মাহমুদুর রহমান
দ্বিতীয় পর্ব
বাংলাদেশে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী ভারত থেকে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে সারি নদী একটি। এই নদীটি মাইনথ্রু (Mainthru) নামে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে জন্মলাভ করেছে। মাইনথ্রু সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নাম নিয়েছে এবং ছাতকের কাছে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন (Goyain) নদীর পানিও সারির সঙ্গে মিশেছে। পাহাড়ি নদী সারি-গোয়াইন মেঘালয় থেকে প্রচুর পাথর, মোটা বালু এবং পলিমাটি বহন করে নিয়ে আসে। নদীতীরবর্তী বিপুলসংখ্যক মানুষ এই নদী থেকে পাথর সংগ্রহ এবং পরিবহনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সুতরাং, নদীটির বেঁচে থাকা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের অন্তত কিছু মানুষের সংসার খরচ মেটানোর জন্যও আবশ্যক।
এই মাসেই ভারত সরকার মাইনথ্রু নদীতে ৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে সেখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। এই বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আমার জানা মতে, আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভারত সরকার বাংলাদেশের অনুমতি নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি। সিলেট অঞ্চলের জনগণ ‘সারি নদী বাঁচাও’ আন্দোলন গড়ে তুললেও ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো রকম প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এই বাঁধ নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ নম্বর ধারা উল্লেখ করা আবশ্যক। সেই ধারায় বলা হয়েছে, ‘Guided by the principles of equity, fairness and no harm to either party, both the governments agree to conclude water sharing Treaties/Agreements with regard to other common rivers.’ অর্থাত্, সমঅধিকার, ন্যায্যতা এবং কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার নীতি অনুসরণ করে, উভয় পক্ষ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করছে। সুতরাং, সারি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এই নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করে গঙ্গা-চুক্তির ৯ নম্বর ধারা সুস্পষ্টভাবে ভঙ্গ করেছে। এই চুক্তিবহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকার সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ ও জনগণের জীবনধারণকে আজ যে হুমকির মুখে ফেলেছে, তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারী ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারও সমভাবে দায়ী। তারা দেশের স্বার্থ বিষয়ে নীরব থেকে ভারতকে বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা চুক্তি ভঙ্গে উত্সাহিত করেছে।
এবার টিপাইমুখ প্রসঙ্গে আসি। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাই উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদী। ভারত সেই বরাক উপত্যকার টিপাইমুখ নামক স্থানে ৩৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৬৩ মিটার উচ্চতার এক অতিকায় বাঁধ (mega-dam) নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী যে জায়গাটিকে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছে, সেটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯৮৮ সালেও এই অঞ্চলে ৬.৬ রিখটার মাত্রার একটি তীব্র ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রয়েছে যে, মণিপুর অঞ্চলে ৮ কিংবা অধিক রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়া সম্ভব। এমন এক স্থানে অতিকায় বাঁধ নির্মাণ সেই ভূমিকম্প প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ৮ রিখটার স্কেলের ঊর্ধ্বমাত্রার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় টিপাইমুখ বাঁধ ভাঙলে মণিপুর ও ঘন বসতিপূর্ণ সিলেট অঞ্চলে যে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হবে, তা সুনামি কিংবা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতিকেও হার মানাবে। অর্থাত্ এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ভয়াবহ এক টাইম বোমার সঙ্গে বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই মণিপুরের স্থানীয় অধিবাসীরাও বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। অবশ্য, এসব আন্দোলনকে দিল্লির শাসকশ্রেণী বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে চলেছে। তাছাড়া সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বিদ্রোহী মণিপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদতলে পিষ্ট একটি রাজ্য মাত্র। এ তো গেল ভূমিকম্পজনিত সর্বনাশের আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সঙ্গত কারণেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়ে গেলে সেখানে কেবল জলবিদ্যুত্ উত্পাদনই করা হবে না, ভবিষ্যতে সময়-সুযোগমত পানি প্রত্যাহার করে পদ্মা অববাহিকার মতো মেঘনা অববাহিকাকেও ধ্বংস করা হবে। সে কারণেই ক্ষমতাসীন মহাজোট এবং ভারত থেকে নিয়মিত মাসোহারাপ্রাপ্ত তথাকথিত সুশীল (?) গোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। জনমতের এই বিরূপতা উপলব্ধি করে বহুরূপী রাজনীতিক, স্বৈরাচারী এরশাদ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের লোক-দেখানো নাটক মঞ্চস্থ করতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রবিরোধী চরিত্র অনুযায়ী আমাদের মাতৃভূমি ধ্বংসকারী যাবতীয় ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেখেও সর্বপ্রকারে লজ্জাহীন দালালি অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতার গত তিন বছরের বক্তব্য এবার খানিকটা ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে।
একসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে নাকি বাংলাদেশের লাভ হবে। আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী, তিস্তাপাড়ের রমেশচন্দ্র সেন বলেছেন, আগে বাঁধ নির্মিত হোক, তারপর বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তখন দেখা হবে। পানি প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তো আর এক কাঠি সরেস। তিনি ভারতের অবস্থান সমর্থন করে বাণী দিয়েছেন, ভারত তাদের নদীতে বাঁধ দিলে আমাদের বলার কী আছে? অর্থাত্ আন্তর্জাতিক নদীর (International/Transboundary river) সংজ্ঞা সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের এই অখ্যাত, দেশবিরোধী আওয়ামী রাজনীতিবিদের কোনো ধারণাই নেই। তবু তিনি শেখ হাসিনার প্রিয় পানি প্রতিমন্ত্রী। এদের আচরণদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগ করলেই বোধহয় ভারতের দালালে রূপান্তরিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দিল্লির পদলেহনকারী বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে নিজের কাছেই ঘৃণাবোধ হয়। এক-এগারোর সামরিক জান্তার সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত এই বিচিত্র, রহস্যময় ব্যক্তিটি বিগত প্রায় চার বছর ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। কাজেই তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সমর্থন করে সভা, সেমিনার, টেলিভিশনে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন অথবা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সেগুলোকে আবর্জনা জ্ঞান করে বিবেচনার বাইরেই রাখলাম।
১৯৯৬ সালের বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক মাত্র কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা বলাটা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। তবু জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর খাতিরে তার কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ বাধ্য হয়েই দিতে হচ্ছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে, আবদুর রাজ্জাক একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে ২০০৯ সালে টিপাইমুখ পরিদর্শনের নামে ভারতে আনন্দ সফর করে এসেছিলেন। দিল্লি থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারত সরকারের পক্ষে তিনি যেভাবে সাফাই গেয়েছিলেন, তাতে দেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক স্তম্ভিত হয়েছে। বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে, সংসদের বক্তৃতায়, টেলিভিশন টকশোতে এবং বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে মরহুম আবদুর রাজ্জাক রহস্যজনক কারণে রীতিমত ওকালতি করেছেন। দিল্লি থেকে ফিরেই ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছিলেন শুধু সেটুকুই ২০০৯ সালের ৫ আগস্টের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বা হুমকির কারণ হবে। ভারতীয় দুই মন্ত্রী এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভারতে ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ভারত এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, বিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা ও কুশিয়ারাতে আগে যে পানি আসত, তা আরও বাড়বে।’
মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে অধিকতর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সর্বশেষ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযুক্ত করে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের পক্ষে যে রায় ঘোষণা করেছেন তা রীতিমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ২০০২ সালে ভারত সরকার সে দেশের আদালতেরই একটি রায়ের প্রেক্ষিতে এই বৃহত্ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ি দাবি করেছিলেন, অভিন্ন নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত বন্যা এবং খরার কবল থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী এই প্রকল্পটির পরিকল্পনার কথা ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশ পেলেও ২০০২ সাল পর্যন্ত এটা কেবল আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাদিয়ার (SH Kapadia) নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত রায়ে একটি নির্ধারিত সময়ের (Time-bound) মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘We direct the Union of India to forthwith constitute a committee for interlinking of rivers. We direct the committee to implement the project.’ (আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন অনতিবিলম্বে নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। আমরা কমিটিকেও প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিচ্ছি)। সুপ্রিমকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত গঙ্গার পানি চুক্তির ৯ নম্বর ধারার (লেখার প্রারম্ভে উদ্ধৃত) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কেবল তাই নয়, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নজিরবিহীন রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আমি এই প্রসঙ্গে কেবল Helsinki Agreement এবং UN Convention-এর আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ করব। এই দুটি ছাড়াও ভাটির দেশের অধিকার রক্ষায় আরও যেসব আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো লেখার কলেবর সীমিত রাখার লক্ষ্যে আপাতত উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ হেলসিংকিতে আন্তর্জাতিক নদীর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যে চুক্তি (Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে পরিষ্কারভাবে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চুক্তিটির নাম ‘Convention on the Protection and the Use of Transboundary Watercourses and International Lakes’। এই চুক্তিতে মোট ২৮টি ধারার মধ্যে আমার আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলিই কেবল পাঠকের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বোঝার সুবিধার্থে এখানে উদ্ধৃত করছি। পাঠকের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার হবে জেনেও বিনীতভাবে তাদের ওই ধারাগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়বার অনুরোধ করছি। আমি মনে করি, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হলে জনগণের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক।
* 2-1. The parties shall take all appropriate measures to prevent, control and reduce any transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং হ্রাস করা যায়।)
* (2-2c) The parties shall in particular take all appropriate measures to ensure that transboundary waters are used in a reasonable and equitable way, taking into particular account their transboundary character, in the case of activities which cause or are likely to cause transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার নিশ্চিত হয়, বিশেষত আন্তর্জাতিক নদীর চরিত্রের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।)* (2-6) The riparian parties shall co-operate on the basis of equality and reciprocity, in particular through bilateral and multilateral agreements, in order to develop harmonized policies, programmes and strategies covering the relevant catchment areas, or parts thereof, aimed at the prevention, control and reduction of transboundary impact and aimed at the protection of environment of transboundary waters or the environment influenced by such waters, including the marine environment. (নদীতীরবর্তী পক্ষগুলো পরস্পরের সঙ্গে ন্যায্যতা ও দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সহযোগিতা করবে, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সমন্বিত নীতিমালা প্রণীত হবে, সংশ্লিষ্ট নদীখাত এলাকা অথবা তার অংশবিশেষে এমন কর্মসূচি অথবা কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা যায় এবং নদীজ পরিবেশসহ আন্তর্জাতিক নদী অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্য অর্জিত হয়।)* ৪) The parties shall establish programmes for monitoring the conditions of transboundary waters. (পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবে)* 9-1. The riparian parties shall on the basis of equality and reciprocity enter into bilateral or multilateral agreements or other arrangements, where these do not yet exist, or adopt existing ones, where necessary to eliminate the contradictions with the basic principles of this convention, in order to define their mutual relations and conduct regarding the prevention, control and reduction of transboundary impact. The riparian parties shall specify the catchment area or parts thereof, subject to co-operation. These agreements or arrangements shall embrace relevant issues covered by this convention, as well as any other issues on which the riparian parties may deem it necessary to co-operate. (অভিন্ন নদীতীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো ন্যায্যতা ও পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যদি বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থা না থাকে, অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই কনভেনশনের সঙ্গে কোনো অসঙ্গতি থাকলে প্রয়োজন অনুসারে সেটি দূর করবে, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অথবা আচরণ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রগুলো যার যার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নদীখাতের এলাকা নির্দিষ্ট করবে। এই চুক্তি অথবা ব্যবস্থা এমনভাবে প্রণয়ন অথবা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং অন্যান্য ইস্যুতেও অভিন্ন নদীর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো তাদের মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতা করবে।)
কাজেই হেলসিংকি চুক্তির আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় যে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই বিতর্কিত, সংকীর্ণ ও একপাক্ষিক রায়ে আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা ও নদীজ পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিন্ন নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা এবং একে অপরের সঙ্গে অবশ্যকরণীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব আগামী বুধবার)
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
বাংলাদেশে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী ভারত থেকে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে সারি নদী একটি। এই নদীটি মাইনথ্রু (Mainthru) নামে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে জন্মলাভ করেছে। মাইনথ্রু সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নাম নিয়েছে এবং ছাতকের কাছে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন (Goyain) নদীর পানিও সারির সঙ্গে মিশেছে। পাহাড়ি নদী সারি-গোয়াইন মেঘালয় থেকে প্রচুর পাথর, মোটা বালু এবং পলিমাটি বহন করে নিয়ে আসে। নদীতীরবর্তী বিপুলসংখ্যক মানুষ এই নদী থেকে পাথর সংগ্রহ এবং পরিবহনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সুতরাং, নদীটির বেঁচে থাকা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের অন্তত কিছু মানুষের সংসার খরচ মেটানোর জন্যও আবশ্যক।
এই মাসেই ভারত সরকার মাইনথ্রু নদীতে ৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে সেখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। এই বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আমার জানা মতে, আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভারত সরকার বাংলাদেশের অনুমতি নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি। সিলেট অঞ্চলের জনগণ ‘সারি নদী বাঁচাও’ আন্দোলন গড়ে তুললেও ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো রকম প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এই বাঁধ নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ নম্বর ধারা উল্লেখ করা আবশ্যক। সেই ধারায় বলা হয়েছে, ‘Guided by the principles of equity, fairness and no harm to either party, both the governments agree to conclude water sharing Treaties/Agreements with regard to other common rivers.’ অর্থাত্, সমঅধিকার, ন্যায্যতা এবং কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার নীতি অনুসরণ করে, উভয় পক্ষ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করছে। সুতরাং, সারি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এই নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করে গঙ্গা-চুক্তির ৯ নম্বর ধারা সুস্পষ্টভাবে ভঙ্গ করেছে। এই চুক্তিবহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকার সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ ও জনগণের জীবনধারণকে আজ যে হুমকির মুখে ফেলেছে, তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারী ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারও সমভাবে দায়ী। তারা দেশের স্বার্থ বিষয়ে নীরব থেকে ভারতকে বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা চুক্তি ভঙ্গে উত্সাহিত করেছে।
এবার টিপাইমুখ প্রসঙ্গে আসি। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাই উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদী। ভারত সেই বরাক উপত্যকার টিপাইমুখ নামক স্থানে ৩৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৬৩ মিটার উচ্চতার এক অতিকায় বাঁধ (mega-dam) নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী যে জায়গাটিকে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছে, সেটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯৮৮ সালেও এই অঞ্চলে ৬.৬ রিখটার মাত্রার একটি তীব্র ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রয়েছে যে, মণিপুর অঞ্চলে ৮ কিংবা অধিক রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়া সম্ভব। এমন এক স্থানে অতিকায় বাঁধ নির্মাণ সেই ভূমিকম্প প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ৮ রিখটার স্কেলের ঊর্ধ্বমাত্রার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় টিপাইমুখ বাঁধ ভাঙলে মণিপুর ও ঘন বসতিপূর্ণ সিলেট অঞ্চলে যে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হবে, তা সুনামি কিংবা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতিকেও হার মানাবে। অর্থাত্ এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ভয়াবহ এক টাইম বোমার সঙ্গে বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই মণিপুরের স্থানীয় অধিবাসীরাও বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। অবশ্য, এসব আন্দোলনকে দিল্লির শাসকশ্রেণী বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে চলেছে। তাছাড়া সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বিদ্রোহী মণিপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদতলে পিষ্ট একটি রাজ্য মাত্র। এ তো গেল ভূমিকম্পজনিত সর্বনাশের আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সঙ্গত কারণেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়ে গেলে সেখানে কেবল জলবিদ্যুত্ উত্পাদনই করা হবে না, ভবিষ্যতে সময়-সুযোগমত পানি প্রত্যাহার করে পদ্মা অববাহিকার মতো মেঘনা অববাহিকাকেও ধ্বংস করা হবে। সে কারণেই ক্ষমতাসীন মহাজোট এবং ভারত থেকে নিয়মিত মাসোহারাপ্রাপ্ত তথাকথিত সুশীল (?) গোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। জনমতের এই বিরূপতা উপলব্ধি করে বহুরূপী রাজনীতিক, স্বৈরাচারী এরশাদ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের লোক-দেখানো নাটক মঞ্চস্থ করতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রবিরোধী চরিত্র অনুযায়ী আমাদের মাতৃভূমি ধ্বংসকারী যাবতীয় ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেখেও সর্বপ্রকারে লজ্জাহীন দালালি অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতার গত তিন বছরের বক্তব্য এবার খানিকটা ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে।
একসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে নাকি বাংলাদেশের লাভ হবে। আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী, তিস্তাপাড়ের রমেশচন্দ্র সেন বলেছেন, আগে বাঁধ নির্মিত হোক, তারপর বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তখন দেখা হবে। পানি প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তো আর এক কাঠি সরেস। তিনি ভারতের অবস্থান সমর্থন করে বাণী দিয়েছেন, ভারত তাদের নদীতে বাঁধ দিলে আমাদের বলার কী আছে? অর্থাত্ আন্তর্জাতিক নদীর (International/Transboundary river) সংজ্ঞা সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের এই অখ্যাত, দেশবিরোধী আওয়ামী রাজনীতিবিদের কোনো ধারণাই নেই। তবু তিনি শেখ হাসিনার প্রিয় পানি প্রতিমন্ত্রী। এদের আচরণদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগ করলেই বোধহয় ভারতের দালালে রূপান্তরিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দিল্লির পদলেহনকারী বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে নিজের কাছেই ঘৃণাবোধ হয়। এক-এগারোর সামরিক জান্তার সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত এই বিচিত্র, রহস্যময় ব্যক্তিটি বিগত প্রায় চার বছর ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। কাজেই তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সমর্থন করে সভা, সেমিনার, টেলিভিশনে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন অথবা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সেগুলোকে আবর্জনা জ্ঞান করে বিবেচনার বাইরেই রাখলাম।
১৯৯৬ সালের বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক মাত্র কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা বলাটা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। তবু জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর খাতিরে তার কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ বাধ্য হয়েই দিতে হচ্ছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে, আবদুর রাজ্জাক একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে ২০০৯ সালে টিপাইমুখ পরিদর্শনের নামে ভারতে আনন্দ সফর করে এসেছিলেন। দিল্লি থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারত সরকারের পক্ষে তিনি যেভাবে সাফাই গেয়েছিলেন, তাতে দেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক স্তম্ভিত হয়েছে। বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে, সংসদের বক্তৃতায়, টেলিভিশন টকশোতে এবং বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে মরহুম আবদুর রাজ্জাক রহস্যজনক কারণে রীতিমত ওকালতি করেছেন। দিল্লি থেকে ফিরেই ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছিলেন শুধু সেটুকুই ২০০৯ সালের ৫ আগস্টের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বা হুমকির কারণ হবে। ভারতীয় দুই মন্ত্রী এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভারতে ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ভারত এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, বিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা ও কুশিয়ারাতে আগে যে পানি আসত, তা আরও বাড়বে।’
মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে অধিকতর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সর্বশেষ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযুক্ত করে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের পক্ষে যে রায় ঘোষণা করেছেন তা রীতিমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ২০০২ সালে ভারত সরকার সে দেশের আদালতেরই একটি রায়ের প্রেক্ষিতে এই বৃহত্ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ি দাবি করেছিলেন, অভিন্ন নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত বন্যা এবং খরার কবল থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী এই প্রকল্পটির পরিকল্পনার কথা ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশ পেলেও ২০০২ সাল পর্যন্ত এটা কেবল আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাদিয়ার (SH Kapadia) নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত রায়ে একটি নির্ধারিত সময়ের (Time-bound) মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘We direct the Union of India to forthwith constitute a committee for interlinking of rivers. We direct the committee to implement the project.’ (আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন অনতিবিলম্বে নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। আমরা কমিটিকেও প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিচ্ছি)। সুপ্রিমকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত গঙ্গার পানি চুক্তির ৯ নম্বর ধারার (লেখার প্রারম্ভে উদ্ধৃত) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কেবল তাই নয়, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নজিরবিহীন রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আমি এই প্রসঙ্গে কেবল Helsinki Agreement এবং UN Convention-এর আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ করব। এই দুটি ছাড়াও ভাটির দেশের অধিকার রক্ষায় আরও যেসব আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো লেখার কলেবর সীমিত রাখার লক্ষ্যে আপাতত উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ হেলসিংকিতে আন্তর্জাতিক নদীর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যে চুক্তি (Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে পরিষ্কারভাবে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চুক্তিটির নাম ‘Convention on the Protection and the Use of Transboundary Watercourses and International Lakes’। এই চুক্তিতে মোট ২৮টি ধারার মধ্যে আমার আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলিই কেবল পাঠকের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বোঝার সুবিধার্থে এখানে উদ্ধৃত করছি। পাঠকের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার হবে জেনেও বিনীতভাবে তাদের ওই ধারাগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়বার অনুরোধ করছি। আমি মনে করি, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হলে জনগণের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক।
* 2-1. The parties shall take all appropriate measures to prevent, control and reduce any transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং হ্রাস করা যায়।)
* (2-2c) The parties shall in particular take all appropriate measures to ensure that transboundary waters are used in a reasonable and equitable way, taking into particular account their transboundary character, in the case of activities which cause or are likely to cause transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার নিশ্চিত হয়, বিশেষত আন্তর্জাতিক নদীর চরিত্রের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।)* (2-6) The riparian parties shall co-operate on the basis of equality and reciprocity, in particular through bilateral and multilateral agreements, in order to develop harmonized policies, programmes and strategies covering the relevant catchment areas, or parts thereof, aimed at the prevention, control and reduction of transboundary impact and aimed at the protection of environment of transboundary waters or the environment influenced by such waters, including the marine environment. (নদীতীরবর্তী পক্ষগুলো পরস্পরের সঙ্গে ন্যায্যতা ও দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সহযোগিতা করবে, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সমন্বিত নীতিমালা প্রণীত হবে, সংশ্লিষ্ট নদীখাত এলাকা অথবা তার অংশবিশেষে এমন কর্মসূচি অথবা কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা যায় এবং নদীজ পরিবেশসহ আন্তর্জাতিক নদী অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্য অর্জিত হয়।)* ৪) The parties shall establish programmes for monitoring the conditions of transboundary waters. (পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবে)* 9-1. The riparian parties shall on the basis of equality and reciprocity enter into bilateral or multilateral agreements or other arrangements, where these do not yet exist, or adopt existing ones, where necessary to eliminate the contradictions with the basic principles of this convention, in order to define their mutual relations and conduct regarding the prevention, control and reduction of transboundary impact. The riparian parties shall specify the catchment area or parts thereof, subject to co-operation. These agreements or arrangements shall embrace relevant issues covered by this convention, as well as any other issues on which the riparian parties may deem it necessary to co-operate. (অভিন্ন নদীতীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো ন্যায্যতা ও পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যদি বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থা না থাকে, অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই কনভেনশনের সঙ্গে কোনো অসঙ্গতি থাকলে প্রয়োজন অনুসারে সেটি দূর করবে, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অথবা আচরণ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রগুলো যার যার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নদীখাতের এলাকা নির্দিষ্ট করবে। এই চুক্তি অথবা ব্যবস্থা এমনভাবে প্রণয়ন অথবা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং অন্যান্য ইস্যুতেও অভিন্ন নদীর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো তাদের মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতা করবে।)
কাজেই হেলসিংকি চুক্তির আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় যে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই বিতর্কিত, সংকীর্ণ ও একপাক্ষিক রায়ে আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা ও নদীজ পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিন্ন নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা এবং একে অপরের সঙ্গে অবশ্যকরণীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব আগামী বুধবার)
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
মন্তব্য প্রতিবেদন : ‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত
মাহমুদুর রহমান
শেষ পর্ব
ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্তের দ্বিতীয় কিস্তি হেলসিঙ্কি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে শেষ করেছিলাম। আজ একই বিষয়ে জাতিসংঘের আইনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আরম্ভ করছি। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ সংক্রান্ত বিরোধ মেটানো ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ যে কনভেনশন (UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses) তৈরি করেছে, হেলসিঙ্কি চুক্তির মতোই ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযোগের বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় তার সরাসরি লঙ্ঘন। জাতিসংঘ কনভেনশন নিম্নোক্ত পাঁচটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে :
1. Universal Participation (সর্বজনীন অংশগ্রহণ)
2. Cooperative Governance (সহযোগিতামূলক শাসন)
3. Equity (ন্যায্যতা)
4. Peaceful dispute resolution (শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি)
5. Communication and environmental protection (যোগাযোগ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ)
উপরিউক্ত নীতিমালার আলোকে যে কনভেনশন প্রণীত হয়েছে, তার ৭ এবং ১২ নম্বর ধারা ভারতের ন্যায়-নীতি বিবর্জিত সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র উপলব্ধির জন্য এখানে উদ্ধৃত করছি :
Article 7-1 : Watercourse states shall, in utilizing an international watercourse in their territories, take all appropriate measures to prevent the causing of significant harm to other watercourse states.
(আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকারে নিশ্চিত করবে যাতে অভিন্ন নদী তীরবর্তী অন্য রাষ্ট্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।)
Article 12 : Before a watercourse state implements or permits the implementation of planned measures which may have a significant adverse effect upon other watercourse states, it shall provide those states with timely notification thereof. Such notification shall be accompanied by available technical data and information, including the results of any environmental impact assessment, in order to enable the notified states to evaluate the possible effects of the planned measures.
(আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারকারী রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন অথবা বাস্তবায়নের অনুমতি প্রদানের আগে সেসব রাষ্ট্রকে আগাম সতর্কতা জানানো বাধ্যতামূলক। এই সতর্ক বার্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কারিগরি তথ্য-উপাত্ত এবং পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়নপূর্বক প্রেরণ করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রকল্পের বিষয়ে তাদের নিজস্ব ক্ষয়-ক্ষতি মূল্যায়নে সক্ষম হয়)
ভারতের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাদিয়া আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ প্রকল্পের নির্দেশনা দেয়ার সময় হয় এ বিষয়ে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাগুলো বিস্মৃত হয়েছিলেন অথবা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্বে তিনি ও তার দুই সহযোগী বিচারপতি বিশ্বাসই করেন না। তাদের এই রায় ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এবং এই দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য এখনই এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে থেকে আমাদের কোনো ফায়দা নেই। বিরোধী দলও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়নে অতি মাত্রায় ব্যস্ত রয়েছে। তাদের কাছে পানি আগ্রাসনের বিষয়টি আপাতত অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের জনগণকেই আপন অস্তিত্বের স্বার্থে এখনই জেগে উঠতে হবে।
ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিবাদের পরিবর্তে বর্তমান সরকার অভিন্ন নদীর বিষয়ে বিগত সোয়া তিন বছরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তার ফলে জীবন-জীবিকার ধ্বংসসাধনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারই ২০০০ সালের জানুয়ারিতে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির (JCE) কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রদান সত্ত্বেও মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় নতুন করে চুক্তির নামে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিস্তার পানির সঙ্গে ভারতের জন্য করিডোরকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাধায় তিস্তার পানি চুক্তি ভেস্তে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত পানি এবং করিডোরের পার্থক্য না বুঝে ঘোষণা করলেন, তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিটও দেয়া হবে না। যেন তিস্তা থেকে যত্সামান্য পানিপ্রাপ্তির বিনিময়ে আমরা দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে ভারতকে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর দিয়ে দেব। সরকারের এই নতজানু অবস্থানের প্রতিবাদ করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকাতেই ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমি লিখেছিলাম, তিস্তা আমাদের অধিকার, করিডোর ওদের আবদার। পরে দেখা গেল, তিস্তা নদীর পানির ব্যাপারে কোনো সুরাহা না হলেও শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার জাতিকে অন্ধকারে রেখে ভারতকে করিডোর কিন্তু ঠিকই দিয়েছে। সে কারণেই গত বছর ১২ অক্টোবর আবারও লিখলাম, আবদার মিটেছে অধিকার মেলেনি।
ভারতের করিডোরের আবদার মেটাতে গিয়ে আমাদের তিতাস নদীর মাঝ বরাবর এপাড়-ওপাড় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে যেভাবে নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো নজির সারা বিশ্বে কোথাও মিলবে না। এত বড় রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ কোনো দেশের সরকার করতে পারে, সেটি কল্পনাতে আনা সম্ভব না হলেও এ দেশে এরকমটিই ঘটেছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিতাস নদী তীরবর্তী মানুষদের নির্লিপ্ততা। তাদের চোখের সামনে নদী হত্যা চালানো হলেও এর প্রতিবাদে কোথাও কোনো বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়নি। এর জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মেরুদণ্ডহীনতা এবং সীমাহীন লোভকেও দায়ী করতে হবে। তাদের লোভ দেখানো হয়েছে যে, আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে করিডোর চালু হলে নানা রকম ব্যবসার সুযোগ পেয়ে তারা সব রাতারাতি সম্পদশালী হয়ে উঠবে। একটি দেশের জনগণের সম্পদের প্রতি এতখানি লোভ-লালসা থাকলে সেই জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা দুরূহ।
তিতাস নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই অসত্ ও রহস্যজনক আচরণ করেছে। এই ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশ সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়ন ও একনেক (ECNEC) কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদন বাধ্যতামূলক হলেও তিতাসের বাঁধের ব্যাপারে এসব কিছুই মানা হয়নি। এমনকি প্রশাসনের কোনো অংশই এখন আর বাঁধ নির্মাণের কোনোরকম দায়দায়িত্ব নিতেও রাজি নয়। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং নৌ-যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা সবাই এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে যেন রাতারাতি কোনো এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আসমান থেকে নেমে এসে তিতাস নদীর মাঝখানে বাঁধটি বানিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে! এলাকার লোকজন অবশ্য অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় কোনো এক কোম্পানি মাসাধিককাল ধরে এই বাঁধ তৈরি করেছে। এই তথ্য সঠিক হলে বলতে হবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীন মহল সবটুকু স্বাধীনতা বৃহত্ প্রতিবেশীর পদতলে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করে বসে আছে। নদী হত্যার বিষয়ে কোথাও কোনো সুরাহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আমি বাদী হয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে সেখান থেকে অবশ্য সরকারের প্রতি রুল জারি করা হয়েছে। এদিকে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংসদে জোরগলায় দাবি করেছেন, তিতাস নদীর স্রোতধারা বন্ধ করে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তাতে নাকি পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি! পরিবেশ সম্পর্কে ডক্টর সাহেবের অগাধ জ্ঞান দেখে দেশবাসী চমত্কৃত হয়েছে। মন্ত্রীর জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য দু’টি আইনের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি। Bengal Canal Act 1864-এ বলা হয়েছে, “Any person who shall willfully cause ... any obstruction to any line of navigation or any damage to the banks or works of such line of navigation, or who shall willfully omit to remove such obstruction after being lawfully required to do so, shall be punished on conviction before a magistrate ...” (কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নৌপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অথবা নদীর পাড়ের কোনো ক্ষতিসাধন অথবা নৌপথের কোনো ক্ষতিসাধন করলে অথবা আইনত বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও সেই প্রতিবন্ধকতা অপসারণে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হবে।)
দ্বিতীয় আইনটি আরও সাম্প্রতিক। Bengal Canal Act-এর আলোকেই নৌপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তির সাজা কঠোরতর করে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে Wetland and Open Space Conservation Act, 2000। তিতাস নদীতে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে উপরে উল্লিখিত আইন ভঙ্গ করার অপরাধে বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কবে সাজা হবে, সেই শুভক্ষণ দেখার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক অপেক্ষা করে রয়েছেন।
ফেনী নদী নিয়ে আলোচনা করেই তিন পর্বে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানব। ভারত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের ন্যায্য অধিকারকে উপেক্ষা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিস্ময়করভাবে আমাদের নিজস্ব ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিয়েছে। ফেনী নদীর উত্পত্তি বাংলাদেশের মাটিরাঙার ভগবানটিলা হলেও ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদীটির উত্পত্তি ত্রিপুরা রাজ্যে বলে দাবি করে এসেছে। ভারতের কাছ থেকে নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কারণে বর্তমান সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট সীমান্ত এলাকায় ভারত গত সেপ্টেম্বর থেকে নদীর পাড়ে ব্লক তৈরি করছে। এই সীমান্তে পাইপ বসিয়ে ভারতের উপেন্দ্রনগরের জন্য পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। রামগড়ের অদূরে ভারতের সাবরুম শহরের পানি সঙ্কট মেটাতে ১৭টি পাইপ বসিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অনবরত পানি প্রত্যাহার করছে।
এই আগ্রাসনের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকার সুযোগ নিয়ে সেখানে একটি পানি শোধনাগার প্রকল্প পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। তিতাস পাড়ের মানুষ যেমন নদী হত্যার সময় চোখ বন্ধ করে থেকেছে, তেমন করেই ফেনী অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও তাদের নদীর পানি রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের অধিকাংশ সংসদীয় এলাকায় ২০০৮-এর ডিজিটাল নির্বাচনে জনগণ বিএনপির পক্ষে রায় দিলেও সেসব সংসদ সদস্যও প্রতিবাদের পরিবর্তে বিস্ময়কর নীরবতা পালন করছেন। ভারতের পানি আগ্রাসন প্রতিরোধে তাদের এই ভীরু আচরণ ক্ষমার অযোগ্য।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি থেকে পানি আগ্রাসনের মাধ্যমে ভারত বিপুল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। কিছুদিন আগে ফারাক্কা বাঁধজনিত ক্ষতি নিরূপণ বিষয়ক এক সেমিনারে দেশের প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তাতে ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরাসরি অন্তত ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে পরিবেশের সার্বিক ক্ষতি যোগ করা হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হবে। গঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এ দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিলে টাকার অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি অনুমান করাও কঠিন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য পানি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার বিএম আব্বাস এ, টি তার ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের ইতিহাসের কথা লিখেছেন। সেই বই থেকেই ক্ষুদ্র একটি অংশ উদ্ধৃত করছি :
‘প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের বাধ্যকর কূটনীতি (Coercive Diplomacy) প্রতিবেশীর উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ নীতি ভারত বা সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। ভারতেও এ অঞ্চলের সব মানুষের মঙ্গলের জন্য নদীগুলোর শরিক দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের সর্বাধিক ও বহুমুখী উন্নয়নের পক্ষে জোরালো সমর্থন রয়েছে। শুধু নদীর শুকনো মৌসুমের পানিবৃদ্ধিই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হবে অববাহিকাভিত্তিক ও বহুমুখী এবং এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিবিদ্যুত্ উত্পাদন, সেচ, পানি নিষ্কাশন, খনিজ ও বন সম্পদ আহরণ ইত্যাদি। এ অঞ্চলের আশু প্রয়োজন তার দরিদ্র, অনাহারক্লিষ্ট ও গৃহহীন কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা। এ প্রচেষ্টায় কোনোরকম বিলম্ব করা আমাদের পক্ষে হবে কর্তব্যের গুরুতর অবহেলা।’
ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নদী সংযোগকরণ নির্দেশ প্রদানকারী রায় বাস্তবায়িত হতে দিলে বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপের অবলুপ্তি অনিবার্য হয়ে উঠবে। সেই আবহমান ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ তো গত চল্লিশ বছরে গেছেই, এবার এক সময়ের ‘সুফলার’ পরিবর্তে এই ভূখণ্ডটি ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই আমাদের মাতৃভূমির এবং ষোল কোটি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোনো মূল্যে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর এই অপতত্পরতা রুখতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিম্নোক্ত তিনটি পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করতে পারি :
১. পানি অগ্রাসনের জন্য ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি : আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এবং অন্যান্য অসংখ্য নদী থেকে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের কয়েক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৩৫ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের জন্য আমাদের ভিক্ষাপাত্র হাতে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। অথচ পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েই অন্তত এক ডজন এরকম সেতু নির্মাণ সম্ভব। জাতিসংঘের কনভেনশনেও উজানে আইনবিরুদ্ধভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে ভাটি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ কনভেনশনের ৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে,
“Where significant harm nevertheless is caused to another watercourse state, the states whose use causes such harm shall, in the absence of agreement to such use, take all appropriate measures, having due regard for the provisions of articles 5 and 6, in consultation with the affected state, to eliminate or mitigate such harm and, where appropriate, to discuss the question of compensation.” (যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে, সেখানে ক্ষতিসাধনকারী রাষ্ট্রগুলো কনভেনশনের ৫ এবং ৬ ধারার আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে পানি প্রত্যাহারজনিত কোনো চুক্তির অবর্তমানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতির কারণ দূর করবে এবং যেখানে প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা করবে।) সুতরাং ১৯৯৭ সালের ২১ মে স্বাক্ষরিত UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses-এর ৭(২) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।
২. ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা : ৫৪টি অভিন্ন নদীর বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট গত ফেব্রুয়ারিতে যে রায় প্রদান করেছে, সেটি হেলসিঙ্কি চুক্তি এবং জাতিসংঘ কনভেনশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী হওয়ায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে এখনই বাংলাদেশের অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
৩. ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আন্দোলন : ভারতের সর্বাত্মক পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বিরোধী দল নির্বিশেষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের প্রতি নানা কারণে নতজানু হওয়ায় তাদের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কোনোরকম সহযোগিতা না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। সেক্ষেত্রে এই সরকারের বিরুদ্ধেও সমান্তরালভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে হয় তাদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে হবে নতুবা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মহাজোটকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এমন একটি দেশপ্রেমিক সরকারকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন করতে হবে যারা ব্যক্তিগত অথবা দলীয় স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেবে না।
শেষ কথা হলো, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ভারতের ভয়ঙ্কর পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সুতরাং, আর কালক্ষেপণ না করে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী ও তার এদেশীয় তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে তিন কিস্তির মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্তের দ্বিতীয় কিস্তি হেলসিঙ্কি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে শেষ করেছিলাম। আজ একই বিষয়ে জাতিসংঘের আইনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আরম্ভ করছি। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ সংক্রান্ত বিরোধ মেটানো ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ যে কনভেনশন (UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses) তৈরি করেছে, হেলসিঙ্কি চুক্তির মতোই ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযোগের বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় তার সরাসরি লঙ্ঘন। জাতিসংঘ কনভেনশন নিম্নোক্ত পাঁচটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে :
1. Universal Participation (সর্বজনীন অংশগ্রহণ)
2. Cooperative Governance (সহযোগিতামূলক শাসন)
3. Equity (ন্যায্যতা)
4. Peaceful dispute resolution (শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি)
5. Communication and environmental protection (যোগাযোগ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ)
উপরিউক্ত নীতিমালার আলোকে যে কনভেনশন প্রণীত হয়েছে, তার ৭ এবং ১২ নম্বর ধারা ভারতের ন্যায়-নীতি বিবর্জিত সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র উপলব্ধির জন্য এখানে উদ্ধৃত করছি :
Article 7-1 : Watercourse states shall, in utilizing an international watercourse in their territories, take all appropriate measures to prevent the causing of significant harm to other watercourse states.
(আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকারে নিশ্চিত করবে যাতে অভিন্ন নদী তীরবর্তী অন্য রাষ্ট্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।)
Article 12 : Before a watercourse state implements or permits the implementation of planned measures which may have a significant adverse effect upon other watercourse states, it shall provide those states with timely notification thereof. Such notification shall be accompanied by available technical data and information, including the results of any environmental impact assessment, in order to enable the notified states to evaluate the possible effects of the planned measures.
(আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারকারী রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন অথবা বাস্তবায়নের অনুমতি প্রদানের আগে সেসব রাষ্ট্রকে আগাম সতর্কতা জানানো বাধ্যতামূলক। এই সতর্ক বার্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কারিগরি তথ্য-উপাত্ত এবং পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়নপূর্বক প্রেরণ করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রকল্পের বিষয়ে তাদের নিজস্ব ক্ষয়-ক্ষতি মূল্যায়নে সক্ষম হয়)
ভারতের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাদিয়া আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ প্রকল্পের নির্দেশনা দেয়ার সময় হয় এ বিষয়ে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাগুলো বিস্মৃত হয়েছিলেন অথবা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্বে তিনি ও তার দুই সহযোগী বিচারপতি বিশ্বাসই করেন না। তাদের এই রায় ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এবং এই দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য এখনই এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে থেকে আমাদের কোনো ফায়দা নেই। বিরোধী দলও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়নে অতি মাত্রায় ব্যস্ত রয়েছে। তাদের কাছে পানি আগ্রাসনের বিষয়টি আপাতত অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের জনগণকেই আপন অস্তিত্বের স্বার্থে এখনই জেগে উঠতে হবে।
ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিবাদের পরিবর্তে বর্তমান সরকার অভিন্ন নদীর বিষয়ে বিগত সোয়া তিন বছরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তার ফলে জীবন-জীবিকার ধ্বংসসাধনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারই ২০০০ সালের জানুয়ারিতে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির (JCE) কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রদান সত্ত্বেও মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় নতুন করে চুক্তির নামে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিস্তার পানির সঙ্গে ভারতের জন্য করিডোরকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাধায় তিস্তার পানি চুক্তি ভেস্তে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত পানি এবং করিডোরের পার্থক্য না বুঝে ঘোষণা করলেন, তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিটও দেয়া হবে না। যেন তিস্তা থেকে যত্সামান্য পানিপ্রাপ্তির বিনিময়ে আমরা দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে ভারতকে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর দিয়ে দেব। সরকারের এই নতজানু অবস্থানের প্রতিবাদ করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকাতেই ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমি লিখেছিলাম, তিস্তা আমাদের অধিকার, করিডোর ওদের আবদার। পরে দেখা গেল, তিস্তা নদীর পানির ব্যাপারে কোনো সুরাহা না হলেও শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার জাতিকে অন্ধকারে রেখে ভারতকে করিডোর কিন্তু ঠিকই দিয়েছে। সে কারণেই গত বছর ১২ অক্টোবর আবারও লিখলাম, আবদার মিটেছে অধিকার মেলেনি।
ভারতের করিডোরের আবদার মেটাতে গিয়ে আমাদের তিতাস নদীর মাঝ বরাবর এপাড়-ওপাড় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে যেভাবে নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো নজির সারা বিশ্বে কোথাও মিলবে না। এত বড় রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ কোনো দেশের সরকার করতে পারে, সেটি কল্পনাতে আনা সম্ভব না হলেও এ দেশে এরকমটিই ঘটেছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিতাস নদী তীরবর্তী মানুষদের নির্লিপ্ততা। তাদের চোখের সামনে নদী হত্যা চালানো হলেও এর প্রতিবাদে কোথাও কোনো বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়নি। এর জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মেরুদণ্ডহীনতা এবং সীমাহীন লোভকেও দায়ী করতে হবে। তাদের লোভ দেখানো হয়েছে যে, আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে করিডোর চালু হলে নানা রকম ব্যবসার সুযোগ পেয়ে তারা সব রাতারাতি সম্পদশালী হয়ে উঠবে। একটি দেশের জনগণের সম্পদের প্রতি এতখানি লোভ-লালসা থাকলে সেই জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা দুরূহ।
তিতাস নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই অসত্ ও রহস্যজনক আচরণ করেছে। এই ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশ সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়ন ও একনেক (ECNEC) কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদন বাধ্যতামূলক হলেও তিতাসের বাঁধের ব্যাপারে এসব কিছুই মানা হয়নি। এমনকি প্রশাসনের কোনো অংশই এখন আর বাঁধ নির্মাণের কোনোরকম দায়দায়িত্ব নিতেও রাজি নয়। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং নৌ-যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা সবাই এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে যেন রাতারাতি কোনো এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আসমান থেকে নেমে এসে তিতাস নদীর মাঝখানে বাঁধটি বানিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে! এলাকার লোকজন অবশ্য অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় কোনো এক কোম্পানি মাসাধিককাল ধরে এই বাঁধ তৈরি করেছে। এই তথ্য সঠিক হলে বলতে হবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীন মহল সবটুকু স্বাধীনতা বৃহত্ প্রতিবেশীর পদতলে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করে বসে আছে। নদী হত্যার বিষয়ে কোথাও কোনো সুরাহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আমি বাদী হয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে সেখান থেকে অবশ্য সরকারের প্রতি রুল জারি করা হয়েছে। এদিকে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংসদে জোরগলায় দাবি করেছেন, তিতাস নদীর স্রোতধারা বন্ধ করে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তাতে নাকি পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি! পরিবেশ সম্পর্কে ডক্টর সাহেবের অগাধ জ্ঞান দেখে দেশবাসী চমত্কৃত হয়েছে। মন্ত্রীর জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য দু’টি আইনের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি। Bengal Canal Act 1864-এ বলা হয়েছে, “Any person who shall willfully cause ... any obstruction to any line of navigation or any damage to the banks or works of such line of navigation, or who shall willfully omit to remove such obstruction after being lawfully required to do so, shall be punished on conviction before a magistrate ...” (কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নৌপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অথবা নদীর পাড়ের কোনো ক্ষতিসাধন অথবা নৌপথের কোনো ক্ষতিসাধন করলে অথবা আইনত বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও সেই প্রতিবন্ধকতা অপসারণে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হবে।)
দ্বিতীয় আইনটি আরও সাম্প্রতিক। Bengal Canal Act-এর আলোকেই নৌপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তির সাজা কঠোরতর করে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে Wetland and Open Space Conservation Act, 2000। তিতাস নদীতে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে উপরে উল্লিখিত আইন ভঙ্গ করার অপরাধে বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কবে সাজা হবে, সেই শুভক্ষণ দেখার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক অপেক্ষা করে রয়েছেন।
ফেনী নদী নিয়ে আলোচনা করেই তিন পর্বে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানব। ভারত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের ন্যায্য অধিকারকে উপেক্ষা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিস্ময়করভাবে আমাদের নিজস্ব ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিয়েছে। ফেনী নদীর উত্পত্তি বাংলাদেশের মাটিরাঙার ভগবানটিলা হলেও ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদীটির উত্পত্তি ত্রিপুরা রাজ্যে বলে দাবি করে এসেছে। ভারতের কাছ থেকে নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কারণে বর্তমান সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট সীমান্ত এলাকায় ভারত গত সেপ্টেম্বর থেকে নদীর পাড়ে ব্লক তৈরি করছে। এই সীমান্তে পাইপ বসিয়ে ভারতের উপেন্দ্রনগরের জন্য পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। রামগড়ের অদূরে ভারতের সাবরুম শহরের পানি সঙ্কট মেটাতে ১৭টি পাইপ বসিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অনবরত পানি প্রত্যাহার করছে।
এই আগ্রাসনের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকার সুযোগ নিয়ে সেখানে একটি পানি শোধনাগার প্রকল্প পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। তিতাস পাড়ের মানুষ যেমন নদী হত্যার সময় চোখ বন্ধ করে থেকেছে, তেমন করেই ফেনী অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও তাদের নদীর পানি রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের অধিকাংশ সংসদীয় এলাকায় ২০০৮-এর ডিজিটাল নির্বাচনে জনগণ বিএনপির পক্ষে রায় দিলেও সেসব সংসদ সদস্যও প্রতিবাদের পরিবর্তে বিস্ময়কর নীরবতা পালন করছেন। ভারতের পানি আগ্রাসন প্রতিরোধে তাদের এই ভীরু আচরণ ক্ষমার অযোগ্য।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি থেকে পানি আগ্রাসনের মাধ্যমে ভারত বিপুল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। কিছুদিন আগে ফারাক্কা বাঁধজনিত ক্ষতি নিরূপণ বিষয়ক এক সেমিনারে দেশের প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তাতে ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরাসরি অন্তত ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে পরিবেশের সার্বিক ক্ষতি যোগ করা হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হবে। গঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এ দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিলে টাকার অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি অনুমান করাও কঠিন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য পানি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার বিএম আব্বাস এ, টি তার ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের ইতিহাসের কথা লিখেছেন। সেই বই থেকেই ক্ষুদ্র একটি অংশ উদ্ধৃত করছি :
‘প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের বাধ্যকর কূটনীতি (Coercive Diplomacy) প্রতিবেশীর উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ নীতি ভারত বা সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। ভারতেও এ অঞ্চলের সব মানুষের মঙ্গলের জন্য নদীগুলোর শরিক দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের সর্বাধিক ও বহুমুখী উন্নয়নের পক্ষে জোরালো সমর্থন রয়েছে। শুধু নদীর শুকনো মৌসুমের পানিবৃদ্ধিই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হবে অববাহিকাভিত্তিক ও বহুমুখী এবং এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিবিদ্যুত্ উত্পাদন, সেচ, পানি নিষ্কাশন, খনিজ ও বন সম্পদ আহরণ ইত্যাদি। এ অঞ্চলের আশু প্রয়োজন তার দরিদ্র, অনাহারক্লিষ্ট ও গৃহহীন কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা। এ প্রচেষ্টায় কোনোরকম বিলম্ব করা আমাদের পক্ষে হবে কর্তব্যের গুরুতর অবহেলা।’
ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নদী সংযোগকরণ নির্দেশ প্রদানকারী রায় বাস্তবায়িত হতে দিলে বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপের অবলুপ্তি অনিবার্য হয়ে উঠবে। সেই আবহমান ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ তো গত চল্লিশ বছরে গেছেই, এবার এক সময়ের ‘সুফলার’ পরিবর্তে এই ভূখণ্ডটি ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই আমাদের মাতৃভূমির এবং ষোল কোটি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোনো মূল্যে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর এই অপতত্পরতা রুখতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিম্নোক্ত তিনটি পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করতে পারি :
১. পানি অগ্রাসনের জন্য ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি : আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এবং অন্যান্য অসংখ্য নদী থেকে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের কয়েক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৩৫ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের জন্য আমাদের ভিক্ষাপাত্র হাতে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। অথচ পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েই অন্তত এক ডজন এরকম সেতু নির্মাণ সম্ভব। জাতিসংঘের কনভেনশনেও উজানে আইনবিরুদ্ধভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে ভাটি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ কনভেনশনের ৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে,
“Where significant harm nevertheless is caused to another watercourse state, the states whose use causes such harm shall, in the absence of agreement to such use, take all appropriate measures, having due regard for the provisions of articles 5 and 6, in consultation with the affected state, to eliminate or mitigate such harm and, where appropriate, to discuss the question of compensation.” (যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে, সেখানে ক্ষতিসাধনকারী রাষ্ট্রগুলো কনভেনশনের ৫ এবং ৬ ধারার আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে পানি প্রত্যাহারজনিত কোনো চুক্তির অবর্তমানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতির কারণ দূর করবে এবং যেখানে প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা করবে।) সুতরাং ১৯৯৭ সালের ২১ মে স্বাক্ষরিত UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses-এর ৭(২) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।
২. ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা : ৫৪টি অভিন্ন নদীর বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট গত ফেব্রুয়ারিতে যে রায় প্রদান করেছে, সেটি হেলসিঙ্কি চুক্তি এবং জাতিসংঘ কনভেনশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী হওয়ায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে এখনই বাংলাদেশের অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
৩. ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আন্দোলন : ভারতের সর্বাত্মক পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বিরোধী দল নির্বিশেষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের প্রতি নানা কারণে নতজানু হওয়ায় তাদের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কোনোরকম সহযোগিতা না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। সেক্ষেত্রে এই সরকারের বিরুদ্ধেও সমান্তরালভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে হয় তাদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে হবে নতুবা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মহাজোটকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এমন একটি দেশপ্রেমিক সরকারকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন করতে হবে যারা ব্যক্তিগত অথবা দলীয় স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেবে না।
শেষ কথা হলো, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ভারতের ভয়ঙ্কর পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সুতরাং, আর কালক্ষেপণ না করে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী ও তার এদেশীয় তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে তিন কিস্তির মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
Online Casino Online USA - ChoDiego Casino
উত্তরমুছুনChoDiego 메리트카지노 Online Casino is a USA septcasino friendly 카지노사이트 online casino. We aim to bring you the best in online casino games and casino games in the USA.