মাহমুদুর রহমান
আজ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক সংলাপের কথা রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্ভবত নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এটাই বিএনপির সঙ্গে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান জানুয়ারির ১১ তারিখ এই সংলাপের দিন কেন নির্ধারণ করলেন, সেটি আমার কাছে অন্তত রহস্যময় মনে হয়েছে। ২০০৭ সালে এই দিনটিতেই মইন-মাসুদ গং বন্দুকের নলের মুখে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে জরুরি আইন জারিতে বাধ্য করেছিল। হয়তো তারিখটির সংবেদনশীলতার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সেই সময়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আজকের রাষ্ট্রপতি অনুধাবন করতে পারেননি। আবার এটাও হতে পারে বিশেষ তারিখটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে সৌভাগ্যের বারতাবাহী।
যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে সংলাপ অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক এবং ইতিবাচক প্রক্রিয়া। তবে সেই সংলাপ সফল হওয়ার জন্য এজেন্ডা নিয়ে আলোচনারত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আগে থেকেই মতৈক্য অত্যাবশ্যক। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে তার সর্বশেষ রোডমার্চ সমাপনী বক্তৃতায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন বিষয়ক আলোচনাকেই তাদের পক্ষের প্রধান এজেন্ডা রূপে ঘোষণা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এটি নতুন অথবা অপ্রত্যাশিত কোনো বক্তব্য নয়। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল বিষয়ক পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বাইরের কোনো বিষয়ে আলোচনায় তার সম্মতি জ্ঞাপন করেননি। উল্লেখ্য, এজেন্ডায় না থাকলেও দেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ইতিমধ্যে জানিয়ে এসেছেন। এমতাবস্থায় সরকার গোঁ-ধরে বসে থাকলে আজকের আলোচনার পরিণতিও ২০০৬ সালের মান্নান ভূঁইয়া-আবদুল জলিলের ব্যর্থ সংলাপের অনুরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি।
দেশের কোনো শান্তিপ্রিয় নাগরিকই ২০০৬-এর আওয়ামী লীগ পরিচালিত লগি-বৈঠার অমার্জনীয় বর্বরতার সময়ে প্রত্যাবর্তন করতে চাইবে না বলেই ধারণা করছি। বেগম খালেদা জিয়াও তার একাধিক বক্তব্যে বলেছেন যে, তিনি আওয়ামী লীগের সেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনুসরণ করবেন না। তবে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ সফল করার গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রতিপালন এবং নৈতিকতার স্বার্থে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকেই গ্রহণ করতে হবে। ১৯৯৫ সালে আজকের রাষ্ট্রপতি যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণয়নের দাবিতে চলমান সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকালে তার নিজের দেয়া বক্তব্য-বিবৃতি থেকে কয়েকটি মাত্র তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং দেশবাসীকে অবহিত করা একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দায়িত্ব বিবেচনা করে এই লেখায় উদ্ধৃত করছি :
১. “প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকার মানসিকতার কারণে দেশ আজ গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত। বেগম জিয়ার দায়িত্বহীনতা ও গণবিরোধী ভূমিকার কারণে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের মাধ্যমে সংসদ ও সরকার বৈধতা হারাইয়াছে। কাজেই বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নাই। তিনি শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানান।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ২ জানুয়ারি ১৯৯৫
২. “আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগের পরও সরকারের বোধোদয় ঘটিতেছে না। এখনও সংলাপের নামে টালবাহানা করা হইতেছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদকে পদত্যাগ করিতে হইবে এবং সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জানুয়ারি ১৯৯৫
৩. “প্রধানমন্ত্রীকে ৯০ দিন আগে পদত্যাগ করিয়া ও সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হইবে। অন্য কোনো পথ পন্থা মানিয়া নেওয়া হইবে না। খালেদা জিয়ার অধীনে কোনো নির্বাচনে বাংলার জনগণ অংশ নেবে না।”—
১৯৯৫ সালের ১২ নভেম্বর ৬ দিনব্যাপী হরতালের প্রথম দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে দেয়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের বক্তব্য।
৪. “ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, অবৈধ সংসদ বাতিল ও সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এবং লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদে আহূত ৬ দিনের হরতালের দ্বিতীয় দিনেও ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হইয়াছে। আগামী দিনের হরতালও একইভাবে পালন করিয়া সরকারকে গণদাবি মানিয়া নিতে বাধ্য করা হইবে।” —
১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত জনসভায় জিল্লুর রহমান
৫. “আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, জনগণের আন্দোলনে বাধ্য হইয়া বেগম খালেদা জিয়া উপনির্বাচন বাতিল করিতে এবং অবৈধ সংসদ ভাঙিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইনশাআল্লাহ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করা হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৫
৬. “জিল্লুর রহমান বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ’৮৮ স্টাইলের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করিয়াছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগে বলিয়াছেন, ‘তামাশা করার জন্য নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করি নাই’ এখন আবার বলিতেছেন, ‘নির্বাচন পিছানো যাইতে পারে।’ বস্তুত সবকিছুই হইতেছে গণদাবীকে উপেক্ষা করার গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করিবেই।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৫।
বিএনপির সঙ্গে আজ সংলাপের আগে রাষ্ট্রপতি আমার লেখাটি পড়বেন কিনা, অথবা আমার কোনো লেখা তিনি আদৌ পঠনযোগ্য বিবেচনা করেন কিনা, সেই তথ্য আমার কাছে নেই। তবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সামরিক-বেসামরিক হর্তা-কর্তারা লেখাটির সারসংক্ষেপ সংলাপ শুরুর আগেই তার গোচরে নিলে এই জীবন সায়াহ্নে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের বিবেকবোধ জাগ্রত হতেও পারে।
১৯৯৫ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মহাজোটভুক্ত দলসমূহ ছাড়াও বিস্ময়করভাবে সেদিনের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। কেবল তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিও সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামীর তত্কালীন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমই উত্থাপন করেছিলেন। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের সেই দাবিটিকেই পরবর্তীকালে নিজেদের করে নিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে আজই অধ্যাপক গোলাম আযমকে কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জবাব দিতে হবে। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে এক সময় পাশে বসিয়ে তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেছিলেন। আওয়ামী বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরূপ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ভোটব্যাংকে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল। তখন অবশ্য আওয়ামী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্টরা জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকদের যুদ্ধাপরাধী নামে অভিহিত করে তাদের অস্পৃশ্য বিবেচনা করতেন না। আওয়ামী লীগের এ জাতীয় দ্বৈতনীতি বাংলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার দলটির নীতিনির্ধারকদের অন্যতম সমস্যা হলো যে, তারা বাংলাদেশের জনগণের স্মৃতিশক্তিকে বড়ই দুর্বল ভাবতে অভ্যস্ত। যাই হোক, আমি আজ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নৈতিকতার প্রশ্নে কলম ধরেছি। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ১৯৯৫ এবং ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের নামে কতটা নৃশংসতা ও সহিংসতা প্রদর্শন করেছিলেন কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তাদের সেদিনের অবস্থান কী ছিল, সেগুলো আলোচনাবহির্ভূত রাখছি।
আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে এখন চারটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমটি, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’, এই বহুল ব্যবহৃত সুবিধাবাদী বক্তব্য দিয়ে ১৯৯৫ সালের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দেয়া বক্তৃতাকে আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক নয় বলে সংলাপে এড়িয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে তিনি কেবল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে পরামর্শের জন্যে সংলাপে ডেকেছেন দাবি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে তার এজেন্ডা-বহির্ভূত ঘোষণা করা। তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আলোচনা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অধিকারবহির্ভূত দাবি করে বিতর্কটিকে সংসদের ঘাড়ে ফিরিয়ে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত রাষ্ট্রপতিকে উপরিউক্ত তিন কৌশলের যে কোনো একটি অবলম্বনের পরামর্শ দেবেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, ক্ষমতাসীন জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা রাষ্ট্রপতির আহূত সংলাপে যোগদান করে ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের জোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের এই ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে জনগণ এ পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি। যে তিনটি রাজনৈতিক কৌশলের কথা বর্ণনা করেছি, তার সবগুলোই প্রবীণ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানকে জীবনের এই প্রান্তসীমায় একজন চরম বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করবে। সেই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে এবং দেশ অবধারিত সংঘাতের দিকে ধাবিত হবে। রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ধিকৃত হবেন। সুতরাং দেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সম্মানজনক পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান চতুর্থ পথটিই কেবল অনুসরণ করতে পারেন। আমার ধারণা, চতুর্থ পথটি তার জন্য অবশ্যই কণ্টকাকীর্ণ হবে। পৃথিবীতে সত্যের পথ কোনোদিনই সহজ হয়নি। চার নম্বর পথটি বর্ণনার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।
শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির উপর কেন এত বিরাগ, তার বিশ্লেষণ আমার গ্রেফতারের আগে এবং পরে বহুবার দিয়েছি। একই বিষয় নিয়ে এতবার লিখতে আমার কাছে যেমন ক্লান্তিকর বোধ হয়, একইভাবে আমি নিশ্চিত যে পাঠকরাও পড়তে বিরক্ত হন। তবে ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের এক অনুুষ্ঠানে শেখ হাসিনা একটি রুচিবহির্ভূত বক্তব্য দেয়াতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই পুরনো কাসুন্দি আবার ঘাঁটতে হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক এলেই যে বিরোধীদলীয় নেতাকে চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসাবে তার গ্যারান্টি কী?” শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তাকে চ্যাংদোলার পরিবর্তে এক সময়ের গ্রামবাংলার পর্দানশীন বধূদের মতো পাল্কিতে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন কিনা, সেটা তারই ভালো জানার কথা।
তবে, শেখ হাসিনার বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আতংকে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। সেই আতংক কতটা ক্ষমতা হারানোর ভয়তাড়িত এবং কতটা বর্তমান প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে পুনরায় অসৌজন্যমূলকভাবে গ্রেফতার হয়ে সাবজেলে যাওয়ার আশংকায়, সেটাও একমাত্র তিনিই জানেন। মোদ্দা কথা, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার চরম অসন্তুষ্টির ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে জনমনে তার প্রতি হারানো শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দুর্নীতির দায়ে ১২ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক পুত্রকে মার্জনা, নাটোরের কুড়িজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দলীয় ক্যাডারকে মার্জনাসহ একেবারে কারাগার থেকে মুক্তিদান এবং সর্বশেষ লক্ষ্মীপুরের অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের চিহ্নিত খুনি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র তাহেরের পুত্রের সাজা মওকুফ করে তিনি আওয়ামী লীগের একেবারে নীতিবিবর্জিত নেতা-কর্মী ছাড়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ চিরস্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে মহান আল্লাহ্ রাষ্ট্রপতিকে তার অতীত কর্মকাণ্ড থেকে ক্ষমা পাওয়ার সম্ভবত একটি শেষ সুযোগ দিয়েছেন। সেই সুযোগ গ্রহণ করে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহস নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবে তারই।
এক এগারোর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জিল্লুর রহমান সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করে তার দল এবং নেত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করব, আজ দেশের জন্য এক এগারোর চেয়েও সংকটময় পরিস্থিতিতে তিনি এবার দলের পরিবর্তে রাষ্ট্র, জনগণ এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখবেন। পরিণামে তাকে হয়তো রাষ্ট্রপতির পদ হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। চারদলীয় জোট সরকার তাদেরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ২০০২ সালে বঙ্গভবন থেকে অত্যন্ত অসম্মানের সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায় করে একটি মন্দ নজির স্থাপন করে গেছে। তারও আগে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই তত্কালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহকে সরিয়ে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে এক লাফে রাষ্ট্রপতির আসনে বসে পড়েছিলেন। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ তত্কালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন বশংবদ সাবেক বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। তবে, সবগুলো ঘটনারই প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল।
আজকের সংলাপে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার বিনিময়ে তাকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হলেও ইতিহাসে তার অবস্থান উজ্জ্বল হবে। তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশের জনগণ একটি পক্ষপাতশূন্য নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করছে। দেশ-বিদেশে সর্বজনগ্রাহ্য সেই নির্বাচন করতে হলে স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাটাও আবশ্যক। এতক্ষণ আশাবাদের কথা শোনালেও বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নিরাশা দিয়েই লেখার সমাপ্তি টানব। ১৯৯৬ সালের সরকারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সংসদের এক বক্তৃতায় জিল্লুর রহমান তার নেত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করার লক্ষ্যে সম্ভবত অতিরিক্ত আবেগের বসে প্রধানমন্ত্রীকে সক্রেটিসের মত কালজয়ী মনীষীর সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছিলেন। এ ধরনের চাটুকারিতা সংসদে প্রথমবারের মত নির্বাচিত ব্যাক বেঞ্চারদেরই (Back-bencher) কেবল মানায়। সেই জিল্লুর রহমান আজ মহামান্য রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করছেন। তিনি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় মানসিকতা কতখানি বর্জন করতে পেরেছেন, এই প্রশ্নের জবাব পেতে দেশের জনগণকে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে সংলাপ অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক এবং ইতিবাচক প্রক্রিয়া। তবে সেই সংলাপ সফল হওয়ার জন্য এজেন্ডা নিয়ে আলোচনারত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আগে থেকেই মতৈক্য অত্যাবশ্যক। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে তার সর্বশেষ রোডমার্চ সমাপনী বক্তৃতায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন বিষয়ক আলোচনাকেই তাদের পক্ষের প্রধান এজেন্ডা রূপে ঘোষণা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এটি নতুন অথবা অপ্রত্যাশিত কোনো বক্তব্য নয়। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল বিষয়ক পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বাইরের কোনো বিষয়ে আলোচনায় তার সম্মতি জ্ঞাপন করেননি। উল্লেখ্য, এজেন্ডায় না থাকলেও দেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ইতিমধ্যে জানিয়ে এসেছেন। এমতাবস্থায় সরকার গোঁ-ধরে বসে থাকলে আজকের আলোচনার পরিণতিও ২০০৬ সালের মান্নান ভূঁইয়া-আবদুল জলিলের ব্যর্থ সংলাপের অনুরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি।
দেশের কোনো শান্তিপ্রিয় নাগরিকই ২০০৬-এর আওয়ামী লীগ পরিচালিত লগি-বৈঠার অমার্জনীয় বর্বরতার সময়ে প্রত্যাবর্তন করতে চাইবে না বলেই ধারণা করছি। বেগম খালেদা জিয়াও তার একাধিক বক্তব্যে বলেছেন যে, তিনি আওয়ামী লীগের সেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনুসরণ করবেন না। তবে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ সফল করার গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রতিপালন এবং নৈতিকতার স্বার্থে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকেই গ্রহণ করতে হবে। ১৯৯৫ সালে আজকের রাষ্ট্রপতি যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণয়নের দাবিতে চলমান সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকালে তার নিজের দেয়া বক্তব্য-বিবৃতি থেকে কয়েকটি মাত্র তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং দেশবাসীকে অবহিত করা একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দায়িত্ব বিবেচনা করে এই লেখায় উদ্ধৃত করছি :
১. “প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকার মানসিকতার কারণে দেশ আজ গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত। বেগম জিয়ার দায়িত্বহীনতা ও গণবিরোধী ভূমিকার কারণে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের মাধ্যমে সংসদ ও সরকার বৈধতা হারাইয়াছে। কাজেই বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নাই। তিনি শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানান।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ২ জানুয়ারি ১৯৯৫
২. “আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগের পরও সরকারের বোধোদয় ঘটিতেছে না। এখনও সংলাপের নামে টালবাহানা করা হইতেছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদকে পদত্যাগ করিতে হইবে এবং সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জানুয়ারি ১৯৯৫
৩. “প্রধানমন্ত্রীকে ৯০ দিন আগে পদত্যাগ করিয়া ও সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হইবে। অন্য কোনো পথ পন্থা মানিয়া নেওয়া হইবে না। খালেদা জিয়ার অধীনে কোনো নির্বাচনে বাংলার জনগণ অংশ নেবে না।”—
১৯৯৫ সালের ১২ নভেম্বর ৬ দিনব্যাপী হরতালের প্রথম দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে দেয়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের বক্তব্য।
৪. “ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, অবৈধ সংসদ বাতিল ও সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এবং লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদে আহূত ৬ দিনের হরতালের দ্বিতীয় দিনেও ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হইয়াছে। আগামী দিনের হরতালও একইভাবে পালন করিয়া সরকারকে গণদাবি মানিয়া নিতে বাধ্য করা হইবে।” —
১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত জনসভায় জিল্লুর রহমান
৫. “আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, জনগণের আন্দোলনে বাধ্য হইয়া বেগম খালেদা জিয়া উপনির্বাচন বাতিল করিতে এবং অবৈধ সংসদ ভাঙিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইনশাআল্লাহ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করা হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৫
৬. “জিল্লুর রহমান বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ’৮৮ স্টাইলের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করিয়াছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগে বলিয়াছেন, ‘তামাশা করার জন্য নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করি নাই’ এখন আবার বলিতেছেন, ‘নির্বাচন পিছানো যাইতে পারে।’ বস্তুত সবকিছুই হইতেছে গণদাবীকে উপেক্ষা করার গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করিবেই।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৫।
বিএনপির সঙ্গে আজ সংলাপের আগে রাষ্ট্রপতি আমার লেখাটি পড়বেন কিনা, অথবা আমার কোনো লেখা তিনি আদৌ পঠনযোগ্য বিবেচনা করেন কিনা, সেই তথ্য আমার কাছে নেই। তবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সামরিক-বেসামরিক হর্তা-কর্তারা লেখাটির সারসংক্ষেপ সংলাপ শুরুর আগেই তার গোচরে নিলে এই জীবন সায়াহ্নে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের বিবেকবোধ জাগ্রত হতেও পারে।
১৯৯৫ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মহাজোটভুক্ত দলসমূহ ছাড়াও বিস্ময়করভাবে সেদিনের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। কেবল তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিও সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামীর তত্কালীন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমই উত্থাপন করেছিলেন। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের সেই দাবিটিকেই পরবর্তীকালে নিজেদের করে নিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে আজই অধ্যাপক গোলাম আযমকে কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জবাব দিতে হবে। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে এক সময় পাশে বসিয়ে তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেছিলেন। আওয়ামী বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরূপ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ভোটব্যাংকে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল। তখন অবশ্য আওয়ামী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্টরা জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকদের যুদ্ধাপরাধী নামে অভিহিত করে তাদের অস্পৃশ্য বিবেচনা করতেন না। আওয়ামী লীগের এ জাতীয় দ্বৈতনীতি বাংলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার দলটির নীতিনির্ধারকদের অন্যতম সমস্যা হলো যে, তারা বাংলাদেশের জনগণের স্মৃতিশক্তিকে বড়ই দুর্বল ভাবতে অভ্যস্ত। যাই হোক, আমি আজ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নৈতিকতার প্রশ্নে কলম ধরেছি। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ১৯৯৫ এবং ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের নামে কতটা নৃশংসতা ও সহিংসতা প্রদর্শন করেছিলেন কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তাদের সেদিনের অবস্থান কী ছিল, সেগুলো আলোচনাবহির্ভূত রাখছি।
আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে এখন চারটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমটি, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’, এই বহুল ব্যবহৃত সুবিধাবাদী বক্তব্য দিয়ে ১৯৯৫ সালের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দেয়া বক্তৃতাকে আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক নয় বলে সংলাপে এড়িয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে তিনি কেবল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে পরামর্শের জন্যে সংলাপে ডেকেছেন দাবি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে তার এজেন্ডা-বহির্ভূত ঘোষণা করা। তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আলোচনা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অধিকারবহির্ভূত দাবি করে বিতর্কটিকে সংসদের ঘাড়ে ফিরিয়ে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত রাষ্ট্রপতিকে উপরিউক্ত তিন কৌশলের যে কোনো একটি অবলম্বনের পরামর্শ দেবেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, ক্ষমতাসীন জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা রাষ্ট্রপতির আহূত সংলাপে যোগদান করে ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের জোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের এই ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে জনগণ এ পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি। যে তিনটি রাজনৈতিক কৌশলের কথা বর্ণনা করেছি, তার সবগুলোই প্রবীণ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানকে জীবনের এই প্রান্তসীমায় একজন চরম বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করবে। সেই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে এবং দেশ অবধারিত সংঘাতের দিকে ধাবিত হবে। রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ধিকৃত হবেন। সুতরাং দেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সম্মানজনক পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান চতুর্থ পথটিই কেবল অনুসরণ করতে পারেন। আমার ধারণা, চতুর্থ পথটি তার জন্য অবশ্যই কণ্টকাকীর্ণ হবে। পৃথিবীতে সত্যের পথ কোনোদিনই সহজ হয়নি। চার নম্বর পথটি বর্ণনার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।
শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির উপর কেন এত বিরাগ, তার বিশ্লেষণ আমার গ্রেফতারের আগে এবং পরে বহুবার দিয়েছি। একই বিষয় নিয়ে এতবার লিখতে আমার কাছে যেমন ক্লান্তিকর বোধ হয়, একইভাবে আমি নিশ্চিত যে পাঠকরাও পড়তে বিরক্ত হন। তবে ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের এক অনুুষ্ঠানে শেখ হাসিনা একটি রুচিবহির্ভূত বক্তব্য দেয়াতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই পুরনো কাসুন্দি আবার ঘাঁটতে হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক এলেই যে বিরোধীদলীয় নেতাকে চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসাবে তার গ্যারান্টি কী?” শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তাকে চ্যাংদোলার পরিবর্তে এক সময়ের গ্রামবাংলার পর্দানশীন বধূদের মতো পাল্কিতে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন কিনা, সেটা তারই ভালো জানার কথা।
তবে, শেখ হাসিনার বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আতংকে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। সেই আতংক কতটা ক্ষমতা হারানোর ভয়তাড়িত এবং কতটা বর্তমান প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে পুনরায় অসৌজন্যমূলকভাবে গ্রেফতার হয়ে সাবজেলে যাওয়ার আশংকায়, সেটাও একমাত্র তিনিই জানেন। মোদ্দা কথা, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার চরম অসন্তুষ্টির ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে জনমনে তার প্রতি হারানো শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দুর্নীতির দায়ে ১২ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক পুত্রকে মার্জনা, নাটোরের কুড়িজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দলীয় ক্যাডারকে মার্জনাসহ একেবারে কারাগার থেকে মুক্তিদান এবং সর্বশেষ লক্ষ্মীপুরের অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের চিহ্নিত খুনি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র তাহেরের পুত্রের সাজা মওকুফ করে তিনি আওয়ামী লীগের একেবারে নীতিবিবর্জিত নেতা-কর্মী ছাড়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ চিরস্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে মহান আল্লাহ্ রাষ্ট্রপতিকে তার অতীত কর্মকাণ্ড থেকে ক্ষমা পাওয়ার সম্ভবত একটি শেষ সুযোগ দিয়েছেন। সেই সুযোগ গ্রহণ করে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহস নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবে তারই।
এক এগারোর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জিল্লুর রহমান সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করে তার দল এবং নেত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করব, আজ দেশের জন্য এক এগারোর চেয়েও সংকটময় পরিস্থিতিতে তিনি এবার দলের পরিবর্তে রাষ্ট্র, জনগণ এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখবেন। পরিণামে তাকে হয়তো রাষ্ট্রপতির পদ হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। চারদলীয় জোট সরকার তাদেরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ২০০২ সালে বঙ্গভবন থেকে অত্যন্ত অসম্মানের সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায় করে একটি মন্দ নজির স্থাপন করে গেছে। তারও আগে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই তত্কালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহকে সরিয়ে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে এক লাফে রাষ্ট্রপতির আসনে বসে পড়েছিলেন। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ তত্কালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন বশংবদ সাবেক বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। তবে, সবগুলো ঘটনারই প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল।
আজকের সংলাপে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার বিনিময়ে তাকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হলেও ইতিহাসে তার অবস্থান উজ্জ্বল হবে। তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশের জনগণ একটি পক্ষপাতশূন্য নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করছে। দেশ-বিদেশে সর্বজনগ্রাহ্য সেই নির্বাচন করতে হলে স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাটাও আবশ্যক। এতক্ষণ আশাবাদের কথা শোনালেও বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নিরাশা দিয়েই লেখার সমাপ্তি টানব। ১৯৯৬ সালের সরকারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সংসদের এক বক্তৃতায় জিল্লুর রহমান তার নেত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করার লক্ষ্যে সম্ভবত অতিরিক্ত আবেগের বসে প্রধানমন্ত্রীকে সক্রেটিসের মত কালজয়ী মনীষীর সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছিলেন। এ ধরনের চাটুকারিতা সংসদে প্রথমবারের মত নির্বাচিত ব্যাক বেঞ্চারদেরই (Back-bencher) কেবল মানায়। সেই জিল্লুর রহমান আজ মহামান্য রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করছেন। তিনি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় মানসিকতা কতখানি বর্জন করতে পেরেছেন, এই প্রশ্নের জবাব পেতে দেশের জনগণকে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন