শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : আগ্রাসী দলীয়করণের অশুভ পরিণতি



মাহমুদুর রহমান
দিন বদলের সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে বিতর্কিত করতে সক্ষম হয়েছে। দলবাজ প্রশাসন নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, গত সপ্তাহে পুলিশের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে আমি নিজেও লিখেছি। আজ বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যকার সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত বাদানুবাদের মধ্যেই আমার মন্তব্য-প্রতিবেদন সীমিত রাখব। এই আমলের বিচার বিভাগের সঙ্গে আমার বৈরী সম্পর্কের কথা শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাও অবগত আছেন। আদালতে সরকারি দলের নজিরবিহীন দলীয়করণের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ‘অপরাধে’ আমি আদালত অবমাননার দুটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলও খেটে এসেছি। সরকার ও বিচার বিভাগের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত হলেও আমার জন্য সন্তোষের বিষয় হলো, যে কথাগুলো আমি আড়াই বছর আগে লিখেছিলাম, সেগুলোই আজ দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। আদালত শুদ্ধিকরণের লড়াইয়ে তখন একাকী হলেও আজ মনে হচ্ছে, আমি আর নিঃসঙ্গ নই। কোটারি সর্বস্ব বাংলাদেশে আমরা যার যার সুবিধামত ইতিহাস তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সুবিধাবাদীদের ইতিহাস তৈরি প্রসঙ্গে এক-এগারোর সরকারের সময়কালীন একটা উদাহরণ দিয়ে আজকের মূল বিষয়ে ফিরব।
এক-এগারো সরকারের একেবারে প্রথমদিকের সমালোচনাকারীদের মধ্যে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্যু দেতার প্রথম দিনে ওই সরকারের গঠন প্রণালী এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিবিসিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রথম যে বিবৃতিটি ছাপা হয়েছিল, সেটিরও এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন সামাদ ভাই। সেই সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকারের মুখোশ উন্মোচনের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছিলাম আমি এবং কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ঔরসে জন্মলাভকারী সরকারটি ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, আর আমি সেই সরকারের সমালোচনা করে প্রথম কলামটি লিখেছিলাম একই মাসের ২৭ জানুয়ারি। ‘অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার বিপদ সংকেত’ শিরোনামে লেখা কলামের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি;
“তবে দেশের ভালো চাইলে, অর্থনীতির উন্নয়ন চাইলে, যত তাড়াতাড়ি জনগণের নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, ততই মঙ্গল। স্বদেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের চেয়ে উত্তম এবং বৈধ কোনো সরকারব্যবস্থা এ যাবত আবিষ্কার হয়নি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই আমরা দ্রুততার সঙ্গে সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবো। আশির দশকের এক পতিত, দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসককে সব দল মিলে মহা তারকারূপে পুনর্বাসিত করে সেই অগ্রস্ত্যযাত্রার প্রথম পদক্ষেপটা আমরা বোধহয় নিয়েই ফেলেছি।”
গণতন্ত্রের সপক্ষে আমার কলম ধরার মুহূর্তে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদরা হয় গা-ঢাকা দিয়েছেন, নয়তো বোবার শত্রু নাই নীতি গ্রহণ করে আত্মরক্ষার চেষ্টায় রত ছিলেন। সেই কঠিন সময়ে দেশের তাবত্ বুদ্ধিজীবীকুল এবং সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ওই একই কলামে এক-এগারোর সরকার যে আইনসিদ্ধ নয়, সেই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলাম—‘বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এ নিশ্চয়তা বোধ হয় কেউ দিতে চাইবেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল প্রজ্ঞাপন এবং সেই বাতিল করা নির্বাচনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ১৭ জন সংসদ সদস্য সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ ভবিষ্যতে উত্থাপিত হবে না।’ উল্লিখিত কলামটি কাশবন প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘জাতির পিতা ও অন্যান্য’তে সঙ্কলিত হয়েছে। লেখালেখির বাইরে টেলিভিশন টকশো’তে দেশবাসীকে বিশেষ সরকারের স্বরূপ চেনানোর বিপজ্জনক দায়িত্ব নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং সাবেক সচিব মো. আসাফউদ্দৌলাহ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। আমিও দুই-একটি চ্যানেল থেকে কখনও সখনও ডাক পেলে ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করতাম। টেলিভিশনে আমার কালো তালিকাভুক্তির সূচনাও তখনই ঘটে। আর এই আমলে তো কোনো চ্যানেলে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে সেই চ্যানেল বন্ধের সরাসরি হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে। আজকাল টক শো’তে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক-এগারো সরকারের বিরোধিতা করার অসত্য দাবি করে থাকেন, তাদের অধিকাংশই তখন হয় নীরব থেকেছেন অথবা সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। ইতিহাস বিকৃতি সম্ভবত আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। একইভাবে বিচার বিভাগ আজ চারদিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক ব্যক্তিই হয়তো দাবি করবেন যে তারাই মামলার ঝুঁকি নিয়েও আদালত পাড়ার অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। হাওয়া বুঝে পাল খাটানোতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির অভাব এ দেশে কোনোদিনই হয়নি। তবে এক্ষেত্রে জেল খাটা আসামি হওয়ার কারণে আমার অন্তত খানিকটা অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। ধারণা করছি, আমার দুটি আদালত অবমাননা মামলার সব নথিপত্র এবং রায় ডিএলআর (DLR)-এ স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং, ইচ্ছে থাকলেও অন্য কারও পক্ষে সেই ইতিহাসে ভাগ বসানো সম্ভব হবে না।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। বর্তমান সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতে রেকর্ড সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। সেসব নিয়োগের পেছনেও মূলত দলীয় বিবেচনাই কাজ করেছে। এই বিচারপতিদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত বিশেষ একজনকে নরসিংদীর জেলা জজ থেকে কয়েক ডজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজে পদোন্নতি দিয়ে পরে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া খুনের মামলার আসামি এবং সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীও বিচারপতি হয়েছেন। বাদবাকি নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অতীতে সরকারদলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের ইতোপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশনার কোনোরকম তোয়াক্কা বর্তমান সরকার করেনি। গত সাড়ে তিন বছরে আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও নির্বিচারে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। আদালতকে অপব্যবহার করে ভিন্নমত দলনের এক চরম নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে দিন বদলের সরকার। হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন নিয়েও আদালত পাড়ায় নানারকম বিতর্ক রয়েছে। সিনিয়র বিচারপতিদের সমন্বয়ে রিট বেঞ্চ গঠন না করে দলীয় বিবেচনায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এক সময় উচ্চ আদালতে অধিক সংখ্যায় বিব্রত হওয়ার নজিরের সঙ্গে হাল আমলে বিভক্ত রায়ের রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে পর্যন্ত হত্যা করার ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য আজ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকেও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লন্ডনে টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে পুলিশের এত বড় নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। একই বিচারপতি মো. আসাফউদ্দৌলাহ, সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং শফিক রেহমানসহ দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের তার এজলাসে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য প্রণীত আচরণবিধিও তিনি প্রতি পদে লঙ্ঘন করেছেন। প্রধান বিচারপতি এই অসঙ্গত আচরণের রাশ টেনে ধরার কোনোরকম চেষ্টা করেননি। অবশেষে সংসদের সঙ্গে আদালতের অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ সৃষ্টিতেও একই বিচারপতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন।
সরকারের অতিমাত্রায় দলীয়করণের নীতি এবং আদালত নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি অবধারিত ছিল। এই আশঙ্কা থেকেই ২০১০ সালের ১০ মে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছিলাম—
“একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্য এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ, সর্বত্র অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে অন্যায়-অবিচারের ভয়াবহ বিস্তৃতি এক সময় দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন ক্যালদীয়রা পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছিল, সেই সময়ের নবী যেরেমিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতির সঞ্চিত পাপ সমস্ত জাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় (অভিশপ্ত নগরী, সত্যেন সেন)।”
এই লেখালিখিতে সংশ্লিষ্টদের সংবিত্ ফেরার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আমাকে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে সুপ্রিমকোর্ট ভবিষ্যতের সব সমালোচকের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ৫ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের তার বিরুদ্ধে দল বেঁধে সমালোচনা আমার উপরিউক্ত লেখার যৌক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নতুন করে প্রমাণ করেছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বোধ করছি।
দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাও সংসদ এবং আদালতের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রের এই দুই স্তম্ভের মধ্যকার তিক্ততা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়বে। তারা দুই পক্ষের মন্তব্যকেই অনভিপ্রেত উল্লেখ করে ব্যাপারটির আশু সমাধান কামনা করেছেন। আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়েই সংসদের ওপর আদালতের এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছে। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন অবশ্য বলেছেন, দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদই সুপিরিয়র। যে ব্রিটিশ সিস্টেমের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, সেখানেও সংসদের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সে কারণে যুক্তরাজ্যে সব বিষয়কে আদালতে টেনে নেয়ার রেওয়াজ নেই। আদালতও Justiciability (আদালতের এখতিয়ার)-এর আলোকে সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়টি তাদের বিচারিক আওতার মধ্যে পড়ে। সাধারণত সংসদ দ্বারা প্রণীত আইন বিষয়ে তারা বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম মানবাধিকার বিষয়ক পর্যালোচনা। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে Human Rights Act প্রণীত হওয়ার পর থেকে আদালত কোনো আইন পর্যালোচনা করে যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ওই আইনের কোনো অংশ Human Rights Act, 1998-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাহলেই কেবল ওই অংশ সংশোধনের জন্য আইনটি সংসদে ফেরত পাঠানো হয়। এর বাইরে অবশ্য Judicial review (বিচারিক পর্যালোচনা) করার রেওয়াজ রয়েছে। আইন নিয়ে পড়াশোনা না করলেও আইন সংক্রান্ত কিছু বই-পত্র উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছে। সংসদে গৃহীত পঞ্চম, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালত কর্তৃক যেভাবে বাংলাদেশে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, আমার ধারণা, তার তুল্য নজির যুক্তরাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে প্রণীত আইনের উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড রিড (Lord Reid) তার এক রায়ে বলেছেন :
“In earlier times many learned lawyers seem to have believed that an Act of Parliament could be disregarded in so far as it was contrary to the law of God or law of nature or natural justice, but since the supremacy of Parliament was finally demonstrated by the revolution of 1688 any such idea has become obsolete.”
(অতীতে অনেক আইনজীবীর মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে, সংসদে প্রণীত আইন উপেক্ষণীয় হতে পারে যদি সেটি স্রষ্টার আইন কিংবা প্রকৃতির আইন অথবা স্বাভাবিক আইনের পরিপন্থী হয়; কিন্তু ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে এ জাতীয় ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে।)
বাংলাদেশে এর আগে কখনও বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়নি। আগের বিচারপতিরা সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে আচরণবিধি সুচারুরূপে পালন করার কারণে সমাজের সব অংশের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধাভাজন থাকতেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কথায় কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে নেয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এক বাদী পবিত্র কোরআন শরীফ পর্যন্ত সংশোধনের আবদার নিয়ে রিট বেঞ্চে হাজির হওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অধঃপতনের দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকেই সর্বতোভাবে বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রাথমিক কাজটি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন (Impeach) করার ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংবিধানের বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী অভিশংসনের জন্য একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে Supreme Judicial Council গঠনের নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ৯৬(৩) ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া নিম্নোক্তভাবে নির্দেশিত হয়েছে :
‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে কাউন্সিল বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুই জন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে।’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিচার বিভাগই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে রায় দিয়ে দেশে অনভিপ্রেত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালে প্রকৃতপক্ষে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান আদৌ আদালতের এখতিয়ারের (Justiciable) মধ্যে পড়ে কি-না, এই প্রশ্ন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যেই রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে জনগণ অবশ্যই সে প্রশ্নের জবাব খুঁজবে। ইতিহাস রচনার দায়িত্ব যে ইতিহাসবিদদের কাছেই থাকা উচিত, আমার এই মন্তব্যের সঙ্গে আশা করি দেশের অধিকাংশ নাগরিকই সহমত পোষণ করবেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে উপলক্ষ করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আবারও সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছেন। তবে হুমকি বাস্তবায়নের ক্ষমতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ক্ষমতাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে ঢাকায় ও লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের তথাকথিত রাজ পরিবারের সদস্যদের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি আদালত পাড়ায় বহুল প্রচারিত। সুতরাং, পুরো বিতর্কটি ধামাচাপা পড়লে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না। এদিকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে আনার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসনের (Impeachment)-এর ক্ষমতা সংসদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সেই সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারাটি পূর্ববত্ রেখে দিয়েছেন। অর্থাত্ রায় লেখার সময় তিনি বিচার বিভাগের কোটারি সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়ে যেহেতু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, কাজেই ভবিষ্যতে এই লক্ষ্যে আবারও সংবিধান সংশোধনের দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।
৪১ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকশ্রেণী জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সংবিধানকে কেবল নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে যার যার সুবিধামত ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সাড়ে তিন বছরে এই গর্হিত কাজটি এতটাই নগ্নভাবে করা হয়েছে যে, জনগণের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কেই এক ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সংবিধানে বারবার কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে এবার দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নই সম্ভবত ষোল কোটি মানুষের মুক্তির পথ হতে পারে। ১৯৭২ সালে যে সংসদ সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, সেই সংসদের সব সদস্য ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসনাধীন লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক (Legal Frame work)-এর অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্রীয় (MNA) ও প্রাদেশিক (MPA) সংসদের সব সদস্যকে একত্রিত করে বাংলাদেশের গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠিত হয়েছিল। নির্বাচিতদের মধ্যে পাকিস্তানের কয়েকজন দালালকে কেবল গণপরিষদের বাইরে রাখা হয়েছিল। এ সবই ইতিহাসের অংশ। কাজেই চার দশকের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের গণআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবার দ্বিতীয় সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া উচিত। নতুন সংবিধান প্রণয়নে সমাজের সব শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করলে সেই দলিলে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করা যায়। এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদসহ দেশের সব বিজ্ঞজন ভেবে দেখতে পারেন।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন