বুধবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই


মাহমুদুর রহমান




বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।
এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।
পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : এক অবরুদ্ধ ‘চান্স’ সম্পাদকের জবানবন্দি


মাহমুদুর রহমান




আমার আকস্মিকভাবে মিডিয়াতে আসা নিয়ে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী সম্পাদককুল এবং জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী কয়েকজন সুবিধাবাদী, মুখচেনা ব্যক্তি। আমার অপরাধ, সাংবাদিকতা পেশায় জীবন শুরু না করে এই শেষ বয়সে এ পথে কেন এলাম। বিষয়টা অনেকটা পাশের বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এ বাড়ির কর্তার কোনো কারণ ছাড়াই চোখ টাটানোর সমতুল্য। ওই ছেলে পরীক্ষা দিলেও পাস করবে না, পাস করলেও চাকরি পাবে না, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না, বেতন পেলেও সেই টাকা বাজারে চলবে না ইত্যাদি।
প্রথমে প্রয়াত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্পাদক আতাউস সামাদের শিক্ষানবিশগিরি এবং পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রূপে চার বছরেরও অধিককাল পার করেছি। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণকালে যে সার্কুলেশন ছিল এই সময়ের মধ্যে তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ১০ লাখের কাছাকাছি ইন্টারনেট হিট এখন ৮০ লাখ ছাড়িয়েছে। অ্যালেক্সা রেটিং এ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও বিশ্বে ১০০ এবং ২০০০০ নম্বর থেকে ডিসেম্বরে ১৭ তারিখে আমার দেশ ৩৯ এবং ১০৬৬২ নম্বরে রয়েছে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ১৬ পাতার পত্রিকার মূল্য প্রায় এক বছর আগে ১০ টাকা নির্ধারণ করা সত্ত্বেও প্রাণের টানে পাঠক সেই বাড়তি দামের বোঝা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছেন। সার্কুলেশন কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েছে।
এই পাঠকশ্রেণী আমাদের স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মূল শক্তি। এদের অনুপ্রেরণা এবং সমর্থনের কারণেই আমার দেশ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা আলোচিত দৈনিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মাত্র চার বছরে নিতান্তই দীনহীন, বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো একটি দৈনিক পত্রিকার ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হওয়াটাকে হয়তো মিডিয়া জগতেরই অনেক রথী-মহারথী মেনে নিতে পারেননি। সুতরাং এই মন্তব্য প্রতিবেদনের লেখককে পত্রিকা সম্পাদক রূপে মেনে নিতে এই অস্বীকৃতির পেছনের কারণ যে অক্ষমের অন্তর্জ্বালা সেটা বুঝে নেয়া কঠিন নয়। এদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই, কেবল একরাশ অনুকম্পা রয়েছে।
সেই পাকিস্তান আমল থেকে অনেকেই আমার মতো করেই পরিণত বয়সে অন্য পেশা থেকে এসে সরাসরি পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে আজ সংবাদপত্র জগতের লিজেন্ড হয়েছেন। তাদের নাম আজও আমরা বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকি। অপরদিকে মালিকানা সূত্রে রাতারাতি সম্পাদক বনে যাওয়ার সংখ্যা এ দেশের পত্রিকা শিল্পে অগুনতি হলেও চিহ্নিত ‘মহামহিম’ সম্পাদককুলের তাতেও কোনো আপত্তি নেই। যত সমস্যা এক মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে। গত বছর আমার জেল মুক্তির পর থেকে এরা মরুভূমির ঝড়ে পতিত উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে কোনোক্রমে আমাকে সহ্য করছিলেন। স্কাইপি কেলেঙ্কারির ঘটনা লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ এবং আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্র তারা স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে টেলিভিশনের পর্দা ফাটাচ্ছেন। সরকারের উন্মত্ত আচরণের পাশাপাশি এই তল্পিবাহকদের হিংসা-বিদ্বেষে কাল হয়ে যাওয়া মুখের নানা রকম অভিব্যক্তি টেলিভিশনে দেখে আমার ছোট্ট অফিস ঘরের অবরুদ্ধ জীবনেও বিমলানন্দ অনুভব করছি। এদের বিপরীতে আমাদের সমর্থনে দেশের প্রবীণতম সম্পাদক-সাংবাদিক এবিএম মূসা এগিয়ে এসেছেন। মূসা ভাই আমার মিডিয়ার শিক্ষক মরহুম আতাউস সামাদেরও শিক্ষক। তাঁর প্রতি আমার দেশ পরিবারের সব সদস্যের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
স্কাইপি কেলেঙ্কারির বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের সব কৃতিত্ব প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্ত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের। এ মাসের ৬ তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম সবাইকে চমকে দিয়ে লন্ডনের বিখ্যাত সাপ্তাহিকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর বিরুদ্ধে এক চাঞ্চল্যকর রুল জারি করেন। সেই রুলে তিনি স্বীকার করে নেন যে, বিচারাধীন মামলা নিয়ে বিচারকার্যে সম্পৃক্ত নন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছেন এবং বিষয়টি ইকোনমিস্টের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে ইকোনমিস্টের একজন সাংবাদিক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে টেলিফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে কতগুলো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে বিচারপতি মহোদয় থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি আদালত অবমাননা নামক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের বর্মের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে এ সংক্রান্ত সংবাদ ইকোনমিস্টে না ছাপানোর নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের বিচারপতিদের হাত দেশের মধ্যে অনেক লম্বা হলেও সেটা যে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছায় না, সেটা বোধহয় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন।
একজন বিচারপতি বিচারাধীন মামলার বিষয়ে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করেছেন, এই তথ্য জনগণকে বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে বিচারাঙ্গনকে নানাভাবে বিতর্কিত করার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও এই অবিশ্বাস্য নতুন নমুনা মেনে নেয়া কোনো বিবেকবান নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বেলজিয়ামবাসী ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং ইউকেবাসী জনৈক রায়হানের কথোপকথনের রেকর্ডকৃত অংশ এবং তাদের মধ্যকার আদান-প্রদানকৃত ই-মেইলের কপি বিদেশ থেকে আমার দেশ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করাকালে ইউ-টিউবেও বিচারপতির স্কাইপি আলাপন ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিষয়টির নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা জনস্বার্থে কথোপকথন হুবহু প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। তবে রিপোর্টে ইকোনমিস্টের মতো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য প্রদান থেকে আমার দেশ বিরত থাকে।
ইকোনমিস্ট সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি আলাদা সম্পাদকের নোট (Editors Note) লিখে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে তাদের যুক্তি পেশ করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সেই নোট থেকে খানিকটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি :
“Normally, we would not publish confidential e-mails and conversations. But there is a compelling public interest. Lives are at stake. So are the court’s reputation .......
We did not solicit the material. We did not pay for it, nor offer any commitment to publish it, we have no reason to suppose that the tapes and e-mails we have seen are fakes, or have been tampered with. The Economist also does not know whether the accused in the trial are innocent or guilty, merely that they are entitled to a presumption of innocence and to an even-handed trial.
(সাধারণত, আমরা গোপনীয় ই-মেইল এবং টেলিফোন আলাপ প্রকাশ করি না। কিন্তু, এখানে গুরুতর জনস্বার্থ জড়িত রয়েছে। জীবন এখানে ঝুঁকির মধ্যে। একইভাবে আদালতের মর্যাদাও ...
নিজ থেকে আমরা তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করিনি। আমরা কোনো অর্থ প্রদান করিনি, কিংবা সংবাদ প্রকাশ করা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও দেইনি। এমন ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই যে, টেপ এবং ই-মেইলগুলো জাল অথবা সেখানে অসত্ উদ্দেশ্যে কোনোরকম পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্ট এটাও জানে না যে অভিযুক্তরা দোষী অথবা নির্দোষ, তবে তাদের বিচারপূর্বক সাময়িক নির্দোষ বিবেচিত হওয়া এবং সঠিক বিচার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে।)
আমার দেশ পত্রিকা এ মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ এই পাঁচদিন স্কাইপি সংলাপ প্রকাশ করেছে। এই সময়ের মধ্যে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমসহ কোনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পত্রিকায় কোনো প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করেননি। এখানে কোনো মিথ্যা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, এ জাতীয় দাবি কোনো মহল থেকে অদ্যাবধি শোনা যায়নি। কিংবা সংবাদ না ছাপানোর নির্দেশ দিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রুলও জারি করা হয়নি। বরঞ্চ, ট্রাইব্যুনাল-১ এর দ্বিতীয় সিনিয়র বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন আমার দেশ-এর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে বলেছেন, পত্রিকার কাজ হচ্ছে লেখা, আমার দেশ তাই করেছে। অনৈতিক ও বেআইনি আচরণের দায় মাথায় নিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান পদ থেকে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও লাজ-লজ্জাহীন সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং আওয়ামীপন্থী মিডিয়া স্কাইপি সংলাপ লেখার আগে ‘কথিত’ শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন।
সরকারের লেজুড়ধারী টক-শো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বিভিন্ন টক-শো’তে অবলীলাক্রমে দাবি করছেন যে ইকোনমিস্টে স্কাইপি সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহা অপরাধ করে ফেলেছে। নির্জলা মিথ্যাচারেরও একটা সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সেই সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করেছে। সে সব মহাপণ্ডিতরা অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। আরে বাবা, ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে যাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে তার কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রক্ষে ছিল? সংবাদ ধামাচাপা দিতে প্রতিবেদক এবং সম্পাদককে হয়তো গুম করে ফেলা হতো। অথবা সাগর-রুনির ভাগ্যবরণ করতে হতো। তাছাড়া সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলাই তো বিচারপতির ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ লংঘন। এদিকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে প্রায় প্রতিদিন এত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে যে জনগণের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
হাইকোর্টে সাধারণত যে কোনো মামলায় একটি বেঞ্চ কোনো রুল, নির্দেশ অথবা অভিমত দিলে অন্য বেঞ্চ সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। বাদী অথবা বিবাদী ওই মামলা নিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চে গেলে তাদের প্রথম বেঞ্চে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। স্কাইপি স্ক্যান্ডালের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটার অ্যাডভোকেট হায়দার আলী ১০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকার নাম উল্লেখপূর্বক বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল-১ এর নজরে আনেন। বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আদেশ দেয়ার জন্য ১১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। ওইদিন বিচারপতি নাসিম এবং প্রসিকিউটার হায়দার আলী ট্রাইব্যুনালে যাওয়া থেকে বিরত থাকলে আর আদেশ প্রদান সম্ভব হয়নি। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন যে, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান এবং প্রসিকিউটর আদালতে ফিরলে আদেশ প্রদান করা হবে। কিন্তু, ওই দিনই বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করায় সেই প্রক্রিয়াও ঝুলে যায়।
১৩ তারিখে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত একই বিষয় ট্রাইব্যুনাল-২ এ উত্থাপন করলে বিচারপতিগণ স্কাইপি সংলাপ বাংলাদেশের কোনো মিডিয়ায় আর প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক আদেশ প্রদানকালে একই বিষয়ে প্রথম আবেদনটি ট্রাইব্যুনাল-১ এ অনিষ্পন্ন অবস্থায় ছিল। এরপর একই দিনে সরকার ছুটে যায় হাইকোর্টের চরম বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে। আদালতের রীতিনীতি অনুযায়ী তিনি আমার বিষয়ে কোনো আবেদন শুনতে পারেন না, কারণ দুর্নীতি এবং বিচারপতির কোড অব কনডাক্ট (Code of Conduct) ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য আমার আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পত্র সংখ্যা ০১.০০.০০০০.০০১১.৩২.০০১.১২-৩১৭ তারিখ ০৮ নভেম্বর ২০১২-এর মাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
আদালতের নিয়ম-কানুনের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোর্টের দিনের নির্ধারিত সময় পার করে আমার বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। সেদিন সন্ধ্যায় আদালতে তার আচরণও বিচারকসুলভ ছিল না। বরঞ্চ, আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিরাগ, বিদ্বেষ এবং ক্ষোভ তার প্রতিটি কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বিচারপতি মানিকের রুলকে ভিত্তি করে সে রাতেই সিএমএম আদালতে বায়বীয় দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী (CRPC) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমতি (Sanction) ব্যতীত এ ধরনের মামলা দায়ের সম্পূর্ণ বেআইনি হলেও আমার ক্ষেত্রে আদালতে সেটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এখানেই শেষ নয়। ১৭ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ স্বত:প্রণোদিত হয়ে একই বিষয়ে আরও একটি অভিমত (Observation) দেন। বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে উচ্চ আদালতের তিনটি পৃথক সমমানের বেঞ্চ থেকে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন আদেশের এই ঘটনা অভূতপূর্ব। ছোটবেলায় শোনা এক জোকের কথা মনে পড়ে গেল। ছাত্র শিক্ষককে প্রশ্ন করল, স্যার Pillar লিখতে কয়টা L (এল) লাগে? জবাবে শিক্ষক বললেন, ‘একটা দিলেও হয়, তয় দুইটা দিলে পোক্ত হয়।’ আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অতি-উত্সাহে দেখা যাচ্ছে আদালত পোক্ততর করতে গোটা চারেক L-এর ব্যবস্থা করেছেন।
অপর একটি বিতর্কের বিষয় উত্থাপন করছি। স্কাইপি কেলেঙ্কারির কাহিনী ছাপা হওয়ার পর থেকে সরকার সমর্থক গোষ্ঠী কেবল একটি প্রশ্নের অবতারণা করে চলেছেন। তাদের কথা হলো, হ্যাকিং অথবা গোপন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ সত্য হলেও মিডিয়ায় প্রকাশ করা নাকি অনৈতিক। দি ইকোনমিস্ট তার সম্পাদকের নোটে এই সমালোচনার যথাযথ জবাব দিয়েছে বলে আমি এই ইস্যুতে নতুন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার প্রশ্ন হলো, একজন বিচারপতি কি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে গোপনে শলা-পরামর্শ চালিয়ে যেতে পারেন? বিচারপতি নাসিমই তো ইকোনমিস্টের সাংবাদিককে বলেছেন যে, তিনি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গেও আলোচনা করেন না। তাহলে কি ধরে নেব ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে তার স্ত্রীর চেয়েও আপন? অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা যায় না বলেও প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে জ্ঞান দিচ্ছেন।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ১৭ ঘণ্টার স্কাইপি কথোপকথনে এবং শত শত ই-মেইলে ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তার আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলাপ করেছেন। এমনকি আগাম রায় লিখে দেয়ারও আবদার করেছেন। রায় প্রদানের বিনিময়ে পদোন্নতি প্রাপ্তি নিয়ে আপিল বিভাগের জনৈক বিচারপতির সঙ্গে আলোচনার চরম নিন্দনীয় উদাহরণও প্রকাশিত স্কাইপি আলাপে রয়েছে। সুতরাং, ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও তার বিদেশে অবস্থানরত বন্ধুদের যোগসাজশে। সেই অপরাধের কথা প্রকাশ করে গণমাধ্যম বরঞ্চ প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন অভিমত প্রদানকালে সম্ভবত এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন।
সর্বশেষ, আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে পাঠককে কিছু তথ্য দেয়া আবশ্যক বিবেচনা করছি। ১৩ তারিখ রাতে সিএমএম আদালতে মামলা দায়ের থেকে এই লেখাটা ১৯ তারিখ রাতে ছাপা হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা অফিসেই অবস্থান করছি। সকালে পাঠকের হাতে পত্রিকা পৌঁছানো পর্যন্ত এখানেই থাকব, নাকি পুলিশ হেফাজতে—সেটা আল্লাহ্ জানেন। সেদিন টক-শোতে এক আওয়ামী সম্পাদক আমার পত্রিকা অফিসে থাকা নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনলাম। আমার পত্রিকা অফিসে আমি রাত্রিযাপন করব, তাতে পঞ্চাশ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার জন্য আত্মগর্বে ফুলে থাকা সম্পাদক কেন বা কোন অধিকারে কূপিত হলেন, সেটা বুঝতে পারলাম না। অবশ্য, আওয়ামী লীগারদের কাছে যুক্তির কথা বলে কোনো ফায়দা নেই।
এক সরকারপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে (Scroll) লেখা দেখলাম, মাহমুদুর রহমান গ্রেফতার এড়াতে আমার দেশ অফিসে অবস্থান করছেন। এতদিন জানতাম গ্রেফতার এড়াতে লোকজন পলাতক থাকে। আওয়ামীপন্থী মিডিয়ার কাছ থেকে জানা গেল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পত্রিকা অফিসে অবস্থান করলেও নাকি গ্রেফতার এড়ানো যায়। এই আমাকেই ২০১০ সালের ১ জুন মধ্যরাতে শত শত রায়ট পুলিশ পাঠিয়ে একটা সাধারণ ডাইরির (General Diary) ভিত্তিতে শেখ হাসিনার সরকার একই পত্রিকা অফিস থেকে গ্রেফতার করেছিল। সেটা বোধহয় ওই টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা ভুলে গেছেন!
এদের নিরেট মাথায় হয়তো ঢুকছে না যে, আমার এবারের লড়াই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাধারণ জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার অথবা আদালত কর্তৃক মিডিয়ার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করার উদ্যোগ দলমত নির্বিশেষে সব মিডিয়া কর্মীর ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা তাদের স্বার্থেই প্রয়োজন। কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে আজ গণমাধ্যমের যে অংশ আমার দেশ’র বিরুদ্ধে কুত্সা রটনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হলে তারাও একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। তখন কিন্তু আজকের এইসব কথা তাদের বেমালুম গিলে ফেলতে হবে।
তবে সমস্যা হলো, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পাপের সব রেকর্ড মুছে ফেলা আগের মতো আর সম্ভব নাও হতে পারে। হাওয়া ভবনের অনুগ্রহপ্রাপ্ত সম্পাদককুল আজ যখন আমাকে জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা করেন, তখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে ওঠে। দেশবাসীকে একটি ভরসার কথা বলে অবরুদ্ধ সম্পাদকের জবানবন্দী সমাপ্ত করব। মিডিয়ায় যারা মাহমুদুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলন্ত দেখার আশায় ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করছেন, ক্ষমতার পট পরিবর্তনসাপেক্ষে তারা আমার মতো তখনকার সরকারের অন্যায় আচরণের শিকার হলে আমার দেশ তাদের রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। নীতির দুর্ভিক্ষের এই দেশেও সব সরকারের আমলে নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে এই পরিবারের প্রতিটি সংবাদকর্মী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
ইমেইল- admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই

মাহমুদুর রহমান
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অক্টোবরে আমাদের দুই প্রবল ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সফর করে দেশে ফিরেছেন। অন্য বিষয়াদির মতোই বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর চরিত্রে লক্ষণীয় ভিন্নতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবরই বিদেশে বেড়াতে বিশেষ পছন্দ করেন। তার সকল নিকট-জনেরাও সপরিবারে প্রবাসী। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারে দুর্নীতির ব্যাপকতা নিয়ে চারদিকে গুঞ্জন ওঠার প্রেক্ষিতে কয়েক মাস আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের সংজ্ঞা দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন। সেই সংজ্ঞায় তিনি ছাড়া তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং উভয়ের পুত্র-কন্যাগণকেবল প্রধান-মন্ত্রীর পরিবারভুক্ত। পুত্রবধূ অথবা কন্যা-জামাতা এবং পৌত্র-পৌত্রীদের এই সংজ্ঞায় স্থান কোথায়, সে বিষয়ে শেখ হাসিনা অবশ্য কিছু বলেননি। যাই হোক, এরা সবাই আমেরিকা, কানাডা ও ব্রিটেনের বাসিন্দা। পদ্মা সেতু দুর্নীতির দেশে-বিদেশে তদন্তের প্রেক্ষিতে তিন দেশের মধ্যে সম্প্রতি কানাডা নিয়েই মিডিয়া ও জনগণের ঔত্সুক্য বিশেষভাবে বেড়েছে। সুতরাং, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণপ্রীতির পেছনে ন্যায্য কারণ রয়েছে। অপরদিকে আগের ইতিহাসে দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া স্বদেশে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাঁচ বছরের সরকারি দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি, তিনি নিজে যেমন বিদেশে যেতে চান না, একইভাবে মন্ত্রী-আমলাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতাকেও যথেষ্ট অপছন্দ করেন। রাজনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত কারণে বিরোধীদলীয় নেত্রীর দুই পুত্র বিগত চার বছরেরও অধিককাল বিদেশে থাকলেও তিনি কিন্তু পরিবার থেকে দূরে থাকার যাতনা সয়ে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া দশ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে প্রায় নয় বছর পার করেছেন এবং এবারের মেয়াদ পূর্ণ করে তিনিও বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের রেকর্ড ধরে ফেলবেন বলেই সকলের ধারণা। মাঝখানের দুই বছরের মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময়টুকু বাদ দিলে দুই নেত্রী দুই দশক ধরে পালাক্রমে সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় প্রধান হয়েছেন। এই সময়ের বিদেশ ভ্রমণের তালিকা প্রণয়ন করলে একজনের বিদেশ ভ্রমণপ্রীতি এবং অপরজনের বিদেশ যেতে অনীহার চিত্রটি জনগণের কাছে পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠবে। ক্ষমতাবানদের বেড়ানোর গল্প রেখে এবার রাজনীতির গুরু-গম্ভীর আলোচনায় আসি।
বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হতে সংবিধান অনুসারে এখনও এক বছরেরও কিছু অধিক সময় বাকি আছে। জনগণ গভীর আশঙ্কা নিয়ে আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশব্যাপী এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির তাবত্ ‘কৃতিত্ব’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। উভয়ে মিলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বাতিল না করলে এই অনভিপ্রেত অস্বস্তির সৃষ্টি হতো না। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল না হলেও পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হচ্ছেন, সেটা নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে ২০০৬ সালের মতো একটা টানাপড়েন যে থাকতো, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ অপরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকই আজ সেই পদের দাবিদার হতেন। ২০০৬ সালে বিচারপতি কেএম হাসানকে সত্তরের দশকে তার সঙ্গে বিএনপির কথিত সাংগঠনিক সম্পর্ক এবং কর্নেল রশীদের সঙ্গে আত্মীয়তার কারণে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেনি।
তদুপরি ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার কর্তৃক বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স ২ (দুই) বছর বৃদ্ধি করার বিষয়টিকে তত্কালীন বিরোধী দল সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখেছে। কিন্তু একজন বিচারপতি হিসেবে কেএম হাসান প্রজ্ঞা, নিরপেক্ষতা, সততা এবং আইনের গভীর জ্ঞানের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত আচরণ সর্বদাই বিচারপতিসুলভ ছিল। দীর্ঘ জজিয়তি জীবনে তিনি যে সকল রায় লিখেছেন, সেগুলো নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। অপরদিকে বিচারপতি খায়রুল হক আদালতপাড়ায় একজন চরম দলবাজ বিচারপতি হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতি তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বিষয়টি সম্পর্কেও দেশবাসী অবহিত। কাজেই বিচারপতি খায়রুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া বিএনপি’র পক্ষে সঙ্গত কারণেই সম্ভব হতো না। মনে রাখা দরকার, এই ধরনের জটিলতা থেকে উত্তরণের পন্থা ত্রয়োদশ সংশোধনীতেই দেয়া ছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন পদ্ধতি সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ, ৫৮গ (৫)-এ বলা ছিল—
“যদি আপীল বিভাগের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে পাওয়া না যায় অথবা তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অসম্মত হন, তাহা হইলে, রাষ্ট্রপতি, যতদূর সম্ভব, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনাক্রমে, বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক এই অনুচ্ছেদের অধীনে উপদেষ্টা হইবার যোগ্য তাহাদের মধ্য হইতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করিবেন।”
এক-এগারোর সরকার গঠনের সময় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই শুধু সামরিক জান্তার নির্দেশে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তার এই পদক্ষেপ সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন হলেও সে সময় সুশীল (?) সমাজভুক্ত আইনজীবীকুল এবং শেখ হাসিনাসহ মহাজোট নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। যাই হোক, দেশের বর্তমান বিবদমান পরিস্থিতিতে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটি রাজনৈতিক সংঘাত থেকে হয়তো জনগণকে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু একতরফাভাবে প্রায় অকার্যকর, একদলীয় সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান পদে নিযুক্তির সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবর্তে প্রধান দুই দল এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন পরিচালনা এবং আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত।
বিগত চার বছরে বিএনপি বিভিন্ন ইস্যুতে থেমে থেমে আন্দোলনের হুঙ্কার দিলেও তেমন কোনো সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেনি। বরং আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থকও হয়তো স্বীকার করবেন যে, ১৯৯১-পরবর্তী বাংলাদেশের বিগত চারটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মেয়াদকালে রাজপথের আন্দোলনের বিবেচনায় এবারই কোনো সরকার তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছে। এখন পর্যন্ত জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাপন হরণকারী রাজনৈতিক কর্মসূচি হরতাল দেয়াতে বিএনপি’র নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পরিষ্কার অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। বিএনপিবিরোধীরা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে অবশ্যই দাবি করতে পারেন যে, বিরোধী দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সরকারের কঠোর পুলিশি ব্যবস্থার কারণেই দেশের রাজনীতি শান্তিপূর্ণ থেকেছে।
যে কারণেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই উত্তরণ ঘটে থাকুক না কেন, বাস্তবতা হলো মহাজোট সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ চার বছর সময় পেয়েও চরম দলীয়করণ, নজিরবিহীন দুর্নীতি ও তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের বিদেশি মুরব্বি গোষ্ঠীও বাংলাদেশে জনমতের পরিবর্তন সঠিকভাবে আন্দাজ করতে পেরে তাদের কৌশলেও পরিবর্তন এনেছে। তাদের সেই পরিবর্তনে এদেশের শাসকগোষ্ঠীও যে বিচলিত হয়ে পড়ছে, সেটাও বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে নেতৃবৃন্দের অকূটনৈতিক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনে পরাজয়-পরবর্তী অবধারিত জনরোষ থেকে রক্ষা পেতেই ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার আয়োজন করছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে এই সর্বনাশা খেলা থেকে তাদের অবশ্যই নিবৃত্ত হওয়া উচিত। ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের ফলাফল হৃদয়বিদারক হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে দুই দফায় একতরফা নির্বাচন করলেও কোনো বারই সংসদের মেয়াদ দুই বছরের বেশি টেকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাকে গণধিকৃত হয়ে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযুক্তির জন্যই করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই স্বল্পকালীন সংসদের মেয়াদও তাই ত্রয়োদশ সংশোধনী গ্রহণের সঙ্গেই সমাপ্ত হয়েছিল।
২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন প্রচেষ্টার বিপজ্জনক পথ ধরেই জেনারেল মইন-মাসুদ গং ক্ষমতা দখল করেছিল। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে তারাও আজকের মহাজোটের মতোই নব্বই দিনের মেয়াদের কথা ভুলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল। বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজ তত্কালীন অসাংবিধানিক সরকারকে শুধু সমর্থনই জানায়নি, ‘মাইনাস টু’ বাস্তবায়নে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। সে সময় ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা : প্রচারণা ও বাস্তবতা’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম। ২০০৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত কলামের এক জায়গায় শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে লিখেছিলাম— “বাস্তবতা হলো, এই দুই নেত্রী মিলে দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরূপে বাংলাদেশ পরিচালনা করেছেন এবং কারাবন্দী অবস্থাতেও এই দু’জনই বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারার রাজনীতির অবিসংবাদিত নেত্রীর স্থানটি ধরে রেখেছেন। বর্তমান নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ হয়তো এমন ধারণা পোষণ করেন যে, জননন্দিত নেতা চাইলেই পাওয়া যায় অথবা হওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এতটা সহজ হলে তথাকথিত মাইনাস টু কৌশল এতদিনে বাস্তবায়ন হয়ে যেত।”
২০০৮ সালের মাঝামাঝি দুই নেত্রী সংসদ এলাকার সাবজেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তবে দুই মুক্তিতে অনেক ফারাক ছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্কালীন সামরিক জান্তার সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের বন্দোবস্ত সমাপ্তি সাপেক্ষেই জেলের বাইরে পা রেখেছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরুদ্ধ সেই অশুভ আঁতাত নিয়ে তখন লিখেছিলাম, ‘আঁতাতকারীরা ক্ষমতার পিঠা ভাগে মত্ত।’ ওই বছর জুলাইয়ের ১৭ তারিখে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত সেই লেখায় আমার মন্তব্য ছিল—
“বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর মাখামাখি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। শেখ হাসিনা কারামুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে এখন বিশ্বভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের একপ্রস্থ সংলাপ নাটকও সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক-এগারোর অন্যতম রূপকার ও প্রচ্ছন্নের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির প্রশংসায় ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন। অপরদিকে এই সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে।”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যান্য মন্ত্রীর জাতিকে এক-এগারোর ভয় দেখানোর প্রেক্ষিতেই পাঠকদের পুরনো কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। তাদের স্মরণে রাখা আবশ্যক, এক-এগারো আওয়ামী লীগ ও সুশীল (?) গোষ্ঠীর যৌথ প্রকল্প ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সেই এক-এগারোর আঁতাতেরই ফসল। এটাই প্রকৃত ইতিহাস। সুতরাং, এক-এগারো সম্পর্কে সমালোচনার নৈতিক অধিকার বাংলাদেশের আর যে নাগরিকই হোক, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাখেন না। ফখরুদ্দীন আহমদের শপথ গ্রহণের দিনে বঙ্গভবনে দলবলসহ তার সহর্ষ উপস্থিতি এবং সেই সরকারের ‘সকল কর্মকাণ্ডের’ আগাম বৈধতা প্রদানের ঘোষণার কথা ভুলো বাঙালি মুসলমান বোধহয় এখনও পুরোপুরি ভুলে যায়নি।
তাছাড়া সেই ক্যু দেতা’র অন্যতম নায়ক লে. জে. (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী চাকরিতে একের পর এক মেয়াদ বৃদ্ধির রেকর্ড সৃষ্টি করে আজ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাকে এই নজিরবিহীন পুরস্কার প্রদানের পেছনে যে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের ব্যাপারটি ক্রিয়াশীল রয়েছে, সেটি দেশের সকল সচেতন নাগরিকই বুঝতে পারেন। এক-এগারোর সরকার দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর মইন-মাসুদকে লক্ষ্য করে যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, তার যে দুই সাবেক জেনারেলের কেশাগ্র স্পর্শ করারও ক্ষমতা নেই, এটা সম্ভবত তিনিও জানেন। তবু চেঁচামেচি করে গায়ের ঝাল যদি কিছুটা কমানো যায় আর কী!
বেগম খালেদা জিয়ার সদ্যসমাপ্ত ভারত সফরের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সহসাই জোর নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করবে বলেই মনে হচ্ছে। সংবিধানের বর্তমান অবস্থায় দশম সংসদ নির্বাচন আগামী বছর অক্টোবরের ২৫ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির ২৪-এর মধ্যবর্তী যে কোনো দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সাবেক প্রধান বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে আবার কমপক্ষে ৪২ দিনের নির্বাচন প্রস্তুতির একটা নির্দেশনা দিয়েছেন। রায়ের ওই অংশটি বিবেচনায় নিলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৮ সালেও ওই মাসেই নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাসে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খানিকটা অতিরিক্ত উদ্দীপনা বিরাজ করে। দীর্ঘ তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাও নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এগিয়ে থাকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চয়ই বিবেচনায় নেবেন। সব মিলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে।
গণআকাঙ্ক্ষা মান্য করে তিনি একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। ১৯৯৬ সালের বিএনপির মতো বর্তমান সংসদে মহাজোটের সংসদ সদস্যের সংখ্যা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সে সময় সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে ১৫ ফেব্রুয়ারির অজনপ্রিয় নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় শেষ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী সংবিধানে যে কোনো সংশোধনী আনার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দলের রয়েছে। তার সরকারের মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত তিনি আইনগতভাবে বৈধ এবং নৈতিকভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
কিন্তু মেয়াদ শেষে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেখ হাসিনা যদি দশম সংসদের একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করতেও পারেন, তাহলেও তাকে আর বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশে-বিদেশে কেউ মেনে নেবে না। সেক্ষেত্রে কেবল পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করেই তাকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের ৪১ বছরের ইতিহাসে সকল অত্যাচারী শাসকের ভয়ানক পরিণতি ঘটেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবেও বর্তমান সরকার ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। শেষ ভরসা ভারতীয় দুর্গতেও বেগম খালেদা জিয়া জোরেশোরে হানা দিয়েছেন। সুতরাং কেবল এক ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে ২০০৮-এর মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে একসঙ্গে পাশে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। এমতাবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের যে কোনো মূল্যে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার ফ্যাসিবাদী চিন্তাই বরং আবারও অসাংবিধানিক শক্তির ক্ষমতা দখলের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমগ্র জাতিকেই শেষ পর্যন্ত এ ধরনের বোধবুদ্ধিহীন দুঃসাহসিকতার মূল্য চুকাতে হয়। মইন-মাসুদ গংয়ের তুঘলকি রাজত্ব-পরবর্তী পাঁচ বছরে সেনাবাহিনী এবং বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত অথবা দুর্বল হয়েছে। দলগুলোর সংকীর্ণ ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা বাংলাদেশকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর পরমুখাপেক্ষী করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের স্বার্থে স্বাধীনতাকামী জনগণের ঐক্য প্রয়োজন। গণতন্ত্রের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে অন্তত জাতীয় ইস্যুতে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হলে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন অপরিহার্য। আশা করি, শেখ হাসিনা উপলব্ধি করবেন, অসাংবিধানিক সরকারের আগমনী পথ প্রশস্ত করার চাইতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা গ্রহণ করাও অধিকতর নিরাপদ ও সম্মানজনক। ২০০৮ সালে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর মাত্র চার বছরের ব্যবধানে জনসমর্থনের বিচারে বেগম খালেদা জিয়ার অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানো থেকে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : বল্গাহীন দুর্নীতি ও ম্রিয়মাণ টিআইবি



মাহমুদুর রহমান
২০০৯ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সহকর্মী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এম. আবদুল্লাহ্ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু কাগজপত্র হাতে খানিকটা উত্তেজিত হয়েই আমার অফিস কক্ষে এলেন। কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখলাম, পাঁচ মিলিয়ন ডলার (৪১ কোটি টাকা) ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলার মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। অভিযোগের তীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের মন্তব্যসহ আমি সংবাদটি ছাপার অনুমতি দিলাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তখন দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের মধুচন্দ্রিমার উষ্ণতা তখনও পুরোপুরি শীতল হয়নি। বেশ ক’জন সহকর্মী সংবাদটি ছাপানোর বিপদ সম্পর্কে আমাকে সাবধান করেছিলেন। সত্য কথা বলা এবং লেখায় কারও সাবধানবাণীতে কর্ণপাত করা বরাবরই আমার স্বভাববিরুদ্ধ। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে মহাজোট আমলের প্রথম দুর্নীতি সংক্রান্ত সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হলো। খবর ছাপা হওয়া মাত্র মৌচাকে ঢিল পড়ল। জেলায় জেলায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং কুশপুত্তলিকা দাহের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো। আগে জানতাম, মানহানির মামলা কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরাই করতে পারেন এবং সেটাও একটিমাত্র মামলাই। ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের জামানায় আমার জানাটা ভুল প্রমাণিত হতে সময় লাগল না। একে একে একই অভিযোগে ছাব্বিশটি মামলা দায়েরের বিশ্ব রেকর্ড তৈরি হলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লিখিত নির্দেশে প্রশাসনের তাবত্ অংশ একসঙ্গে আমাকে জন্মের মতো শিক্ষা দেয়ার অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পরের ইতিহাস দেশবাসী জানেন।
আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ এবং আমাকে জেলে পুরে সরকার এদেশে দুর্নীতিবিরোধী সব কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিল। প্রশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরাও আমাকে নজিরবিহীনভাবে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন আমার করুণ পরিণতি দেখার পর বাংলাদেশের আর কোনো নাগরিক অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হবে না। কিন্তু, তারা ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে গিয়েছিলেন। সরকারের সাড়ে তিন বছর অন্তে আজ দেখা যাচ্ছে, আমি জেল খেটেছি বটে, তবে মহাজোট সরকারের যাবতীয় অপকর্মের কেচ্ছা সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে আলোচনার খোরাকে পরিণত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে অবশ্য মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের অর্থ নির্বিচারে লুণ্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়লেও বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই কেবল রাজস্ব ব্যয় মেটানোর জন্যই দেশ-বিদেশে ভিক্ষাপাত্র হাতে অর্থমন্ত্রীকে ঘুরে বেড়াতে হবে। ভবিষ্যত্ উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নের হাল পদ্মা সেতুর অবস্থা থেকেই সবার বোঝা উচিত।
অনেক টানাপড়েনের পর গত শনিবার দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতু অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করতে বলা চলে একরকম বাধ্যই হয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি তদন্তে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে কানাডীয় পুলিশ সেদেশের বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের অফিসে অভিযান চালিয়ে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতির বিষয়ে সম্যক অবহিত করেছিল। সরকার বা বিশ্বব্যাংক কোনো পক্ষই সেই দুর্নীতিতে বাংলাদেশের কারা কারা জড়িত সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত সরাসরি মুখ না খুললেও বিভিন্ন সূত্র থেকে শোনা যাচ্ছিল, কেবল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনই নন, ঘুষ দাবি অথবা লেনদেন প্রক্রিয়ায় সরকারের আরও ওপরের ক্ষমতাশালীরাও জড়িত। ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরামর্শক নিয়োগে মোটামুটি দশ শতাংশ ঘুষের নাকি রফা হয়েছিল। ঘুষের এই হারকে ক্ষমতাসীনদের স্ট্যান্ডার্ড ধরে হিসেব কষলে এক পদ্মা সেতু থেকেই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
বিএনপির দুর্নীতিবাজদের মতো আওয়ামী লীগ যে ছিটেফোঁটায় সন্তুষ্ট হয় না, সেটা এবারের সাড়ে তিন বছরের মেয়াদে তারা বহু ঘটনায় জনগণের কাছে প্রমাণ দিয়েছে। মাশাল্লাহ্ গলার জোরও যে আওয়ামী নেতাদের অনেক বেশি, সে বিষয়টি বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রতিদিনই টেলিভিশনে দেখাচ্ছেন। বিএনপি আমলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন গ্যাস কোম্পানি নাইকো’র কাছ থেকে কেবল একটি গাড়ি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ব্যবহারের জন্য নিয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। এর বাইরে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অপ্রমাণিত অভিযোগ হলো, বিদেশ ভ্রমণকালে ওই কানাডীয় কোম্পানির কাছ থেকেই তিনি নাকি মাত্র ৫ হাজার ডলার (চার লাখ টাকা) রাহা খরচ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এতেই দুদকের লাফালাফি দেখে কে!
অপরদিকে সুরঞ্জিত বাবুর এপিএস রাতদুপুরে ঘুষের ৭০ লাখ টাকা (দুষ্ট লোকে বলে টাকার প্রকৃত অংক কয়েক কোটি) মন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার সময় গাড়ি চালকের সাহসিকতায় বমাল ধরা পড়লেও এককালের বাম নেতা এখনও জনগণের টাকায় মন্ত্রীর ফ্ল্যাগ উড়িয়ে চলেছেন। দুই কান কাটাদের আধিক্যের ফলেই রাজনীতির আজ এই হতশ্রী দশা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সুপুত্র মাত্র ষাট হাজার টাকা নিজের পুঁজি নিয়ে (!) নগদ পাঁচ কোটি টাকায় টেলিকম লাইসেন্স নিয়েছেন। মন্ত্রীপুত্রের দাবি, লোকজন তাকে নাকি শুধু ভালোবেসে এই বিপুল অংকের অর্থ ঋণ দিয়েছে। সরকারের লেজুড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ ‘স্বাধীন’ দুদক সুরঞ্জিতপুত্রের সেই ভালোবাসার দাবি মেনে নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রীকে সচ্চরিত্রের সার্টিফিকেট দেয়ার আয়োজনও প্রায় সম্পন্ন করেছে। একই দুদক অবশ্য এর আগে পদ্মা সেতু ইস্যুতেই মন্ত্রী আবুল হোসেনকেও সততার সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমার পরিচিত এক অধ্যাপক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের দুদককে ‘আওয়ামী লীগের ধোপা’ নামকরণ করেছেন। ক্ষমতাসীন দলটির মন্ত্রী-এমপিদের গায়ে লেগে থাকা দুর্নীতির কালিমাগুলো পরিষ্কার করে তাদের সাদা করে দেয়াই নাকি প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান কাজ। অধ্যাপক মহোদয়ের রসবোধে আমি চমত্কৃত হয়েছি।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা দিয়ে বিশ্বব্যাংক যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে, তার মর্মার্থ অর্থাত্ ইংরেজিতে যাকে between the line meaning বলা হয়ে থাকে সেটি বুঝতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ ভেবে যে কোনো নাগরিক আতঙ্কিত বোধ করবেন। সেই বিবৃতি থেকে কয়েকটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি :
* The world bank has credible evidence corroborated by a variety of sources which points to a high level corruption conspiracy...
(বিশ্বব্যাংকের কাছে কয়েকটি উত্স দ্বারা সমর্থিত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে ...)
* The world bank provided evidence from two investigations to the Prime minister, as well as the minister of Finance and the Chairman of the Anti Corruption Commission of Bangladesh (ACC) in September 2011 and April 2012.
(বিশ্বব্যাংক দুটি ভিন্ন তদন্তের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সেপ্টেম্বর ২০১১ এবং এপ্রিল ২০১২ তারিখে হস্তান্তর করে)
* In an effort to go the extra mile, we sent a high level team to Dhaka to fully explain the Bank’s position and receive the Government’s response. The response has been unsatisfactory.
(বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত ছাড় হিসেবে এক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল ব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা এবং সরকারের জবাব পাওয়ার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সরকারের জবাব সন্তোষজনক হয়নি।)
* The World Bank cannot, should not, and will not turn a blind eye to evidence of corruption. We have both an ethical obligation and fiduciary responsibility to our shareholders and IDA donor countries.
(দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাংক চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না, থাকা উচিত নয় এবং থাকবে না। আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং ব্যাংকের অংশীদার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর কাছে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।)
বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে এ দেশের শাসকগোষ্ঠীর ওপর মহলের হাত রয়েছে এবং প্রায় এক বছর আগেই দুর্নীতির প্রমাণাদি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কাজেই পদ্মা চুক্তি অর্থায়ন বাতিলের দায় দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গসহ এই তিন ব্যক্তি এড়াতে পারেন না। এখন মুখরক্ষার জন্য সরকার বায়বীয় মালয়েশীয় বিনিয়োগ নিয়ে মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। মালয়শিয়ার প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য প্রচণ্ড ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিকে ধোঁকা দেয়ার জন্য দাবি করছেন যে, বিশ্বব্যাংক ঋণের চেয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে মালয়েশীয় অর্থায়ন নাকি সাশ্রয়ী হবে। বাণীর রাজা নামে খ্যাত এই মন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণকে সম্ভবত একেবারেই মূর্খ ও নির্বোধ বিবেচনা করেন। বিশ্বব্যাংকের যে কোনো ঋণে সর্বোচ্চ সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ এবং সচরাচর ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। একমাত্র সরাসরি অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে এর চেয়ে সুলভে ঋণ পাওয়ার অন্য কোনো উপায় আমার অন্তত জানা নেই। তথাকথিত মালয়েশীয় বিনিয়োগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে দেশের সব অর্থনীতিবিদই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ওদের শর্ত মেনে নিলে পদ্মা সেতুর ব্যয় তিন থেকে চার গুণ বৃদ্ধি পাবে। এতদিন সততার ডঙ্কা বাজিয়ে ওবায়দুল কাদের অবশেষে স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন।
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদকারী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পদ্মা সেতু ইস্যুতে সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা এক তাত্ক্ষণিক বিবৃতিতে শাসকগোষ্ঠীর বল্গাহীন দুর্নীতির সমালোচনার পরিবর্তে বিশ্বব্যাংককেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থায়ন বন্ধ করে সরকার ও দেশের মানুষকে কষ্ট দেয়ার অধিকার বিশ্বব্যাংকের নেই। টিআইবি পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই টিআইবিই গত বছর তাদের এক প্রতিবেদনে বিচার বিভাগকে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের ‘মর্যাদা’ দান করেছিল। সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের লোকজন দিয়ে দুর্নীতি তদন্তের দাবির চেয়ে স্ববিরোধী প্রস্তাব আর কী হতে পারে?
আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা? মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিচার বিভাগের যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগে রাজনৈতিক দলীয়করণ এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে বিরোধী দলের লোকজন কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের সুবিচার প্রাপ্তির আর কোনো পরিবেশ অবশিষ্ট নেই। এহেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের পরিণাম স্বাধীন দুদকের তদন্তের চাইতে ভিন্নতর কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝখান থেকে মন্ত্রী আবুল হোসেনের ফুলের মতো চরিত্রের আরও একটি সনদপ্রাপ্তির সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। দেশের অধিকাংশ নাগরিক যখন সরকারের দুর্নীতির বহরে লজ্জায় অধোবদন, সেই সময় বিভ্রান্তিকর সব প্রস্তাব উত্থাপন করে টিআইবি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অবশ্য টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ড সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাদের বিবৃতি অথবা দুর্নীতিপরায়ণ মহাজোট সরকারের ত্রাতার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামানের অবতীর্ণ হওয়ার পেছনের কারণ বুঝে ফেলা শক্ত নয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বর্তমান চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল চক্রবর্তী আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই সারাদেশে সুপরিচিত। তিনি ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের পছন্দের ব্যক্তিরূপে ড. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই সরকার থেকে পদত্যাগকারী চারজন উপদেষ্টার অন্যতম ছিলেন সুলতানা কামাল চক্রবর্তী। সেই পদত্যাগের পথ ধরেই এক এগারোর সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের আর একজন প্রভাবশালী সদস্যের নাম অ্যাডভোকেট তৌফিক নেওয়াজ। বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট আইনজীবীর আরও একটি পরিচয় হলো, তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনির স্বামী। আপন স্ত্রী যে সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেই সরকারের দুর্নীতির বিষয়ে তার ভূমিকা কী হতে পারে সেটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। একই ট্রাস্টি বোর্ডে আছেন সাবেক চিফ ইলেকশন কমিশনার ড. শামসুল হুদা। ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনের এই প্রধান ব্যক্তি মইনউদ্দিন জামানায় বিএনপিকে বিভক্ত করার ‘মহত্’ কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। সাবেক এই আমলা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনকালে চারদলীয় জোট সরকারের প্রতি গণমাধ্যমের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তার মেধার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করেনি। এহেন একজন দলবাজ টিআইবিতে থেকে যে আওয়ামী লীগের স্বার্থের পক্ষেই প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করবেন, সেটা বুঝতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। টিআইবি’র বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি জেনারেল, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের আওয়ামী লীগ প্রীতির ব্যাপারটিও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মোটামুটি জানা রয়েছে। এই ক’জন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডে অন্য যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের মধ্যেও আওয়ামীপন্থীদের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতো। সুতরাং বিএনপি সরকারের সময় টিআইবি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতখানি আদর্শিক ও নৈতিক অবস্থান প্রদর্শন করেছিল, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সেটি তাদের কাছে আশা করাটাই বোকামি। তাছাড়া স্মরণে রাখা দরকার, টিআইবিতে এখনও ড. মোজাফফর আহমেদের মতো ব্যক্তির শূন্যতা পূরণ হয়নি।
বাংলাদেশের সুশীল (?) সমাজের এক বিরাট গোষ্ঠীর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণেই এদেশে সিভিল সোসাইটি মুভমেন্ট পাশ্চাত্যের মতো বিকশিত হতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুশীল (?) সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালালেও এই কারণেই আজ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা দেশের সাধারণ নাগরিকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। পদ্মা সেতু দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি’র এবারের বিতর্কিত অবস্থান কেবল সুশীল (?) সমাজকেই যে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করবে তাই নয়, এদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকেও দুর্বল করে ফেলবে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে যদি টিআইবি’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সমস্যা হয়, তাহলে সবিনয়ে অন্তত তাদেরকে নীরব থাকতেই অনুরোধ জানাব। মহাজোট সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের অপশাসনকালে টিআইবিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগের তুলনায় নিষ্ক্রিয় ঠেকেছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদের বাকি দেড় বছরও তারা একটি দীর্ঘ শীতকালীন নিদ্রা (যরনবত্হধঃরড়হ) দিলে সবারই মঙ্গল হবে। বাংলাদেশের সচেতন দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী দুর্নীতিপরায়ণ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ে টিআইবি মার্কা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ছাড়াই ইন্শাআল্লাহ বিজয় লাভ করবে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : দুর্নীতিসহায়ক অপচয়ের বাজেট



মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনপূর্ব ইশতেহারে মন্ত্রিসভার সব সদস্যের সম্পদের বিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে জনগণকে জানানোর অঙ্গীকার করেছিল। মন্ত্রীর আসনে বসার আগে সেই হিসাব জনগণকে দিয়ে প্রতি বছর তার হ্রাস-বৃদ্ধি প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি সে সময় জনগণকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উত্সাহিতও করেছিল। সরকারের সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত প্রায়। দেশের কোনো নাগরিক আজ পর্যন্ত মন্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেনি। কথিত দিনবদলের সনদে প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো সম্পদের হিসাব দেয়ার প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করতে কোনোরকম লজ্জাবোধ করেনি ক্ষমতাসীন মহল। উল্টো মন্ত্রীদের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।
এরা এতটাই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে যে, ঘুষের টাকা বমাল ধরা পড়ার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখনও মন্ত্রী পদে রয়েছেন, দিলীপ বড়ুয়া সাড়ে তিন বছরে ছয় ছয়টি সরকারি প্লট বাগানোর পরও দাবি করছেন, প্রভাব খাটালে তিনি নাকি এতদিনে বারোটি প্লটের মালিক হতে পারতেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক দুর্নীতিবাজ সরকারের সব কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে মন্তব্য প্রতিবেদনের নির্ধারিত জায়গা শেষ হয়ে যাবে, বাজেট নিয়ে আর লেখার সুযোগ হবে না। কাজেই ওই চেষ্টা অন্য কোনো দিনের জন্য রেখে দিয়ে আজ বাজেটের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
এবারের বাজেট পরিষ্কারভাবে দুর্নীতিকে উত্সাহিত করার জন্যই প্রণীত হয়েছে। গত তিন বাজেটে সরকার কালো টাকা নিয়ে নানারকম টালবাহানা করার পর শেষপর্যন্ত বিশেষ কয়েকটি খাতে সেই টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছিল। এবার অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার পূর্বপর্যন্ত এ প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থেকে তাদের এবারের শাসনামলে কালোটাকা সাদা করার সবচেয়ে ঢালাও সুযোগটি এ বছরের বাজেটে করে দিয়েছেন। আগের মতো বিশেষ খাত-টাতের আর বালাই রাখেননি। দশ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে যে কোনো পরিমাণ অর্থ প্রায় সব খাতেই বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন। জনগণের পক্ষে এই ‘বদান্যতার’ কারণ বোঝা কঠিন নয়। আগামী বছর জুনে সরকারের সাড়ে চার বছর অতিক্রান্ত হবে। সেই সময়ের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, দলীয় পাণ্ডা নির্বিশেষে যারাই অবৈধ অর্থের মালিক হবেন, তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যেই বাজেটে এই আয়োজন রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তাছাড়া পরবর্তী নির্বাচনের খরচ জোগানো এবং ডজন খানেক নতুন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধন দেখাতেও পর্বতপ্রমাণ কালো টাকার প্রয়োজন পড়বে। অতএব ঢালাও দুর্নীতি জায়েজ না করে উপায় নেই। অথচ বিরোধী দলে থাকার সময় কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার থেকেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি বলতেন, লুটপাট জায়েজ করার জন্যই বিএনপি বাজেটে এই সুযোগটি রেখে দেয়। সেসব কথা প্রধানমন্ত্রীর হয়তো এখন মনেই পড়ে না। বোকা জনগণের হাতে কাঁচকলা ধরিয়ে তাদের মাথায় মুন্সিয়ানার সঙ্গে কাঁঠাল ভেঙে চলেছেন মহাজোটের কর্তাব্যক্তিরা। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের কিছু ব্যক্তি নেহাতই চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করেছে, এরা একেবারে ডাকাতি করে ছাড়লো। আগামী এক বছরে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ পেয়ে সরকারঘনিষ্ঠরা অতিকায় বাজেট থেকে যে লুটপাটের নিত্যনতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবেন, সেটি সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তার আগের আমলে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রথম তিন বছর চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখতে পারলেও পরের দুই বছরে সেটি আমাদের হাতছাড়া হয়। প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে, এই মেয়াদেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই হারানো চ্যাম্পিয়নশিপ পুনরুদ্ধার করে তবেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তার সরকারের প্রতি আগাম অভিনন্দন রইল।
এবার অপচয়ের আলোচনায় আসি। রাজস্ব খাত অর্থাত্ অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় দিয়ে শুরু করা যাক। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এই খাতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৩৮০৭০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেই খরচ বৃদ্ধি পেয়ে ১০৪২৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৬৭৩৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো ৭ বছরে দেশের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৮৬৬৮ কোটি টাকা অথবা ২.৬ গুণ। একই হিসাব আরেক রকম করেও দেখানো যেতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার-পরবর্তী ৭ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করি সব অর্থনীতিবিদই স্বীকার করবেন, অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি দেশের জাতীয় আয়ে (জিডিপি) কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান তো রাখেই না; বরং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। সে কারণেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বর্তমান অর্থবছরে দুই অংকের (১০.৯৯) মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কাছাকাছি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও জনগণের জীবনযাত্রার মান বর্তমানের মতো নিচে নেমে যেত না, যদি রাজস্ব ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের মাথাপিছু আয়ও প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেত। জনগণের নিট আয় না বেড়ে কেবল রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির অর্থই হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বব্যাপী অপচয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি রাষ্ট্রে প্রতি বছর এত উচ্চ হারে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার শামিল। মহাজোট সরকার তাদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে অপচয় যে বাড়ছে, তার আরও একটি প্রমাণ হলো শতকরা হিসাবে উন্নয়ন বাজেটের ক্রমাবনতি।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে এডিপির পরিমাণ ছিল অনুন্নয়ন খাতে ব্যয়ের ৫১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয়ের বিপরীতে এডিপির অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। উন্নয়ন বাজেট এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ভারসাম্যহীনতার ফলেই জিডিপি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ০.৩৯ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ০.৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগের ধারাবাহিক চিত্র আরও ভয়াবহ। জেনারেল মইনউদ্দিন ও ড. ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকার যে অর্থবছরে বিদায় নিয়েছিল, সে বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ১৯.৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র জিডিপির ১৯.০ শতাংশ। অর্থাত্ বর্তমান সরকারের আমলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অব্যাহতভাবে নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে এবং সাড়ে তিন বছরে জিডিপি’র ০.৭ শতাংশ কমেছে। বর্তমান অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগেও একই রকম ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মে মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত কাহিনী মনে পড়লো। ২০১০ সালে বন্দী অবস্থায় আমার রিমান্ড চলাকালীন টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে একজন প্রশ্নকর্তা বলেছিল, আমার বিরুদ্ধে নাকি বিনিয়োগ বোর্ডে নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জবাবে আমি বলেছিলাম, প্রথম কথা অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আর দ্বিতীয়ত বিনিয়োগ হ্রাস পেলে যদি নির্বাহী চেয়ারম্যানকে টিএফআই সেলে ধরে এনে নির্যাতন করার রীতি চালু হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তিই এই দায়িত্বটি আর নিতে চাইবেন না। জানি না ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে আমার মতো করে বিনিয়োগ বোর্ডের বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যানকেও টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে কি-না।
বাজেট বিষয়ে লিখিত আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন ভর্তুকি, বাজেট ঘাটতি, জাতীয় সঞ্চয় এবং রফতানির অবস্থা বর্ণনা করে শেষ করব। বিএনপি আমলের শেষ বছর (২০০৫-০৬) বাজেটে মোট ভর্তুকি ও চলতি স্থানান্তর খাতে অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১১০৭৩ কোটি টাকা। আর সেই একই খাতে বর্তমান অর্থবছরে সরকার ৩৪৬৪২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ছয় বছরে তিন গুণেরও অধিক ভর্তুকি দেয়ার ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে অব্যাহত রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার এই যে অপচয়ের মহোত্সবের সূচনা করেছে, তার ফলে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়বে। ভর্তুকির মতো বাজেট ঘাটতিতেও সরকার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে একটি রাষ্ট্রে বাজেট ঘাটতি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদের আগে এই ঘাটতি সর্বদাই ৫ শতাংশের অনেক নিচে অবস্থান করেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে প্রাক্কলিত ঘাটতি ৪৫২০২ কোটি টাকা অতিক্রম করে প্রকৃত ব্যয় ৪৬৩২৪ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট দেশজ উত্পাদনের ৫.১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫২০৫৮ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত দেশজ উত্পাদনের ৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরকে বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বছর বলা চলে। কারণ সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনী (পঞ্চদশ সংশোধনী) অনুযায়ী আগামী সাধারণ নির্বাচন ২৫ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ মধ্যবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি, সরকারের শেষ বছরেই ক্ষমতাসীনরা সর্বাধিক লুটপাটে ব্যস্ত থাকবে। সেই লুটপাটে সহায়তা করার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগও রেখেছেন। সুতরাং, অধিক হারে দুর্নীতিজনিত ঘাটতি যে এবারও প্রাক্কলিত বরাদ্দকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার সংক্ষেপে রফতানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যাক। এ বছর মার্চ থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসে রফতানিতে ধারাবাহিক পতনের ধারা অব্যাহত আছে। গত অর্থবছরে রফতানিতে রেকর্ড ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬.৭-এ উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল। এ বছর প্রথম এগারো মাসে সেই রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থবছরের সর্বশেষ মাস অর্থাত্ জুনের রফতানি হিসাব পাওয়া গেলে বছর শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী বর্তমান অর্থবছরে ৪৪টি পণ্যের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দীর্ঘায়িত হওয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের রফতানি খাতে। তদুপরি বিদ্যুত্সহ অন্যান্য অবকাঠামোজনিত দুর্বলতা শিল্প খাতে উত্পাদন সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা কাটার কোনোরকম আশু সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলে আগামী অর্থবছরেও রফতানি খাতে সুসময় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। রফতানি হ্রাস পেলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশের জিডিপিও নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে।
আজকের সর্বশেষ আলোচনা জাতীয় সঞ্চয় নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরে (২০০৭-০৮) জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ৩০.২ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে সেই সঞ্চয় ২৯.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাত্ গত চার বছরে আমাদের জাতীয় সঞ্চয় ০.৮ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে দিনবদলের সরকার। একদিকে ভর্তুকি এবং বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি এবং অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার অর্থই হলো সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিজনিত অপচয় দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর অন্তে শেখ হাসিনার সরকার যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নরূপ :
১. জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
২. জাতীয় সঞ্চয় বিপজ্জনক হারে কমেছে;
৩. বেসরকারি খাতে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে;
৪. রফতানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
৫. বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ অতিক্রম করায় আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে;
৬. ভর্তুকি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে;
৭. সুশাসন নির্বাসনে; এবং
৮. প্রশাসনে সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার ধারণা, দেশের দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করবেন, তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা এনেছিলেন। বাজেট ঘাটতি এবং ভর্তুকির বিষয়ে তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজেও সমর্থন করতেন। ফলে মন্ত্রিসভায় সহকর্মীদের চাপকে সাইফুর রহমান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণ জাতীয় আয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে শুরু করেছিল। ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে বিএনপির সর্বশেষ বছর ২০০৫-০৬ পর্যন্ত জিডিপি টানা ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে থেকে মূল্যস্ফীতি এক অংকে ৩ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে জিডিপিতে তুলনামূলক বৃদ্ধি না হলেও মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে দুই অংক অতিক্রম করেছে। ফলে জনগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি খাতে তাদের জীবনযাপনের ব্যয়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে। লোডশেডিং না কমলেও এক বিদ্যুত্ বিলেই ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ২০০ শতাংশের অধিক। তুলনামূলকভাবে কম মূল্যের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ডিম ও ডালের মূল্য বেড়েছে যথাক্রমে ৩০০ ও ২০০ শতাংশ। বাড়িভাড়া, যানবাহনের খরচ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির ফলে নির্ধারিত আয়ের জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য মন্ত্রী, সরকারি দলের এমপি এবং মহাজোটের নেতাকর্মীদের রাতারাতি আয় বৃদ্ধি আলাদিনের চেরাগ দ্বারা প্রাপ্ত সম্পদকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মহাজোটের নব্য সম্পদশালীদের কাহিনী প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যকার ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ’ এবং ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ সম্পর্কে কী প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি :
১.১ দ্রব্যমূল্য : দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মত আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা : দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।
আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার যে আসমান-জমিন ফারাক, সে বিষয়ে অধিক লেখার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের যে নজির বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে, জনগণের কাছে তার জবাবদিহি করার সময় আগতপ্রায়। ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল বিধায় যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করেই বলছি, কোনো দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী শাসকের পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে গণআকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ইনশাআল্লাহ্ এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : আগ্রাসী দলীয়করণের অশুভ পরিণতি



মাহমুদুর রহমান
দিন বদলের সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে বিতর্কিত করতে সক্ষম হয়েছে। দলবাজ প্রশাসন নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, গত সপ্তাহে পুলিশের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে আমি নিজেও লিখেছি। আজ বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যকার সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত বাদানুবাদের মধ্যেই আমার মন্তব্য-প্রতিবেদন সীমিত রাখব। এই আমলের বিচার বিভাগের সঙ্গে আমার বৈরী সম্পর্কের কথা শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাও অবগত আছেন। আদালতে সরকারি দলের নজিরবিহীন দলীয়করণের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ‘অপরাধে’ আমি আদালত অবমাননার দুটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলও খেটে এসেছি। সরকার ও বিচার বিভাগের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত হলেও আমার জন্য সন্তোষের বিষয় হলো, যে কথাগুলো আমি আড়াই বছর আগে লিখেছিলাম, সেগুলোই আজ দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। আদালত শুদ্ধিকরণের লড়াইয়ে তখন একাকী হলেও আজ মনে হচ্ছে, আমি আর নিঃসঙ্গ নই। কোটারি সর্বস্ব বাংলাদেশে আমরা যার যার সুবিধামত ইতিহাস তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সুবিধাবাদীদের ইতিহাস তৈরি প্রসঙ্গে এক-এগারোর সরকারের সময়কালীন একটা উদাহরণ দিয়ে আজকের মূল বিষয়ে ফিরব।
এক-এগারো সরকারের একেবারে প্রথমদিকের সমালোচনাকারীদের মধ্যে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্যু দেতার প্রথম দিনে ওই সরকারের গঠন প্রণালী এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিবিসিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রথম যে বিবৃতিটি ছাপা হয়েছিল, সেটিরও এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন সামাদ ভাই। সেই সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকারের মুখোশ উন্মোচনের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছিলাম আমি এবং কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ঔরসে জন্মলাভকারী সরকারটি ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, আর আমি সেই সরকারের সমালোচনা করে প্রথম কলামটি লিখেছিলাম একই মাসের ২৭ জানুয়ারি। ‘অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার বিপদ সংকেত’ শিরোনামে লেখা কলামের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি;
“তবে দেশের ভালো চাইলে, অর্থনীতির উন্নয়ন চাইলে, যত তাড়াতাড়ি জনগণের নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, ততই মঙ্গল। স্বদেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের চেয়ে উত্তম এবং বৈধ কোনো সরকারব্যবস্থা এ যাবত আবিষ্কার হয়নি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই আমরা দ্রুততার সঙ্গে সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবো। আশির দশকের এক পতিত, দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসককে সব দল মিলে মহা তারকারূপে পুনর্বাসিত করে সেই অগ্রস্ত্যযাত্রার প্রথম পদক্ষেপটা আমরা বোধহয় নিয়েই ফেলেছি।”
গণতন্ত্রের সপক্ষে আমার কলম ধরার মুহূর্তে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদরা হয় গা-ঢাকা দিয়েছেন, নয়তো বোবার শত্রু নাই নীতি গ্রহণ করে আত্মরক্ষার চেষ্টায় রত ছিলেন। সেই কঠিন সময়ে দেশের তাবত্ বুদ্ধিজীবীকুল এবং সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ওই একই কলামে এক-এগারোর সরকার যে আইনসিদ্ধ নয়, সেই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলাম—‘বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এ নিশ্চয়তা বোধ হয় কেউ দিতে চাইবেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল প্রজ্ঞাপন এবং সেই বাতিল করা নির্বাচনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ১৭ জন সংসদ সদস্য সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ ভবিষ্যতে উত্থাপিত হবে না।’ উল্লিখিত কলামটি কাশবন প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘জাতির পিতা ও অন্যান্য’তে সঙ্কলিত হয়েছে। লেখালেখির বাইরে টেলিভিশন টকশো’তে দেশবাসীকে বিশেষ সরকারের স্বরূপ চেনানোর বিপজ্জনক দায়িত্ব নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং সাবেক সচিব মো. আসাফউদ্দৌলাহ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। আমিও দুই-একটি চ্যানেল থেকে কখনও সখনও ডাক পেলে ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করতাম। টেলিভিশনে আমার কালো তালিকাভুক্তির সূচনাও তখনই ঘটে। আর এই আমলে তো কোনো চ্যানেলে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে সেই চ্যানেল বন্ধের সরাসরি হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে। আজকাল টক শো’তে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক-এগারো সরকারের বিরোধিতা করার অসত্য দাবি করে থাকেন, তাদের অধিকাংশই তখন হয় নীরব থেকেছেন অথবা সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। ইতিহাস বিকৃতি সম্ভবত আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। একইভাবে বিচার বিভাগ আজ চারদিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক ব্যক্তিই হয়তো দাবি করবেন যে তারাই মামলার ঝুঁকি নিয়েও আদালত পাড়ার অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। হাওয়া বুঝে পাল খাটানোতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির অভাব এ দেশে কোনোদিনই হয়নি। তবে এক্ষেত্রে জেল খাটা আসামি হওয়ার কারণে আমার অন্তত খানিকটা অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। ধারণা করছি, আমার দুটি আদালত অবমাননা মামলার সব নথিপত্র এবং রায় ডিএলআর (DLR)-এ স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং, ইচ্ছে থাকলেও অন্য কারও পক্ষে সেই ইতিহাসে ভাগ বসানো সম্ভব হবে না।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। বর্তমান সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতে রেকর্ড সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। সেসব নিয়োগের পেছনেও মূলত দলীয় বিবেচনাই কাজ করেছে। এই বিচারপতিদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত বিশেষ একজনকে নরসিংদীর জেলা জজ থেকে কয়েক ডজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজে পদোন্নতি দিয়ে পরে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া খুনের মামলার আসামি এবং সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীও বিচারপতি হয়েছেন। বাদবাকি নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অতীতে সরকারদলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের ইতোপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশনার কোনোরকম তোয়াক্কা বর্তমান সরকার করেনি। গত সাড়ে তিন বছরে আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও নির্বিচারে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। আদালতকে অপব্যবহার করে ভিন্নমত দলনের এক চরম নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে দিন বদলের সরকার। হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন নিয়েও আদালত পাড়ায় নানারকম বিতর্ক রয়েছে। সিনিয়র বিচারপতিদের সমন্বয়ে রিট বেঞ্চ গঠন না করে দলীয় বিবেচনায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এক সময় উচ্চ আদালতে অধিক সংখ্যায় বিব্রত হওয়ার নজিরের সঙ্গে হাল আমলে বিভক্ত রায়ের রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে পর্যন্ত হত্যা করার ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য আজ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকেও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লন্ডনে টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে পুলিশের এত বড় নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। একই বিচারপতি মো. আসাফউদ্দৌলাহ, সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং শফিক রেহমানসহ দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের তার এজলাসে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য প্রণীত আচরণবিধিও তিনি প্রতি পদে লঙ্ঘন করেছেন। প্রধান বিচারপতি এই অসঙ্গত আচরণের রাশ টেনে ধরার কোনোরকম চেষ্টা করেননি। অবশেষে সংসদের সঙ্গে আদালতের অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ সৃষ্টিতেও একই বিচারপতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন।
সরকারের অতিমাত্রায় দলীয়করণের নীতি এবং আদালত নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি অবধারিত ছিল। এই আশঙ্কা থেকেই ২০১০ সালের ১০ মে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছিলাম—
“একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্য এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ, সর্বত্র অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে অন্যায়-অবিচারের ভয়াবহ বিস্তৃতি এক সময় দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন ক্যালদীয়রা পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছিল, সেই সময়ের নবী যেরেমিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতির সঞ্চিত পাপ সমস্ত জাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় (অভিশপ্ত নগরী, সত্যেন সেন)।”
এই লেখালিখিতে সংশ্লিষ্টদের সংবিত্ ফেরার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আমাকে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে সুপ্রিমকোর্ট ভবিষ্যতের সব সমালোচকের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ৫ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের তার বিরুদ্ধে দল বেঁধে সমালোচনা আমার উপরিউক্ত লেখার যৌক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নতুন করে প্রমাণ করেছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বোধ করছি।
দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাও সংসদ এবং আদালতের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রের এই দুই স্তম্ভের মধ্যকার তিক্ততা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়বে। তারা দুই পক্ষের মন্তব্যকেই অনভিপ্রেত উল্লেখ করে ব্যাপারটির আশু সমাধান কামনা করেছেন। আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়েই সংসদের ওপর আদালতের এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছে। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন অবশ্য বলেছেন, দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদই সুপিরিয়র। যে ব্রিটিশ সিস্টেমের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, সেখানেও সংসদের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সে কারণে যুক্তরাজ্যে সব বিষয়কে আদালতে টেনে নেয়ার রেওয়াজ নেই। আদালতও Justiciability (আদালতের এখতিয়ার)-এর আলোকে সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়টি তাদের বিচারিক আওতার মধ্যে পড়ে। সাধারণত সংসদ দ্বারা প্রণীত আইন বিষয়ে তারা বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম মানবাধিকার বিষয়ক পর্যালোচনা। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে Human Rights Act প্রণীত হওয়ার পর থেকে আদালত কোনো আইন পর্যালোচনা করে যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ওই আইনের কোনো অংশ Human Rights Act, 1998-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাহলেই কেবল ওই অংশ সংশোধনের জন্য আইনটি সংসদে ফেরত পাঠানো হয়। এর বাইরে অবশ্য Judicial review (বিচারিক পর্যালোচনা) করার রেওয়াজ রয়েছে। আইন নিয়ে পড়াশোনা না করলেও আইন সংক্রান্ত কিছু বই-পত্র উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছে। সংসদে গৃহীত পঞ্চম, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালত কর্তৃক যেভাবে বাংলাদেশে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, আমার ধারণা, তার তুল্য নজির যুক্তরাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে প্রণীত আইনের উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড রিড (Lord Reid) তার এক রায়ে বলেছেন :
“In earlier times many learned lawyers seem to have believed that an Act of Parliament could be disregarded in so far as it was contrary to the law of God or law of nature or natural justice, but since the supremacy of Parliament was finally demonstrated by the revolution of 1688 any such idea has become obsolete.”
(অতীতে অনেক আইনজীবীর মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে, সংসদে প্রণীত আইন উপেক্ষণীয় হতে পারে যদি সেটি স্রষ্টার আইন কিংবা প্রকৃতির আইন অথবা স্বাভাবিক আইনের পরিপন্থী হয়; কিন্তু ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে এ জাতীয় ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে।)
বাংলাদেশে এর আগে কখনও বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়নি। আগের বিচারপতিরা সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে আচরণবিধি সুচারুরূপে পালন করার কারণে সমাজের সব অংশের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধাভাজন থাকতেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কথায় কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে নেয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এক বাদী পবিত্র কোরআন শরীফ পর্যন্ত সংশোধনের আবদার নিয়ে রিট বেঞ্চে হাজির হওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অধঃপতনের দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকেই সর্বতোভাবে বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রাথমিক কাজটি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন (Impeach) করার ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংবিধানের বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী অভিশংসনের জন্য একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে Supreme Judicial Council গঠনের নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ৯৬(৩) ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া নিম্নোক্তভাবে নির্দেশিত হয়েছে :
‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে কাউন্সিল বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুই জন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে।’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিচার বিভাগই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে রায় দিয়ে দেশে অনভিপ্রেত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালে প্রকৃতপক্ষে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান আদৌ আদালতের এখতিয়ারের (Justiciable) মধ্যে পড়ে কি-না, এই প্রশ্ন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যেই রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে জনগণ অবশ্যই সে প্রশ্নের জবাব খুঁজবে। ইতিহাস রচনার দায়িত্ব যে ইতিহাসবিদদের কাছেই থাকা উচিত, আমার এই মন্তব্যের সঙ্গে আশা করি দেশের অধিকাংশ নাগরিকই সহমত পোষণ করবেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে উপলক্ষ করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আবারও সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছেন। তবে হুমকি বাস্তবায়নের ক্ষমতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ক্ষমতাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে ঢাকায় ও লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের তথাকথিত রাজ পরিবারের সদস্যদের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি আদালত পাড়ায় বহুল প্রচারিত। সুতরাং, পুরো বিতর্কটি ধামাচাপা পড়লে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না। এদিকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে আনার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসনের (Impeachment)-এর ক্ষমতা সংসদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সেই সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারাটি পূর্ববত্ রেখে দিয়েছেন। অর্থাত্ রায় লেখার সময় তিনি বিচার বিভাগের কোটারি সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়ে যেহেতু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, কাজেই ভবিষ্যতে এই লক্ষ্যে আবারও সংবিধান সংশোধনের দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।
৪১ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকশ্রেণী জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সংবিধানকে কেবল নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে যার যার সুবিধামত ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সাড়ে তিন বছরে এই গর্হিত কাজটি এতটাই নগ্নভাবে করা হয়েছে যে, জনগণের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কেই এক ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সংবিধানে বারবার কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে এবার দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নই সম্ভবত ষোল কোটি মানুষের মুক্তির পথ হতে পারে। ১৯৭২ সালে যে সংসদ সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, সেই সংসদের সব সদস্য ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসনাধীন লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক (Legal Frame work)-এর অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্রীয় (MNA) ও প্রাদেশিক (MPA) সংসদের সব সদস্যকে একত্রিত করে বাংলাদেশের গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠিত হয়েছিল। নির্বাচিতদের মধ্যে পাকিস্তানের কয়েকজন দালালকে কেবল গণপরিষদের বাইরে রাখা হয়েছিল। এ সবই ইতিহাসের অংশ। কাজেই চার দশকের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের গণআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবার দ্বিতীয় সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া উচিত। নতুন সংবিধান প্রণয়নে সমাজের সব শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করলে সেই দলিলে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করা যায়। এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদসহ দেশের সব বিজ্ঞজন ভেবে দেখতে পারেন।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ



মাহমুদুর রহমান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দীর্ঘদিন মেঠো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে এবং একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন মাঠকর্মী হিসেবে প্রবীণ বয়সে এমপি হওয়াটাই তার জন্য পরম গৌরবের বিষয় ছিল। কিন্তু বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকায় তিনি প্রথম সুযোগেই কেবল ফুল মন্ত্রী নন, মহাশক্তিধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও দখল করতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি-নৈতিকতা শিকেয় তুলে অতিমাত্রায় দল এবং দলীয় প্রধানের প্রতি অনুগত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
সাহারা খাতুন তার বিভিন্ন বক্তব্যে প্রসঙ্গ থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনে এনে তার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের বয়ান দেন, সেটার কারণও জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতে আমজনতার হয়তো তেমন কোনো সমস্যাও হতো না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হাতে পেয়ে তিনি প্রজাতন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে যে নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং দলীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন, সেখানেই যত সমস্যা। গত সাড়ে তিন বছরে তার কণ্ঠে ‘আমার পুলিশ’ কথাটি যে কতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার হিসাব রাখাই কঠিন।
পুলিশ যে প্রজাতন্ত্রের, সাহারা খাতুনের নয়—এটা বোঝানোর মতো কেউ সম্ভবত তার পাশে নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, তদীয় কন্যা শেখ হাসিনা এবং সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনীতিবিদ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো করে রাষ্ট্রকে একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি বিবেচনা করেননি। একজন মন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয়কে পৈতৃক অথবা দলীয় জমিদারি ভাবতে শুরু করেন, তখনই সুশাসনের বারোটা বেজে যায়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আইন ও মানবাধিকারের প্রতি যে চূড়ান্ত অবজ্ঞা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার প্রধান দায়-দায়িত্ব তাই বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই বহন করতে হবে।
সাহারা খাতুনের পুলিশ গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যে অমার্জনীয় কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্তসার এবার প্রস্তুত করা যাক। গত মাসের ২৬ তারিখে রোকেয়া সরণিতে পলিটেকনিকের ছাত্রীদের অবরোধের ছবি তোলার সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিককে বেধড়ক লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পেটানোর সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার চিত্কার করে বলেছে, পেটা সাংবাদিকদের, ওরাই যত নষ্টের গোড়া, এদেশে সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। পুলিশ কর্মকর্তার দাবির পেছনে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, ঘরে ঢুকে সাংবাদিক খুন করলে যে দেশে কিছু হয় না, সেখানে যত্সামান্য পিটুনি তো নস্যি! একই মাসের ২৯ তারিখে পুরনো ঢাকার আদালতপাড়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে পুলিশ ক্লাবে ধরে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে আওয়ামী-বাকশালী পুলিশ। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন তিন সাংবাদিক, দুই আইনজীবীসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারী জনতা। আহত তিন সাংবাদিক যথাক্রমে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে কর্মরত আছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য নির্যাতিত তরুণীকেই উল্টো কোতোয়ালি থানায় ধরে নিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অতি ঘনিষ্ঠ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী খবর পেয়ে থানায় ছুটে না গেলে তরুণীটির কপালে আরও দুঃখ ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের সামনেই কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনের উদ্ধত ব্যবহারের খানিকটা নমুনা আমরা টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছি। কোতোয়ালি থানার এই ওসির সঙ্গে আমার রিমান্ড চলাকালীন সাক্ষাত্ হয়েছিল।
‘পবিত্র ভূমি’ গোপালগঞ্জের অধিবাসী পুলিশ কর্মকর্তাটি আমাকে সারা রাত থানা গারদে জনা পনেরো মাদকাসক্ত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেই অসহনীয় পরিবেশে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালে এক গ্লাস পানি পানেরও প্রবৃত্তি হয়নি। মিনিট তিরিশের কথাবার্তায় আমার কাছে ওসি সালাহউদ্দিনকে পুলিশের পোশাকে ছাত্রলীগের একজন পাণ্ডার মতোই লেগেছিল। সে বার বার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিল, গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার অপরাধে বিএনপি জমানায় তার ভালো কোনো জায়গায় পোস্টিং হয়নি। ভাবখানা ছিল আমিই যেন সেজন্য দায়ী।
ওসি সালাহউদ্দিন ছাড়াও ওই এলাকার বর্তমান ডিসি হারুন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ডিসি হারুন সংসদ এলাকায় বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেশব্যাপী বিশেষ ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছে। তার সেই ‘বীরত্বপূর্ণ’ কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবেই সাহারা খাতুন হারুন-উর রশীদকে তেজগাঁও জোনের এডিসি থেকে পদোন্নতি দিয়ে লালবাগ জোনের ডিসি বানিয়েছেন। হারুন-উর রশীদ এর আগে লালবাগ জোনে এসির দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১০ সালে লালবাগ জোনে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ হয়েছিল। ছাত্রলীগ সংযোগের জোরে সে যাত্রায় তার চাকরি রক্ষা পেয়েছিল। হারুন-সালাহউদ্দিনের যৌথ তাণ্ডবে লালবাগ-কোতোয়ালি এলাকার জনগণের কী হাল হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যা-ই হোক, অনেক টালবাহানা শেষে ৩০ তারিখ রাত দুটায় নির্যাতিত তরুণীর মামলা কোতোয়ালি থানা গ্রহণ করেছে। গত মাসের ৩০ তারিখে গাজীপুরের পুলিশ মামুন ভূঁইয়া নামে একজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে খুনিদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে অসহায় মামুনকে হত্যা করে। হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ নিহতের হাতকড়া খুলে অকুস্থলে ফেলে রাখে। পুলিশ হেফাজতে আসামি খুনের এ এক লোমহর্ষক কলঙ্কজনক ঘটনা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একই সপ্তাহের অন্যান্য খবর পর্যালোচনা করলে থানা হেফাজতে অভিযুক্তদের পুলিশি নির্যাতনের আরও অনেক নৃশংস ঘটনা চোখে পড়বে।
নজিরবিহীন পুলিশি নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি সত্ত্বেও সাহারা খাতুন অব্যাহতভাবে দাবি করে চলেছেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি দশ বছরের মধ্যে সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি আরও দাবি করছেন, পুলিশও নাকি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই দাবির পেছনে তার যুক্তি হলো, বিরোধী দলে থাকাকালীন রাস্তায় আন্দোলনের সময় পুলিশ পিটিয়ে তার একটি পা ভেঙে দিয়েছিল। এখন সেই পুলিশ জাতীয় সংসদের সামনে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা এবং মাথা ভেঙে দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সেটাকে যথেষ্ট বিবেচনা করছেন না। বরং যে পুলিশ কর্মকর্তা এই গর্হিত কাজটি দিনদুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে করেছিল, তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন দিনবদলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি যেদিন তার প্রিয় পুলিশের সাফাই গাইছিলেন, তার আগের দিনেই আদালত চত্বরে এক বিচারপ্রার্থী তরুণী পুলিশের শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও অর্ধডজন নারী বর্তমান মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করলেও তাদের কাছ থেকে ধর্ষকামী পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণের কোনো নিন্দা এ যাবত জাতির শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও দুটি তাকলাগানো মন্তব্য করেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পর তিনি দাবি করছেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কথা তিনি বলেননি। তিনি শুধু পুলিশকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি শুনে সেই ‘তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল’ বিতর্কের কথা মনে পড়ে গেল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রতিপালিত না হওয়ার অপরাধে পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয়ে অবশ্য সাহারা খাতুন মুখ খোলেননি। একই অনুষ্ঠানে চমত্কৃত হওয়ার মতো তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার কথা বলেননি। মিডিয়াই নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহা শক্তিধরের কথা বিকৃত করে ছেপেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের পর্বতসম ব্যর্থতা ঢাকতে মিডিয়াকে দোষারোপ করা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের রীতিমত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী-বিএনপি-সুশীল-বাম — সবপন্থী পত্রিকাতেই সাহারা খাতুন এবং শামসুল হক টুকুর বক্তব্য অভিন্নভাবে ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি সত্য হলে মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের তাবত গণমাধ্যম একসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পেছনে লেগেছে। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুযায়ী উভয়েরই এবার পদত্যাগ অথবা পদচ্যুতির সময় এসেছে। পদত্যাগের সংস্কৃতি আমাদের দেশে তেমন একটা নেই। বিশেষ করে, কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি উজিরে খামাখার চেয়ারে বসে কিছুকাল নিশ্চুপ থেকে এখন আবার যেভাবে প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে এসে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে জনগণ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় না করা পর্যন্ত মহাজোটের কেউ আর মন্ত্রিত্বের চেয়ার ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেও যেহেতু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের মতো এতগুলো মেরুদণ্ডহীন চাটুকার একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও কঠিন হবে, কাজেই পদচ্যুতিরও প্রশ্ন ওঠে না। অতএব পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সার্টিফিকেটের পর বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে অপেক্ষমাণ, সে আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে অন্য ধরনের একটি তথ্য দিয়ে আজকের মতো মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করব। বাংলাদেশ পুলিশের PRP (Police Reform Programme) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পটি ইউএনডিপি (UNDP) এবং ডিএফআইডি (DFID)’র যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউএনডিপি প্রণীত প্রকল্পটির একটি সারসংক্ষেপ (Summary) পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই নথিতে Outcome এবং Output নামে দু’টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। Outcome-এ বলা হয়েছে, “The human rights of children, women and vulnerable groups are progressively fulfilled within the foundations of strengthened democratic governance.” অর্থাত্ শিশু, নারী এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সংরক্ষিত হবে যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর Output অংশে বলা হয়েছে, “Strengthened capacity of the justice system to ensure democratic governance, protect human rights and human security, improve participation in governance, and access to public services among poor communities.” অর্থাত্ গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহজ প্রবেশাধিকার। পিআরপি প্রকল্পের প্রাক্কলিত বাজেটের পরিমাণও বিশাল। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল, এই পাঁচ বছরে ২৯.০১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (২৪৫ কোটি টাকা) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ইউএনডিপি ৮ মিলিয়ন ডলার এবং ডিএফআইডি ১৬.৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (PRP-Phase I) শুরু হয় ২০০৫ সালে এবং বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের (PRP-Phase II) বাস্তবায়ন চলছে। প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকলে সেটি পরিশোধের দায় বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের। কাজেই জনগণের অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর যদি পুলিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর বর্বর আচরণে অভ্যস্ত হয় এবং মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে, তাহলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকই এই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে এ-জাতীয় প্রশিক্ষণে যে আসলে কোনো কাজ হয় না, সেটা আমরা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখেছি। বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকল্প নিয়ে বিচারপতিদের বিদেশ যাত্রার সুযোগ বেড়েছে বটে; কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের আদালতগুলোতে সাধারণ নাগরিকের বিচার পাওয়ার সুযোগও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রণীত পিআরপি-তেও Justice system-এর দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন ও উচ্চ উভয় আদালতেই দলীয়করণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বিচারপতিগণ আগের মতো সাহসিকতার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারছেন না। গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে কোনো রাখঢাক না রেখেই মন্তব্য করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত, আদালতে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আদালত ও পুলিশ উভয়ই তীব্র বেগে রসাতলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত এ-জাতীয় যাবতীয় প্রকল্পের মূল্যায়ন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার সরকার মূলত পুলিশ এবং আদালতের ওপর ভর করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট দেয়ার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে মহাজোট সরকার। এরশাদ পতনের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। একটি নির্যাতক পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা তাদের মসনদে টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। আড়িয়ল বিল এবং বিল কপালিয়ার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখেও তাদের সংবিত্ ফিরছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দেশেই নির্যাতনকারীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদের দুঃখজনক পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক’দিন আগে গণহত্যার অভিযোগে মিসরের এক সময়ের লৌহমানব হোসনি মোবারকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ছোটখাটো লৌহমানবীরা সেখান থেকে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
বি. দ্র. : গত সপ্তাহে ওসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এই সোমবার মামলা দায়ের করেছেন নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী। বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মারপিট, জখম ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com