মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : সরকারি দলের ঢাকা দখল



মাহমুদুর রহমান
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিকে আগামী ১২ মার্চের কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না। ওইদিনের আগেই সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা নাকি ঢাকা শহর দখল করে নেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা দখলদার বাহিনী নামে অভিহিত করতাম। ইরাক এবং আফগানিস্তানেও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সেনাজোটকে বিশ্বের অধিকাংশ জনগণ দখলদার সেনারূপেই বিবেচনা করে। কাশ্মীর, সিকিম, নাগাল্যান্ড, মিজোরামেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মান সম্ভবত দখলদারের ঊর্ধ্বে নয়।
কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদের সেই রাষ্ট্রের রাজধানী দখলের উদ্ভট বাসনা হতে পারে, সেটি জানা ছিল না। অবশ্য, দেশে গৃহযুদ্ধ চললে তখন হয়তো দখল-পুনর্দখলের প্রশ্ন উঠতে পারে। আওয়ামী লীগের ঢাকা দখলের এই ঘোষণাও দেশে গৃহযুদ্ধের কোনো আলামত কিনা সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলবলই ভালো বলতে পারবেন। মহানগর আওয়ামী লীগের ঢাকা দখলের ঘোষণা দেয়ার দিনেই প্রধানমন্ত্রী অন্য একটি অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় ২৯ এবং ৩০ জানুয়ারির বিএনপির গণমিছিলে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও রাজশাহীতে পুলিশের বেপরোয়া গুলিতে পাঁচজন বিএনপি-জামায়াত কর্মী ও সাধারণ ভ্যান চালক নিহত হওয়ায় কোনোরকম দুঃখ প্রকাশের পরিবর্তে উল্টো এই ট্র্যাজেডির জন্য বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ী করেছেন।
বর্তমান সরকার প্রধান ও তার তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীদের অভিমত অনুযায়ী অপশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের যে কোনো ধরনের প্রতিবাদই অপরাধ। হরতাল করলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রোডমার্চ করলে জ্বালানি তেল পোড়ার কারণে জাতীয় সম্পদের অপচয় ঘটে, গণমিছিল করলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়, মানববন্ধন করলে পথচারীদের হাঁটার পথ রুদ্ধ হয়, জনসভা করার জন্য পল্টন ময়দান তো দূরের কথা, মুক্তাঙ্গন পর্যন্ত পাওয়া যাবে না, এরপরও বাংলাদেশ নাকি গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা শাসিত হচ্ছে! আসল কথা হলো, ভয়াবহ অপশাসনের অবধারিত প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীনরা এখন জনগণকে রীতিমত ভয় পেতে শুরু করেছেন। জনগণ যাতে সংঘবদ্ধ হতে না পারে, সে কারণেই বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পুলিশ এবং দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী মাঠে নামিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
অপরদিকে, গণমাধ্যমকেও নানা উপায়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে, যাতে সরকারি দলের অপকর্ম সম্পর্কে দেশবাসীকে অন্ধকারে রাখা যায়। সংবাদ মাধ্যমের ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার ব্যাপারটি অবশ্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সাংবাদিকতার বিষয়ে পর্যবেক্ষণকারী প্যারিসভিত্তিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ তাদের ২০১১ সালের প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় ৩ ধাপ এবং বর্তমান সরকারের ৩ বছরে সর্বমোট ৮ ধাপ পিছিয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ১২১ নম্বর অবস্থান ২০১১ তে নেমেছে ১২৯ নম্বরে। সংগঠনটি তাদের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১১-১২ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অব্যাহতভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমকে আক্রমণ ও বাধাগ্রস্ত করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ তাদের ২০০৮ সালের দিনবদলের ইশতেহারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নিম্নোক্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল;
দিনবদলের সনদ
১৯. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য-প্রবাহ
১৯.১ সকল প্রকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য-প্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা হবে। জাতীয়ভিত্তিক ছাড়াও স্থানীয়ভিত্তিক কমিউনিটি রেডিও চালুর উদ্যোগ নেয়া হবে।
১৯.২ সকল সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার করে প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা এবং সাংবাদিক নির্যাতন, তাদের প্রতি ভয়-ভীতি-হুমকি প্রদর্শন এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে।
১৯.৩ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি, দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে তার বিকাশে সহায়তা প্রদান করা হবে।
সরকারের তিন বছরে জনগণকে ২০০৮ সালে নির্বাচনী প্রচারে প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো গণমাধ্যম সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতিও অবলীলায় ভঙ্গ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ঢাকা দখলের উস্কানিমূলক ঘোষণা একটি গণবিচ্ছিন্ন সরকারের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ রূপেই সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। এই অসাড় হুমকির মাধ্যমেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, অন্তত মানসিকভাবে রাজধানীর ওপর নিয়ন্ত্রণ মহাজোট সরকার হারিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, অর্থনীতির বেহাল দশা এবং নতজানু পররাষ্ট্রনীতি জনগণকে সরকারের প্রতি প্রচণ্ড রকম বিরূপ করে তুলেছে। মইন-ফখরুদ্দীন আমলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যে দিশেহারা জনগণ আওয়ামী লীগের ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ, বিনে পয়সায় সার প্রদান, ইত্যকার অবাস্তব প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত হয়ে দলবেঁধে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য-পণ্যের মূল্য হ্রাস এবং ২০০৮ ও ২০০৯ সালে উপর্যুপরি দেশে ফসল ভালো হওয়ায় মহাজোটের ক্ষমতা লাভের প্রাথমিক পর্যায়ে দেশীয় বাজারে পণ্যমূল্য অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকারের অন্যান্য অপকর্মের দিকে জনগণ তখন পর্যন্ত তেমন একটা দৃষ্টিপাত করেনি। সরকারের প্রথম দু’বছরের অপশাসন, অপচয়, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির ফলে দেশীয় কৃষিপণ্য উত্পাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাজেটে টান পড়তে শুরু করে। দেশের অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনায় সরকারের অমার্জনীয় ব্যর্থতার ফলে তৃতীয় বছরে গিয়ে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক অতিক্রম করলে বিশ্বের সব ফ্যাসিবাদী শাসকের মতোই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সর্বাত্মক নিপীড়নের পথ বেছে নেন, যা দিনে দিনে তীব্র হয়েছে।
শেয়ারবাজারে সরকার প্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লোকজন বাজার কারসাজির মাধ্যমে জনগণকে ১৯৯৬ সালের পর দ্বিতীয়বার সর্বস্বান্ত করায় জনমনে ক্ষোভের পরিমাণ প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে এলে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের পরিবর্তে উপরের নির্দেশে পুলিশি অ্যাকশন আরম্ভ হয়েছে। পুলিশ রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারীদের ধরে থানায় নিয়ে তাদের ওপর থার্ড ডিগ্রি নির্যাতন চালাচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পুঁজি হারানো নাগরিকের আত্মহত্যার মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটলেও অদ্যাবধি নীতিনির্ধারকরা নির্বিকার থাকছেন। তোফায়েল আহমেদের মতো মন্ত্রিত্ব না পাওয়া সরকারি দলের সিনিয়র সদস্যরা সংসদে মাঝেমধ্যে হইচই করলেও তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। সরকার প্রধান এবং অন্যান্য মন্ত্রী চিহ্নিত লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে এখানেও বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রের গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী নিজেও সর্বস্ব হারানো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে সূচকের আর পতন হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তিন বছরে সার্বিক অর্থনীতিরও মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রতি বছর রেকর্ড সৃষ্টিকারী অতিকায় বাজেটের নামে দুর্নীতি ও অপচয়ের মহোত্সব চললেও দেশের কোথাও দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো উন্নয়নের চিহ্ন নেই। রফতানি প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে হ্রাস পেলেও আমদানির বছরওয়ারি বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে, বাণিজ্য ঘাটতি আগের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এদিকে, শেয়ারবাজারের লুণ্ঠিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে লব্ধ মুদ্রা পাচারের যুগল প্রতিক্রিয়ায় টাকার মানের অবমূল্যায়নেরও রেকর্ড গড়তে পেরেছেন অতিকথন প্রিয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী সংগঠন মুজিববাদী দালাল গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় অর্থনীতি একেবারে বেহাল অবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত এতদিন ব্যবসায়ী নেতারাও ঠোঁট সেলাই করে নীরবতা পালন করেছেন। সম্ভবত জনরোষের ভয়ে অতি সম্প্রতি সরকারি দলের চিহ্নিত স্তাবক ব্যবসায়ীরা সেই সেলাই খুলতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সুশীল (?) সমাজের অধিকাংশ আওয়ামীপন্থী হওয়ায় তারাও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আগের সরকারগুলোর আমলের মতো সরব থাকেননি। চতুর্দিক থেকে এত সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থনীতির দুরবস্থার জন্য বিস্ময়করভাবে অর্থনীতিবিদ এবং গণমাধ্যমকে দোষারোপ করে কাঁধ থেকে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে নিজেকে জনগণের কাছে অধিকতর হাস্যস্পদ করে তুলেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ সরকার বিভিন্ন সময়ে হঠকারিতার কারণে এক সময়ের একচেটিয়া পশ্চিমা সমর্থন হারিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ অকাতরে বিসর্জনের বিনিময়ে ক্রমেই ভারতের কোলে আশ্রয় খুঁজেছে।
বাংলাদেশকে নিরাপত্তাহীন করে আমাদের মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর মৃগয়াক্ষেত্র বানানোর কাজটি বর্তমান সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ সালের এই ফেব্রুয়ারি মাসেই বিডিআর বিদ্রোহের আবরণে একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতের আশ্রিত করে ফেলা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো রকম ঘটনাতেই প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার জন্য আঞ্চলিক পরাশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। ক’দিন আগে সেনাসদর আনুষ্ঠানিকভাবে এক রহস্যময় ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের সংবাদ গণমাধ্যমকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লির শাসকশ্রেণী যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যে কোনো বাংলাদেশী নাগরিকের জন্য চরম অবমাননাকর। প্রাথমিকভাবে সেই অভ্যুত্থানকে কথিত ‘ধর্মান্ধ’ গোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালনার অভিযোগ আনা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারঘনিষ্ঠ সামরিক ও বেসামরিক লোকজনই ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমান শাসকশ্রেণীর মধ্যে যে কোনো প্রকার আত্মসম্মানবোধ আর অবশিষ্ট যে নেই, সেটি সৈয়দ আশরাফ, দীপু মনি, গওহর রিজভী, মসিউর রহমানদের বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমেই দেশবাসী বুঝতে পেরেছেন। সীমান্তে আমাদের একজন নাগরিককে উলঙ্গ করে বিএসএফ কর্তৃক ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র দেখে সমগ্র দেশবাসী যখন শিউরে উঠেছে, বিদেশের মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলো নিন্দা প্রকাশ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচার পর্যন্ত দাবি করছে, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ জানাচ্ছেন যে, তার সরকার এই কলঙ্কজনক ঘটনাতেও চিন্তিত নয়। সৈয়দ আশরাফ বিএসএফ-এর অব্যাহত হত্যাযজ্ঞকে তুচ্ছজ্ঞান করে উড়িয়ে দিয়েছেন।
বৃহত্তর সিলেটসহ সম্পূর্ণ মেঘনা বেসিনের জনপদের অধিবাসীরা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলেও আমাদেরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সংসদে আধিপত্যবাদী ভারতের পক্ষ টেনে বলছেন, ওই বাঁধ নাকি আসামের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত হচ্ছে। এতদিন কিন্তু আমরা শুনে এসেছিলাম শুধু জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের উদ্দেশ্যেই ভারত বিশ্বের অন্যতম ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় এই বৃহত্ বাঁধ নির্মাণের আয়োজন করেছে। এ দেশের সাধারণ মানুষের কথা হলো আসামের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যই হোক, কিংবা জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যেই হোক, বরাক নদীতে বাঁধ নির্মাণ হলে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের নাগরিকরাই সর্বতোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অনিষ্ট হলে দীপু মনিদের তো কিছু যায়-আসে না। তারা তো আপাদমস্তক বন্ধক দিয়েই দিল্লির কাছ থেকে নিরাপত্তা লাভ করে বসে আছেন। দেশের জনগণ চূড়ান্তভাবে খেপে উঠলে প্রয়োজনে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্যরা এই দালাল গোষ্ঠীকে নিরাপদ জায়গায় উড়িয়েও হয়তো নিয়ে যাবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে ভিয়েতনামের বাছাই করা দালালদের মার্কিন দূতাবাসের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করার চিত্র স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী পরাজিত হলে ইয়াহিয়ার দালাল মন্ত্রীরা তত্কালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল অর্থাত্ আজকের রূপসী বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিল। সৈয়দ আশরাফ, দীপু মনির মতো করেই আবুল মাল আবদুল মুহিত, গওহর রিজভী এবং মসিউর রহমান গং ভারতকে বিনা শুল্কে করিডোর দেয়ার অতি উত্সাহে সম্পূর্ণ জাতিকে অন্ধকারে রেখে তিতাস নদী ভরাট করে সেই নদীর বুকের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছে। নিহত তিতাস নদী এবং তীরবর্তী মানুষের কান্না তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। সর্ব প্রকার রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের অপরাধে ইনশাআল্লাহ, একদিন এই পঞ্চম বাহিনীকে সদলবলে বিচারের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
আমার ধারণা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের জনসমর্থন হারানোর বিষয়ে সম্যক অবহিত। এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার ফলাফল কী হতে পারে, সে সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন যুগান্তর পত্রিকায় গত সপ্তাহেই ছাপা হয়েছে। সেই সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, পত্রিকা কর্তৃপক্ষের পরিচালিত জনমত জরিপ অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মাত্র ৬৯টি আসনে বিজয়ী হবে। পক্ষান্তরে বিএনপি একাই ১৭০টি আসনে জয়লাভ করবে। যুগান্তরের সম্পাদক মহাজোটের অংশীদার লে. জে. হু. মো. এরশাদের জাতীয় পার্টির মহিলা কোটার একজন সংসদ-সদস্য হওয়ায় পত্রিকাটিকে বিএনপিপন্থী বলার কোনো সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাতেও যে ধস নেমেছে, সেটিও ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার তার নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন সাময়িকী ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের বিষয়ে লিখতে গিয়ে নিবন্ধকার নীল চৌধুরী দেশে গণঅসন্তোষ বৃদ্ধির কথা বলেছেন। তিনি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে পৃথিবীর ‘সর্বনিকৃষ্ট’ আখ্যা দিয়েছেন। নীল চৌধুরীর প্রতিবেদন পাঠ করে আমার শেখ মুজিবুর রহমানের আমলের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ অপবাদের কথা মনে পড়ে গেল। তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ১৯৭৪ সালে ওই নামেই ডেকেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় পিতা এবং কন্যার ‘দক্ষতার’ কী চমত্কার সাদৃশ্য!
লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘দি ইকনোমিস্ট’ কয়েক মাস আগেই তিন কিস্তিতে বাংলাদেশে সুশাসনের চরম অভাবের কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ দেশের বিপর্যয়কর চিত্র এভাবেই একের পর এক উঠে আসার প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জনগণের তহবিলের লাখ লাখ পাউন্ড খরচ করে বিদেশের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের বায়বীয় সাফল্যের কথা প্রচারের ব্যর্থ চেষ্টা করছে। উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে সরকারকে একই কুমিরছানা বারবার দেখানোর মতো করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে তথাকথিত জঙ্গি তত্ত্ব ফেরি করার পাশাপাশি বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানবিষয়ক আষাঢ়ে গল্পও ফাঁদতে হচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সেনা সদরকে ব্যবহার করার মতো আত্মঘাতী কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও দেশ-বিদেশে সরকারের পক্ষে তেমন একটা সমর্থন আদায় করা সম্ভব হয়নি। একমাত্র প্রত্যাশামত দিল্লি থেকে বাংলাদেশের জনগণ ও সেনাবাহিনীকে পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে যে, তারা সর্ব অবস্থায় বশংবদ শেখ হাসিনা সরকারের পাশেই থাকবে। তবে দেশের আশি শতাংশ জনগণ ফ্যাসিবাদী সরকারের জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ালে দিল্লির পক্ষে সেই জনজোয়ারের বিরুদ্ধে গিয়ে মহাজোট সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা কতখানি সম্ভব হবে, সেটি আমরা ভবিষ্যতেই দেখতে পাব।
মহানগর আওয়ামী লীগের ঢাকা দখলের ঘোষণা দেশে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের আগ্রাসনের পটভূমি প্রস্তুতের কৌশল কীনা সে ব্যাপারেও স্বাধীনতাকামী জনগণকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। গত মাসের ২৯ তারিখে বিএনপির পূর্বঘোষিত গণমিছিলের দিনে নগর আওয়ামী লীগ জনসভা ডেকে তাদের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছিল। ওই তারিখে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে পুলিশ গুলি চালিয়ে বিরোধী দলের পাঁচজন নাগরিককে হত্যা এবং ঢাকার গণমিছিল ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করলেও বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রনায়কোচিত আত্মসংযম বজায় রেখেছিলেন। গণমিছিল একদিন পিছিয়ে দিয়ে তিনি কেবল সহিষ্ণুতা ও বিজ্ঞতারই পরিচয় দেননি, রাজনীতির খেলাতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছেন। সরকারের যাবতীয় উস্কানি উপেক্ষা করে আগামী ১২ মার্চ ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পারলে তিনি পুনর্বার রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হবেন। ক্ষমতাসীন মহল মানসিকভাবে এর মধ্যেই পরাজিত হয়েছেন বলে ক্ষমতায় থেকেও নিজ দেশের রাজধানী দখলের উদ্ভট ঘোষণা দিয়ে তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত চেহারাটি জনগণের কাছে দেখিয়ে ফেলেছেন। মহাজোট সরকার সম্ভবত উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, সর্বক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার কারণে তারা রাষ্ট্রশাসনের ন্যায্যতা সর্বতোভাবে হারিয়েছে। মেয়াদের বাকি সময়টা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার নানা রকম কৌশল প্রণয়নে নীতিনির্ধারকদের ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। সুতরাং, আইন প্রতিমন্ত্রী যতই হুঙ্কার ছাড়ুন না কেন, প্রয়োজনের মুহূর্তে আওয়ামী মাঠ কর্মীদের মাঠে খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি। জানুয়ারির ৩০ তারিখে প্রশাসনের যাবতীয় বাধা উপেক্ষা করে বিএনপির গণমিছিলে জনজোয়ার সৃষ্টির বিপরীতে নগর আওয়ামী লীগের সভার দৈন্যদশা দেশের সব গণমাধ্যমে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। সুতরাং, বিরোধ ও সহিংসতা এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সরকারপক্ষের বিরোধী দলের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনায় বসলে কেবল দেশটাই বাঁচবে না, আপনারাও হয়তো রক্ষা পাবেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন