ম সম্পর্কে জানার পর থেকে আমার সেই ভাগ্নেকেও আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছি। আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনলো কিনা সেটা নিয়ে ইদানীং আমি উদ্বেগ বোধ করি।
কয়েকদিন আগে আমার অফিসে গল্প করার সময় অগ্রজপ্রতিম জনপ্রিয় সম্পাদক শফিক রেহমান সমাজ পরিবর্তনের একটা চমত্কার ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, ল্যাপটপ প্রযুক্তির বয়স খুব বেশি নয়। তাই যথেষ্ট পরিণত বয়সে পৌঁছেই কেবল আমরা প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। তার আগে বাংলা-ইংরেজি ভাষায় নানা ধরনের বই পড়াটাই আমাদের জ্ঞানার্জন ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। তারা প্রযুক্তির সঙ্গে আগে পরিচিত হচ্ছে, তারপর পড়াশোনা। এর ফলে তাদের মননে চিরায়ত মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের বিকাশ ঘটছে না। অনেকে হয়তো শফিক ভাইয়ের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমি সেখানে চিন্তার খোরাক পেয়েছি।
লেখার শুরুতেই পশ্চিমা বিশ্বে নাস্তিকের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছি। ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যে সেই সংখ্যা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হলেও সে সব দেশে নাস্তিকরা খ্রিস্টধর্ম কিংবা যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে ফেসবুকে ঠঁষমধত্ কোনো পোস্ট দিচ্ছে না। মৌলবাদী ইহুদি ও খ্রিস্টানদের একাংশের তীব্র ইসলাম বিদ্বেষের কারণে কখনও কখনও আমাদের ধর্ম এবং রসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে আক্রমণের নিশানা বানানো হলেও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার আলোকে স্বীকার করতে হবে যে, তার অসভ্যতা অথবা ব্যাপকতা এখনও কথিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। বাংলাদেশে নাস্তিকতার আবরণে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামীর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার সুযোগ নিয়ে একটি গোষ্ঠী ইসলামের সব প্রতীককে অনবরত আক্রমণ করে চলেছে। রাজাকারের ছবি আঁকতে গেলেই তাবত্ আওয়ামীপন্থী এবং সুশীল(?) মিডিয়ায় বীভত্স মুখ এঁকে মাথায় চাঁদ-তারা খচিত টুপি এবং থুতনিতে দাড়ি দেখানো হচ্ছে। অথচ ইসলামের আগমনকাল থেকেই চাঁদ-তারা আমাদের পূর্বপুরুষের পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দাড়ি এবং টুপি আমাদের মহানবী (সা.)’র সুন্নত। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মুখেই দাড়ি এবং মাথায় টুপি রয়েছে। অনেক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধার মুখেও দাড়ি রয়েছে। নামাজ পড়ার সময় তারাও টুপি ব্যবহার করেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও একই ধরনের ভয়াবহ ইসলামবিরোধী পরিবেশ বিরাজ করছে। নাটক ও সিনেমায় অবলীলাক্রমে রাজাকার দেখাতে গিয়ে অহরহ মুসল্লিদের অপমান করা হচ্ছে। এ দেশের নাট্যকর্মীদের অধিকাংশই ভারত-প্রেমে বুঁদ হয়ে আছেন। সেই ভারতের নাটক, সোপ অপেরা ও সিনেমায় সাধারণভাবে হিন্দু ধর্মকে মহত্ভাবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নাস্তিক ভারতপ্রেমীদের মতো তাদের বিখ্যাত সব মেগাস্টাররা কখনোই ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন না।
শাহবাগ থেকে আমার সহকর্মী ফটোসাংবাদিক মোস্তফা এক ভয়াবহ ছবি তুলে নিয়ে এসেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, টুপি মাথায় এক তরুণ রাজাকার সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর হাস্যোজ্জ্বল এক বালিকা তার মাথায় জুতো দিয়ে পেটাচ্ছে! ছবিটা দেখে অনেকক্ষণ নির্বাক হয়ে নিজের চেয়ারে বসে থাকলাম। ধর্মের প্রতি এ কেমন ঘৃণার বীজ শিশুর কোমল মনে রোপণ করা হচ্ছে? কাদের ইশারায় হচ্ছে এসব? শাহবাগের নাস্তিকদের বিষয়ে আমার অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। এদের যত আক্রোশ কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতি কেন? বিতর্কিত ব্লগগুলোতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্মকে আক্রমণ করে কোনো পোস্ট তো লেখা হচ্ছে না। আজান, নামাজ এদের চক্ষুশূল হলে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোতে এত উত্সাহ কেন? ইসলাম নিয়ে সমালোচনার ভাষাই-বা এত অশ্লীল, এত কুরুচিপূর্ণ হয় কী করে? যে সব ব্লগার এই অপকর্ম করছে, তারা কি সব মানুষরূপী শয়তান? এদের পিতা-মাতার পরিচয়ই-বা কী? সেসব পিতা-মাতা পুত্র-কন্যাদের এই বিকৃত মানসিকতা সম্পর্কে কি অবহিত? তরুণ প্রজন্মের মগজ ধোলাইয়ের কাজে কোনো বিশেষ বিদেশি রাষ্ট্র কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগ আছে কিনা, সেই রহস্যের উদ্ঘাটনই-বা কে করবে? ঝড়সবযিবত্ব রহ নষড়ম নামে যে ব্লগে অশ্লীল ইসলামবিরোধী প্রচারণা চলছে, তার মালিকানায় বিদেশি অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে এখনই বিশদভাবে তদন্ত করা দরকার। কিন্তু, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?
কাকতালীয়ভাবে মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশে এজাতীয় চরম ইসলাম-বিদ্বেষী গোষ্ঠীর তত্পরতা শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মো. খুরশিদ আলম সরকারের দ্বৈত বেঞ্চ অবিলম্বে ওয়েবসাইট ও ব্লগ বন্ধ এবং অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে রুল জারি করেন। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, “Pending hearing of the Rule, the respondents are hereby directed to take all necessary steps to block the above noted facebooks/websites/webpages and URL and/or any other similar internet sites and also to initiate investigation to identify the perpetrators of all such offensive websites, at once and submit a report along with compliance within 2 weeks from the date of receipt of this order.” (রুল নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া চলাকালে, বিবাদী পক্ষকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে যে তারা যেন এই মুহূর্তে আপত্তিকর সকল ফেসবুক/ওয়েবসাইট/ওয়েব এবং ইউআরএল এবং/অথবা অন্যান্য ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং এই সকল ওয়েবসাইটের হোতাদের খুঁজে বের করে। এই আদেশ প্রাপ্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে নির্দেশ প্রতিপালন ও প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেয়া হলো।)
আদালতের নির্দেশের পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার চরম ইসলাম-বিদ্বেষী ও অশ্লীল ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ এবং তাদের হোতাদের চিহ্নিত করে শাস্তিবিধান করেনি। উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে মহাজোট সরকারের সব মন্ত্রী ও এমপি অপরাধীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। শাহবাগের এক ধর্মদ্রোহী, নষ্ট তরুণ অজানা ঘাতকের হাতে নিহত হলে তাকে শহীদের খেতাব দিয়ে প্রকৃত শহীদদের অবমাননা করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সিধারীদের বাধেনি। স্বয়ং এটর্নি জেনারেল উচ্চ আদালতের রুলের বিষয়ে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের বখে যাওয়া স্বঘোষিত নেতাকে জাতীয় বীর আখ্যা দিয়েছেন।
আদালত যাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য উল্টো প্রশাসন থেকে গানম্যান দেয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল কেবল ইসলামের বিরুদ্ধেই সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করেননি, তারা একইসঙ্গে আদালতেরও অবমাননা করেছেন। কথিত শাহবাগ গণজাগরণের প্রথম থেকেই আমার দেশ এটিকে সরকারের রিমোট কন্ট্রোলে পরিচালিত রাজনৈতিক চালরূপে বিবেচনা করছে। গত ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচি চলাকালীন বিচিত্র কর্মকাণ্ডে আমাদের বিশ্লেষণের সত্যতা সর্বাংশে প্রমাণিত হয়েছে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া বাকি রয়েছে। কথিত গণজাগরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে ঢাকার কোন্ কোন্ বিদেশি রাষ্ট্রের দূতাবাস জড়িত ছিল এবং খাদ্য, পানীয়, ফুর্তির বিপুল অর্থায়ন কোথা থেকে হয়েছে সে তথ্যটি পাওয়া গেলেই সব রহস্যের অবসান ঘটবে। পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে তিনিই সর্বোত্তম কৌশলী। অতএব, এসব প্রশ্নের জবাবও ইনশাআল্লাহ্, একদিন মিলবে।
মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে ব্যবহার করে রাজাকারবিরোধী প্রচারণার আড়ালে বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই ঘৃণা ছড়াচ্ছে। অথচ আজ তারাই ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের কার্যকলাপ আমার দেশ এবং আরও কয়েকটি পত্রিকায় ছাপা হলে তাকে ঐধঃব ঈধসঢ়ধরমহ বলে গাল-মন্দ করছেন। এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়া প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও হাতে-গোনা দুই-একটি মাত্র পত্রিকায় ইসলামের পক্ষে লেখালেখিও তারা সহ্য করতে পারছেন না। সুশীলত্বের আবরণে ঢাকা এই ফ্যাসিবাদী চিন্তা-চেতনা ক্রমেই দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। কয়েকজন তথাকথিত পেশাদার আওয়ামীপন্থী সম্পাদক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং আমার গ্রেফতারের জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে অনবরত দেন-দরবার চালাচ্ছেন। এদের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি বিশেষভাবে অবহিত আছি। এদের পেছনে যে একটি বিশেষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় রয়েছে, সে তথ্যও আমার জানা। প্রায় আড়াই মাস পরিবার পরিজন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনেক অসুবিধার মধ্যে অফিসে দিনযাপন করছি। শাহবাগ চত্বর থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন চিহ্নিত খুনি প্রকাশ্যে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন পত্রিকা বন্ধ এবং আমাকে দেখে নেয়ার হুঙ্কার ছাড়ছেন। সরকার সমর্থক সম্পাদকদের ষড়যন্ত্রের গল্প খানিক আগেই বলেছি। এত প্রতিকূলতাও আমাদের মনোবল ভাঙতে সক্ষম হয়নি। সম্পাদকীয় নীতি হিসেবে আমার দেশ দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকরা ধর্মবিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার দেশ পত্রিকার পাঠক ও দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর অভাবনীয় ভালোবাসায় আমরা ধন্য হয়েছি। সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং তাদের তল্পিবাহকদের নির্যাতন থেকে দেশপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ জনগণের দোয়ার বরকতে আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন।
 
 
সদস্য লগইন
ইউজার আইডি :
পাসওয়ার্ড :

সাইন আপ
পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন ?

বুধবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৩

মন্তব্য প্রতিবেদন : জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাই


মাহমুদুর রহমান




আজ বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ইংরেজি সাল ২০১৩। আমার অফিস বন্দিত্বের এক মাস ৩ দিন চলছে। এর মধ্যে এ মাসের ৮ তারিখে হাইকোর্টে একবার আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার দেশ পত্রিকার নিয়মিত পাঠক মাত্রই জানেন, সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ সেদিন দীর্ঘ শুনানি শেষে আমার আবেদন ফিরিয়ে দিয়ে সিনিয়র কোনো বেঞ্চে যাওয়ার মৌখিক পরামর্শ দিয়েছিলেন। অবশ্য যে লিখিত আদেশ পরদিন বিচারপতিদ্বয় দিয়েছেন, সেখানে বোধগম্য কারণে ‘সিনিয়র বেঞ্চ’ এই কথাটি আর রাখেননি। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন তাদের আদেশে লিখেছেন, Let it go out of list with liberty to mention the matter before any other appropriate bench (আবেদনটি তালিকার বাইরে পাঠানো হোক এই স্বাধীনতা সহকারে যাতে অন্য কোনো উপযুক্ত বেঞ্চে উত্থাপন করা যায়)। হাইকোর্টে বেঞ্চ গঠনের সময় আদালতের গঠনবিধি অনুসারে প্রতিটি বেঞ্চের এখতিয়ার বিশদভাবে বর্ণনা করা থাকে। সাধারণত উচ্চ আদালতের সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতীত যে কোনো দীর্ঘ ছুটির পরই হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। এছাড়া প্রধান বিচারপতি চাইলে যে কোনো সময়ই বেঞ্চ নতুন করে গঠন করতে পারেন।
এ বছরের শীতের ছুটির শেষে উচ্চ আদালত ২ জানুয়ারি থেকে খুলেছে। তার একদিন আগে অর্থাত্ ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ২০১৩ইং সনের ১নং গঠনবিধি শিরোনামে হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ গঠন করেছেন। তার উপরোক্ত আদেশের ১৪ নম্বর সিরিয়ালে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের এখতিয়ার নিম্নরূপ : “একত্রে ডিভিশন বেঞ্চে বসিবেন এবং শুনানীর জন্য ডিভিশন বেঞ্চে গ্রহণযোগ্য ফৌজদারী মোশন; ফৌজদারী আপীল মঞ্জুরীর আবেদনপত্র এবং তত্সংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র; মঞ্জুরীকৃত আপীল ও তত্সংক্রান্ত জামিনের আবেদনপত্র; ২০০৮ইং সন পর্যন্ত ফৌজদারী বিবিধ এবং ফৌজদারী রিভিশন ও রেফারেন্স মোকদ্দমাসমূহ এবং উপরোল্লিখিত বিষয়াদি সংক্রান্ত রুল ও আবেদনপত্র গ্রহণ করিবেন।” আইনি ভাষার কূট-কচালি বাদ দিলে মোদ্দা কথা আমার মতো নাগরিকের আবেদন শুনানির জন্য উল্লিখিত দ্বৈত বেঞ্চকে প্রয়োজনীয় সব এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। তারপরও আমার জামিন আবেদন বিষয়ে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় কেন তাদের বেঞ্চকে উপযুক্ত বিবেচনা না করে অন্য কোথাও যেতে আদেশ দিলেন? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে সেদিনকার আদালতের বিচিত্র পরিস্থিতি বয়ান করতে হবে।
জানুয়ারির ২ তারিখ আদালত খুললেও আমার জামিন আবেদনের শুনানি উল্লিখিত বেঞ্চ ৮ তারিখের আগে শুনতে সম্মত হননি। আমার আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী তার সাধ্যমত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সেই ১৩ ডিসেম্বর থেকে অফিসে অবরুদ্ধ রয়েছি, তাই শুনানি ৩ জানুয়ারি করা হোক। কিন্তু, আদালত অটল থেকে বলেছেন আগাম জামিন আবেদন শুনানির জন্য সপ্তাহের নির্ধারিত দিবস মঙ্গলবার ব্যতীত তারা আমার আবেদন শুনবেন না। এতে নাকি নিয়মের ব্যত্যয় হবে। অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে মেনশনের দিনেই শুনানি হওয়ার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। তার মধ্য থেকে একটা প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ২০০০ সালে ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক এ. এম. এম. বাহাউদ্দীনের জামিনের শুনানি গ্রহণের জন্য রাত দশটায় প্রধান বিচারপতির নির্দেশে হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ বসানো হয়েছিল এবং তিনি সে রাতে আগাম জামিনও পেয়েছিলেন। সম্পাদক বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধেও তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকার আমার মতোই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিল। এখন অবশ্য তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধুর সম্পর্ক রয়েছে।
আমি মাওলানা মান্নানের পুত্র, ইনকিলাব সম্পাদকের মতো ভাগ্যবান নই তাই ৬ দিন অপেক্ষা করেই হাইকোর্টে গেলাম। পথিমধ্যে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমার সহকর্মী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান আমার দেশ অফিস থেকে একই গাড়িতে উঠলেন। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রেফতার হওয়া কোনো বিষয় নয়, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমের মতো গুম হওয়াটাই অধিকতর আশঙ্কার। সেই জন্যই ছোটভাইসম দুই বন্ধু আমার সঙ্গেই আদালতে গেলেন। সাড়ে দশটায় আদালতে উঠতেই হতাশ হলাম। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী জানালেন যে, শুনানি দুপুর দুটো পর্যন্ত মুলতবি থাকবে, কারণ ‘মহামহিম’ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্বয়ং আসবেন জামিনের বিরোধিতা করতে। আর তার অভিপ্রায় উপেক্ষা করবে এমন ক্ষমতা কার? সরকার আমার মতো এক নগণ্য নাগরিককে এতখানি সম্মান দেয়ায় পুলকিত বোধ করলাম। আমার আইনজীবীরা দেখলাম খুবই আত্মবিশ্বাসী। সরকারের দায়ের করা মামলা এতই বানোয়াট যে পাঁচ মিনিটে জামিন হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বাইরে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গঠিত বাংলাদেশের ‘স্বাধীন’ আদালত, যেখানে বেছে বেছে ‘সেরা’ ব্যক্তিদের ‘মাননীয়’ বিচারপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আমি চাইলাম আর তারা জামিন আবেদন মঞ্জুর করে ফেললেন, এতখানি আশাবাদী হতে পারছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত বেলা আড়াইটায় শুনানি শুরু হলো। কোথায় গেল পাঁচ মিনিটে জামিনের আশাবাদ। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আমার বিরুদ্ধে সরকারের অভিযোগ যে কতটা মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হয়রানিমূলক এবং বেআইনি সেটা বিভিন্ন ধারা উল্লেখপূর্বক দীর্ঘক্ষণ ধরে বলেই যাচ্ছেন। আর মাননীয় বিচারকদ্বয়ের একজন স্মিতমুখে এবং অপরজন দৃষ্টি সামনের ফাইলে নিবদ্ধ করে বিষম গাম্ভীর্যের সঙ্গে অসীম ধৈর্যসহকারে সেই নিবেদন শুনেই যাচ্ছেন। মনে হলো তারা সামান্য জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নয়, মূল মামলার রায় যেন আজই দিয়ে ফেলবেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমার পক্ষের আইনজীবী থামলেন। এবার অ্যাটর্নি জেনারেলের পালা। ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার নিজস্ব রাজনৈতিক বাচনভঙ্গিতে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে আধ ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দিলেন। তিনি বললেন, বিচারপতির সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত অপর এক ব্যক্তির চলমান মামলা সংক্রান্ত আলাপচারিতা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমিই নাকি মহা অপরাধ করে ফেলেছি যদিও হ্যাকিংয়ের সঙ্গে আমার কোনোরকম সম্পৃক্ততার প্রমাণ সরকারের কাছে নেই। সে সব বিষয় এখনও প্রাথমিক তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে।
বিচারপতির স্কাইপ সংলাপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে কোনো বিচারপতির এই আচরণ আইনসম্মত কিনা, আদালত সেটি জানতে চাইলে বিব্রত অ্যাটর্নি জেনারেল আমতা আমতা করে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যানের পক্ষাবলম্বন করে কিছু একটা বলতে চাইলেন। আদালত কক্ষে উপস্থিত সবাই বুঝতে পারছিলেন যে, অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তাছাড়া এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের আমার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন রুল দেয়া প্রসঙ্গেও অ্যাটর্নি জেনারেল কোনো যুক্তি খাড়া করতে ব্যর্থ হলেন। সেই বেআইনি রুল অবশ্য আপিল বিভাগ ইতোমধ্যে স্থগিত করে দেয়ায় অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমের পক্ষে তার বিরোধিতা করাও সম্ভব হয়নি। বক্তব্যের শেষে তিনি আমার আদালত অবমাননার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্তির পুরনো প্রসঙ্গ তুলে জামিন দেয়ার বিরোধিতা করলেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের আর্গুমেন্টে আমি কৌতুক বোধ করছিলাম। আমার বিরুদ্ধে মামলার ধারা হলো রাষ্ট্রদ্রোহের, আর তিনি তুলছেন আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ।
অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে আমার জামিন আবেদন দাখিল নিয়েও অসত্য বক্তব্য দিলেন। আমার বিরুদ্ধে সরকার ১৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে মামলা দায়ের করলে আমি পরবর্তী কার্যদিবস অর্থাত্ সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন দাখিল করি। অথচ অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম অম্লান বদনে দাবি করলেন, আমি নাকি ইচ্ছা করে ৮ জানুয়ারি জামিনের আবেদন করে মহা অন্যায় করে ফেলেছি। দুই পক্ষের সওয়াল-জবাব শেষ হলে আদালতের আদেশ দেয়ার পালা। আদেশ শুনে আদালতে উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত।
আমার মামলাটি নাকি এতই জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ যে, আদালত তাদের চেয়েও সিনিয়র কোনো বেঞ্চে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তালিকার মামলা দীর্ঘ দুই ঘণ্টা শুনানির পর উচ্চ আদালতের এমন আদেশ নজিরবিহীন। হাইকোর্টের বেঞ্চের এখতিয়ার সিনিয়র-জুনিয়র বিবেচনা করে নির্ধারিত হয় না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী সেটি নির্ধারণ করে দেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাভভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতকে বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন অন্তত পরবর্তী বেঞ্চে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত আমাকে যেন পুলিশ হয়রানি না করে এ ধরনের একটি মৌখিক আদেশ প্রদানের জন্য। কিন্তু আদালত সেই অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে শুধু বললেন, আমরা দুঃখিত। পীড়াপীড়ি করে তাদেরকে আর বিব্রত না করারও অনুরোধ করলেন। এদিকে আদালতের সময়ও ততক্ষণে প্রায় শেষ। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলীর তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ওই আদালত থেকে ছুটে বেরিয়ে আমাকে এক রকম টানতে টানতেই নিয়ে গেলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে। দুই মাননীয় বিচারপতি সেই মুহূর্তে অন্য একটি মামলা শুনছিলেন। শুনানির মাঝখানে কিছুটা প্রথা ভেঙেই ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আমাদের অসহায় অবস্থার প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। দৃশ্যত বিরক্ত হয়েই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী বললেন, আপনাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, শুনানি যেটা চলছে শেষ হতে দিন, তারপর না হয় আপনাদের কথা শুনব। আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শুনানি শেষ হলে আদালত আমার পক্ষের আইনজীবীর কথা শুনতে চাইলেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী উত্তেজনা ও হতাশা যথাসম্ভব চেপে রেখে অতি সংক্ষেপে পূর্ববর্তী বেঞ্চের কাহিনী বর্ণনা করলেন। বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী সঠিকভাবেই আদালতের নিয়ম-কানুনের উল্লেখ করে দুই সিনিয়র আইনজীবীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এভাবে হঠাত্ করে তাদের পক্ষে কোনো মামলা শোনা সম্ভব নয়। তালিকাভুক্ত কোনো মামলার আবেদন নিয়ে অন্য বেঞ্চে যাওয়ার আগে অবশ্যই প্রথমে আদালতের লিখিত আদেশ নিয়ে আসতে হবে। আমাকে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর আদালতে অপেক্ষা করতে বলে আমার অত্যন্ত শুভানুধ্যায়ী আইনজীবীদ্বয় আবার ছুটলেন বিচারপতি কামরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে। আমি ভাবলাম হয়তো আজই দ্বিতীয় আদালতে আবেদন পেশের সুযোগ পাব। প্রত্যাশা করছিলাম প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদের ফেরা পর্যন্ত নিশ্চয়ই বিচারপতিরা অপেক্ষা করবেন। আদালত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের তখনও বাকি ছিল। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক চারটা বাজতেই বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এত দ্রুততার সঙ্গে বেঞ্চ থেকে নেমে গেলেন যে, আমার ভয় হচ্ছিল মাননীয় বিচারপতিরা না আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে আঘাত পান। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন বিএনপি সমর্থক নবীন আইনজীবী ছিলেন। বিচারপতিদের এজলাস থেকে নেমে যাওয়ায় তাদের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট হতাশার চিহ্ন দেখলাম। বেচারাদের চোখ বলছিল আমার গ্রেফতার বোধহয় আর ঠেকানো গেল না। কেন জানি না এইসব কাজ-কারবারে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল। আদালতে হাসা বারণ, কারণ তাতে আবার আদালত অবমাননা হয়। দ্রুত হাসি গিলে ফেলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই পত্রিকা অফিসে ফিরব। কিন্তু, নাছোড়বান্দা শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকটা জোর করেই আমাকে বার প্রেসিডেন্টের অফিসে নিয়ে তুললো। পাঁচ মিনিটের বেশি অবশ্য সেখানে ছিলাম না।
লোকজন পরামর্শ দিচ্ছিল রাতের মতো কোনো এক আইনজীবীর কক্ষে পালিয়ে থাকতে। তাদের তখনও আশা পরদিন নিশ্চয়ই কোনো একটা আদালত আমার আবেদন শুনবেন। পরামর্শ শুনেই ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। তরুণ ব্যারিস্টার কায়সার কামালকে বেশ উচ্চস্বরেই বললাম, তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমি রাজনীতিবিদ কিংবা আইনজীবী নই। অনেকের মতো, মধ্যরাতে চুপিসারে আদালতে ঢোকা কিংবা ছদ্মবেশ ধারণ করা ইত্যাদি কাজ-কর্মে আমি মোটেই অভ্যস্ত নই। অনেকটা ধাক্কা দিয়ে সবাইকে সরিয়ে সুপ্রিমকোর্ট বার সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিনের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখন অগুনতি ক্যামেরা আমার দিকে তাক করে রয়েছে। সেগুলো দুই হাতে ঠেলে পথ করে নিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে দেখি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান অপেক্ষমাণ। কোনো কথা না বলে আমাকে অনুসরণের ইশারা করে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। আমার এক সহকর্মীকে বললাম গাড়ি খুঁজে বের করতে। চকিতে চারদিকে চেয়ে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ দেখতে পেলেও পোশাকধারী কাউকে না দেখে অবাকই হলাম। বুঝলাম প্রশাসনও সম্ভবত ঘটনার এই আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
অনেকটা নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো গাড়িতে উঠলাম। পেছনে আমি এবং আমার দেশ-এর রিপোর্টার মাহবুব ও বাছির জামাল। সামনের সিটে আদিলুর রহমান খান। কুড়ি বছর ধরে আমার গাড়িচালক বাদলকে বললাম সোজা কারওয়ান বাজার যেতে। আদিলকে বললাম রাস্তায় গ্রেফতার হলে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সেই ঘটনার সাক্ষী থাকতে। গাড়ি থেকে স্ত্রীকে ফোন করে সারাদিনের ঘটনা জানালাম। সৌভাগ্যক্রমে অন্যান্য দিনের তুলনায় রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা লাগলো। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় ভবনের চত্বরে। ততক্ষণে আমার সব সহকর্মী সাংবাদিক ১১ তলার অফিস ছেড়ে নিচে নেমে এসেছে। আমি হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামতেই একটা হর্ষধ্বনি উঠলো। অপেক্ষমাণ লিফটে চড়ে পৌঁছে গেলাম আমার দেশ কার্যালয়ে। সকাল সাড়ে আটটায় যে অবরুদ্ধ জীবন ছেড়ে গিয়েছিলাম আদালতে ন্যায়বিচারের অলীক প্রত্যাশায়, বিকাল পাঁচটার মধ্যে সেখানেই আমার প্রত্যাবর্তন ঘটলো। বাংলাদেশে কথিত আইনের শাসনের অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা দিনভর সঞ্চয় হলো।
এতদিন জানতাম জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তির জন্যই জনগণ উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চের আজকের আদেশ শোনার পর থেকেই একটি প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা যে মামলার গুরুত্ব ও জটিলতার কারণে কোনোরকম আদেশ দিতে বিব্রত হন, সেই মামলার বিচারকার্য সিএমএম কিংবা জেলা জজ আদালতের মতো নিম্ন আদালতে তাহলে কেমন করে চলবে, এই প্রশ্নের জবাব কার কাছে খুঁজব? সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের সব বেঞ্চই যে আমার প্রতি একই রকম আচরণ করবেন না, তারই-বা নিশ্চয়তা কোথায়? আজই তো দুটো বেঞ্চে ছুটোছুটি করেও ন্যায়বিচার অধরাই থেকে গেল।
আদালতের ৮ তারিখের রোমাঞ্চকর গল্প শেষ হলো। এবার আমার মামলা জনগণের আদালতে পেশ করার পালা। তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার যে আমি পাবই, এ নিয়ে আমার মনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। সপ্তাহ তিনেক আগে ‘এক অবরুদ্ধ চান্স সম্পাদকের জবানবন্দী’ শিরোনামে মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখেছিলাম। সেই লেখায় সরকারের এই দেশদ্রোহ মামলার খানিকটা বিবরণ ছিল। দুই কিস্তির বর্তমান মন্তব্য প্রতিবেদনে প্রসঙ্গক্রমে সেখানকার কিছু তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটলে পাঠকের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
(দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি আগামী বুধবার)
admahmudrahman@gmail.com

বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই


মাহমুদুর রহমান




বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : এক অবরুদ্ধ ‘চান্স’ সম্পাদকের জবানবন্দি


মাহমুদুর রহমান




আমার আকস্মিকভাবে মিডিয়াতে আসা নিয়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী সম্পাদককুল এবং জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী কয়েকজন সুবিধাবাদী, মুখচেনা ব্যক্তি। আমার অপরাধ, সাংবাদিকতা পেশায় জীবন শুরু না করে এই শেষ বয়সে এ পথে কেন এলাম। বিষয়টা অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এ বাড়ির কর্তার কোনো কারণ ছাড়াই চোখ টাটানোর সমতুল্য। ওই ছেলে পরীক্ষা দিলেও পাস করবে না, পাস করলেও চাকরি পাবে না, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না, বেতন পেলেও সেই টাকা বাজারে চলবে না ইত্যাদি।
প্রথমে প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্পাদক আতাউস সামাদের শিক্ষানবিশগিরি এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রূপে চার বছরেরও অধিককাল পার করেছি। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণকালে যে সার্কুলেশন ছিল এই সময়ের মধ্যে তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ১০ লাখের কাছাকাছি ইন্টারনেট হিট এখন ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। অ্যালেক্সা রেটিং এ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও বিশ্বে ১০০ এবং ২০০০০ নম্বর থেকে ডিসেম্বরে ১৭ তারিখে আমার দেশ ৩৯ এবং ১০৬৬২ নম্বরে রয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ১৬ পাতার পত্রিকার মূল্য প্রায় এক বছর আগে ১০ টাকা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও প্রাণের টানে পাঠক সেই বাড়তি দামের বোঝা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন। সার্কুলেশন কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েছে।
এই পাঠকশ্রেণী আমাদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মূল শক্তি। এদের অনুপ্রেরণা এবং সমর্থনের কারণেই আমার দেশ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা আলোচিত দৈনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাত্র চার বছরে নিতান্তই দীনহীন, বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হওয়াটাকে হয়তো মিডিয়া জগতেরই অনেক রথী-মহারথী মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং এই মন্তব্য প্রতিবেদনের লেখককে পত্রিকা সম্পাদক রূপে মেনে নিতে এই অস্বীকৃতির পেছনের কারণ যে অক্ষমের অন্তর্জ্বালা সেটা বুঝে নেয়া কঠিন নয়। এদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, কেবল একরাশ অনুকম্পা রয়েছে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকে অনেকেই আমার মতো করেই পরিণত বয়সে অন্য পেশা থেকে এসে সরাসরি পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে আজ সংবাদপত্র জগতের লিজেন্ড হয়েছেন। তাদের নাম আজও আমরা বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি। অপরদিকে মালিকানা সূত্রে রাতারাতি সম্পাদক বনে যাওয়ার সংখ্যা এ দেশের পত্রিকা শিল্পে অগুনতি হলেও চিহ্নিত ‘মহামহিম’ সম্পাদককুলের তাতেও কোনো আপত্তি নেই। যত সমস্যা এক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে। গত বছর আমার জেল মুক্তির পর থেকে এরা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে কোনোক্রমে আমাকে সহ্য করছিলেন। স্কাইপি কেলেঙ্কারির ঘটনা লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ এবং আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্র তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে টেলিভিশনের পর্দা ফাটাচ্ছেন। সরকারের উন্মত্ত আচরণের পাশাপাশি এই তল্পিবাহকদের হিংসা-বিদ্বেষে কাল হয়ে যাওয়া মুখের নানা রকম অভিব্যক্তি টেলিভিশনে দেখে আমার ছোট্ট অফিস ঘরের অবরুদ্ধ জীবনেও বিমলানন্দ অনুভব করছি। এদের বিপরীতে আমাদের সমর্থনে দেশের প্রবীণতম সম্পাদক-সাংবাদিক এবিএম মূসা এগিয়ে এসেছেন। মূসা ভাই আমার মিডিয়ার শিক্ষক মরহুম আতাউস সামাদেরও শিক্ষক। তাঁর প্রতি আমার দেশ পরিবারের সব সদস্যের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের সব কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের। এ মাসের ৬ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সবাইকে চমকে দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর বিরুদ্ধে এক চাঞ্চল্যকর রুল জারি করেন। সেই রুলে তিনি স্বীকার করে নেন যে, বিচারাধীন মামলা নিয়ে বিচারকার্যে সম্পৃক্ত নন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছেন এবং বিষয়টি ইকোনমিস্টের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ইকোনমিস্টের একজন সাংবাদিক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে টেলিফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে কতগুলো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে বিচারপতি মহোদয় থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি আদালত অবমাননা নামক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বর্মের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ ইকোনমিস্টে না ছাপানোর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদের হাত দেশের মধ্যে অনেক লম্বা হলেও সেটা যে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছায় না, সেটা বোধহয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
একজন বিচারপতি বিচারাধীন মামলার বিষয়ে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করেছেন, এই তথ্য জনগণকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিচারাঙ্গনকে নানাভাবে বিতর্কিত করার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও এই অবিশ্বাস্য নতুন নমুনা মেনে নেয়া কোনো বিবেকবান নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বেলজিয়ামবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং ইউকেবাসী জনৈক রায়হানের কথোপকথনের রেকর্ডকৃত অংশ এবং তাদের মধ্যকার আদান-প্রদানকৃত ই-মেইলের কপি বিদেশ থেকে আমার দেশ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করাকালে ইউ-টিউবেও বিচারপতির স্কাইপি আলাপন ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিষয়টির নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা জনস্বার্থে কথোপকথন হুবহু প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। তবে রিপোর্টে ইকোনমিস্টের মতো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য প্রদান থেকে আমার দেশ বিরত থাকে।
ইকোনমিস্ট সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি আলাদা সম্পাদকের নোট (Editors Note) লিখে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে তাদের যুক্তি পেশ করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেই নোট থেকে খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
“Normally, we would not publish confidential e-mails and conversations. But there is a compelling public interest. Lives are at stake. So are the court’s reputation .......
We did not solicit the material. We did not pay for it, nor offer any commitment to publish it, we have no reason to suppose that the tapes and e-mails we have seen are fakes, or have been tampered with. The Economist also does not know whether the accused in the trial are innocent or guilty, merely that they are entitled to a presumption of innocence and to an even-handed trial.
(সাধারণত, আমরা গোপনীয় ই-মেইল এবং টেলিফোন আলাপ প্রকাশ করি না। কিন্তু, এখানে গুরুতর জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে। জীবন এখানে ঝুঁকির মধ্যে। একইভাবে আদালতের মর্যাদাও ...
নিজ থেকে আমরা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা কোনো অর্থ প্রদান করিনি, কিংবা সংবাদ প্রকাশ করা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেইনি। এমন ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই যে, টেপ এবং ই-মেইলগুলো জাল অথবা সেখানে অসত্ উদ্দেশ্যে কোনোরকম পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্ট এটাও জানে না যে অভিযুক্তরা দোষী অথবা নির্দোষ, তবে তাদের বিচারপূর্বক সাময়িক নির্দোষ বিবেচিত হওয়া এবং সঠিক বিচার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।)
আমার দেশ পত্রিকা এ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ এই পাঁচদিন স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করেছে। এই সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমসহ কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পত্রিকায় কোনো প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেননি। এখানে কোনো মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, এ জাতীয় দাবি কোনো মহল থেকে অদ্যাবধি শোনা যায়নি। কিংবা সংবাদ না ছাপানোর নির্দেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রুলও জারি করা হয়নি। বরঞ্চ, ট্রাইব্যুনাল-১ এর দ্বিতীয় সিনিয়র বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন আমার দেশ-এর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে বলেছেন, পত্রিকার কাজ হচ্ছে লেখা, আমার দেশ তাই করেছে। অনৈতিক ও বেআইনি আচরণের দায় মাথায় নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও লাজ-লজ্জাহীন সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং আওয়ামীপন্থী মিডিয়া স্কাইপি সংলাপ লেখার আগে ‘কথিত’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন।
সরকারের লেজুড়ধারী টক-শো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বিভিন্ন টক-শো’তে অবলীলাক্রমে দাবি করছেন যে ইকোনমিস্টে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। নির্জলা মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সেই সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। সে সব মহাপণ্ডিতরা অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। আরে বাবা, ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে যাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে তার কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রক্ষে ছিল? সংবাদ ধামাচাপা দিতে প্রতিবেদক এবং সম্পাদককে হয়তো গুম করে ফেলা হতো। অথবা সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে হতো। তাছাড়া সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলাই তো বিচারপতির ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ লংঘন। এদিকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে প্রায় প্রতিদিন এত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে যে জনগণের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
হাইকোর্টে সাধারণত যে কোনো মামলায় একটি বেঞ্চ কোনো রুল, নির্দেশ অথবা অভিমত দিলে অন্য বেঞ্চ সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। বাদী অথবা বিবাদী ওই মামলা নিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চে গেলে তাদের প্রথম বেঞ্চে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। স্কাইপি স্ক্যান্ডালের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার অ্যাডভোকেট হায়দার আলী ১০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার নাম উল্লেখপূর্বক বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১ এর নজরে আনেন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আদেশ দেয়ার জন্য ১১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। ওইদিন বিচারপতি নাসিম এবং প্রসিকিউটার হায়দার আলী ট্রাইব্যুনালে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে আর আদেশ প্রদান সম্ভব হয়নি। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন যে, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান এবং প্রসিকিউটর আদালতে ফিরলে আদেশ প্রদান করা হবে। কিন্তু, ওই দিনই বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় সেই প্রক্রিয়াও ঝুলে যায়।
১৩ তারিখে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত একই বিষয় ট্রাইব্যুনাল-২ এ উত্থাপন করলে বিচারপতিগণ স্কাইপি সংলাপ বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় আর প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক আদেশ প্রদানকালে একই বিষয়ে প্রথম আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল-১ এ অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল। এরপর একই দিনে সরকার ছুটে যায় হাইকোর্টের চরম বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে। আদালতের রীতিনীতি অনুযায়ী তিনি আমার বিষয়ে কোনো আবেদন শুনতে পারেন না, কারণ দুর্নীতি এবং বিচারপতির কোড অব কনডাক্ট (Code of Conduct) ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য আমার আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পত্র সংখ্যা ০১.০০.০০০০.০০১১.৩২.০০১.১২-৩১৭ তারিখ ০৮ নভেম্বর ২০১২-এর মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
আদালতের নিয়ম-কানুনের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোর্টের দিনের নির্ধারিত সময় পার করে আমার বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় আদালতে তার আচরণও বিচারকসুলভ ছিল না। বরঞ্চ, আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিরাগ, বিদ্বেষ এবং ক্ষোভ তার প্রতিটি কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারপতি মানিকের রুলকে ভিত্তি করে সে রাতেই সিএমএম আদালতে বায়বীয় দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী (CRPC) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমতি (Sanction) ব্যতীত এ ধরনের মামলা দায়ের সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও আমার ক্ষেত্রে আদালতে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানেই শেষ নয়। ১৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই বিষয়ে আরও একটি অভিমত (Observation) দেন। বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে উচ্চ আদালতের তিনটি পৃথক সমমানের বেঞ্চ থেকে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদেশের এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ছোটবেলায় শোনা এক জোকের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্র শিক্ষককে প্রশ্ন করল, স্যার Pillar লিখতে কয়টা L (এল) লাগে? জবাবে শিক্ষক বললেন, ‘একটা দিলেও হয়, তয় দুইটা দিলে পোক্ত হয়।’ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অতি-উত্সাহে দেখা যাচ্ছে আদালত পোক্ততর করতে গোটা চারেক L-এর ব্যবস্থা করেছেন।
অপর একটি বিতর্কের বিষয় উত্থাপন করছি। স্কাইপি কেলেঙ্কারির কাহিনী ছাপা হওয়ার পর থেকে সরকার সমর্থক গোষ্ঠী কেবল একটি প্রশ্নের অবতারণা করে চলেছেন। তাদের কথা হলো, হ্যাকিং অথবা গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ সত্য হলেও মিডিয়ায় প্রকাশ করা নাকি অনৈতিক। দি ইকোনমিস্ট তার সম্পাদকের নোটে এই সমালোচনার যথাযথ জবাব দিয়েছে বলে আমি এই ইস্যুতে নতুন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার প্রশ্ন হলো, একজন বিচারপতি কি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে গোপনে শলা-পরামর্শ চালিয়ে যেতে পারেন? বিচারপতি নাসিমই তো ইকোনমিস্টের সাংবাদিককে বলেছেন যে, তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেন না। তাহলে কি ধরে নেব ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে তার স্ত্রীর চেয়েও আপন? অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা যায় না বলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জ্ঞান দিচ্ছেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৭ ঘণ্টার স্কাইপি কথোপকথনে এবং শত শত ই-মেইলে ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তার আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন। এমনকি আগাম রায় লিখে দেয়ারও আবদার করেছেন। রায় প্রদানের বিনিময়ে পদোন্নতি প্রাপ্তি নিয়ে আপিল বিভাগের জনৈক বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার চরম নিন্দনীয় উদাহরণও প্রকাশিত স্কাইপি আলাপে রয়েছে। সুতরাং, ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের যোগসাজশে। সেই অপরাধের কথা প্রকাশ করে গণমাধ্যম বরঞ্চ প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন অভিমত প্রদানকালে সম্ভবত এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ, আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে পাঠককে কিছু তথ্য দেয়া আবশ্যক বিবেচনা করছি। ১৩ তারিখ রাতে সিএমএম আদালতে মামলা দায়ের থেকে এই লেখাটা ১৯ তারিখ রাতে ছাপা হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা অফিসেই অবস্থান করছি। সকালে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছানো পর্যন্ত এখানেই থাকব, নাকি পুলিশ হেফাজতে—সেটা আল্লাহ্ জানেন। সেদিন টক-শোতে এক আওয়ামী সম্পাদক আমার পত্রিকা অফিসে থাকা নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনলাম। আমার পত্রিকা অফিসে আমি রাত্রিযাপন করব, তাতে পঞ্চাশ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার জন্য আত্মগর্বে ফুলে থাকা সম্পাদক কেন বা কোন অধিকারে কূপিত হলেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। অবশ্য, আওয়ামী লীগারদের কাছে যুক্তির কথা বলে কোনো ফায়দা নেই।
এক সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে (Scroll) লেখা দেখলাম, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার এড়াতে আমার দেশ অফিসে অবস্থান করছেন। এতদিন জানতাম গ্রেফতার এড়াতে লোকজন পলাতক থাকে। আওয়ামীপন্থী মিডিয়ার কাছ থেকে জানা গেল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পত্রিকা অফিসে অবস্থান করলেও নাকি গ্রেফতার এড়ানো যায়। এই আমাকেই ২০১০ সালের ১ জুন মধ্যরাতে শত শত রায়ট পুলিশ পাঠিয়ে একটা সাধারণ ডাইরির (General Diary) ভিত্তিতে শেখ হাসিনার সরকার একই পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেটা বোধহয় ওই টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ভুলে গেছেন!
এদের নিরেট মাথায় হয়তো ঢুকছে না যে, আমার এবারের লড়াই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার অথবা আদালত কর্তৃক মিডিয়ার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ দলমত নির্বিশেষে সব মিডিয়া কর্মীর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা তাদের স্বার্থেই প্রয়োজন। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে আজ গণমাধ্যমের যে অংশ আমার দেশ’র বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হলে তারাও একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। তখন কিন্তু আজকের এইসব কথা তাদের বেমালুম গিলে ফেলতে হবে।
তবে সমস্যা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পাপের সব রেকর্ড মুছে ফেলা আগের মতো আর সম্ভব নাও হতে পারে। হাওয়া ভবনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত সম্পাদককুল আজ যখন আমাকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে ওঠে। দেশবাসীকে একটি ভরসার কথা বলে অবরুদ্ধ সম্পাদকের জবানবন্দী সমাপ্ত করব। মিডিয়ায় যারা মাহমুদুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত দেখার আশায় ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনসাপেক্ষে তারা আমার মতো তখনকার সরকারের অন্যায় আচরণের শিকার হলে আমার দেশ তাদের রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। নীতির দুর্ভিক্ষের এই দেশেও সব সরকারের আমলে নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে এই পরিবারের প্রতিটি সংবাদকর্মী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ইমেইল- admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই

মাহমুদুর রহমান
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অক্টোবরে আমাদের দুই প্রবল ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সফর করে দেশে ফিরেছেন। অন্য বিষয়াদির মতোই বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর চরিত্রে লক্ষণীয় ভিন্নতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবরই বিদেশে বেড়াতে বিশেষ পছন্দ করেন। তার সকল নিকট-জনেরাও সপরিবারে প্রবাসী। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারে দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে চারদিকে গুঞ্জন ওঠার প্রেক্ষিতে কয়েক মাস আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের সংজ্ঞা দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। সেই সংজ্ঞায় তিনি ছাড়া তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং উভয়ের পুত্র-কন্যাগণকেবল প্রধান-মন্ত্রীর পরিবারভুক্ত। পুত্রবধূ অথবা কন্যা-জামাতা এবং পৌত্র-পৌত্রীদের এই সংজ্ঞায় স্থান কোথায়, সে বিষয়ে শেখ হাসিনা অবশ্য কিছু বলেননি। যাই হোক, এরা সবাই আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেনের বাসিন্দা। পদ্মা সেতু দুর্নীতির দেশে-বিদেশে তদন্তের প্রেক্ষিতে তিন দেশের মধ্যে সম্প্রতি কানাডা নিয়েই মিডিয়া ও জনগণের ঔত্সুক্য বিশেষভাবে বেড়েছে। সুতরাং, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণপ্রীতির পেছনে ন্যায্য কারণ রয়েছে। অপরদিকে আগের ইতিহাসে দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া স্বদেশে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাঁচ বছরের সরকারি দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, তিনি নিজে যেমন বিদেশে যেতে চান না, একইভাবে মন্ত্রী-আমলাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতাকেও যথেষ্ট অপছন্দ করেন। রাজনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই পুত্র বিগত চার বছরেরও অধিককাল বিদেশে থাকলেও তিনি কিন্তু পরিবার থেকে দূরে থাকার যাতনা সয়ে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া দশ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে প্রায় নয় বছর পার করেছেন এবং এবারের মেয়াদ পূর্ণ করে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের রেকর্ড ধরে ফেলবেন বলেই সকলের ধারণা। মাঝখানের দুই বছরের মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময়টুকু বাদ দিলে দুই নেত্রী দুই দশক ধরে পালাক্রমে সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় প্রধান হয়েছেন। এই সময়ের বিদেশ ভ্রমণের তালিকা প্রণয়ন করলে একজনের বিদেশ ভ্রমণপ্রীতি এবং অপরজনের বিদেশ যেতে অনীহার চিত্রটি জনগণের কাছে পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠবে। ক্ষমতাবানদের বেড়ানোর গল্প রেখে এবার রাজনীতির গুরু-গম্ভীর আলোচনায় আসি।
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হতে সংবিধান অনুসারে এখনও এক বছরেরও কিছু অধিক সময় বাকি আছে। জনগণ গভীর আশঙ্কা নিয়ে আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশব্যাপী এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির তাবত্ ‘কৃতিত্ব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। উভয়ে মিলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল না করলে এই অনভিপ্রেত অস্বস্তির সৃষ্টি হতো না। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল না হলেও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হচ্ছেন, সেটা নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ২০০৬ সালের মতো একটা টানাপড়েন যে থাকতো, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ অপরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকই আজ সেই পদের দাবিদার হতেন। ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানকে সত্তরের দশকে তার সঙ্গে বিএনপির কথিত সাংগঠনিক সম্পর্ক এবং কর্নেল রশীদের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি।
তদুপরি ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার কর্তৃক বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ২ (দুই) বছর বৃদ্ধি করার বিষয়টিকে তত্কালীন বিরোধী দল সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে। কিন্তু একজন বিচারপতি হিসেবে কেএম হাসান প্রজ্ঞা, নিরপেক্ষতা, সততা এবং আইনের গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ সর্বদাই বিচারপতিসুলভ ছিল। দীর্ঘ জজিয়তি জীবনে তিনি যে সকল রায় লিখেছেন, সেগুলো নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অপরদিকে বিচারপতি খায়রুল হক আদালতপাড়ায় একজন চরম দলবাজ বিচারপতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সম্পর্কেও দেশবাসী অবহিত। কাজেই বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া বিএনপি’র পক্ষে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হতো না। মনে রাখা দরকার, এই ধরনের জটিলতা থেকে উত্তরণের পন্থা ত্রয়োদশ সংশোধনীতেই দেয়া ছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, ৫৮গ (৫)-এ বলা ছিল—
“যদি আপীল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে, রাষ্ট্রপতি, যতদূর সম্ভব, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনাক্রমে, বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হইবার যোগ্য তাহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।”
এক-এগারোর সরকার গঠনের সময় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই শুধু সামরিক জান্তার নির্দেশে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার এই পদক্ষেপ সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন হলেও সে সময় সুশীল (?) সমাজভুক্ত আইনজীবীকুল এবং শেখ হাসিনাসহ মহাজোট নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। যাই হোক, দেশের বর্তমান বিবদমান পরিস্থিতিতে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি রাজনৈতিক সংঘাত থেকে হয়তো জনগণকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু একতরফাভাবে প্রায় অকার্যকর, একদলীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান পদে নিযুক্তির সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবর্তে প্রধান দুই দল এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন পরিচালনা এবং আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।
বিগত চার বছরে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে আন্দোলনের হুঙ্কার দিলেও তেমন কোনো সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বরং আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থকও হয়তো স্বীকার করবেন যে, ১৯৯১-পরবর্তী বাংলাদেশের বিগত চারটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মেয়াদকালে রাজপথের আন্দোলনের বিবেচনায় এবারই কোনো সরকার তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছে। এখন পর্যন্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপন হরণকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল দেয়াতে বিএনপি’র নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পরিষ্কার অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপিবিরোধীরা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে অবশ্যই দাবি করতে পারেন যে, বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সরকারের কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার কারণেই দেশের রাজনীতি শান্তিপূর্ণ থেকেছে।
যে কারণেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই উত্তরণ ঘটে থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো মহাজোট সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ চার বছর সময় পেয়েও চরম দলীয়করণ, নজিরবিহীন দুর্নীতি ও তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিদেশি মুরব্বি গোষ্ঠীও বাংলাদেশে জনমতের পরিবর্তন সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পেরে তাদের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। তাদের সেই পরিবর্তনে এদেশের শাসকগোষ্ঠীও যে বিচলিত হয়ে পড়ছে, সেটাও বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে নেতৃবৃন্দের অকূটনৈতিক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে পরাজয়-পরবর্তী অবধারিত জনরোষ থেকে রক্ষা পেতেই ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আয়োজন করছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে এই সর্বনাশা খেলা থেকে তাদের অবশ্যই নিবৃত্ত হওয়া উচিত। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের ফলাফল হৃদয়বিদারক হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুই দফায় একতরফা নির্বাচন করলেও কোনো বারই সংসদের মেয়াদ দুই বছরের বেশি টেকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে গণধিকৃত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযুক্তির জন্যই করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই স্বল্পকালীন সংসদের মেয়াদও তাই ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণের সঙ্গেই সমাপ্ত হয়েছিল।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার বিপজ্জনক পথ ধরেই জেনারেল মইন-মাসুদ গং ক্ষমতা দখল করেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে তারাও আজকের মহাজোটের মতোই নব্বই দিনের মেয়াদের কথা ভুলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল। বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ তত্কালীন অসাংবিধানিক সরকারকে শুধু সমর্থনই জানায়নি, ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা : প্রচারণা ও বাস্তবতা’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত কলামের এক জায়গায় শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে লিখেছিলাম— “বাস্তবতা হলো, এই দুই নেত্রী মিলে দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরূপে বাংলাদেশ পরিচালনা করেছেন এবং কারাবন্দী অবস্থাতেও এই দু’জনই বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারার রাজনীতির অবিসংবাদিত নেত্রীর স্থানটি ধরে রেখেছেন। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ হয়তো এমন ধারণা পোষণ করেন যে, জননন্দিত নেতা চাইলেই পাওয়া যায় অথবা হওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ হলে তথাকথিত মাইনাস টু কৌশল এতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে যেত।”
২০০৮ সালের মাঝামাঝি দুই নেত্রী সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে দুই মুক্তিতে অনেক ফারাক ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্কালীন সামরিক জান্তার সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত সমাপ্তি সাপেক্ষেই জেলের বাইরে পা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরুদ্ধ সেই অশুভ আঁতাত নিয়ে তখন লিখেছিলাম, ‘আঁতাতকারীরা ক্ষমতার পিঠা ভাগে মত্ত।’ ওই বছর জুলাইয়ের ১৭ তারিখে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সেই লেখায় আমার মন্তব্য ছিল—
“বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মাখামাখি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেখ হাসিনা কারামুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে এখন বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের একপ্রস্থ সংলাপ নাটকও সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক-এগারোর অন্যতম রূপকার ও প্রচ্ছন্নের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির প্রশংসায় ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। অপরদিকে এই সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে।”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্য মন্ত্রীর জাতিকে এক-এগারোর ভয় দেখানোর প্রেক্ষিতেই পাঠকদের পুরনো কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। তাদের স্মরণে রাখা আবশ্যক, এক-এগারো আওয়ামী লীগ ও সুশীল (?) গোষ্ঠীর যৌথ প্রকল্প ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সেই এক-এগারোর আঁতাতেরই ফসল। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। সুতরাং, এক-এগারো সম্পর্কে সমালোচনার নৈতিক অধিকার বাংলাদেশের আর যে নাগরিকই হোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখেন না। ফখরুদ্দীন আহমদের শপথ গ্রহণের দিনে বঙ্গভবনে দলবলসহ তার সহর্ষ উপস্থিতি এবং সেই সরকারের ‘সকল কর্মকাণ্ডের’ আগাম বৈধতা প্রদানের ঘোষণার কথা ভুলো বাঙালি মুসলমান বোধহয় এখনও পুরোপুরি ভুলে যায়নি।
তাছাড়া সেই ক্যু দেতা’র অন্যতম নায়ক লে. জে. (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী চাকরিতে একের পর এক মেয়াদ বৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাকে এই নজিরবিহীন পুরস্কার প্রদানের পেছনে যে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের ব্যাপারটি ক্রিয়াশীল রয়েছে, সেটি দেশের সকল সচেতন নাগরিকই বুঝতে পারেন। এক-এগারোর সরকার দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মইন-মাসুদকে লক্ষ্য করে যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, তার যে দুই সাবেক জেনারেলের কেশাগ্র স্পর্শ করারও ক্ষমতা নেই, এটা সম্ভবত তিনিও জানেন। তবু চেঁচামেচি করে গায়ের ঝাল যদি কিছুটা কমানো যায় আর কী!
বেগম খালেদা জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সহসাই জোর নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করবে বলেই মনে হচ্ছে। সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় দশম সংসদ নির্বাচন আগামী বছর অক্টোবরের ২৫ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২৪-এর মধ্যবর্তী যে কোনো দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সাবেক প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আবার কমপক্ষে ৪২ দিনের নির্বাচন প্রস্তুতির একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের ওই অংশটি বিবেচনায় নিলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৮ সালেও ওই মাসেই নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাসে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খানিকটা অতিরিক্ত উদ্দীপনা বিরাজ করে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে থাকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। সব মিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে।
গণআকাঙ্ক্ষা মান্য করে তিনি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। ১৯৯৬ সালের বিএনপির মতো বর্তমান সংসদে মহাজোটের সংসদ সদস্যের সংখ্যা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে সময় সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে ১৫ ফেব্রুয়ারির অজনপ্রিয় নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় শেষ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী সংবিধানে যে কোনো সংশোধনী আনার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দলের রয়েছে। তার সরকারের মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আইনগতভাবে বৈধ এবং নৈতিকভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
কিন্তু মেয়াদ শেষে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ হাসিনা যদি দশম সংসদের একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করতেও পারেন, তাহলেও তাকে আর বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে কেউ মেনে নেবে না। সেক্ষেত্রে কেবল পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করেই তাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সকল অত্যাচারী শাসকের ভয়ানক পরিণতি ঘটেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও বর্তমান সরকার ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। শেষ ভরসা ভারতীয় দুর্গতেও বেগম খালেদা জিয়া জোরেশোরে হানা দিয়েছেন। সুতরাং কেবল এক ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে ২০০৮-এর মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে একসঙ্গে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার ফ্যাসিবাদী চিন্তাই বরং আবারও অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমগ্র জাতিকেই শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বোধবুদ্ধিহীন দুঃসাহসিকতার মূল্য চুকাতে হয়। মইন-মাসুদ গংয়ের তুঘলকি রাজত্ব-পরবর্তী পাঁচ বছরে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা দুর্বল হয়েছে। দলগুলোর সংকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা বাংলাদেশকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর পরমুখাপেক্ষী করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের স্বার্থে স্বাধীনতাকামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজন। গণতন্ত্রের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অন্তত জাতীয় ইস্যুতে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। আশা করি, শেখ হাসিনা উপলব্ধি করবেন, অসাংবিধানিক সরকারের আগমনী পথ প্রশস্ত করার চাইতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করাও অধিকতর নিরাপদ ও সম্মানজনক। ২০০৮ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র চার বছরের ব্যবধানে জনসমর্থনের বিচারে বেগম খালেদা জিয়ার অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানো থেকে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : বল্গাহীন দুর্নীতি ও ম্রিয়মাণ টিআইবি



মাহমুদুর রহমান
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সহকর্মী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম. আবদুল্লাহ্ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু কাগজপত্র হাতে খানিকটা উত্তেজিত হয়েই আমার অফিস কক্ষে এলেন। কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখলাম, পাঁচ মিলিয়ন ডলার (৪১ কোটি টাকা) ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। অভিযোগের তীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের মন্তব্যসহ আমি সংবাদটি ছাপার অনুমতি দিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তখন দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের মধুচন্দ্রিমার উষ্ণতা তখনও পুরোপুরি শীতল হয়নি। বেশ ক’জন সহকর্মী সংবাদটি ছাপানোর বিপদ সম্পর্কে আমাকে সাবধান করেছিলেন। সত্য কথা বলা এবং লেখায় কারও সাবধানবাণীতে কর্ণপাত করা বরাবরই আমার স্বভাববিরুদ্ধ। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে মহাজোট আমলের প্রথম দুর্নীতি সংক্রান্ত সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হলো। খবর ছাপা হওয়া মাত্র মৌচাকে ঢিল পড়ল। জেলায় জেলায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং কুশপুত্তলিকা দাহের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো। আগে জানতাম, মানহানির মামলা কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই করতে পারেন এবং সেটাও একটিমাত্র মামলাই। ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের জামানায় আমার জানাটা ভুল প্রমাণিত হতে সময় লাগল না। একে একে একই অভিযোগে ছাব্বিশটি মামলা দায়েরের বিশ্ব রেকর্ড তৈরি হলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লিখিত নির্দেশে প্রশাসনের তাবত্ অংশ একসঙ্গে আমাকে জন্মের মতো শিক্ষা দেয়ার অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পরের ইতিহাস দেশবাসী জানেন।
আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ এবং আমাকে জেলে পুরে সরকার এদেশে দুর্নীতিবিরোধী সব কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরাও আমাকে নজিরবিহীনভাবে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন আমার করুণ পরিণতি দেখার পর বাংলাদেশের আর কোনো নাগরিক অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হবে না। কিন্তু, তারা ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিলেন। সরকারের সাড়ে তিন বছর অন্তে আজ দেখা যাচ্ছে, আমি জেল খেটেছি বটে, তবে মহাজোট সরকারের যাবতীয় অপকর্মের কেচ্ছা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের অর্থ নির্বিচারে লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়লেও বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই কেবল রাজস্ব ব্যয় মেটানোর জন্যই দেশ-বিদেশে ভিক্ষাপাত্র হাতে অর্থমন্ত্রীকে ঘুরে বেড়াতে হবে। ভবিষ্যত্ উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নের হাল পদ্মা সেতুর অবস্থা থেকেই সবার বোঝা উচিত।
অনেক টানাপড়েনের পর গত শনিবার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতু অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করতে বলা চলে একরকম বাধ্যই হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তদন্তে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে কানাডীয় পুলিশ সেদেশের বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের অফিসে অভিযান চালিয়ে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতির বিষয়ে সম্যক অবহিত করেছিল। সরকার বা বিশ্বব্যাংক কোনো পক্ষই সেই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের কারা কারা জড়িত সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত সরাসরি মুখ না খুললেও বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছিল, কেবল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনই নন, ঘুষ দাবি অথবা লেনদেন প্রক্রিয়ায় সরকারের আরও ওপরের ক্ষমতাশালীরাও জড়িত। ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরামর্শক নিয়োগে মোটামুটি দশ শতাংশ ঘুষের নাকি রফা হয়েছিল। ঘুষের এই হারকে ক্ষমতাসীনদের স্ট্যান্ডার্ড ধরে হিসেব কষলে এক পদ্মা সেতু থেকেই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
বিএনপির দুর্নীতিবাজদের মতো আওয়ামী লীগ যে ছিটেফোঁটায় সন্তুষ্ট হয় না, সেটা এবারের সাড়ে তিন বছরের মেয়াদে তারা বহু ঘটনায় জনগণের কাছে প্রমাণ দিয়েছে। মাশাল্লাহ্ গলার জোরও যে আওয়ামী নেতাদের অনেক বেশি, সে বিষয়টি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিদিনই টেলিভিশনে দেখাচ্ছেন। বিএনপি আমলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন গ্যাস কোম্পানি নাইকো’র কাছ থেকে কেবল একটি গাড়ি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। এর বাইরে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অপ্রমাণিত অভিযোগ হলো, বিদেশ ভ্রমণকালে ওই কানাডীয় কোম্পানির কাছ থেকেই তিনি নাকি মাত্র ৫ হাজার ডলার (চার লাখ টাকা) রাহা খরচ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এতেই দুদকের লাফালাফি দেখে কে!
অপরদিকে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস রাতদুপুরে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা (দুষ্ট লোকে বলে টাকার প্রকৃত অংক কয়েক কোটি) মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সময় গাড়ি চালকের সাহসিকতায় বমাল ধরা পড়লেও এককালের বাম নেতা এখনও জনগণের টাকায় মন্ত্রীর ফ্ল্যাগ উড়িয়ে চলেছেন। দুই কান কাটাদের আধিক্যের ফলেই রাজনীতির আজ এই হতশ্রী দশা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুপুত্র মাত্র ষাট হাজার টাকা নিজের পুঁজি নিয়ে (!) নগদ পাঁচ কোটি টাকায় টেলিকম লাইসেন্স নিয়েছেন। মন্ত্রীপুত্রের দাবি, লোকজন তাকে নাকি শুধু ভালোবেসে এই বিপুল অংকের অর্থ ঋণ দিয়েছে। সরকারের লেজুড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ ‘স্বাধীন’ দুদক সুরঞ্জিতপুত্রের সেই ভালোবাসার দাবি মেনে নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রীকে সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়ার আয়োজনও প্রায় সম্পন্ন করেছে। একই দুদক অবশ্য এর আগে পদ্মা সেতু ইস্যুতেই মন্ত্রী আবুল হোসেনকেও সততার সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমার পরিচিত এক অধ্যাপক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের দুদককে ‘আওয়ামী লীগের ধোপা’ নামকরণ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলটির মন্ত্রী-এমপিদের গায়ে লেগে থাকা দুর্নীতির কালিমাগুলো পরিষ্কার করে তাদের সাদা করে দেয়াই নাকি প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান কাজ। অধ্যাপক মহোদয়ের রসবোধে আমি চমত্কৃত হয়েছি।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বব্যাংক যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তার মর্মার্থ অর্থাত্ ইংরেজিতে যাকে between the line meaning বলা হয়ে থাকে সেটি বুঝতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ভেবে যে কোনো নাগরিক আতঙ্কিত বোধ করবেন। সেই বিবৃতি থেকে কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি :
* The world bank has credible evidence corroborated by a variety of sources which points to a high level corruption conspiracy...
(বিশ্বব্যাংকের কাছে কয়েকটি উত্স দ্বারা সমর্থিত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে ...)
* The world bank provided evidence from two investigations to the Prime minister, as well as the minister of Finance and the Chairman of the Anti Corruption Commission of Bangladesh (ACC) in September 2011 and April 2012.
(বিশ্বব্যাংক দুটি ভিন্ন তদন্তের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সেপ্টেম্বর ২০১১ এবং এপ্রিল ২০১২ তারিখে হস্তান্তর করে)
* In an effort to go the extra mile, we sent a high level team to Dhaka to fully explain the Bank’s position and receive the Government’s response. The response has been unsatisfactory.
(বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ছাড় হিসেবে এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা এবং সরকারের জবাব পাওয়ার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সরকারের জবাব সন্তোষজনক হয়নি।)
* The World Bank cannot, should not, and will not turn a blind eye to evidence of corruption. We have both an ethical obligation and fiduciary responsibility to our shareholders and IDA donor countries.
(দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয় এবং থাকবে না। আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যাংকের অংশীদার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর কাছে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।)
বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে এ দেশের শাসকগোষ্ঠীর ওপর মহলের হাত রয়েছে এবং প্রায় এক বছর আগেই দুর্নীতির প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কাজেই পদ্মা চুক্তি অর্থায়ন বাতিলের দায় দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গসহ এই তিন ব্যক্তি এড়াতে পারেন না। এখন মুখরক্ষার জন্য সরকার বায়বীয় মালয়েশীয় বিনিয়োগ নিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। মালয়শিয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য প্রচণ্ড ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য দাবি করছেন যে, বিশ্বব্যাংক ঋণের চেয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশীয় অর্থায়ন নাকি সাশ্রয়ী হবে। বাণীর রাজা নামে খ্যাত এই মন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণকে সম্ভবত একেবারেই মূর্খ ও নির্বোধ বিবেচনা করেন। বিশ্বব্যাংকের যে কোনো ঋণে সর্বোচ্চ সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ এবং সচরাচর ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। একমাত্র সরাসরি অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে এর চেয়ে সুলভে ঋণ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় আমার অন্তত জানা নেই। তথাকথিত মালয়েশীয় বিনিয়োগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে দেশের সব অর্থনীতিবিদই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ওদের শর্ত মেনে নিলে পদ্মা সেতুর ব্যয় তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতদিন সততার ডঙ্কা বাজিয়ে ওবায়দুল কাদের অবশেষে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন।
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পদ্মা সেতু ইস্যুতে সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এক তাত্ক্ষণিক বিবৃতিতে শাসকগোষ্ঠীর বল্গাহীন দুর্নীতির সমালোচনার পরিবর্তে বিশ্বব্যাংককেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থায়ন বন্ধ করে সরকার ও দেশের মানুষকে কষ্ট দেয়ার অধিকার বিশ্বব্যাংকের নেই। টিআইবি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই টিআইবিই গত বছর তাদের এক প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের ‘মর্যাদা’ দান করেছিল। সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের লোকজন দিয়ে দুর্নীতি তদন্তের দাবির চেয়ে স্ববিরোধী প্রস্তাব আর কী হতে পারে?
আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিচার বিভাগের যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে রাজনৈতিক দলীয়করণ এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে বিরোধী দলের লোকজন কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সুবিচার প্রাপ্তির আর কোনো পরিবেশ অবশিষ্ট নেই। এহেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের পরিণাম স্বাধীন দুদকের তদন্তের চাইতে ভিন্নতর কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝখান থেকে মন্ত্রী আবুল হোসেনের ফুলের মতো চরিত্রের আরও একটি সনদপ্রাপ্তির সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। দেশের অধিকাংশ নাগরিক যখন সরকারের দুর্নীতির বহরে লজ্জায় অধোবদন, সেই সময় বিভ্রান্তিকর সব প্রস্তাব উত্থাপন করে টিআইবি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবশ্য টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাদের বিবৃতি অথবা দুর্নীতিপরায়ণ মহাজোট সরকারের ত্রাতার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামানের অবতীর্ণ হওয়ার পেছনের কারণ বুঝে ফেলা শক্ত নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বর্তমান চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল চক্রবর্তী আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই সারাদেশে সুপরিচিত। তিনি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিরূপে ড. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সরকার থেকে পদত্যাগকারী চারজন উপদেষ্টার অন্যতম ছিলেন সুলতানা কামাল চক্রবর্তী। সেই পদত্যাগের পথ ধরেই এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের আর একজন প্রভাবশালী সদস্যের নাম অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ। বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট আইনজীবীর আরও একটি পরিচয় হলো, তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনির স্বামী। আপন স্ত্রী যে সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই সরকারের দুর্নীতির বিষয়ে তার ভূমিকা কী হতে পারে সেটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। একই ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন সাবেক চিফ ইলেকশন কমিশনার ড. শামসুল হুদা। ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের এই প্রধান ব্যক্তি মইনউদ্দিন জামানায় বিএনপিকে বিভক্ত করার ‘মহত্’ কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সাবেক এই আমলা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে চারদলীয় জোট সরকারের প্রতি গণমাধ্যমের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তার মেধার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করেনি। এহেন একজন দলবাজ টিআইবিতে থেকে যে আওয়ামী লীগের স্বার্থের পক্ষেই প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবেন, সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের আওয়ামী লীগ প্রীতির ব্যাপারটিও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মোটামুটি জানা রয়েছে। এই ক’জন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যেও আওয়ামীপন্থীদের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতো। সুতরাং বিএনপি সরকারের সময় টিআইবি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতখানি আদর্শিক ও নৈতিক অবস্থান প্রদর্শন করেছিল, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সেটি তাদের কাছে আশা করাটাই বোকামি। তাছাড়া স্মরণে রাখা দরকার, টিআইবিতে এখনও ড. মোজাফফর আহমেদের মতো ব্যক্তির শূন্যতা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজের এক বিরাট গোষ্ঠীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণেই এদেশে সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট পাশ্চাত্যের মতো বিকশিত হতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুশীল (?) সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালালেও এই কারণেই আজ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা দেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি’র এবারের বিতর্কিত অবস্থান কেবল সুশীল (?) সমাজকেই যে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তাই নয়, এদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকেও দুর্বল করে ফেলবে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে যদি টিআইবি’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সমস্যা হয়, তাহলে সবিনয়ে অন্তত তাদেরকে নীরব থাকতেই অনুরোধ জানাব। মহাজোট সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের অপশাসনকালে টিআইবিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় নিষ্ক্রিয় ঠেকেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদের বাকি দেড় বছরও তারা একটি দীর্ঘ শীতকালীন নিদ্রা (যরনবত্হধঃরড়হ) দিলে সবারই মঙ্গল হবে। বাংলাদেশের সচেতন দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে টিআইবি মার্কা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াই ইন্শাআল্লাহ বিজয় লাভ করবে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com