মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ



মাহমুদুর রহমান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দীর্ঘদিন মেঠো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে এবং একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন মাঠকর্মী হিসেবে প্রবীণ বয়সে এমপি হওয়াটাই তার জন্য পরম গৌরবের বিষয় ছিল। কিন্তু বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকায় তিনি প্রথম সুযোগেই কেবল ফুল মন্ত্রী নন, মহাশক্তিধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও দখল করতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি-নৈতিকতা শিকেয় তুলে অতিমাত্রায় দল এবং দলীয় প্রধানের প্রতি অনুগত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
সাহারা খাতুন তার বিভিন্ন বক্তব্যে প্রসঙ্গ থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনে এনে তার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের বয়ান দেন, সেটার কারণও জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতে আমজনতার হয়তো তেমন কোনো সমস্যাও হতো না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হাতে পেয়ে তিনি প্রজাতন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে যে নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং দলীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন, সেখানেই যত সমস্যা। গত সাড়ে তিন বছরে তার কণ্ঠে ‘আমার পুলিশ’ কথাটি যে কতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার হিসাব রাখাই কঠিন।
পুলিশ যে প্রজাতন্ত্রের, সাহারা খাতুনের নয়—এটা বোঝানোর মতো কেউ সম্ভবত তার পাশে নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, তদীয় কন্যা শেখ হাসিনা এবং সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনীতিবিদ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো করে রাষ্ট্রকে একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি বিবেচনা করেননি। একজন মন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয়কে পৈতৃক অথবা দলীয় জমিদারি ভাবতে শুরু করেন, তখনই সুশাসনের বারোটা বেজে যায়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আইন ও মানবাধিকারের প্রতি যে চূড়ান্ত অবজ্ঞা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার প্রধান দায়-দায়িত্ব তাই বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই বহন করতে হবে।
সাহারা খাতুনের পুলিশ গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যে অমার্জনীয় কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্তসার এবার প্রস্তুত করা যাক। গত মাসের ২৬ তারিখে রোকেয়া সরণিতে পলিটেকনিকের ছাত্রীদের অবরোধের ছবি তোলার সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিককে বেধড়ক লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পেটানোর সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার চিত্কার করে বলেছে, পেটা সাংবাদিকদের, ওরাই যত নষ্টের গোড়া, এদেশে সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। পুলিশ কর্মকর্তার দাবির পেছনে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, ঘরে ঢুকে সাংবাদিক খুন করলে যে দেশে কিছু হয় না, সেখানে যত্সামান্য পিটুনি তো নস্যি! একই মাসের ২৯ তারিখে পুরনো ঢাকার আদালতপাড়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে পুলিশ ক্লাবে ধরে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে আওয়ামী-বাকশালী পুলিশ। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন তিন সাংবাদিক, দুই আইনজীবীসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারী জনতা। আহত তিন সাংবাদিক যথাক্রমে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে কর্মরত আছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য নির্যাতিত তরুণীকেই উল্টো কোতোয়ালি থানায় ধরে নিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অতি ঘনিষ্ঠ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী খবর পেয়ে থানায় ছুটে না গেলে তরুণীটির কপালে আরও দুঃখ ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের সামনেই কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনের উদ্ধত ব্যবহারের খানিকটা নমুনা আমরা টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছি। কোতোয়ালি থানার এই ওসির সঙ্গে আমার রিমান্ড চলাকালীন সাক্ষাত্ হয়েছিল।
‘পবিত্র ভূমি’ গোপালগঞ্জের অধিবাসী পুলিশ কর্মকর্তাটি আমাকে সারা রাত থানা গারদে জনা পনেরো মাদকাসক্ত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেই অসহনীয় পরিবেশে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালে এক গ্লাস পানি পানেরও প্রবৃত্তি হয়নি। মিনিট তিরিশের কথাবার্তায় আমার কাছে ওসি সালাহউদ্দিনকে পুলিশের পোশাকে ছাত্রলীগের একজন পাণ্ডার মতোই লেগেছিল। সে বার বার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিল, গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার অপরাধে বিএনপি জমানায় তার ভালো কোনো জায়গায় পোস্টিং হয়নি। ভাবখানা ছিল আমিই যেন সেজন্য দায়ী।
ওসি সালাহউদ্দিন ছাড়াও ওই এলাকার বর্তমান ডিসি হারুন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ডিসি হারুন সংসদ এলাকায় বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেশব্যাপী বিশেষ ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছে। তার সেই ‘বীরত্বপূর্ণ’ কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবেই সাহারা খাতুন হারুন-উর রশীদকে তেজগাঁও জোনের এডিসি থেকে পদোন্নতি দিয়ে লালবাগ জোনের ডিসি বানিয়েছেন। হারুন-উর রশীদ এর আগে লালবাগ জোনে এসির দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১০ সালে লালবাগ জোনে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ হয়েছিল। ছাত্রলীগ সংযোগের জোরে সে যাত্রায় তার চাকরি রক্ষা পেয়েছিল। হারুন-সালাহউদ্দিনের যৌথ তাণ্ডবে লালবাগ-কোতোয়ালি এলাকার জনগণের কী হাল হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যা-ই হোক, অনেক টালবাহানা শেষে ৩০ তারিখ রাত দুটায় নির্যাতিত তরুণীর মামলা কোতোয়ালি থানা গ্রহণ করেছে। গত মাসের ৩০ তারিখে গাজীপুরের পুলিশ মামুন ভূঁইয়া নামে একজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে খুনিদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে অসহায় মামুনকে হত্যা করে। হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ নিহতের হাতকড়া খুলে অকুস্থলে ফেলে রাখে। পুলিশ হেফাজতে আসামি খুনের এ এক লোমহর্ষক কলঙ্কজনক ঘটনা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একই সপ্তাহের অন্যান্য খবর পর্যালোচনা করলে থানা হেফাজতে অভিযুক্তদের পুলিশি নির্যাতনের আরও অনেক নৃশংস ঘটনা চোখে পড়বে।
নজিরবিহীন পুলিশি নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি সত্ত্বেও সাহারা খাতুন অব্যাহতভাবে দাবি করে চলেছেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি দশ বছরের মধ্যে সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি আরও দাবি করছেন, পুলিশও নাকি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই দাবির পেছনে তার যুক্তি হলো, বিরোধী দলে থাকাকালীন রাস্তায় আন্দোলনের সময় পুলিশ পিটিয়ে তার একটি পা ভেঙে দিয়েছিল। এখন সেই পুলিশ জাতীয় সংসদের সামনে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা এবং মাথা ভেঙে দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সেটাকে যথেষ্ট বিবেচনা করছেন না। বরং যে পুলিশ কর্মকর্তা এই গর্হিত কাজটি দিনদুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে করেছিল, তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন দিনবদলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি যেদিন তার প্রিয় পুলিশের সাফাই গাইছিলেন, তার আগের দিনেই আদালত চত্বরে এক বিচারপ্রার্থী তরুণী পুলিশের শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও অর্ধডজন নারী বর্তমান মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করলেও তাদের কাছ থেকে ধর্ষকামী পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণের কোনো নিন্দা এ যাবত জাতির শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও দুটি তাকলাগানো মন্তব্য করেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পর তিনি দাবি করছেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কথা তিনি বলেননি। তিনি শুধু পুলিশকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি শুনে সেই ‘তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল’ বিতর্কের কথা মনে পড়ে গেল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রতিপালিত না হওয়ার অপরাধে পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয়ে অবশ্য সাহারা খাতুন মুখ খোলেননি। একই অনুষ্ঠানে চমত্কৃত হওয়ার মতো তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার কথা বলেননি। মিডিয়াই নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহা শক্তিধরের কথা বিকৃত করে ছেপেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের পর্বতসম ব্যর্থতা ঢাকতে মিডিয়াকে দোষারোপ করা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের রীতিমত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী-বিএনপি-সুশীল-বাম — সবপন্থী পত্রিকাতেই সাহারা খাতুন এবং শামসুল হক টুকুর বক্তব্য অভিন্নভাবে ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি সত্য হলে মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের তাবত গণমাধ্যম একসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পেছনে লেগেছে। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুযায়ী উভয়েরই এবার পদত্যাগ অথবা পদচ্যুতির সময় এসেছে। পদত্যাগের সংস্কৃতি আমাদের দেশে তেমন একটা নেই। বিশেষ করে, কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি উজিরে খামাখার চেয়ারে বসে কিছুকাল নিশ্চুপ থেকে এখন আবার যেভাবে প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে এসে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে জনগণ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় না করা পর্যন্ত মহাজোটের কেউ আর মন্ত্রিত্বের চেয়ার ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেও যেহেতু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের মতো এতগুলো মেরুদণ্ডহীন চাটুকার একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও কঠিন হবে, কাজেই পদচ্যুতিরও প্রশ্ন ওঠে না। অতএব পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সার্টিফিকেটের পর বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে অপেক্ষমাণ, সে আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে অন্য ধরনের একটি তথ্য দিয়ে আজকের মতো মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করব। বাংলাদেশ পুলিশের PRP (Police Reform Programme) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পটি ইউএনডিপি (UNDP) এবং ডিএফআইডি (DFID)’র যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউএনডিপি প্রণীত প্রকল্পটির একটি সারসংক্ষেপ (Summary) পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই নথিতে Outcome এবং Output নামে দু’টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। Outcome-এ বলা হয়েছে, “The human rights of children, women and vulnerable groups are progressively fulfilled within the foundations of strengthened democratic governance.” অর্থাত্ শিশু, নারী এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সংরক্ষিত হবে যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর Output অংশে বলা হয়েছে, “Strengthened capacity of the justice system to ensure democratic governance, protect human rights and human security, improve participation in governance, and access to public services among poor communities.” অর্থাত্ গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহজ প্রবেশাধিকার। পিআরপি প্রকল্পের প্রাক্কলিত বাজেটের পরিমাণও বিশাল। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল, এই পাঁচ বছরে ২৯.০১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (২৪৫ কোটি টাকা) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ইউএনডিপি ৮ মিলিয়ন ডলার এবং ডিএফআইডি ১৬.৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (PRP-Phase I) শুরু হয় ২০০৫ সালে এবং বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের (PRP-Phase II) বাস্তবায়ন চলছে। প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকলে সেটি পরিশোধের দায় বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের। কাজেই জনগণের অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর যদি পুলিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর বর্বর আচরণে অভ্যস্ত হয় এবং মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে, তাহলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকই এই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে এ-জাতীয় প্রশিক্ষণে যে আসলে কোনো কাজ হয় না, সেটা আমরা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখেছি। বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকল্প নিয়ে বিচারপতিদের বিদেশ যাত্রার সুযোগ বেড়েছে বটে; কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের আদালতগুলোতে সাধারণ নাগরিকের বিচার পাওয়ার সুযোগও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রণীত পিআরপি-তেও Justice system-এর দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন ও উচ্চ উভয় আদালতেই দলীয়করণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বিচারপতিগণ আগের মতো সাহসিকতার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারছেন না। গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে কোনো রাখঢাক না রেখেই মন্তব্য করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত, আদালতে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আদালত ও পুলিশ উভয়ই তীব্র বেগে রসাতলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত এ-জাতীয় যাবতীয় প্রকল্পের মূল্যায়ন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার সরকার মূলত পুলিশ এবং আদালতের ওপর ভর করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট দেয়ার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে মহাজোট সরকার। এরশাদ পতনের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। একটি নির্যাতক পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা তাদের মসনদে টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। আড়িয়ল বিল এবং বিল কপালিয়ার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখেও তাদের সংবিত্ ফিরছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দেশেই নির্যাতনকারীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদের দুঃখজনক পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক’দিন আগে গণহত্যার অভিযোগে মিসরের এক সময়ের লৌহমানব হোসনি মোবারকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ছোটখাটো লৌহমানবীরা সেখান থেকে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
বি. দ্র. : গত সপ্তাহে ওসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এই সোমবার মামলা দায়ের করেছেন নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী। বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মারপিট, জখম ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন