মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : ছিটমহলবাসীর বঞ্চনা



মাহমুদুর রহমান
গত সপ্তাহে অনশনরত ছিটমহলবাসীর দুঃখ-কষ্টের কাহিনী সরাসরি জানার জন্য অনেকটা হঠাত্ করেই পঞ্চগড়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়কের ঠিক পাশেই অনশনস্থলে গিয়ে জানলাম, ওটাই নাকি ভারতীয় ছিটমহল। বাংলাদেশের একেবারে ভেতরে ভারতীয় ছিটমহলের অবস্থান কী করে সম্ভব, সেটা জানার জন্য র্যাডক্লিফ সাহেবের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু সেটা তো এই জীবনে আর সম্ভব হচ্ছে না। মরার পর তার সঙ্গে দেখা হবে কি-না, সেটাও একমাত্র আল্লাহই জানেন।
স্যার খেতাবপ্রাপ্ত সিরিল র্যাডক্লিফ (Cyril Radcliffe) ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানা ভাগাভাগি করার কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের তত্কালীন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন (Lord Louis Mountbatten) এবং স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ বিলেতে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছিলেন। পরম বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পাক-ভারত উপমহাদেশকে দুই ভাগ করার গুরুদায়িত্ব যে ব্যক্তিটির ওপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণী অর্পণ করেছিল, সেই সিরিল র্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালের আগে কোনোদিন এই অঞ্চলে পা রাখেননি। সে বছর ৮ জুলাই দিল্লিতে আসার পর তাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে বৈরী দু’টি প্রতিবেশী স্বাধীন দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। তিনি নিজের মতো করে সীমানা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন করে ১৫ আগস্ট বিলেতে ফিরে যান।
বিস্ময়ের আরও বাকি আছে। পাকিস্তান এবং ভারত যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করলেও সীমানা ভাগাভাগির কাগজপত্র সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। সীমান্ত নিয়ে এই সংশয়ের কারণেই ওইদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদায় পাকিস্তানি পতাকা উড্ডীন ছিল। হিন্দু-মুসলমানের হানাহানি এড়ানোর অজুহাতে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ সীমানা নির্ধারণের পুরো কাজটি অতি গোপনে সম্পন্ন করেন এবং ভারত ত্যাগের আগে তিনি এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র রহস্যজনকভাবে পুড়িয়েও দিয়ে গেছেন।
তবে অনেক ঐতিহাসিকই এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, মাউন্টব্যাটেন দম্পতির সঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে ভারতীয় কংগ্রেস সব তথ্যই আগেভাগে পেয়েছিলেন। অন্ধকারে যদি প্রকৃতই কেউ থেকে থাকে, তাহলে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অবশ্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন সবসময়ই দাবি করে গেছেন যে, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বিশেষ ব্যক্তিগত সখ্য থাকলেও মুসলমানদের সঙ্গে তিনি কোনো প্রতারণা করেননি। র্যাডক্লিফ সাহেব যেহেতু প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়ে গেছেন, তাই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দাবির সত্যতা দীর্ঘ ৬৫ বছর পর নিরূপণের কোনো সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মোট ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক লাখ অধিবাসী র্যাডক্লিফ এবং মাউন্টব্যাটেনের খেয়ালখুশির অসহায় শিকার হয়ে আজ পর্যন্ত নিজভূমে পরবাসীর জীবনযাপনে যে বাধ্য হচ্ছেন, সেটা সর্বাংশে বাস্তব। আরও বাস্তব হলো, ছিটমহলবাসীর মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের জনগণই রয়েছেন। দেশভাগ নিয়ে হানাহানি এড়ানোর যে লক্ষ্যের কথা ব্রিটিশ শাসকরা প্রচার করেছিলেন, সেটিও শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিল এবং দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা তথ্যভেদে ২ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত দাবি করা হয়ে থাকে। এবার বর্তমানে ফিরে আসি।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পুটিমারী ছিটমহলে পৌঁছাতে বিকাল চারটা হয়ে গিয়েছিল। সেখানে তখন শ’দুয়েক নারী-পুরুষ এবং শিশু সামিয়ানার নিচে বসে আছেন। নারীদের মধ্যে শাখা-সিঁদুর পরিহিতাদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। অর্থাত্ সমস্যাটির সঙ্গে কোনোরকম সাম্প্রদায়িকতা জড়িত নেই। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে ঢাকা থেকে গেছি জেনে উপস্থিত আন্দোলনরত ছিটমহলবাসী অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আমি কথা দিলাম, আমার দেশ পত্রিকা অন্তত এই অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশে থাকবে। গোলাম মোস্তফা তার মোবাইলের মাধ্যমে সমন্বয় কমিটির ভারতীয় ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের সঙ্গে আমাকে কথা বলিয়ে দিলেন। তিনি তখন টানা ২৪ দিনের অনশনে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। দীপ্তিমান জানালেন, ২০০৯ সালে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি টানা ২৪ দিন অনশন করেছিলেন। সেই সময় তার অনশনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তত্কালীন বামফ্রন্ট রাজ্য সরকার আলোচনায় বসেছিল। অথচ ছিটমহলবাসী ২৪ দিন অনশন করলেও তাদের সঙ্গে সেই মমতা ব্যানার্জির সরকারের কেউ যোগাযোগ করেননি, স্বাস্থ্যের খোঁজখবরও নেননি। আমি উভয়পক্ষকে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে অন্য কোনো পন্থায় তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিলাম।
বাংলাদেশের গোলাম মোস্তফা কিংবা ভারতের দীপ্তিমান কেউই অনশন ভঙ্গ করতে সম্মত হলেন না। তাদের সম্মিলিত দাবি, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। সে পর্যন্ত তো বটেই, দুই দেশের মধ্যে চুক্তি না হলে আমৃত্যু তাদের অনশন চলবে। এই সিদ্ধান্তে কষ্ট পেলেও বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে লেখালেখির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের জনগণকে ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টার বাইরে কিছু করার সাধ্য আমার নেই। উভয় রাষ্ট্রের সরকার এদের প্রতি যে নির্লিপ্ততা দেখাচ্ছে, তাকে ধিক্কার জানানো আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। বিশেষত আমরা যারা মানবাধিকারের কথা বলি, তাদের পক্ষে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার সুযোগ নেই। কয়েক লাখ মানুষ ৬৫ বছর ধরে ভূমিপুত্র হয়েও নাগরিকের অধিকার পাবেন না—এমন অবিচার মেনে নেয়া যায় না। তাদের ভোটাধিকার নেই, লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, চিকিত্সার অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং কৃষি ছাড়া কর্মসংস্থানেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ কাগজে-কলমে সেই ১৯৫৮ সালেই সমস্যাটির একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান হয়ে আছে। কেবল সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণীর মানসিক দীনতা ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার জন্যই সেই সমাধান আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। এই প্রসঙ্গে আবারও খানিক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুই দেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির শিরোনাম ছিল : “Agreement between the Government of the Republic of India and Government of the People’s Republic of Bangladesh concerning the demarcation of the land boundary between India and Bangladesh and related matters.” চুক্তির এক নম্বর ধারার ১২ নম্বর উপধারায় ছিটমহল বিনিময়ের কথা এভাবে বলা হয়েছে :
“12. Enclaves
The Indian enclaves in Bangladesh and the Bangladesh enclaves in India should be exchanged expeditously, excepting the enclaves mentioned in paragraph, 14 without claim or compensation for the additional area going to Bangladesh.”
(বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় করা হবে, কেবল ১৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিটমহল এই বিনিময়ের বাইরে থাকবে এবং বাংলাদেশ যে অতিরিক্ত জমি পাবে তার জন্য অপরপক্ষ কোনো দাবি উত্থাপন করবে না অথবা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে না।)
উপরে উদ্ধৃত ধারায় বর্ণিত ১৪ অনুচ্ছেদ বেরুবাড়ী সম্পর্কিত, যেখানে বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং ছিটমহলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ড সংযুক্ত করার জন্য তিন বিঘা জমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিষয়টি ভারতীয় লোকসভায় ১৯৭৪ সালের ২২ জুলাই এক বিবৃতির মাধ্যমে তত্কালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং অবহিত করেন। একই বিষয়ে ২৬ জুলাই লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং বলেন :
“(a) Hon’ble Members will recall that under the Nehru-Noon Agreement of 1958 it was provided that, besides exchange of all Indian and Pakistani enclaves, as they then were, the four enclaves adjacent to the southern half of Berubari Union No. 12 would be transferred to the then East Pakistan, together with that portion of Berubari.
Under the recent Agreement with Bangladesh it has been agreed that these four enclaves, and the portion of Berubari that was to be transferred, will remain with India. In exchange Bangladesh will retain the enclaves of Dahagram and Angarpota.
(b) The area thus to be retained by India is estimated at approximately 7.0 square miles and the area retained by Bangladesh at 7.21 square miles.
(c) Since India and Bangladesh both thus retain areas at present in their possession, persons of these areas are not affected.”
(ক. সম্মানিত সদস্যদের স্মরণে আছে যে, ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সব ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে, বেরুবাড়ী ইউনিয়ন ১২’র দক্ষিণ অর্ধের পার্শ্ববর্তী চারটি ছিটমহল এবং বেরুবাড়ীর ওই অংশ পাকিস্তানের অনুকূলে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক চুক্তিতে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, ওই চারটি ছিটমহল এবং বেরুবাড়ীতে যে অংশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেগুলো ভারতের সঙ্গেই থাকবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও অঙ্গরপোতা ছিটমহল পাবে।
খ. এই চুক্তির ফলে ভারত প্রায় ৭.০ বর্গমাইল এবং বাংলাদেশ প্রায় ৭.২১ বর্গমাইল এলাকা প্রাপ্ত হবে।
গ, যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশ যার যার ভোগদখলকৃত ছিটমহলগুলো নিজেদের অধিকারে রাখবে, কাজেই ছিটমহলের জনগণ এই বিনিময়ের দ্বারা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।)

চুক্তির আইনি ভাষার মারপ্যাঁচ বিবেচনার বাইরে রেখে নেহরু-নুন চুক্তির ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ছিটমহল হস্তান্তর বিষয়ে যে চুক্তি করেছিলেন, সহজ বাংলায় তার মূল কথা আমার কাছে অন্তত নিম্নরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে :
১। বেরুবাড়ী ছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সব ছিটমহল যত দ্রুত সম্ভব বিনিময় করা হবে।
২। ছিটমহলের অধিবাসীরা যার যার বর্তমান অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।
৩। নুন-নেহরু চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী পাকিস্তানের অংশ হলেও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে সেই ছিটমহলটি ভারতের অংশরূপে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং তিনবিঘা করিডোর চিরস্থায়ীভাবে বাংলাদেশকে দেয়া হবে।
১৯৭৪ সালে চুক্তি প্রণয়নের পর ৩৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার অংশটুকু বাস্তবায়ন করলেও ভারত নানা অজুহাতে অদ্যাবধি সময়ক্ষেপণ করে চলেছে। ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের সংসদে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী গৃহীত হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ বেরুবাড়ীর ওপর থেকে তার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী তার বিনিময়ে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল পাওয়া গেলেও তিনবিঘা করিডোরের মালিকানা আমরা আজ পর্যন্ত পাইনি। প্রায় ৩৭ বছর পর ২০১১ সালে ছিটমহলবাসীকে মূল ভূখণ্ডে সার্বক্ষণিক যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ করিডোরটি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে সম্মত হলেও তিনবিঘার মালিকানা কিন্তু পাওয়া যায়নি। বিস্ময়করভাবে তিনবিঘা করিডোর সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ প্রাপ্তিকেই বর্তমান সরকার তাদের রাজনীতির বিপুল বিজয়রূপে অভিহিত করে চলেছে।
কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক দলীয় সভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যঙ্গ করে বলতে শুনেছি, আমরা ভারতের কাছ থেকে তিনবিঘা আনতে পেরেছি, আপনি ক্ষমতায় গেলে কি সেটা ফিরিয়ে দেবেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তিনবিঘা আনতে পারেননি, ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছেন মাত্র। দেশের জনগণকে অর্ধসত্য বলে বিভ্রান্ত করা হলে আন্তর্জাতিক চুক্তি পালনে সবসময় উদাসীন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকেই প্রকারান্তরে সহায়তা করা হবে। অবশ্য ভারতপ্রেমে অন্ধ আওয়ামী-জাতীয় পার্টি জোট সরকারকে এসব কথা বলা আর উলু বনে মুক্তা ছড়ানোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
মোদ্দা কথা, ভারত সরকারের অসহযোগিতার কারণেই ছিটমহলবাসী ৬৫ বছর ধরে ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকার মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সর্বতোভাবে বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে বার বার অনুরোধ করলেও আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী নির্বিকার থেকেছে। তাই বাধ্য হয়েই আজ ছিটমহলবাসী আমরণ অনশন করার মতো চূড়ান্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি ভারত সরকারের উপেক্ষার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ভারত-তোষণনীতি যুক্ত হয়ে ছিটমহলবাসীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অধিকতর কঠিন করে তুলেছে। ক’দিন আগে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ছিটমহলবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে দাবি করেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নাকি ভারতীয় লোকসভা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন করবে। এ দেশের জনগণের প্রতি এই শেকড়বিহীন লোকটির যে ন্যূনতম মমত্ববোধ নেই, তার প্রমাণ দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে অবহেলিত, নির্যাতিত ছিটমহলবাসীকে আরও ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছেন। তিনি ভুলে গেছেন, একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া আর কোথাও বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর মতো নিজভূমে পরবাসী হওয়ার নজির নেই। গত সপ্তাহে পঞ্চগড়ে ছিটমহলবাসীকে কথা দিয়ে এসেছিলাম আমার দেশ তাদের সংগ্রামের সাথী হবে, আমিও পরবর্তী মন্তব্য প্রতিবেদনে তাদের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরব। বাংলাদেশের গোলাম মোস্তফা এবং ভারতের দীপ্তিমান সেনগুপ্তকে উদ্দেশ করে বলছি, আমার এই লেখায় সেই কথা রাখার চেষ্টা করেছি। আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন পড়ে দেশের সচেতন নাগরিক অধিক সংখ্যায় যদি ছিটমহলবাসীর দাবির প্রতি একাত্মতা জানান, তাহলে আমার বিশ্বাস ভারত এবং বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে অবশ্যই বাধ্য হবে।
ই-মেইল- admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন