মাহমুদুর রহমান
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অক্টোবরে আমাদের দুই প্রবল
ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সফর করে দেশে ফিরেছেন। অন্য বিষয়াদির মতোই
বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর চরিত্রে লক্ষণীয়
ভিন্নতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবরই বিদেশে বেড়াতে বিশেষ পছন্দ
করেন। তার সকল নিকট-জনেরাও সপরিবারে প্রবাসী। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারে
দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে চারদিকে গুঞ্জন ওঠার প্রেক্ষিতে কয়েক মাস আগে
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের সংজ্ঞা দেশবাসীকে
জানিয়েছিলেন। সেই সংজ্ঞায় তিনি ছাড়া তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং উভয়ের
পুত্র-কন্যাগণকেবল প্রধান-মন্ত্রীর পরিবারভুক্ত। পুত্রবধূ অথবা
কন্যা-জামাতা এবং পৌত্র-পৌত্রীদের এই সংজ্ঞায় স্থান কোথায়, সে বিষয়ে শেখ
হাসিনা অবশ্য কিছু বলেননি। যাই হোক, এরা সবাই আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেনের
বাসিন্দা। পদ্মা সেতু দুর্নীতির দেশে-বিদেশে তদন্তের প্রেক্ষিতে তিন দেশের
মধ্যে সম্প্রতি কানাডা নিয়েই মিডিয়া ও জনগণের ঔত্সুক্য বিশেষভাবে বেড়েছে।
সুতরাং, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণপ্রীতির পেছনে ন্যায্য কারণ
রয়েছে। অপরদিকে আগের ইতিহাসে দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া স্বদেশে থাকতেই
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাঁচ বছরের সরকারি দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, তিনি নিজে যেমন বিদেশে যেতে চান না, একইভাবে
মন্ত্রী-আমলাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতাকেও যথেষ্ট অপছন্দ করেন।
রাজনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই পুত্র বিগত চার
বছরেরও অধিককাল বিদেশে থাকলেও তিনি কিন্তু পরিবার থেকে দূরে থাকার যাতনা
সয়ে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া দশ বছর বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে প্রায় নয় বছর
পার করেছেন এবং এবারের মেয়াদ পূর্ণ করে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের
রেকর্ড ধরে ফেলবেন বলেই সকলের ধারণা। মাঝখানের দুই বছরের
মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময়টুকু বাদ দিলে দুই নেত্রী দুই দশক ধরে
পালাক্রমে সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় প্রধান হয়েছেন। এই সময়ের বিদেশ
ভ্রমণের তালিকা প্রণয়ন করলে একজনের বিদেশ ভ্রমণপ্রীতি এবং অপরজনের বিদেশ
যেতে অনীহার চিত্রটি জনগণের কাছে পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠবে। ক্ষমতাবানদের
বেড়ানোর গল্প রেখে এবার রাজনীতির গুরু-গম্ভীর আলোচনায় আসি।
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হতে সংবিধান অনুসারে এখনও এক বছরেরও কিছু অধিক সময় বাকি আছে। জনগণ গভীর আশঙ্কা নিয়ে আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশব্যাপী এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির তাবত্ ‘কৃতিত্ব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। উভয়ে মিলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল না করলে এই অনভিপ্রেত অস্বস্তির সৃষ্টি হতো না। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল না হলেও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হচ্ছেন, সেটা নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ২০০৬ সালের মতো একটা টানাপড়েন যে থাকতো, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ অপরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকই আজ সেই পদের দাবিদার হতেন। ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানকে সত্তরের দশকে তার সঙ্গে বিএনপির কথিত সাংগঠনিক সম্পর্ক এবং কর্নেল রশীদের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি।
তদুপরি ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার কর্তৃক বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ২ (দুই) বছর বৃদ্ধি করার বিষয়টিকে তত্কালীন বিরোধী দল সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে। কিন্তু একজন বিচারপতি হিসেবে কেএম হাসান প্রজ্ঞা, নিরপেক্ষতা, সততা এবং আইনের গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ সর্বদাই বিচারপতিসুলভ ছিল। দীর্ঘ জজিয়তি জীবনে তিনি যে সকল রায় লিখেছেন, সেগুলো নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অপরদিকে বিচারপতি খায়রুল হক আদালতপাড়ায় একজন চরম দলবাজ বিচারপতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সম্পর্কেও দেশবাসী অবহিত। কাজেই বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া বিএনপি’র পক্ষে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হতো না। মনে রাখা দরকার, এই ধরনের জটিলতা থেকে উত্তরণের পন্থা ত্রয়োদশ সংশোধনীতেই দেয়া ছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, ৫৮গ (৫)-এ বলা ছিল—
“যদি আপীল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে, রাষ্ট্রপতি, যতদূর সম্ভব, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনাক্রমে, বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হইবার যোগ্য তাহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।”
এক-এগারোর সরকার গঠনের সময় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই শুধু সামরিক জান্তার নির্দেশে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার এই পদক্ষেপ সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন হলেও সে সময় সুশীল (?) সমাজভুক্ত আইনজীবীকুল এবং শেখ হাসিনাসহ মহাজোট নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। যাই হোক, দেশের বর্তমান বিবদমান পরিস্থিতিতে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি রাজনৈতিক সংঘাত থেকে হয়তো জনগণকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু একতরফাভাবে প্রায় অকার্যকর, একদলীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান পদে নিযুক্তির সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবর্তে প্রধান দুই দল এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন পরিচালনা এবং আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।
বিগত চার বছরে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে আন্দোলনের হুঙ্কার দিলেও তেমন কোনো সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বরং আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থকও হয়তো স্বীকার করবেন যে, ১৯৯১-পরবর্তী বাংলাদেশের বিগত চারটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মেয়াদকালে রাজপথের আন্দোলনের বিবেচনায় এবারই কোনো সরকার তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছে। এখন পর্যন্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপন হরণকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল দেয়াতে বিএনপি’র নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পরিষ্কার অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপিবিরোধীরা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে অবশ্যই দাবি করতে পারেন যে, বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সরকারের কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার কারণেই দেশের রাজনীতি শান্তিপূর্ণ থেকেছে।
যে কারণেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই উত্তরণ ঘটে থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো মহাজোট সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ চার বছর সময় পেয়েও চরম দলীয়করণ, নজিরবিহীন দুর্নীতি ও তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিদেশি মুরব্বি গোষ্ঠীও বাংলাদেশে জনমতের পরিবর্তন সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পেরে তাদের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। তাদের সেই পরিবর্তনে এদেশের শাসকগোষ্ঠীও যে বিচলিত হয়ে পড়ছে, সেটাও বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে নেতৃবৃন্দের অকূটনৈতিক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে পরাজয়-পরবর্তী অবধারিত জনরোষ থেকে রক্ষা পেতেই ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আয়োজন করছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে এই সর্বনাশা খেলা থেকে তাদের অবশ্যই নিবৃত্ত হওয়া উচিত। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের ফলাফল হৃদয়বিদারক হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুই দফায় একতরফা নির্বাচন করলেও কোনো বারই সংসদের মেয়াদ দুই বছরের বেশি টেকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে গণধিকৃত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযুক্তির জন্যই করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই স্বল্পকালীন সংসদের মেয়াদও তাই ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণের সঙ্গেই সমাপ্ত হয়েছিল।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার বিপজ্জনক পথ ধরেই জেনারেল মইন-মাসুদ গং ক্ষমতা দখল করেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে তারাও আজকের মহাজোটের মতোই নব্বই দিনের মেয়াদের কথা ভুলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল। বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ তত্কালীন অসাংবিধানিক সরকারকে শুধু সমর্থনই জানায়নি, ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা : প্রচারণা ও বাস্তবতা’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত কলামের এক জায়গায় শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে লিখেছিলাম— “বাস্তবতা হলো, এই দুই নেত্রী মিলে দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরূপে বাংলাদেশ পরিচালনা করেছেন এবং কারাবন্দী অবস্থাতেও এই দু’জনই বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারার রাজনীতির অবিসংবাদিত নেত্রীর স্থানটি ধরে রেখেছেন। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ হয়তো এমন ধারণা পোষণ করেন যে, জননন্দিত নেতা চাইলেই পাওয়া যায় অথবা হওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ হলে তথাকথিত মাইনাস টু কৌশল এতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে যেত।”
২০০৮ সালের মাঝামাঝি দুই নেত্রী সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে দুই মুক্তিতে অনেক ফারাক ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্কালীন সামরিক জান্তার সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত সমাপ্তি সাপেক্ষেই জেলের বাইরে পা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরুদ্ধ সেই অশুভ আঁতাত নিয়ে তখন লিখেছিলাম, ‘আঁতাতকারীরা ক্ষমতার পিঠা ভাগে মত্ত।’ ওই বছর জুলাইয়ের ১৭ তারিখে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সেই লেখায় আমার মন্তব্য ছিল—
“বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মাখামাখি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেখ হাসিনা কারামুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে এখন বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের একপ্রস্থ সংলাপ নাটকও সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক-এগারোর অন্যতম রূপকার ও প্রচ্ছন্নের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির প্রশংসায় ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। অপরদিকে এই সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে।”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্য মন্ত্রীর জাতিকে এক-এগারোর ভয় দেখানোর প্রেক্ষিতেই পাঠকদের পুরনো কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। তাদের স্মরণে রাখা আবশ্যক, এক-এগারো আওয়ামী লীগ ও সুশীল (?) গোষ্ঠীর যৌথ প্রকল্প ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সেই এক-এগারোর আঁতাতেরই ফসল। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। সুতরাং, এক-এগারো সম্পর্কে সমালোচনার নৈতিক অধিকার বাংলাদেশের আর যে নাগরিকই হোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখেন না। ফখরুদ্দীন আহমদের শপথ গ্রহণের দিনে বঙ্গভবনে দলবলসহ তার সহর্ষ উপস্থিতি এবং সেই সরকারের ‘সকল কর্মকাণ্ডের’ আগাম বৈধতা প্রদানের ঘোষণার কথা ভুলো বাঙালি মুসলমান বোধহয় এখনও পুরোপুরি ভুলে যায়নি।
তাছাড়া সেই ক্যু দেতা’র অন্যতম নায়ক লে. জে. (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী চাকরিতে একের পর এক মেয়াদ বৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাকে এই নজিরবিহীন পুরস্কার প্রদানের পেছনে যে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের ব্যাপারটি ক্রিয়াশীল রয়েছে, সেটি দেশের সকল সচেতন নাগরিকই বুঝতে পারেন। এক-এগারোর সরকার দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মইন-মাসুদকে লক্ষ্য করে যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, তার যে দুই সাবেক জেনারেলের কেশাগ্র স্পর্শ করারও ক্ষমতা নেই, এটা সম্ভবত তিনিও জানেন। তবু চেঁচামেচি করে গায়ের ঝাল যদি কিছুটা কমানো যায় আর কী!
বেগম খালেদা জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সহসাই জোর নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করবে বলেই মনে হচ্ছে। সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় দশম সংসদ নির্বাচন আগামী বছর অক্টোবরের ২৫ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২৪-এর মধ্যবর্তী যে কোনো দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সাবেক প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আবার কমপক্ষে ৪২ দিনের নির্বাচন প্রস্তুতির একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের ওই অংশটি বিবেচনায় নিলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৮ সালেও ওই মাসেই নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাসে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খানিকটা অতিরিক্ত উদ্দীপনা বিরাজ করে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে থাকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। সব মিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে।
গণআকাঙ্ক্ষা মান্য করে তিনি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। ১৯৯৬ সালের বিএনপির মতো বর্তমান সংসদে মহাজোটের সংসদ সদস্যের সংখ্যা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে সময় সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে ১৫ ফেব্রুয়ারির অজনপ্রিয় নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় শেষ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী সংবিধানে যে কোনো সংশোধনী আনার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দলের রয়েছে। তার সরকারের মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আইনগতভাবে বৈধ এবং নৈতিকভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
কিন্তু মেয়াদ শেষে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ হাসিনা যদি দশম সংসদের একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করতেও পারেন, তাহলেও তাকে আর বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে কেউ মেনে নেবে না। সেক্ষেত্রে কেবল পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করেই তাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সকল অত্যাচারী শাসকের ভয়ানক পরিণতি ঘটেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও বর্তমান সরকার ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। শেষ ভরসা ভারতীয় দুর্গতেও বেগম খালেদা জিয়া জোরেশোরে হানা দিয়েছেন। সুতরাং কেবল এক ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে ২০০৮-এর মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে একসঙ্গে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার ফ্যাসিবাদী চিন্তাই বরং আবারও অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমগ্র জাতিকেই শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বোধবুদ্ধিহীন দুঃসাহসিকতার মূল্য চুকাতে হয়। মইন-মাসুদ গংয়ের তুঘলকি রাজত্ব-পরবর্তী পাঁচ বছরে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা দুর্বল হয়েছে। দলগুলোর সংকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা বাংলাদেশকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর পরমুখাপেক্ষী করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের স্বার্থে স্বাধীনতাকামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজন। গণতন্ত্রের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অন্তত জাতীয় ইস্যুতে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। আশা করি, শেখ হাসিনা উপলব্ধি করবেন, অসাংবিধানিক সরকারের আগমনী পথ প্রশস্ত করার চাইতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করাও অধিকতর নিরাপদ ও সম্মানজনক। ২০০৮ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র চার বছরের ব্যবধানে জনসমর্থনের বিচারে বেগম খালেদা জিয়ার অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানো থেকে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হতে সংবিধান অনুসারে এখনও এক বছরেরও কিছু অধিক সময় বাকি আছে। জনগণ গভীর আশঙ্কা নিয়ে আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশব্যাপী এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির তাবত্ ‘কৃতিত্ব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। উভয়ে মিলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল না করলে এই অনভিপ্রেত অস্বস্তির সৃষ্টি হতো না। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল না হলেও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হচ্ছেন, সেটা নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ২০০৬ সালের মতো একটা টানাপড়েন যে থাকতো, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ অপরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকই আজ সেই পদের দাবিদার হতেন। ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানকে সত্তরের দশকে তার সঙ্গে বিএনপির কথিত সাংগঠনিক সম্পর্ক এবং কর্নেল রশীদের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি।
তদুপরি ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার কর্তৃক বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ২ (দুই) বছর বৃদ্ধি করার বিষয়টিকে তত্কালীন বিরোধী দল সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে। কিন্তু একজন বিচারপতি হিসেবে কেএম হাসান প্রজ্ঞা, নিরপেক্ষতা, সততা এবং আইনের গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ সর্বদাই বিচারপতিসুলভ ছিল। দীর্ঘ জজিয়তি জীবনে তিনি যে সকল রায় লিখেছেন, সেগুলো নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অপরদিকে বিচারপতি খায়রুল হক আদালতপাড়ায় একজন চরম দলবাজ বিচারপতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সম্পর্কেও দেশবাসী অবহিত। কাজেই বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া বিএনপি’র পক্ষে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হতো না। মনে রাখা দরকার, এই ধরনের জটিলতা থেকে উত্তরণের পন্থা ত্রয়োদশ সংশোধনীতেই দেয়া ছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, ৫৮গ (৫)-এ বলা ছিল—
“যদি আপীল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে, রাষ্ট্রপতি, যতদূর সম্ভব, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনাক্রমে, বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হইবার যোগ্য তাহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।”
এক-এগারোর সরকার গঠনের সময় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই শুধু সামরিক জান্তার নির্দেশে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার এই পদক্ষেপ সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন হলেও সে সময় সুশীল (?) সমাজভুক্ত আইনজীবীকুল এবং শেখ হাসিনাসহ মহাজোট নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। যাই হোক, দেশের বর্তমান বিবদমান পরিস্থিতিতে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি রাজনৈতিক সংঘাত থেকে হয়তো জনগণকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু একতরফাভাবে প্রায় অকার্যকর, একদলীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান পদে নিযুক্তির সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবর্তে প্রধান দুই দল এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন পরিচালনা এবং আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।
বিগত চার বছরে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে আন্দোলনের হুঙ্কার দিলেও তেমন কোনো সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বরং আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থকও হয়তো স্বীকার করবেন যে, ১৯৯১-পরবর্তী বাংলাদেশের বিগত চারটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মেয়াদকালে রাজপথের আন্দোলনের বিবেচনায় এবারই কোনো সরকার তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছে। এখন পর্যন্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপন হরণকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল দেয়াতে বিএনপি’র নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পরিষ্কার অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপিবিরোধীরা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে অবশ্যই দাবি করতে পারেন যে, বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সরকারের কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার কারণেই দেশের রাজনীতি শান্তিপূর্ণ থেকেছে।
যে কারণেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই উত্তরণ ঘটে থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো মহাজোট সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ চার বছর সময় পেয়েও চরম দলীয়করণ, নজিরবিহীন দুর্নীতি ও তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিদেশি মুরব্বি গোষ্ঠীও বাংলাদেশে জনমতের পরিবর্তন সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পেরে তাদের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। তাদের সেই পরিবর্তনে এদেশের শাসকগোষ্ঠীও যে বিচলিত হয়ে পড়ছে, সেটাও বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে নেতৃবৃন্দের অকূটনৈতিক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে পরাজয়-পরবর্তী অবধারিত জনরোষ থেকে রক্ষা পেতেই ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আয়োজন করছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে এই সর্বনাশা খেলা থেকে তাদের অবশ্যই নিবৃত্ত হওয়া উচিত। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের ফলাফল হৃদয়বিদারক হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুই দফায় একতরফা নির্বাচন করলেও কোনো বারই সংসদের মেয়াদ দুই বছরের বেশি টেকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে গণধিকৃত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযুক্তির জন্যই করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই স্বল্পকালীন সংসদের মেয়াদও তাই ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণের সঙ্গেই সমাপ্ত হয়েছিল।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার বিপজ্জনক পথ ধরেই জেনারেল মইন-মাসুদ গং ক্ষমতা দখল করেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে তারাও আজকের মহাজোটের মতোই নব্বই দিনের মেয়াদের কথা ভুলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল। বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ তত্কালীন অসাংবিধানিক সরকারকে শুধু সমর্থনই জানায়নি, ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা : প্রচারণা ও বাস্তবতা’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত কলামের এক জায়গায় শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে লিখেছিলাম— “বাস্তবতা হলো, এই দুই নেত্রী মিলে দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরূপে বাংলাদেশ পরিচালনা করেছেন এবং কারাবন্দী অবস্থাতেও এই দু’জনই বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারার রাজনীতির অবিসংবাদিত নেত্রীর স্থানটি ধরে রেখেছেন। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ হয়তো এমন ধারণা পোষণ করেন যে, জননন্দিত নেতা চাইলেই পাওয়া যায় অথবা হওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ হলে তথাকথিত মাইনাস টু কৌশল এতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে যেত।”
২০০৮ সালের মাঝামাঝি দুই নেত্রী সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে দুই মুক্তিতে অনেক ফারাক ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্কালীন সামরিক জান্তার সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত সমাপ্তি সাপেক্ষেই জেলের বাইরে পা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরুদ্ধ সেই অশুভ আঁতাত নিয়ে তখন লিখেছিলাম, ‘আঁতাতকারীরা ক্ষমতার পিঠা ভাগে মত্ত।’ ওই বছর জুলাইয়ের ১৭ তারিখে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সেই লেখায় আমার মন্তব্য ছিল—
“বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মাখামাখি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেখ হাসিনা কারামুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে এখন বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের একপ্রস্থ সংলাপ নাটকও সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক-এগারোর অন্যতম রূপকার ও প্রচ্ছন্নের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির প্রশংসায় ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। অপরদিকে এই সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে।”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্য মন্ত্রীর জাতিকে এক-এগারোর ভয় দেখানোর প্রেক্ষিতেই পাঠকদের পুরনো কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। তাদের স্মরণে রাখা আবশ্যক, এক-এগারো আওয়ামী লীগ ও সুশীল (?) গোষ্ঠীর যৌথ প্রকল্প ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সেই এক-এগারোর আঁতাতেরই ফসল। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। সুতরাং, এক-এগারো সম্পর্কে সমালোচনার নৈতিক অধিকার বাংলাদেশের আর যে নাগরিকই হোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখেন না। ফখরুদ্দীন আহমদের শপথ গ্রহণের দিনে বঙ্গভবনে দলবলসহ তার সহর্ষ উপস্থিতি এবং সেই সরকারের ‘সকল কর্মকাণ্ডের’ আগাম বৈধতা প্রদানের ঘোষণার কথা ভুলো বাঙালি মুসলমান বোধহয় এখনও পুরোপুরি ভুলে যায়নি।
তাছাড়া সেই ক্যু দেতা’র অন্যতম নায়ক লে. জে. (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী চাকরিতে একের পর এক মেয়াদ বৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাকে এই নজিরবিহীন পুরস্কার প্রদানের পেছনে যে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের ব্যাপারটি ক্রিয়াশীল রয়েছে, সেটি দেশের সকল সচেতন নাগরিকই বুঝতে পারেন। এক-এগারোর সরকার দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মইন-মাসুদকে লক্ষ্য করে যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, তার যে দুই সাবেক জেনারেলের কেশাগ্র স্পর্শ করারও ক্ষমতা নেই, এটা সম্ভবত তিনিও জানেন। তবু চেঁচামেচি করে গায়ের ঝাল যদি কিছুটা কমানো যায় আর কী!
বেগম খালেদা জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সহসাই জোর নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করবে বলেই মনে হচ্ছে। সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় দশম সংসদ নির্বাচন আগামী বছর অক্টোবরের ২৫ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২৪-এর মধ্যবর্তী যে কোনো দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সাবেক প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আবার কমপক্ষে ৪২ দিনের নির্বাচন প্রস্তুতির একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের ওই অংশটি বিবেচনায় নিলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৮ সালেও ওই মাসেই নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাসে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খানিকটা অতিরিক্ত উদ্দীপনা বিরাজ করে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে থাকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। সব মিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে।
গণআকাঙ্ক্ষা মান্য করে তিনি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। ১৯৯৬ সালের বিএনপির মতো বর্তমান সংসদে মহাজোটের সংসদ সদস্যের সংখ্যা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে সময় সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে ১৫ ফেব্রুয়ারির অজনপ্রিয় নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় শেষ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী সংবিধানে যে কোনো সংশোধনী আনার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দলের রয়েছে। তার সরকারের মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আইনগতভাবে বৈধ এবং নৈতিকভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
কিন্তু মেয়াদ শেষে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ হাসিনা যদি দশম সংসদের একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করতেও পারেন, তাহলেও তাকে আর বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে কেউ মেনে নেবে না। সেক্ষেত্রে কেবল পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করেই তাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সকল অত্যাচারী শাসকের ভয়ানক পরিণতি ঘটেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও বর্তমান সরকার ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। শেষ ভরসা ভারতীয় দুর্গতেও বেগম খালেদা জিয়া জোরেশোরে হানা দিয়েছেন। সুতরাং কেবল এক ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে ২০০৮-এর মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে একসঙ্গে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার ফ্যাসিবাদী চিন্তাই বরং আবারও অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমগ্র জাতিকেই শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বোধবুদ্ধিহীন দুঃসাহসিকতার মূল্য চুকাতে হয়। মইন-মাসুদ গংয়ের তুঘলকি রাজত্ব-পরবর্তী পাঁচ বছরে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা দুর্বল হয়েছে। দলগুলোর সংকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা বাংলাদেশকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর পরমুখাপেক্ষী করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের স্বার্থে স্বাধীনতাকামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজন। গণতন্ত্রের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অন্তত জাতীয় ইস্যুতে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। আশা করি, শেখ হাসিনা উপলব্ধি করবেন, অসাংবিধানিক সরকারের আগমনী পথ প্রশস্ত করার চাইতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করাও অধিকতর নিরাপদ ও সম্মানজনক। ২০০৮ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র চার বছরের ব্যবধানে জনসমর্থনের বিচারে বেগম খালেদা জিয়ার অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানো থেকে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন