মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : শেয়ারবাজারে তুঘলকি কারবার : প্রথম পর্ব


মাহমুদুর রহমান
শেখ হাসিনা তার দুই দফার শাসনামলে সাফল্যের সঙ্গে শেয়ারবাজারের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করতে পেরেছেন। কিন্তু বিস্ময় ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জনগণের এত বড় ক্ষতিসাধন সত্ত্বেও তার কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয়েছে এর কোনো চিহ্ন এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো মূলধন হারিয়ে পথে বসে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের দোষারোপ করে সরকারের হর্তাকর্তারা নসিহত করছেন যে, পুঁজিবাজারে লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ এটা জেনেই তাদের ওই বাজারে টাকা খাটাতে হবে। অথচ ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতা হাতে নিয়েই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত এসইসি’র (SEC) তত্কালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকলেও আবুল মাল আবদুল মুহিত পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার বিষয়টিকে এতটা অগ্রাধিকার কেন দিয়েছিলেন? শেয়ারবাজারের চিহ্নিত খেলোয়াড়দের নানারকম কারসাজির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার দুই বছরের মধ্যে মূল্যসূচক ও লেনদেন বিপজ্জনক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হলে বিনিয়োগকারীদের আশু বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার পরিবর্তে একই অর্থমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, ছিয়ানব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি কিছুতেই হতে দেয়া হবে না। ডিজিটাল সরকারের মিথ্যা আশ্বাসে আস্থা স্থাপন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা চূড়ান্তভাবে ঠকেছেন। ১৯৯৬ সালে লুটপাটের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে এবার লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন করা হয়েছে।
আমি জেলে যাওয়ার দিনদুয়েক আগে মূল্যসূচক যখন ৬০০০-এর কাছাকাছি ছিল, তখনই মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে জনগণকে সাবধান করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম। টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়েও অব্যাহতভাবে বলেছি, সূচক ও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় বাস্তবসম্মত নয়। আমার লেখা ও কথায় কারও সংবিত্ ফেরেনি। জেলে থাকতেই খবর পেয়েছি সূচক বাড়তে বাড়তে ৯০০০-এর চূড়া ছুঁয়েছে। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের সব সঞ্চয় নিয়ে মুগ্ধ পতঙ্গের মতো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে শেয়ারবাজারের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কেবল সঞ্চয় ভেঙেই নয়, লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকে সম্পত্তি বিক্রি করে এমনকি ধারদেনা করেও শেয়ারে বিনিয়োগের নামে জুয়া খেলায় মত্ত হয়েছে। জনগণের এই বেকুবি দেখে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত শ্রেণী তাদের প্রাত্যহিক বিশেষ প্রকৃতির আমোদ-প্রমোদের আসরে দলবল নিয়ে মনের আনন্দে উল্লাস করেছে।
অর্থনীতির অবধারিত নিয়মে কৃত্রিম মূল্যসূচকের সেই অতিকায় বেলুন আমি জেলখানায় থাকতেই ফেটেছে। ২০১১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমার মুক্তির আগেই শাসকশ্রেণীর শেয়ারবাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণের টাকা লুটে নেয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ছিলেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। তারা কী পরিমাণ সম্পদশালী হয়েছেন, তার কোনো আন্দাজ আমাদের মতো নাগরিকের পক্ষে কল্পনাতে আনাও সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে তাদের বিলাসবহুল জীবন-যাপনের নানারকম খবর কানে আসে। এগুলো অবশ্য এখন পর্যন্ত শোনা কথাই, কাজেই কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব না। ভবিষ্যতে কখনও কাগজপত্র হাতে পেলে আমার দেশ পত্রিকায় অবশ্যই নাম-ধামসহ তাদের কীর্তি-কাহিনী ছাপা হবে।
বাংলাদেশের বিত্তশালীদের বিদেশে বাড়ি-ঘর কেনার গল্প অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এসব বাড়ি কেনার অর্থ হুন্ডিসহ অন্য যেসব পন্থায় তারা বিদেশে পাচার করেন, সে সম্পর্কেও পত্রপত্রিকায় অতীতে কিছু লেখালেখি হয়েছে। তবে এই সরকারের আমলে নতুন উপসর্গ জুটেছে। শেয়ারবাজার এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ইজ্জতের মাপকাঠি আগের মতো কেবল দেশ-বিদেশে প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক হওয়াতে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এখন তারা নাকি কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্যক্তিগত জেটবিমান কিনছেন। তাদের এই বিমানগুলো এমন দেশে রাখা হয়, যেখানে ঢাকা থেকে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্যিক বিমানে চড়ে পৌঁছানো সম্ভব। সেখানে পৌঁছানোর পর ইউরোপ, আমেরিকায় তারা ব্যক্তিগত জেটেই সাধারণত উড়ে বেড়ান।
ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানি একবার তার স্ত্রীর জন্মদিনে বিশেষভাবে নির্মিত বোয়িং-৭৩৭ বিমান উপহার দিয়ে সেদেশের গণমাধ্যমে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। অথচ মুকেশ আম্বানির সেই ভারতেই পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যার এমন হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করে, যারা সপ্তাহে একদিন ভাত খেতে পেলে বর্তে যায়। বাকি ছ’দিন বন-জঙ্গল থেকে আহরিত শাক-পাতা খেয়েই এই হতভাগ্য দরিদ্র ভারতীয়রা জীবনধারণ করে থাকে। মহাশ্বেতা দেবী এবং অরুন্ধতী রায় আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের এই শোষিত শ্রেণীকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের এমন ভয়াবহ অসম বণ্টনের অবধারিত প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্ধ্র থেকে পশ্চিমবাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত কথিত ‘রেড করিডোরে’ (Red Corridor) বামধারার সশস্ত্র সংগ্রাম বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল সরকারও তাদের তিন বছরের শাসনামলে বেশকিছু এ দেশি আম্বানি সৃষ্টি করে বিশেষ শ্রেণীর রাতারাতি উন্নয়নের ম্যাজিক দেখিয়েছে।
প্রকৃত আম্বানিরা তবু ভারতের শিল্পায়ন ও জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আমাদের নকল আম্বানিরা সাধারণ জনগণের টাকা লুটপাট করে নির্লজ্জ ফুটানিতে মত্ত হয়েছে। আমাদের দেশের বামধারার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারগুলোর পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণকেই এ অবস্থার জন্য প্রধানত দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু জীবনের সুদীর্ঘকাল বেসরকারি খাতে মোটামুটি শীর্ষ পদগুলোতে চাকরি করার অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি, এদেশে প্রকৃত পুঁজিবাদের চর্চাও ঠিকমত হচ্ছে না। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, তাকে দেশ ও জনগণের সম্পদের নির্ভেজাল ডাকাতি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকার সুযোগ নেই। পুঁজিবাদের নিয়ম-নীতি মেনে চললে দুর্বল জনগোষ্ঠীর শোষণ সত্ত্বেও কিছুটা অন্তত জাতীয় পুঁজি (National Capital) সঞ্চিত হয়। কিন্তু বিদেশে ব্যক্তিগত জেটবিমান, লন্ডনের হাইড পার্ক সংলগ্ন পার্ক লেন (Park Lane) অথবা ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে (Beverley Hills) লুটেরাদের বাড়ি অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো হিসাবেই দেশের সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। বিদেশে সম্পত্তি ক্রয় এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাহামা, কেইম্যান আইল্যান্ড (Cayman Island) ইত্যাদি রাষ্ট্রে দুর্নীতিলব্ধ বিপুল অর্থ সঞ্চয় করার জন্য বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চিত্রও জনগণ এতদিনে দেখে ফেলেছেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে ডলারের ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি অধিক মাত্রায় অর্থ পাচারেরই (Money Laundering) অশুভ পরিণতি।
অবৈধ সঞ্চয় লুকিয়ে রাখার জন্য একসময় সুইজারল্যান্ড নিরাপদ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করলেও এখন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত আলোচনায় মিডিয়ায় বেশি করে আসতে শুরু করেছে। লোকমুখে শুনি, চৌকস বাংলাদেশী লুটেরারা নাকি সেসব স্বল্প পরিচিত দেশের সন্ধানও পেয়ে গেছেন। শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিপুল অংকের টাকাও বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে অপরিচিত এসব বিভিন্ন গন্তব্যে বর্তমান শাসক শ্রেণীর জ্ঞাতসারেই পৌঁছে যাওয়া বিচিত্র নয়। দিনবদলের সরকারের সম্ভবত এই মেয়াদের মতো শেয়ারবাজার লুণ্ঠন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ার পর গত প্রায় ছয় মাস ধরে দেশবাসী বাজার স্থিতিশীল করার নামে নানারকম নাটক দেখে চলেছে। সেসব বিষয় নিয়ে আগে একাধিক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছি। সেই লেখাগুলো থেকে কোনোরকম পুনরাবৃত্তি না করে এবারের দুই পর্বের মন্তব্য প্রতিবেদনে কেবল তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব।
বহুল আলোচিত কালোটাকা দিয়েই শুরু করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারই আন্দোলনের ফসল মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের হলেও এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ সততার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও বক্তব্য-বিবৃতিতে তিনি সর্বদা নিজেকে, তার পরিবার ও দলকে ধোয়া তুলসিপাতা রূপেই প্রচার করে থাকেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দকে অবশ্য তিনি সরাসরি চোর ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করেন না। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহারটি আওয়ামী লীগ মহা সাড়ম্বরে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছিল, সেখানেও দুদককে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রদান ছাড়াও দুর্নীতি দমনের বিষয়ে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি ছিল। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে কোনো সংস্থা থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমন ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে উত্সাহিত করেছেন। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সব সরকারের আমলেই বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত ঘোষণা এতদিন সচরাচর এনবিআর থেকেই দেয়া হতো। এবার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এমন কথা বলায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সকল স্তরে বেশ খানিকটা সমালোচনারও সৃষ্টি হয়।
এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় ডিজিটাল সরকারের তুঘলকি আচরণ। বিশেষত গত সপ্তাহে মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন নীতিনির্ধারকদের অপ্রকৃতস্থতার প্রমাণ দেয়। ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে ১৯৭৯ সালের একটি নীতিমালার প্রসঙ্গ টেনে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ পড়ন্ত বাজার দ্রুততর গতিতে ডুবতে শুরু করলে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়ে সরকার সেদিনের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ১৮ তারিখ বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান দাবি করেন যে, পূর্বসন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর স্বয়ং প্রেস সচিবের ব্রিফিংয়ে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার খবর সঠিক নয়। মন্ত্রিসভা ওই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাকি গ্রহণ করেনি। এসইসি চেয়ারম্যানের এই আশ্বাসবাণীতে কোনো কাজ হয়নি, সারাদিনে সূচকের ১৬৭ পয়েন্ট পতন ঘটে। বিক্ষোভকারীরা ডিএসই’র সামনের রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রতিপালনকল্পে পরিপত্র জারি করে জানিয়ে দেয় যে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করতে পারবেন না। সচিবালয় থেকে আকস্মিক পরিপত্র জারিতে মতিঝিলে বিক্ষোভের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে দুপুরে জারি করা পরিপত্র সন্ধ্যায় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। উন্মাদেরও বোধহয় অসুস্থতার একটা লেভেল থাকে। ১৮ তারিখে সারাদিন ধরে সরকারের যেসব নীতিনির্ধারক এই প্রকৃতির বিকৃত মস্তিষ্ক আচরণ করেছেন, তাদের জনস্বার্থে অনতিবিলম্বে পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভয়ানক উন্মাদদের সঙ্গে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আটক রাখা আবশ্যক। নইলে দেশের আরও ব্যাপক সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।
পরিপত্র নাটক অন্তে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বিস্ময়করভাবে মূল্যসূচক একদিনে ২৫০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ পূর্ববত্ আইনসিদ্ধ রাখাতেই যদি এই বৃদ্ধি হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখনও সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেননি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের সর্বোচ্চ প্রায় ৯০০০ সূচকের বর্তমানে অর্ধেকে নেমে আসার সময়কালে এসব সরকারি কর্মকর্তা পুঁজিবাজারে তাদের টাকা পূর্ববত্ কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই খাটিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সূচকের ধস থামানো যায়নি। বাস্তবতা হলো, সূচকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শেয়ারের অবিশ্বাস্য দরপতন উভয় ক্ষেত্রেই বাজার কারসাজি (Market manipulation) ক্রিয়াশীল থেকেছে। এই কারসাজির মাধ্যমেই চিহ্নিত লুটেরারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং গত বৃহস্পতিবার একদিনে বাজারমূল্যের গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির মধ্যে আমি অন্তত অর্থনৈতিক কার্যকারণের পরিবর্তে আবারও কারসাজির গন্ধ পাচ্ছি। এরপরও সংবিত্ না ফিরলে বিনিয়োগকারীদের কপালে আরও দুঃখ বাকি আছে। আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হতে তিনদিনের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বর্তমান সপ্তাহের প্রথম দু’দিনেই সূচক ৩০০ পয়েন্টেরও অধিক নেমে গেছে। সর্বশেষ বাজার কারসাজির প্রতিবাদে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদ মঙ্গলবার মতিঝিল এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকলে সরকার গণহারে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার শুরু করে। রিমান্ডে পিটুনির ভয়ে বিনিয়োগকারীরা শেষপর্যন্ত হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা যাক শেয়ারবাজার নিয়ে কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। আমি দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা করছি যে, শেষপর্যন্ত সূচক চার হাজারেরও নিচে নেমে আসবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত না হলেই আমি আনন্দিত হবো।
এদিকে কালোটাকার সংজ্ঞা নিয়েও এনবিআর বিপুল সংশয় তৈরি করে বসে আছে। তাদের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ বৈধ করা হলেও সেখানে নিম্নোক্ত দুটি ডেমোক্লিসের তরবারি বিনিয়োগকারীদের মাথার ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে :
১. ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হলে রাজস্ব বোর্ড টাকার উত্স নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না—বলার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে যে, অন্য কোনো সংস্থা থেকে সেই টাকার খোঁজ-খবর নেয়ার নামে হয়রানি করা হলে তার দায়িত্ব এনবিআর নেবে না। অর্থাত্ আওয়ামী লীগের লোকজন অবৈধ অর্থ শেয়ারবাজারে খাটালে অন্য সংস্থা যেমন—দুদক, এনএসআই, ডিজিএফআই অন্তত এই সরকারের শাসনামলে চোখ বন্ধ করেই রাখবে। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বীরা একই কর্ম করিলে তাহাদের খবর আছে। নখদন্তহীন দুদক সেক্ষেত্রে হিংস্র মানুষখেকো ব্যাঘ্রে পরিণত হবে। আইনের শাসনের কী চমত্কার নমুনা!
২. উপরোক্ত শর্তে কালোটাকা বিনিয়োগ করা যাবে; কিন্তু এই টাকা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত হলে এনবিআর তাদের ছাড় দেবে না। সাদা চোখে দেখলে আইনটি ভালো। সত্যিই তো, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে অর্জিত টাকাকে বৈধ করার সুযোগ কেন দেয়া হবে? কিন্তু সমস্যা হলো, টাকার গায়ে তো আর উত্স লেখা থাকবে না। সুতরাং, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখানেও আইনের প্রয়োগ লোক বুঝেই করা হবে। কালোটাকার মালিক কালো কোটধারী মুজিববাদী হলে কোনোই সমস্যা নেই, গায়ে বিএনপি কিংবা জামায়াতের গন্ধ থাকলে এনবিআর ও দুদকের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগটি সুকৌশলে রেখে দেয়া হলো। একেই বলে আওয়ামী লীগের বুদ্ধি।
অধিকাংশ পাঠকই জানেন, আমি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ছিলাম। তত্কালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমি প্রায়ই বলতাম, প্রশাসনে দুর্নীতি কমাতে হলে মন্ত্রী, সচিবদের স্বেচ্ছানুসারে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা (discretionary power) হ্রাস করা আবশ্যক। আর এই লক্ষ্য সাধন করতে হলে যথাসম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে বিধি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইনের ভাষার মারপ্যাঁচ কমানো গেলেই রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজশের (nexus) মাধ্যমে জনগণের অর্থ লুটপাটের সুযোগ সংকুচিত করা সম্ভব। সরকারি দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে সুশাসন বিষয়ক এই দর্শনের প্রতি আমার আগের আস্থা আরও দৃঢ় হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকার সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাই করছে মূলত discretionary power-এর ওপর ভর করে। বিনা টেন্ডারে কার্যাদেশ দেয়ার বিধান করে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে অগাধ লুটপাটের যে মহোত্সব ক্ষমতাসীনরা চালাচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে ওই discretionary power। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে নতুন বিধিমালাটি রাজস্ব বোর্ড প্রণয়ন করেছে, তারও ছত্রে ছত্রে discretionary power প্রয়োগের সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। যেসব রথী-মহারথী আগে সুশাসন নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বেড়াতেন, তাদের অধিকাংশই চিন্তা-চেতনায় কট্টর মুজিববাদী হওয়ায় হাওয়া বুঝে প্রকাশ্য দুর্নীতি দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদেরও বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের বায়বীয় ইসলামী সন্ত্রাস দমনের বিনিময়ে দুর্নীতিপরায়ণ সেক্যুলার শাসকশ্রেণীকে সুশাসনের বিষয়ে ছাড় দিতে তাদের এখন তেমন একটা আপত্তি নেই। পশ্চিমাদের সর্বত্র ইসলামী নবজাগরণের ভীতিটিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে সুশাসনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানকেও ‘ধর্মান্ধ’ বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে। যেন সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অংশ অভ্যুত্থান করলে কোনো সমস্যা নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের যে সাম্প্রতিক সমস্যা চলছে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তার পেছনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগের চাইতেও বেশি কাজ করেছে ড. ইউনূস ইস্যু। ব্যক্তিগত জিদ মেটাতে গিয়ে শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের খানিকটা সাময়িক বিরাগের কারণ হয়েছেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
দ্বিতীয় পর্ব আগামী বুধবার


মন্তব্য প্রতিবেদন : শেয়ারবাজারে তুঘলকি কারবার : দ্বিতীয় পর্ব

মাহমুদুর রহমান
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি বিষয়ক মন্তব্য প্রতিবেদনের শেষ পর্ব বড় বিষণ্ন মন নিয়েই লিখতে বসেছি। গত সোমবার এক তরুণ বিনিয়োগকারী তার ৭০ লাখ টাকার পুঁজি হারানোর মনোবেদনা সইতে না পেরে অসহায় স্ত্রী এবং চার বছরের একমাত্র আদরের শিশু কন্যাটিকে কঠিন জীবন সংগ্রামে এই সংসার সমুদ্রে নিঃসঙ্গ ফেলে রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেই ট্রাজেডির সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রতিবার ক্ষমতায় আসবে আর দেশের লাখ লাখ মানুষকে শেয়ারবাজার ব্যবসায় নানারূপে প্রলুব্ধ করে তাদের সর্বস্বান্ত করে যাবে এমন পরিস্থিতি মেনে নেয়া যায় না। এই লুটেরা শাসকশ্রেণীর প্রতি হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণা একত্রিত করে ধিক্কার জানাচ্ছি।
শেয়ারবাজার কারসাজির বিষয়ে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ওই বাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ সুবিধা এবং এদেশের ধনিক শ্রেণীর কুিসত বিলাস-ব্যসন নিয়েই লিখেছিলাম। আজ সরকার এবং সরকার সমর্থকদের দুই দফায় শেয়ারবাজারে তারল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ তহবিলের নিষম্ফলা ঘোষণা এবং ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেই দুই পর্বের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব।
গত ছয় মাস ধরে কৃত্রিম মূল্যসূচক অন্তত ৬০০০-এর কোটায় ধরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সরকার প্রধানত কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা এবং বাজারে তারল্য বৃদ্ধি করার বারংবার ঘোষণা দিয়ে একই কুমিরছানা বার বার দেখানোর ব্যর্থ কৌশল নিয়েছিল। প্রথমে ২০১১ সালের মার্চে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। তখন বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা), জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) যৌথ উদ্যোগে এই তহবিল গঠিত হবে। দেশের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় মেয়াদহীন (Open end) মিউচ্যুয়াল ফান্ড ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ সূচক ১০৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৫৩৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আশার বেলুনে হাওয়া দেয়ার জন্য আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নতুন এই তহবিল গঠনের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। সেই বহুল আলোচিত ফান্ডের বর্তমান অবস্থা সার্বিক শেয়ারবাজারের মতোই করুণ। অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে ইউনিট বিক্রি শুরু হলেও আমার পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এ পর্যন্ত মাত্র ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা গেছে।
বাংলাদেশ ফান্ড এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে অপর একটি মেয়াদহীন (Open end) ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিতে রীতিমত বাধ্য করা হয়। অক্টোবর ২২, ২০১১ তারিখে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএবি ৫ হাজার কোটি টাকার মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের ঘোষণা দিলেও ফান্ডে কোনো অর্থ জমা হওয়া তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত এ ফান্ডের আনুষ্ঠানিক আবেদন পর্যন্ত এসইসিতে জমা দেয়া হয়নি। কেবল সরকারপ্রধানকে খুশি করার জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুনরায় প্রতারণায় অংশ নিয়েছেন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) নামক সংগঠনের নেতারা। গত বছর নভেম্বর থেকে বিনিয়োগ শুরু করার কথা থাকলেও বিএবি’র নেতারা এখন পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিয়ে সেদিন বিএবি’র চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার জানিয়েছিলেন, প্রাথমিকভাবে তহবিলের আকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত এর আকার আরও বাড়বে। তার কথা শুনে তখন মনে হয়েছিল, টাকা ছাপানোর দায়িত্ব এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তে বোধহয় দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। যেন তারা ইচ্ছামত টাকা ছাপাবেন এবং শেয়ারবাজারে অকাতরে ঢালতে থাকবেন।
বিএবি চেয়ারম্যান ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দ্বিগুণ আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলেন, আমানতের ১০ শতাংশের আইনি সীমা মেনে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি আরও দাবি করেন, এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ শুরু করেছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারের এসব বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই সেদিনও পুঁজিবাজারে পূর্ববত্ প্রভাব পড়েছিল। দিনের প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই মূল্যসূচক ২৯৫ পয়েন্ট বেড়ে গিয়েছিল। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ধারা অবশ্য সারাদিন অব্যাহত না থাকলেও দিনশেষে সূচক ১০৯ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৫৪-তে দাঁড়িয়েছিল। সূচকের সঙ্গে তাল রেখে লেনদেনের গতিও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেদিন ঢাকার পুঁজিবাজারে ৬১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। বিএবি’র মুজিববাদী নেতৃবৃন্দও যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পথে বসাতে পুঁজিবাজারের চিহ্নিত সব মার্কেট ম্যানিপুলেটরদের মতোই আচরণ করেছেন, সেটি বিগত তিন মাসে প্রমাণিত হয়েছে। ‘স্টক মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ নামক সোনার হরিণ আজ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। বিএবি চেয়ারম্যান গত নভেম্বরে যখন শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটি টাকার গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছিলেন, তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হিসেবে তিনি বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না—এমন কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। অর্থাত্ জেনে-শুনেই বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ফান্ড গঠনের কাগুজে ঘোষণা দেয়ায় বিএবি আজ জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত। ফান্ডের আলোচনা সমাপ্ত করে এবার বাজার তারল্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি, বিএবি নেতৃবৃন্দের বায়বীয় ফান্ড গঠনের ঘোষণার সময় দেশের বিপুলসংখ্যক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। গত শুক্রবার রাতে চ্যানেল আই’র ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে সাবেক সচিব মো. আসাফ্উদ্দৌলাহ এসেছিলেন। বিদ্যমান তারল্য সঙ্কট নিয়ে আলোচনাকালে তিনি তার এক বন্ধুর ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা উত্তোলন নিয়ে হয়রানির গল্প শোনালেন। সেই ভদ্রলোককে তারই সঞ্চয়ী হিসাব থেকে নিজের টাকা পেতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অবশ্য ভদ্রলোককে চা-কফি খাইয়ে যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। সঙ্গত কারণেই সে রাতের আলোচক ব্যাংকের নামটি উল্লেখ করেননি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর শাশুড়ি জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে মাত্র চার লাখ টাকা উত্তোলন করতে গেলে তাকে একদিনে পুরো টাকা দেয়া যায়নি।
গত শনিবার ইংরেজি দৈনিক দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ ছিল, “18 banks face acute liquidity crisis, some banks are desperate in getting cash, driving call money rate high”। সংবাদটির প্রথম প্যারাটি উদ্ধৃত করলেই পাঠক সঙ্কটের ভয়াবহতা সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। দি ইনডিপেন্ডেন্ট বলছে, “Two state owned, 14 private and two foreign banks are in such an acute liquidity crisis that they are driven to borrow from the call money market almost every working day to meet their clients demand for cash.” (দুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ১৪টি বেসরকারি এবং দুটি বিদেশি ব্যাংক এতটাই তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে যে, গ্রাহকদের নগদ চাহিদা মেটাতে প্রায় প্রতিদিন তারা মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হচ্ছে।)
শুধু তা-ই নয়, একই সংবাদে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতবহির্ভূত অন্য আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও বিপজ্জনক। দি ইনডিপেন্ডেন্ট সরকার সমর্থক পত্রিকা হিসেবেই সাংবাদিক ও পাঠকমহলে সবিশেষ পরিচিত। এই পত্রিকার মালিক সালমান রহমান কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পারিবারিকভাবে অতি ঘনিষ্ঠ বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টাই নন, তিনি এদেশের শেয়ারবাজারেরও অন্যতম নিয়ন্ত্রক। এবারের শেয়ারবাজার কারসাজির জন্য প্রধানত সালমান রহমান, লোটাস কামাল এবং ফারুক খান গংকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই মহাবিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও উন্মাদ সরকার জনগণের অর্থ আরেকদফা লুটপাটের উদ্দেশ্যে বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষমতাসীন মহলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লুটেরারা নাকি মৌখিক আশ্বাসের ভিত্তিতে লাইসেন্স প্রদানের আগেই বিলাসবহুল সব অফিসও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। বিপর্যয়কর সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত একসময়ের ভারতসম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে বর্তমান সরকারের অপ্রকৃতিস্থ নীতিনির্ধারকদের তুলনা করলে সেই ভারতসম্রাটকে বোধহয় অপমানই করা হবে।
দেশি-বিদেশি এবং সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশের ৪৭টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ১৮টি অর্থাত্ ৩৮ শতাংশ ব্যাংকই তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। ফলে এফডিআর এবং কলমানি উভয় ক্ষেত্রেই সুদের হার বিগত তিন বছরে অনেক বেড়ে গেছে। নতুন আমানত সংগ্রহের জন্য দেউলিয়াত্বের প্রান্তসীমায় উপস্থিত ব্যাংকের আমানত সংগ্রহকারী কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দোরে দোরে ঘুরছেন। ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করা হচ্ছে। অর্থনীতির এই অবস্থায় কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যাদেরই কোনো সঞ্চয় রয়েছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই কারসাজির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারানোর ঝুঁকি নেয়ার পরিবর্তে উচ্চ সুদের নিরাপদ এফডিআরের দিকেই ঝুঁকছেন। এদিকে এসইসিও বিনিয়োগকারীদের প্রতি সতর্ক বার্তা প্রকাশের মাধ্যমে শেয়ারবাজার যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেই ঘোষণাও আনুষ্ঠানিকভাবেই দিয়েছে। বাজার সূচক যখন কারসাজির মাধ্যমে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠানো হয়েছিল, তখন কিন্তু এসইসি’র জনগণকে সতর্ক করার কথা স্মরণে আসেনি। লুটপাট সাঙ্গ হওয়ার পর তারা এখন ‘সাধু’ সাজার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
বাস্তবতা হলো, তারল্য সঙ্কটে জর্জরিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে বিনিয়োগের কোনো সামর্থ্যই নেই। এদিকে ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীদের একাংশ মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগের দিকেও ঝুঁকে পড়ছেন। আস্থার অভাব, সার্বিক তারল্য সঙ্কট এবং সামর্থ্যবান জনগণের এফডিআর ও বিদেশি মুদ্রায় বিনিয়োগের প্রবণতার মিলিত প্রভাবে পুঁজিবাজারে লেনদেন প্রত্যাশিতভাবেই ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস অর্থাত্ বৃহস্পতিবারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা জানুয়ারির সর্বনিম্ন লেনদেন। মাঝে-মধ্যে কৃত্রিম ঘোষণা দিয়ে লেনদেনের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা গত ছয় মাসের অধিককাল ধরে চালানো হলেও অবস্থার বিশেষ একটা হেরফের হচ্ছে না। গত বছর নভেম্বরের ৩ তারিখে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল মাত্র ১৮১ কোটি টাকা। সুতরাং কালো টাকা বিনিয়োগের পুরনো সুযোগের নতুন করে ঘোষণা এবং একাধিক ফান্ড গঠনের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে লেনদেন বাড়ানো যায়নি। পাঠককে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, বাজার কারসাজির মাধ্যমে ২০০৯-১০ সালে কৃত্রিমভাবে সূচকের রকেট গতিতে বৃদ্ধির সময় শেয়ারবাজারে দৈনিক লেনদেন অবিশ্বাস্য ৩ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল।
তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে নানারকম উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে জনগণকে ধাপ্পা দেয়ার পর সরকার শেষমেশ স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার কথিত বিনিয়োগ প্রস্তাব, প্রাইভেট পাবলিক পার্টিসিপেশন (পিপিপি)-এর মাধ্যমে বিশাল সব প্রকল্পের অর্থ জোগান, ইত্যাকার আজগুবি গল্প শোনানোর পর হতাশ ও মরিয়া প্রধানমন্ত্রী এখন বিশ্বব্যাংককে রীতিমত ধমকের সুরে বলছেন, দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহায়তাই নেব না। যেন বিশ্বব্যাংক টাকার থলি নিয়ে জোড়হস্তে আমাদের মহাপ্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমত সাধাসাধি করছে! ‘বাণীর রাজা’ খেতাবপ্রাপ্ত নতুন যোগাযোগমন্ত্রী জাতিকে শুনিয়েছেন, টাকা কোত্থেকে আসবে জিজ্ঞেস করবেন না, তবে পদ্মা সেতুর কাজ দেড় বছর পর অন্তত শুরু হবেই। ওবায়দুল কাদেরের ‘আশাবাদ’ বাস্তবে রূপ নিলেও মহাজোট সরকারের বর্তমান মেয়াদের তখন আর মাত্র তিন-চার মাস বাকি থাকবে। দেশের জনগণ আশা করি, এখনও ভুলে যাননি যে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে ভিন্ন দফতরে বদলিকৃত প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই দাবি করেছিলেন, এই সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কেবল শুরুই হবে না, সেটি সম্পন্নও হবে। খানিকটা প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে পদ্মা সেতুর বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রেক্ষিতে উল্লেখ করলাম।
গত জুনে ২০১১-১২ অর্থবছরের অবাস্তবায়নযোগ্য অতিকায় বাজেট উত্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কমপক্ষে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার কথা জোরগলায় বলেছিলেন। আমাদের মতো যত্সামান্য লেখাপড়া করা ব্যক্তিরা তো বটেই, এমনকি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি’র মতো আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই লক্ষ্যমাত্রাকে তখনই অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। আমাদের অর্থমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় সন্দেহপোষণকারীদের রাবিশ, স্টুপিড ইত্যাকার বিশেষণে ভূষিত করে প্রাণভরে গালাগাল করেছিলেন। অর্থবছরের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি থাকতে এবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই স্বীকার করা হয়েছে যে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কোনোক্রমেই ৬.৫ শতাংশের বেশি হবে না। ডিজিটাল সরকার শেয়ার কারসাজির মতো পরিসংখ্যান কারসাজিতেও সিদ্ধহস্ত বলে জনমনে বিশ্বাস রয়েছে। প্রবৃদ্ধিসহ নানারকম উন্নয়ন সূচকের যেসব দাবি তারা সচরাচর করেন, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও দেশ-বিদেশে যথেষ্ট সন্দেহও আছে। তারপরও এ বছর অন্তত প্রবৃদ্ধিকে ৭ শতাংশে টেনে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না।
যা-ই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সর্বশেষ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় জিডিপি ও বিনিয়োগ হ্রাসের সঙ্গে শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহও নিশ্চিতভাবেই কমবে। শেয়ারবাজারে গত ক’দিনের ধসের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে নতুন মুদ্রানীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির এই বিপর্যস্ত অবস্থার সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, অর্থ-উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরসহ বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদেরই নিতে হবে। সরকারের দুই-একটি একেবারে দালাল শ্রেণীর পত্রিকা ছাড়া দেশের সব পত্র-পত্রিকায় ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণের সংবাদ ও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন লেখা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের ঘুম ভাঙেনি। তারা তখন বিশাল সব প্রকল্প থেকে বিদেশি মুদ্রায় বিপুল অংকের কমিশন গ্রহণের সুখ-স্বপ্নে বিভোর থেকেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণপ্রবাহে আচমকা ভাটা পড়ায় সেই সুখ-স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। মহানগরীতে মনোরেলের আর খবর নেই, পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের নামে বিমানবন্দর নির্মাণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, পদ্মা সেতু শূন্যে ভাসমান। এ অবস্থায় বাগাড়ম্বর ছাড়া ক্ষমতাসীনদের করার আর আছেটা কী?
চারদলীয় জোট সরকারের একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় দুর্নীতির প্রবল প্রচারণা সত্ত্বেও ২০০৬ সালে সেই সরকার একটি স্থিতিশীল এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির জাতীয় অর্থনীতি রেখে দায়িত্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল। অর্থনীতির সব পর্যায়ে একপ্রকার শৃঙ্খলাও প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান টেন্ডারবিহীন প্রকল্পের ছদ্মাবরণে আজকের মতো সর্বব্যাপী দুর্নীতির দরজা খুলে দিতে কোনো অবস্থাতেই যে সম্মত হতেন না, সে ব্যাপারে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি শতভাগ নিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক সময়ই সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ উঠেছে। সেই তুলনায় শেখ হাসিনা হয়তো অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্তের নামে তিন বছরের শাসনামলে অর্থনীতিসহ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রায় সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব হঠকারী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, তার পরিণতিতে বাংলাদেশ প্রকৃতই আজ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গতি সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে; কিন্তু বোধবুদ্ধিহীন হঠকারিতা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জনগণের সম্পদ লুটপাট অন্তে যদি বাকি জীবন বিলাস-বৈভবে বিদেশের মাটিতে কাটাতে চান, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করা সম্ভব হলে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই বহু রথী-মহারথীকে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে আর খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি।
চারদিক থেকে গুজব শুনছি যে, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নাকি এরই মধ্যে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে অফুরন্ত টাকা-পয়সাসহ বিদেশে পাঠাতে শুরু করেছেন। সময়-সুযোগমত তারাও দেশ ছাড়বেন। আমাদের মতো সাধারণ ব্যক্তিরা যেভাবে এক-এগারো পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ সমর্থিত মহাশক্তিধর সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সরাসরি সমালোচনা দেশে থেকেই অব্যাহতভাবে করে গেছি, তারা আগামীতেও ইনশাআল্লাহ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে একই ভূমিকা নির্ভয়ে পালন করব। সে কারণেই আমাদের মধ্যে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারভীতি কাজ করে না। যারা তিন বছরে শেয়ারবাজার এবং সরকারের অন্যত্র অপকর্মের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়েছেন, তারাই যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামটি শুনলেই কারাগারে ফিরে যাওয়ার ভয়ে লুটেরা শাসকদের হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। মোদ্দা কথা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেখান থেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসম্ভব পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আন্তরিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী একটি গণমুখী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণের আর কোনো সুযোগ নেই। সেই সময় অবধি লিয়াকত আলীর মতো আর কোনো যুবককে যেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে না হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সেই প্রার্থনা করেই এই লেখার সমাপ্তি টানছি।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন