মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : লুটেরা শাসক নির্জীব জনগণ



মাহমুদুর রহমান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই নাকি বাংলাদেশের জনগণ কিছু পায়। শেখ পরিবার দেশ ও জনগণকে কেবল দিতেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও দয়া করে ক্ষমতায় আসেন। প্রধানমন্ত্রীর পিতার আমলে জনগণের প্রাপ্তিস্বরূপ দুর্ভিক্ষ, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বাকস্বাধীনতা হরণ, একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে গত তিন যুগে প্রচুর কথাবার্তা, লেখালেখি হওয়ায় আজ আর তার পুনরুল্লেখ করছি না।
শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে দিন বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারত-মার্কিন প্রশাসন ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসেছিলেন। আর মাত্র একদিন বাদেই সেই ডিজিটাল সরকারের তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার সাধারণত প্রথম চার বছরের মধ্যেই নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করে। মেয়াদের শেষ বছরটি রাজনৈতিক ডামাডোল এবং পরবর্তী নির্বাচনের প্রচারণাতেই মূলত পার হয়ে যায়। সেই হিসেবে দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন করতে এই সরকারের হাতে আর মাত্র বারোটি মাস সময় রয়েছে। গত তিন বছরের পারঙ্গমতা বিবেচনা করলে পরবর্তী বারো মাসে বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ছাড়া সোনিয়া-মনমোহনের পোষ্য সরকার আর কিছুই যে দিতে পারবে না, এটা বোধহয় দেশের সচেতন নাগরিকমাত্রই বুঝতে পারছেন। অবশ্য যারা জেগে ঘুমাচ্ছে, তাদের কথা আলাদা। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করছেন, তিনি জনগণকে নাকি এর মধ্যেই অনেক কিছু দিয়ে ফেলেছেন। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদনে আমি কেবল জ্বালানি খাতে জনগণের প্রাপ্তি নিয়েই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
চার দলীয় জোট সরকারের একেবারে শেষদিকে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াআমাকে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত জ্বালানি উপদেষ্টারও দায়িত্ব দিয়ে মাত্র ১৫ মাসের জন্য ওই মন্ত্রণালয়টি দেখভালের সুযোগ দিয়েছিলেন। অনেক পাঠকের মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, এক এগারোতে দুর্নীতির অভিযোগে দীর্ঘদিন কারাভোগকারী বর্তমান মহাশক্তিধর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর মতো আমিও বিদ্যুত্ ও জ্বালানি উভয় মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্বে ছিলাম। একাধিকবার পাঠকদের এই ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করেছি। তারপরও অনেকেই দেখেছি জেনেও না জানার ভান করছেন। আজ পুনরায় বলছি যে, আমি কেবল বিপিসি এবং পেট্রোবাংলা অর্থাত্ জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা সংক্রান্ত বিভাগগুলোই চালিয়েছি। জোট সরকারের পাঁচ বছরে দুই দফায় বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল কবির তালুকদার।
জনগণের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বর্তমান সরকার সদ্য বিদায় নেয়া বছরে পাঁচ দফায় সব প্রকার জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। জয়তু শেখ হাসিনা। ভবিষ্যতের কোনো সরকারের পক্ষে এই রেকর্ড অতিক্রম করা আসলেই কঠিন হবে। অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল এবং সিএনজি—এই ছয়টি জ্বালানি পণ্যের চার দলীয় জোট সরকার এবং বর্তমান আমলের মূল্যের একটি তুলনামূলক তালিকা পাঠকের পরিস্থিতি বোঝার সুবিধার্থে উদ্ধৃত করে বর্তমান সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ পাঠকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

অক্টোবর ২০০৬ জানুয়ারি ২০১২ মূল্যবৃদ্ধি
(টাকা) (টাকা) (টাকা) (%)
ফার্নেস অয়েল ২০/লিটার ৬০/লিটার ৪০ ২০০
ডিজেল ৩৩/লিটার ৬১/লিটার ২৮ ৮৫
কেরোসিন ৩৩/লিটার ৬১/লিটার ২৮ ৮৫
পেট্রোল ৫৬/লিটার ৯১/লিটার ৩৫ ৬৩
অকটেন ৫৮/লিটার ৯৪/লিটার ৩৬ ৬২
সিএনজি ৮.৫০/ঘন মিটার ৩০/ঘন মিটার ২১.৫০ ২৫৩

শেখ হাসিনা, মাল মুহিত, তৌফিক-ই-ইলাহী এবং আওয়ামী লীগের চেলা-চামুণ্ডারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে অম্লান বদনে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়াতেই নাকি এমন অকল্পনীয় হারে সরকারকে বাধ্য হয়ে বার বার দাম বাড়াতে হচ্ছে। চরিত্রগতভাবে মিথ্যাচারে অভ্যস্ত আওয়ামী নেতৃবৃন্দের এই দাবি যে কত অসার, তার জন্য একটি প্রমাণ দেয়াই সম্ভবত যথেষ্ট হবে। ২০০৬ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে যে পরিশোধিত ডিজেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি মার্কিন ডলার ৮৪ ছিল, তার বর্তমান মূল্য মার্কিন ডলার ১২০। অর্থাত্ এক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ৪৩ শতাংশ। এই ৪৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে জননেত্রীর দাবিদার শেখ হাসিনা জ্বালানি খাতে জনগণের কাঁধে পণ্য ভেদে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপিয়েছেন সর্বনিম্ন ৬৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৫৩ শতাংশ পর্যন্ত। প্রধানত, গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের ব্যবহার্য এক কেরোসিনের দামই বেড়েছে শতকরা ৮৫ ভাগ! পরিবহন ও সেচ কার্যের জন্য ব্যবহৃত ডিজেলের মূল্যও বেড়েছে ৮৫ শতাংশ হারে।
জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালীন জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে জ্বালানির মূল্য সীমিত রাখার লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়নে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে ভারতে চোরাচালান এবং মজুতদারি করে কৃত্রিমভাবে মূল্য বাড়াতে না পারে, তার জন্য দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বিপিসি চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ সহকর্মীকে নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি। শত শত কিলোমিটার গাড়ি চালাতে যে তেল কিনতে হয়েছে, তার দামও নিজের গাঁটের পয়সা থেকেই দিয়েছি, সরকারের খরচ বাড়াইনি। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত শলা-পরামর্শ করে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ওপর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ দাম বাড়ানোর জন্য অবিরত চাপ সৃষ্টি করে গেলেও সাধারণ মানুষের কল্যাণে অন্তত ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস অয়েল এবং এলপিজি’র মূল্য যথাসম্ভব সীমিত যে রাখতে পেরেছিলাম, তার অকাট্য প্রমাণ ২০০৬ এবং ২০১২ সালের জ্বালানির মূল্যের উপরে প্রণীত তুলনামূলক চার্টেই মিলবে। এই প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছি।
২০০৬ সালে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ থেকে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়ায় যমুনা নদীতে নাব্য আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। ফলে চট্টগ্রাম থেকে তেল ভর্তি ইনল্যান্ড অয়েল ট্যাঙ্কারগুলো বাঘাবাড়ী ঘাটে ভিড়তে পারছিল না। বিপিসির সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বাঘাবাড়ীর পরিবর্তে উত্তরবঙ্গের চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে পাঠাব এবং সেখান থেকে তেলের ট্যাঙ্কারের (বাউজার) মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের পঞ্চগড় পর্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করা হবে। কিন্তু, সমস্যা বাধল অন্যত্র। এই যে কয়েকশ’ কিলোমিটার ঘুরপথে নদী এবং রাস্তা দিয়ে তেল পাঠানো হবে, তাতে লিটারপ্রতি বিপিসি’র খরচ বাড়বে অন্তত দুই টাকা। এমনিতেই বিপিসি তখন ভর্তুকির চাপে নিদারুণ অর্থকষ্টে ভুগছে। বকেয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্র খুলতে অস্বীকৃতি জানানোয় আমাকে বিকল্প উত্স থেকে অর্থের সংস্থান করতে হচ্ছে।
ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, কুয়েত সরকার এবং একটি বিদেশি ব্যাংক সেই কঠিন সময়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। এমতাবস্থায়, ফাইন্যান্স ডিরেক্টর আমাকে বললেন, লিটার প্রতি অতিরিক্ত দুই টাকার বোঝা বহন করা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সম্ভব নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশের জনগণকে সমস্যার গভীরতা যথাযথ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করে কেবল শুষ্ক মৌসুমের জন্য উত্তরবঙ্গে লিটার প্রতি এক টাকা করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানাব। বাকি এক টাকা বিপিসির ভর্তুকির সঙ্গে যুক্ত হয়ে না হয় সরকারের লোকসান খানিকটা বাড়বে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশে ছিলেন। শুষ্ক মৌসুমের মাত্র তিনটি মাসের জন্য অনন্যোপায় হয়ে লিটার প্রতি একটি টাকা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় মৌচাকে যেন ঢিল পড়ল। তখন সংসদ অধিবেশন চলছিল। সেখানে বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, জিল্লুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের সব সংসদ সদস্য এক টাকা দাম বাড়ানোর জন্য আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়লেন। এদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার স্বভাবসুলভ কায়দায় সংসদের ভেতরে-বাইরে যেসব রুচিবিহর্গিত মন্তব্য করতে লাগলেন, তার জবাব দেয়া কোনো ভদ্র সন্তানের কর্ম নয়। মাত্র এক টাকার জন্য সে এক মহা হুলুস্থুল অবস্থা।
সংসদে উত্তপ্ত বিতর্ক চলাকালীন বিএনপি’র একজন নীতিনির্ধারক বাধ্য হয়ে ফোনে আমাকে পরামর্শ দিলেন মূল্যবৃদ্ধি ঘোষণার কথাটা মিডিয়ার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি আখ্যা দিয়ে আমি যেন বেমালুম অস্বীকার করি। বাকিটা তিনি সংসদে সামলে নেবেন। তিনি মোবাইলে অনুচ্চ কণ্ঠে যখন এই পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তখনও সংসদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় আমি এপার থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। এ দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদের মতো সময়-সুযোগমত বক্তব্য পাল্টানো আমি কোনোদিনই ঠিক শিখে উঠতে পারিনি। আমার সেই বয়োজ্যেষ্ঠ শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শের জবাবে আমি লিটারপ্রতি এক টাকা মূল্যবৃদ্ধির সব দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে তত্ক্ষণাত্ সরকার থেকে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দিলাম। বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে অবস্থানরত অবস্থাতে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণে তার অসম্মতির কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত বিপিসি’র লোকসান বাড়িয়ে সেই এক টাকা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে আমাকে জোট সরকারকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে হয়েছিল।
আজ যখন ফার্নেস অয়েলের মূল্য ২০০ শতাংশ (লিটার প্রতি ৪০ টাকা) এবং সিএনজি’র মূল্য ২৬৩ শতাংশ (ঘন মিটার প্রতি ২১.৫০) বৃদ্ধি করা হচ্ছে, তখন জনগণের কথিত সেবক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সদ্যপ্রাপ্ত মন্ত্রীর ক্ষমতার আস্বাদনে বিভোর। লিটারে ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি সম্ভবত তার কাছে অতি তুচ্ছ বিষয়। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর জনগণের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে চিন্তা করার প্রয়োজন এই রাজনীতিবিদের আপাতত ফুরিয়েছে। মহাজোটের বিশাল মন্ত্রী-উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে কতজন রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি থেকে ভাগ পেয়ে ব্যক্তিগতভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন, সেটা সুরঞ্জিত বাবুরাই ভালো জানেন। মূল্যবৃদ্ধির কাহিনীর এখানেই শেষ নয়। আমার জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালীন যে এলপিজি সিলিন্ডার প্রতি ৪৭৫ টাকায় বিক্রি হতো, বর্তমানে তার সরকারি মূল্য কাগজে-কলমে ৭০০ টাকা (৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি) লেখা থাকলেও ১৩০০ টাকার (২৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি) নিচে কোথাও পাওয়া দুষ্কর। মাত্র তিন বছরের মধ্যে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন এই অবিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণই হচ্ছে জ্বালানি খাতে শাসকগোষ্ঠীর সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী দুর্নীতি ও লুটপাট।
বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে একমাত্র মরহুম জিয়াউর রহমান ছাড়া অন্য কোনো সরকারই প্রকৃত অর্থে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সেই কারণেই জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত সততার কাহিনী এদেশে আজও কিংবদন্তীতুল্য হয়ে আছে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে চারটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বা আছে, তার মধ্যেও বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকার নিঃসন্দেহে তুলনামূলকভাবে অধিকতর সততার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছে। ১৯৯৬ সাল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের মধ্যে যে সার্বিক অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছে, তার চূড়ান্ত রূপ এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এর মধ্যে উল্লেখ করেছি জনগণের কাঁধে অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের যে বোঝা মহাজোট সরকার মাত্র তিন বছরে চাপিয়ে দিয়েছে, তার পেছনেও রয়েছে দুর্নীতির মাধ্যমে অগাধ সম্পদ আহরণের কুিসত প্রতিযোগিতা। আজকের লেখার শুরুতেই বলেছি জ্বালানি খাতের বাইরে কলম যেতে দেব না, তাই কেবল এই খাতটির দুর্নীতির প্রসঙ্গে লিখেই মন্তব্য-প্রতিবেদনে সমাপ্তি টানব।
দিনবদলের সরকারের সূচনাতে মন্ত্রীদের চেহারা দেখেই জনগণ বুঝে গিয়েছিল যে, রাষ্ট্রের ভাণ্ডার থেকে লুটপাটের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের জন্য যোগাযোগ, বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে। অবাধ লুটপাটের আইনি বাধা দূর করার জন্য বিনা টেন্ডারে সরকারি কাজ বণ্টন করার নির্লজ্জ পদ্ধতি আবিষ্কারই শুধু করা হয়নি, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথও একদলীয় সংসদে আইন করে রুদ্ধ করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা দোসররা এক সময় বাংলাদেশে সুশাসন নিয়ে তাদের অতি-উত্সাহের ঘটা দেখালেও সেক্যুলার সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতির মহোত্সবের সময় একই গোষ্ঠী নীরবতা পালন করে প্রকারান্তরে উত্সাহ জুগিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নও স্থগিত হতো না, যদি না শেখ হাসিনা প্রফেসর ইউনূসের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের নির্দেশ অবজ্ঞা করতেন। নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার মনঃকষ্টে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। মার্কিন প্রশাসন এতদিনে সম্ভবত এটাও বুঝে গেছে যে, শেখ হাসিনার কাছে ভারতীয় স্বার্থই সর্বদা প্রাধান্য পাবে।
সকলেই মোটামুটি অবগত আছেন যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ট্রাস্টি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য হয় মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার দোসর অথবা তার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সহানুভূতিশীল। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির স্বামী অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ, বিএনপি ও জিয়া পরিবারের চরম বিরোধী পত্রিকা ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী যে সংগঠনের ট্রাস্টি, তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করার মতো নির্বোধ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক হবেন বলেই আমার ধারণা। স্বাভাবিকভাবেই এই আমলে দুর্নীতির প্রকৃত ভয়াবহ চিত্রের অতি সামান্যই টিআইবি’র বিভিন্ন প্রতিবেদনে গত তিন বছরে উঠে এসেছে। ফলে সরকারের পক্ষে বিনা টেন্ডারে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে একের পর এক কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রের চুক্তি করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে বর্তমান সরকারের দুই বহুল আলোচিত ব্যক্তি ফারুক খান এবং আবুল হোসেনের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে একের পর এক ভাড়ায় বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এক কথায় বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়কে আগামী নির্বাচনের অন্যতম Fund Collector-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ৬ টাকার বিদ্যুত্ ১৪ থেকে ১৮ টাকা প্রতি ইউনিট দরে কিনে দেশের অর্থনীতি সম্মিলিতভাবে রসাতলে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, বিদ্যুত্ উপদেষ্টা ও অর্থমন্ত্রী।
আজ যে জ্বালানি তেলের মূল্য দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে, তার মূলেও রয়েছে এসব কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র সংক্রান্ত লুটপাট। অধিকাংশ বিদ্যুত্ কেন্দ্র জ্বালানি তেলনির্ভর হওয়ায় এখন দেশের জনগণকেই বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্যের দায় নেয়ার অতিরিক্ত সেই তেলের ভর্তুকির মূল্যও পকেট থেকে মেটাতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের ভোট চুরি করা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মুহিত এর মধ্যে আগামী তিন বছর অব্যাহতভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণাও দিয়েছেন। অথচ, বেসরকারি খাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনের এই ভ্রান্ত নীতি যে পরিণামে দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ ডেকে আনবে, সেই সাবধানবাণী গ্রেফতার হওয়ার আগে আমার বিভিন্ন লেখা ও টকশোতে বহুবার উচ্চারণ করেও সরকার অথবা জনগণের সংবিত্ ফেরাতে পারিনি।
সরকারের প্রথম থেকেই সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার কারণে আমার দেশ ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েছে এবং সর্বাত্মক দলীয়করণের পাঁকে নিমজ্জিত বিচার বিভাগের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন আমাকে কারান্তরালে অত্যাচারিত হতে হয়েছে। আজও আমার দেশ’র পাঠক সরকারের জ্বালানি খাতে দুর্নীতির চিত্র সংবলিত লেখাটি যখন পড়ছেন, সেই মুহূর্তেও সিএমএম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে বিটিআরসি’র মানহানি মামলায় আমার বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের নাটক উপভোগ করছি। ফ্যাসিবাদী সরকারের এসব নির্যাতন আমার দেশ পরিবারকে অবদমিত করতে অবশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। আমরা অব্যাহতভাবে দেশের জনগণকে যাবতীয় দুর্নীতির তথ্য দেয়ার চেষ্টা করে গেছি। তবে, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করা একদা বীর জাতি আজ মহাজোট সরকারের পেটোয়া বাংলাদেশী পুলিশ বাহিনীর অ্যাকশনের সামনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গৃহাভ্যন্তরে মা, বোন, স্ত্রীর আঁচলের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। চারদিকে নির্জীব জনতার কাপুরুষতা দর্শনে মাঝে মাঝে মনে হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই বীরত্বগাঁথা কি কেবলই স্বপ্ন ছিল? কোন কালে ঘি খেয়েছিলাম, তার সুবাস এখনও হাত থেকে শোঁকার ব্যর্থ চেষ্টার মতো করেই সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একদা প্রতিবাদী, আদর্শবান তরুণদের আজ সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছি।
মনে পড়ছে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে বুয়েটে আমার প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছিল। ওইদিনই ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্বিচার বোমা বর্ষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে শেখ মুজিব সরকারের পুলিশের গুলিতে ঢাকা কলেজের মতিউল ও কাদের জীবন দিয়েছিল। তাদের দু’জনকে ভিয়েতনাম সরকার জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এই গুলিবর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তত্কালীন ডাকসু ভিপি এবং সিপিবির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য পদের কাগজ পর্যন্ত ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেলিম সাহেবরা আওয়ামী লীগের বি-টিম হয়ে গণধিকৃত বাকশালে যোগদান করেছিলেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের আওয়ামী লীগ প্রীতিতে এখনও যে ভাটা পড়েনি, সেটা ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সিপিবি’র আলোচনা সভার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছে।
আজ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত আমার কন্যাসম ফেলানীর লাশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় নির্মমভাবে দিনের পর দিন ঝুলে থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র-শিক্ষকদের হাততালি কুড়িয়ে যান। নোবেল বিজয়ী বয়ঃবৃদ্ধ অমর্ত্য সেন বাংলা একাডেমীতে এসে বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সমঝোতা না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হুমকি দিয়ে যান। আধিপত্যবাদের এসব এজেন্টদের প্রতিরোধের পরিবর্তে এ দেশের ডিজিটাল যুগের তরুণরা সব কানে আইপি-থ্রি লাগিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে মশগুল হয়ে আছে। যে দেশে তরুণরা জুলুমের প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়, নির্লিপ্ত থাকে অথবা ভয় পায়, সে দেশের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জনদুর্ভোগ লাঘবে মাঠে নামার পরিবর্তে আঁতাতের মাধ্যমে বিরোধীদল ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছে। জনদুর্ভোগ লাঘবে গণআন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে তোষণ করেই কেবল ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, এমন আত্মবিনাশী থিসিসের প্রবক্তারা সম্ভবত বর্তমান বিরোধী দলসমূহের প্রধান নীতিনির্ধারকের ভূমিকা পালন করছেন। ভারতকে করিডোর দেয়ার জন্য তিতাস নদীর ভেতরে বাঁধ দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে বহমান নদীটিকে মেরে ফেললেও বিএনপি থেকে আজ পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি। অন্যদিকে টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে পদ্মার মতো মেঘনা নদী অববাহিকাকেও ধ্বংস করার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। এমন ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ ভারতের চিহ্নিত দালালরা টেলিভিশনে প্রতিদিন আমাদের ভারতপ্রেমের নসিহত দিয়ে চলেছেন।
দেশের এই সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যে আজও একমাত্র তরুণরাই পারে আবার ১৯৭১ সালের মতো গর্জে উঠে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পদলেহী শাসকশ্রেণীকে উত্খাত করে প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। সেই এক এগারো থেকেই এই জনজোয়ার দেখার আশায় প্রতীক্ষা করে আছি। ২০১২ সালে অন্তহীন প্রতীক্ষার অবসান হোক—এটুকুই প্রত্যাশা। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজচিন্তক, মনীষী লেখক বদরুদ্দীন উমরের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি যে বক্তৃতাটি দিয়েছেন, তারই একটি ক্ষুদ্র অংশ উদ্ধৃত করে আজকের লেখায় সমাপ্তি টানব। ওই অনুষ্ঠানে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “এই যে অসহিষ্ণুতা, যেটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ঔদ্ধত্য, এটা কিন্তু একটা সংগ্রামের সময় থাকে। যেমন—ফরাসি বিপ্লবের সময় Robespierre-এর সেই বিখ্যাত উক্তি আছে—[Audacity, Audacity, more Audacity. আসল উক্তিটা : We need audacity yet more audacity, and always audacity.]
ঔদ্ধত্য, ঔদ্ধত্য আরও ঔদ্ধত্য! সে সময় কিন্তু ঔদ্ধত্যের প্রয়োজন হয়। সেখানে ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে আমি যদি বিনয়াবনত হই, তাতে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমাদের দেশের অবস্থা আজ এমন দাঁড়িয়েছে যে, এখানে অসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজন আছে।”
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন