মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : আইএসআই নাটকের কলাকুশলী ও বাংলাদেশের রাজনীতি



মাহমুদুর রহমান
গত তিন সপ্তাহ ভারতের পানি আগ্রাসন নিয়ে লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার কারণে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লিখতে বেশ বিলম্ব হয়ে গেল। গণবিচ্ছিন্ন সরকারের বিপদ উদ্ধারের মহত্ দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতার মাস মার্চের জন্য যুত্সই এক হাওয়াই গল্প রচনা করে বাজারে ছেড়েছে সুশীল (?) দৈনিক প্রথম আলো। দুবাইয়ের ইংরেজি দৈনিক খালিজ টাইমসের মার্চের ৩ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদের সূত্র ধরে ৪ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় তথ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে একটি সিঙ্গেল কলাম খবর ছাপায়। সেই সংবাদে ১৯৯১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনী ফান্ডে পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সংবাদটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংস্থাটির সাবেক প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানীর পাকিস্তানের আদালতে প্রদত্ত এক জবানবন্দির সঙ্গে বিএনপিকে রুপি দেয়ার অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আইএসআই’র ভূমিকাকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত মামলায় জেনারেল আসাদ দুররানী সম্প্রতি সেখানকার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আর যায় কোথায়! অগ্রপশ্চাত্, সত্য-মিথ্যা বিবেচনা না করেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি বধের লক্ষ্যে দিল্লিতে বিশেষভাবে তৈরি অস্ত্রটি নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রথম আলোর সংবাদের দিল্লি কানেকশনের বিষয়টি খানিক পরে খোলাসা করছি। এদিকে মিথ্যা গল্পের বেলুন কয়েকদিনের মধ্যে ফুটো হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভোঁতা অস্ত্র দিয়েই তার স্বভাব অনুযায়ী যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। আজকের লেখার শুরুতে খালিজ টাইমস পত্রিকায় প্রকৃতপক্ষে কী ছাপা হয়েছিল, সেটি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নেয়া যাক।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, দুবাইভিত্তিক পত্রিকাটির মালিক বিতর্কিত গালাদারি ভ্রাতৃকুল (Galadari Brothers)। এদের সঙ্গে সত্তরের দশকে তত্কালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গভীর বন্ধুত্বের গল্প বহুল প্রচারিত ছিল। শোনা যায়, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী ভারতে গালাদারি ব্রাদার্সের সোনা চোরাচালানে সহায়তা করতেন। মহারাষ্ট্রের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী আব্দুর রহমান আনতুলে নাকি এসব ব্যবসার সহযোগী ছিলেন। যতদূর স্মরণে আছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলে ভারত সরকার বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ এনে গালাদারি ভাইদের ভারতে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল। ইন্টারনেট ঘাঁটলে পাঠকরা এ সংক্রান্ত অনেক তথ্যই পাবেন। খালিজ টাইমস’র চিফ রিপোর্টার এলেন জ্যাকব (Allen Jacob) সম্ভবত একজন ভারতীয় নাগরিক। ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজে লেখাপড়া করেছেন। খালিজ টাইমস’র প্রধান সম্পাদক (Editor-in-Chief) এবং উপদেষ্টা সম্পাদকদ্বয় (Editorial Advisor) যথাক্রমে রাহুল শর্মা (Rahul Sharma) ও বিক্রম বোহরা (Vikram Bohra)। অর্থাত্ মধ্যপ্রাচ্যের এই পত্রিকাটির সঙ্গে রহস্যময় ভারতীয় সংযোগ রয়েছে। এহেন খালিজ টাইমস মার্চের ৩ তারিখে জেনারেল আসাদ দুররানীর পাকিস্তানের আদালতে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে যে সংবাদ প্রকাশ করেছে, তার একটি স্থানে খানিকটা আকস্মিকভাবেই লেখা হয়েছে,
“Another Rs. 50 million was allegedly paid to Bangladesh’s Khaleda Zia to help her in polls against Hasina Wajid’s Awami league generally perceived by Pakistan’s Security establishment as pro-India.”
(আরও পাঁচ কোটি রুপি বাংলাদেশের খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে সাহায্য করার জন্য প্রদান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যাকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ ভারতপন্থী রূপে বিবেচনা করে।)
একটু লক্ষ্য করলেই সংবাদটি প্রণয়নে চাতুর্য দৃষ্টিগোচর হবে। সংবাদে কোথাও সরাসরি বলা হয়নি যে, কথাগুলো জেনারেল দুররানী আদালতে তার এফিডেভিটে বলেছেন। কোনোরকম সূত্র উল্লেখ ছাড়াই পত্রিকাটি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কেবল রহস্যময় অভিযোগ উত্থাপন করে দায়িত্ব শেষ করেছে। মূল সংবাদের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক এবং উদ্দেশ্যমূলক এই খবর মধ্যপ্রাচ্যের একটি সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া মাত্র দিল্লির উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে। বাকি কাজটি সেখানকার জনৈক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী করে দিয়েছেন। পাঁচ কোটিকে পঞ্চাশ কোটি বানিয়ে বানোয়াট সংবাদটি দি ডেইলি মেইলের দিল্লিস্থ অনলাইন ভার্সন এবং ইন্ডিয়া টুডেকে তিনি গিলিয়েছেন। আর বাংলাদেশে প্রথম আলো’র ভূমিকার কথা আগেই বলেছি। দিল্লির এই চৌধুরী মহোদয় সম্পর্কে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী দিল্লিতে বাংলাদেশের মার্কিন ও ভারতপন্থী সুশীল (?) পত্রিকা প্রথম আলো’র প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এসব খবর গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিএনপি তার প্রতিবাদপত্রে দীপাঞ্জন চৌধুরীর প্রথম আলো সংযোগের কথা উল্লেখও করেছে। খালিজ টাইমস, প্রথম আলো, দি ডেইলি মেইল, ইন্ডিয়া টুডে এবং দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর নেকসাসের (nexus) স্বরূপ আশা করি, বাংলাদেশের জনগণের কাছে এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র বাসসও (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) পিছিয়ে থাকেনি। তারাও উপর মহলের নির্দেশানুযায়ী পাঁচ কোটিকে পঞ্চাশ কোটি বানানোসহ দিল্লির চৌধুরীর গাঁজাখুরি গল্প সোত্সাহে প্রচার করে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনসাপেক্ষে বেশ শক্ত একটা মামলার ঝুঁকি নিয়েছে।
পাঠক ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে, বিএনপির পক্ষ থেকে খালিজ টাইমস এবং প্রথম আলোতে প্রতিবাদ পাঠানোর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া গ্রুপ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। দি ডেইলি স্টার কোনো রাখঢাক না করেই ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের জন্য প্রথম পাতায় দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছে Daily Star’s stand corrected (ডেইলি স্টারের অবস্থান সংশোধন করা হলো)। প্রথম আলো তার অপকর্মের জন্য এখনও সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা না করলেও নানা রকম দুর্বল যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে এবং বিএনপি’র সংবাদ কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ার মতো গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়ে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০০৭ সালে আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে আপত্তিকর কার্টুন ও ব্যঙ্গাত্মক ছড়া ছাপিয়ে বিপদে পড়ার পর পুনর্বার প্রথম আলো’র সাংবাদিকতার নিগূঢ় উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সেবার সম্পাদক মতিউর রহমান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব উবায়দুল হকের হাঁটু স্পর্শ করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রথম আলোতে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কার্টুনিস্টকে জেলে পাঠিয়ে নিজে রক্ষা পেয়েছিলেন। এখানেই আমার মতো ‘চান্স’ সম্পাদকের সঙ্গে তার মতো পেশাদার সম্পাদকের নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডের পার্থক্য।
আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সব দায় আপন কাঁধে নিয়ে আমি সহকর্মীদের অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলাম। সংবাদের শিরোনামটাও যে আমার দেয়া, সেটাও নিসংকোচে কবুল করেছিলাম। স্মরণে আছে বিচারপতি এমএ মতিন যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সবার দায়িত্ব আপনি একা কেন নিচ্ছেন? প্রথম আলো’র পেশাদার সম্পাদক মতিউর রহমানের মতো বুদ্ধিমান হলে আমিও হয়তো সহকর্মী অলিউল্লাহ নোমানের ওপর সংবাদের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে লর্ডশিপদের হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে অবধারিত সাজা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম। অন্যদের মতো করেই হয়তো ভাবতাম, আত্মমর্যাদা চুলোয় যাক, আগে জেল থেকে তো বাঁচি! এ রকম আচরণ করলে অবশ্য ভবিষ্যতে আর কোনোদিন আমার সহকর্মীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলতাম। তবে মিডিয়া জগতের সব নামি-দামি ব্যক্তির মানসম্মান জ্ঞান সচরাচর আমার সমতুল্য আমজনতার মতো এতটা ঠুনকো হয় না। বিপদে পড়লেই মাফ চাইতে তাদের একেবারেই বাধে না। এক এগারো’র সরকারের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার নামে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানোর পক্ষে ওকালতি করতে বাংলাদেশের সব সুশীল (?) সম্পাদকের বাধেনি। এখন একই ব্যক্তিরা আবার দেশবাসীকে অহরহ গণতন্ত্রের সবক দিয়ে যাচ্ছেন!
যাই হোক, যে কার্টুনিস্ট আমাদের মহানবীকে নিয়ে আপত্তিকর কার্টুন এঁকেছিল তার নাম আরিফুর রহমান। বর্তমানে সে নরওয়েতে প্রবাসী জীবনযাপন করছে। সম্প্রতি অন লাইন মিডিয়া বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম তার একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেছে। আরিফুর রহমান সেই সাক্ষাত্কারে প্রথম আলো পত্রিকা এবং সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, ‘আমার কথা হচ্ছে, সম্পাদকের হাত দিয়ে অনুমতি পাওয়ার পরই তো কার্টুনটি ছাপা হয়েছে। এখানে দায়ভার যে শুধু আমার, তা নয়। আমি যা ইচ্ছে তা লিখতে ও আঁকতে পারি না। পত্রিকার সম্পাদক ছাপানোর উপযোগী মনে করেছেন বিধায় তা ছাপিয়েছেন। আমি এক নগণ্য কার্টুনিস্ট। আমি জেলে যাওয়ার পরদিন প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা আমাকে চেনে না। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রথম আলো আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নিজেদের গা বাঁচিয়ে আমাকে জেলে ঢুকিয়েছে।’
পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি পাঠকরা যাতে বুঝতে পারেন, সে কারণেই কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের সাক্ষাত্কারের অংশবিশেষ আইএসআই সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত না হওয়া সত্ত্বেও উদ্ধৃত করলাম। অবশ্য, আইএসআই সম্পর্কিত সর্বৈব মিথ্যা সংবাদ ছাপানোর জন্য পত্রিকাটির কারও জেলে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ বিএনপি বর্তমানে ক্ষমতায় নেই। আর ক্ষমতায় থাকলেও প্রথম আলো’র কোনো সমস্যা হতো না বলেই আমি মনে করি। বিএনপি দলটিকে যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, তাতে আমার ধারণা আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতেই বরঞ্চ প্রথম আলো সমর্থক লবি অনেক বেশি শক্তিশালী। কয়েকটা দিন প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় বিএনপি ও তার প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের খবর ভালো করে ছাপা হলেই সবকিছু ঠিকঠাক মতো ম্যানেজ হয়ে যাবে। চাই কি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান পুরস্কৃতও হতে পারেন। বিএনপি’র গত মেয়াদেও আওয়ামীপন্থী সম্পাদকদের নানারকম ন্যায্য-অন্যায্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ মার্কিন ও ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। এতসব বড় মুরুব্বি পাশে থাকলে বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। মতিউর রহমান এবং মাহমুদুর রহমানের ক্ষমতার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এদিকে সরকারের সোয়া তিন বছর মেয়াদ পার হয়ে গেলেও তাদের নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতি পূরণে পর্বতসমান ব্যর্থতার ফলে ক্ষুব্ধ জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য শেখ হাসিনার যে নতুন ইস্যুর প্রয়োজন ছিল, সেটি দুবাই-ঢাকা-দিল্লির দক্ষ কলাকুশলীরা মিলে তাকে তৈরি করে দিয়েছে। এদেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অবিরত মিথ্যাচার করে গেলেও দেশের কোনো আদালতেই তার মানহানির মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কাও নেই। কাজেই আইএসআই’র রুপি দেয়ার গল্প সত্য না মিথ্যা, সেটা তার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেখার বিষয় হলো, খালিজ টাইমস এবং প্রথম আলো তাদের গোয়েবলসীয় কারখানায় যে খবরটি উত্পাদন করেছে, সেই খবর ব্যবহার করে ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতখানি ফায়দা তুলতে পারেন। জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নানাবিধ বিচার ও মামলার অতি ব্যবহারে এবং যুদ্ধাপরাধের চর্বিত চর্বণে ভোটারদের বিরক্তির পারদ যে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে, সেটা সম্ভবত নীতিনির্ধারকরা ধারণা করতে পারছেন। অতএব, নতুন ইস্যুর জন্য হন্যে হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের কাছে আইএসআই সংশ্লিষ্ট কল্প-কাহিনী ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো করেই আবির্ভূত হয়েছে।
মহাজোটের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, তারা অবাধ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সে কারণেই প্রশাসনকে ব্যবহার করে সরকার সর্বপ্রকার নিপীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ হীনবল করতে চাচ্ছে, যাতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে কোনো কার্যকর আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে না পারে। মার্চের ১২ তারিখে বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচালে সরকারের তিনদিনব্যাপী অঘোষিত কারফিউ, স্বাধীনতা দিবসে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে সাভার স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা প্রদান, ২৮ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়ার ওপর লিখিত বইয়ের প্রকাশনা উত্সব গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপে বন্ধ করা, ইত্যাদি ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের যুধ্যমান মনোভাবেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। জনসমর্থনের দিক দিয়ে পাল্লা অনেক ভারি হলেও সাংগঠনিকভাবে এখনও দুর্বল বিএনপি এসব আক্রমণের যুত্সই কোনো জবাব দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা তার দু’দফায় বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা পালনকালে অতি ব্যবহারে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতালকে ভোঁতা করে দিয়ে গেছেন। তাছাড়া হরতাল পালনকালে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে, সেই সক্ষমতা বিএনপির কোনোকালেই ছিল না। দলের এই সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে সঙ্গত কারণেই হরতাল কর্মসূচির প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। ১২ই মার্চের মহাসমাবেশে কর্মসূচির নামে ১৭ দিন পরে ২৯ মার্চের হরতালের ঘোষণা দিয়ে এবং প্রথম সুযোগেই ঘোষিত হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপি হরতাল পালনে তাদের অক্ষমতা আবারও প্রকাশ করেছে।
স্বাধীনতা দিবসে বেগম খালেদা জিয়ার চলাচলে বাধা প্রদান এবং জেনারেল জিয়ার ওপর লিখিত বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ করার প্রতিবাদেও দল থেকে অতি দুর্বল কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। পুলিশের হাতে নিগৃহীত এবং জেলে যাওয়ার ভয়ে সর্বদা আতঙ্কিত নেতাকর্মী দিয়ে একদলীয় বাকশালী আদর্শে বিশ্বাসী মহাজোটের মতো চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী একটি সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি’র লড়াই করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আদায় করার সক্ষমতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের পাল্লাও এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার দিকেই অধিক মাত্রায় ঝুঁকে আছে বলেই মনে হচ্ছে। এই সরকারকে রক্ষায় দিল্লি কতদূর যেতে পারে, সেটা উপলব্ধির জন্য এক আইএসআই নাটক পর্যালোচনাই যথেষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব সুশীলদের সঙ্গে নিয়ে এক এগারোতে যে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, তার থেকে নীতিগতভাবে সে সব রাষ্ট্র খুব একটা সরে গেছে এমনটি মনে করার সময় এখনও আসেনি।
পশ্চিমাদের অতি ঘনিষ্ঠ প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিরোধের সৃষ্টি না হলে আমরা হয়তো আজও বারিধারার গ্রিন জোনের সব বিদেশি বাসিন্দার সর্বক্ষণ সরকারের গুণকীর্তনে মুখর থাকতেই দেখতাম। এই সরকারের সোয়া তিন বছরে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, গণমাধ্যম এবং বিরোধী মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে, দেশের অর্থনীতি রসাতলে গেছে, সর্বব্যাপী দুর্নীতি পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়েছে, প্রশাসনে দলীয়করণের বিশ্ব রেকর্ড গড়া হয়েছে এবং সুশাসন নির্বাসনে গেছে। ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণী যে পরিমাণ অপকর্ম এ পর্যন্ত করেছে, সে তুলনায় তথাকথিত দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে তাদের সামান্যই সমালোচনা শুনতে হয়েছে। সুতরাং, ২০০৭-এর মতো কোনো একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিএনপি বিরত থাকলেও নির্বাচন প্রতিরোধে পশ্চিমাদের আগের মতো অতি উত্সাহী ভূমিকায় দেখা নাও যেতে পারে। সেই সময় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পটভূমি সৃষ্টির লক্ষ্যে একদিকে রাজপথে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি বিনা বাধায় দিনের পর দিন চালাতে দেয়া হয়েছে এবং অপরদিকে মিডিয়া ও ব্যবসায়ী সংগঠনকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দিল্লির ইঙ্গিতে দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে, তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত আইএসআই নাটক। এখান থেকেই ধারণা করা যেতে পারে, নির্বাচন এগিয়ে এলে এসব পত্রপত্রিকা বিএনপি’র বিরুদ্ধে কতটা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই সম্পর্কেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির প্রথম দাবি উত্থাপিত হয়েছিল এফবিসিসিআই থেকেই। আগামী নির্বাচনের সময় আগের মতো রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে একই এফবিসিসিআই সম্পূর্ণ উল্টো সুরে গান গাইবে বলেই আমার ধারণা। গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে একতরফা নির্বাচনের পক্ষেই সংগঠনটির কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক বর্তমান সভাপতি একে আজাদ কিংবা তারই মতো অন্য কোনো ব্যবসায়ী বিবৃতি দেবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর টপ ব্রাসের (Top Brass) পক্ষপাতমূলক ভূমিকার ধারাবাহিকতাতেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আইএসপিআর কর্তৃক চরিত্রহনন এবং মাত্র কিছুদিন আগের কথিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর লেখা বইয়ের প্রকাশনা উত্সব বন্ধ করার পেছনেও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সরাসরি সংযোগের দুর্ভাগ্যজনক খবর প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে সম্পৃক্ত করা না গেলে বাংলাদেশে অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনোরকম সম্ভাবনা আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। বিএনপি নেতৃত্বের যে অংশ রাজপথে আন্দোলন ব্যতিরেকে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রয়েছেন, তাদের প্রতি অনুকম্পা জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। আইএসআই নাটককে একটি বিপদ সংকেত বিবেচনা করে দ্রুততার সঙ্গে সর্বাত্মক আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের কোনো বিকল্প বিএনপি’র সামনে খোলা নেই। একমাত্র জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছেই পূর্ব-পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদীরা পরাজিত হতে পারে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন