মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : দুর্নীতিসহায়ক অপচয়ের বাজেট



মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনপূর্ব ইশতেহারে মন্ত্রিসভার সব সদস্যের সম্পদের বিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে জনগণকে জানানোর অঙ্গীকার করেছিল। মন্ত্রীর আসনে বসার আগে সেই হিসাব জনগণকে দিয়ে প্রতি বছর তার হ্রাস-বৃদ্ধি প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি সে সময় জনগণকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উত্সাহিতও করেছিল। সরকারের সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত প্রায়। দেশের কোনো নাগরিক আজ পর্যন্ত মন্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেনি। কথিত দিনবদলের সনদে প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো সম্পদের হিসাব দেয়ার প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করতে কোনোরকম লজ্জাবোধ করেনি ক্ষমতাসীন মহল। উল্টো মন্ত্রীদের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।
এরা এতটাই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে যে, ঘুষের টাকা বমাল ধরা পড়ার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখনও মন্ত্রী পদে রয়েছেন, দিলীপ বড়ুয়া সাড়ে তিন বছরে ছয় ছয়টি সরকারি প্লট বাগানোর পরও দাবি করছেন, প্রভাব খাটালে তিনি নাকি এতদিনে বারোটি প্লটের মালিক হতে পারতেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক দুর্নীতিবাজ সরকারের সব কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে মন্তব্য প্রতিবেদনের নির্ধারিত জায়গা শেষ হয়ে যাবে, বাজেট নিয়ে আর লেখার সুযোগ হবে না। কাজেই ওই চেষ্টা অন্য কোনো দিনের জন্য রেখে দিয়ে আজ বাজেটের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
এবারের বাজেট পরিষ্কারভাবে দুর্নীতিকে উত্সাহিত করার জন্যই প্রণীত হয়েছে। গত তিন বাজেটে সরকার কালো টাকা নিয়ে নানারকম টালবাহানা করার পর শেষপর্যন্ত বিশেষ কয়েকটি খাতে সেই টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছিল। এবার অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার পূর্বপর্যন্ত এ প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থেকে তাদের এবারের শাসনামলে কালোটাকা সাদা করার সবচেয়ে ঢালাও সুযোগটি এ বছরের বাজেটে করে দিয়েছেন। আগের মতো বিশেষ খাত-টাতের আর বালাই রাখেননি। দশ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে যে কোনো পরিমাণ অর্থ প্রায় সব খাতেই বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন। জনগণের পক্ষে এই ‘বদান্যতার’ কারণ বোঝা কঠিন নয়। আগামী বছর জুনে সরকারের সাড়ে চার বছর অতিক্রান্ত হবে। সেই সময়ের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, দলীয় পাণ্ডা নির্বিশেষে যারাই অবৈধ অর্থের মালিক হবেন, তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যেই বাজেটে এই আয়োজন রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তাছাড়া পরবর্তী নির্বাচনের খরচ জোগানো এবং ডজন খানেক নতুন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধন দেখাতেও পর্বতপ্রমাণ কালো টাকার প্রয়োজন পড়বে। অতএব ঢালাও দুর্নীতি জায়েজ না করে উপায় নেই। অথচ বিরোধী দলে থাকার সময় কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার থেকেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি বলতেন, লুটপাট জায়েজ করার জন্যই বিএনপি বাজেটে এই সুযোগটি রেখে দেয়। সেসব কথা প্রধানমন্ত্রীর হয়তো এখন মনেই পড়ে না। বোকা জনগণের হাতে কাঁচকলা ধরিয়ে তাদের মাথায় মুন্সিয়ানার সঙ্গে কাঁঠাল ভেঙে চলেছেন মহাজোটের কর্তাব্যক্তিরা। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের কিছু ব্যক্তি নেহাতই চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করেছে, এরা একেবারে ডাকাতি করে ছাড়লো। আগামী এক বছরে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ পেয়ে সরকারঘনিষ্ঠরা অতিকায় বাজেট থেকে যে লুটপাটের নিত্যনতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবেন, সেটি সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তার আগের আমলে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রথম তিন বছর চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখতে পারলেও পরের দুই বছরে সেটি আমাদের হাতছাড়া হয়। প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে, এই মেয়াদেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই হারানো চ্যাম্পিয়নশিপ পুনরুদ্ধার করে তবেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তার সরকারের প্রতি আগাম অভিনন্দন রইল।
এবার অপচয়ের আলোচনায় আসি। রাজস্ব খাত অর্থাত্ অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় দিয়ে শুরু করা যাক। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এই খাতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৩৮০৭০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেই খরচ বৃদ্ধি পেয়ে ১০৪২৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৬৭৩৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো ৭ বছরে দেশের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৮৬৬৮ কোটি টাকা অথবা ২.৬ গুণ। একই হিসাব আরেক রকম করেও দেখানো যেতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার-পরবর্তী ৭ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করি সব অর্থনীতিবিদই স্বীকার করবেন, অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি দেশের জাতীয় আয়ে (জিডিপি) কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান তো রাখেই না; বরং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। সে কারণেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বর্তমান অর্থবছরে দুই অংকের (১০.৯৯) মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কাছাকাছি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও জনগণের জীবনযাত্রার মান বর্তমানের মতো নিচে নেমে যেত না, যদি রাজস্ব ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের মাথাপিছু আয়ও প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেত। জনগণের নিট আয় না বেড়ে কেবল রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির অর্থই হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বব্যাপী অপচয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি রাষ্ট্রে প্রতি বছর এত উচ্চ হারে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার শামিল। মহাজোট সরকার তাদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে অপচয় যে বাড়ছে, তার আরও একটি প্রমাণ হলো শতকরা হিসাবে উন্নয়ন বাজেটের ক্রমাবনতি।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে এডিপির পরিমাণ ছিল অনুন্নয়ন খাতে ব্যয়ের ৫১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয়ের বিপরীতে এডিপির অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। উন্নয়ন বাজেট এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ভারসাম্যহীনতার ফলেই জিডিপি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ০.৩৯ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ০.৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগের ধারাবাহিক চিত্র আরও ভয়াবহ। জেনারেল মইনউদ্দিন ও ড. ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকার যে অর্থবছরে বিদায় নিয়েছিল, সে বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ১৯.৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র জিডিপির ১৯.০ শতাংশ। অর্থাত্ বর্তমান সরকারের আমলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অব্যাহতভাবে নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে এবং সাড়ে তিন বছরে জিডিপি’র ০.৭ শতাংশ কমেছে। বর্তমান অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগেও একই রকম ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মে মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত কাহিনী মনে পড়লো। ২০১০ সালে বন্দী অবস্থায় আমার রিমান্ড চলাকালীন টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে একজন প্রশ্নকর্তা বলেছিল, আমার বিরুদ্ধে নাকি বিনিয়োগ বোর্ডে নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জবাবে আমি বলেছিলাম, প্রথম কথা অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আর দ্বিতীয়ত বিনিয়োগ হ্রাস পেলে যদি নির্বাহী চেয়ারম্যানকে টিএফআই সেলে ধরে এনে নির্যাতন করার রীতি চালু হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তিই এই দায়িত্বটি আর নিতে চাইবেন না। জানি না ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে আমার মতো করে বিনিয়োগ বোর্ডের বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যানকেও টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে কি-না।
বাজেট বিষয়ে লিখিত আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন ভর্তুকি, বাজেট ঘাটতি, জাতীয় সঞ্চয় এবং রফতানির অবস্থা বর্ণনা করে শেষ করব। বিএনপি আমলের শেষ বছর (২০০৫-০৬) বাজেটে মোট ভর্তুকি ও চলতি স্থানান্তর খাতে অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১১০৭৩ কোটি টাকা। আর সেই একই খাতে বর্তমান অর্থবছরে সরকার ৩৪৬৪২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ছয় বছরে তিন গুণেরও অধিক ভর্তুকি দেয়ার ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে অব্যাহত রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার এই যে অপচয়ের মহোত্সবের সূচনা করেছে, তার ফলে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়বে। ভর্তুকির মতো বাজেট ঘাটতিতেও সরকার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে একটি রাষ্ট্রে বাজেট ঘাটতি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদের আগে এই ঘাটতি সর্বদাই ৫ শতাংশের অনেক নিচে অবস্থান করেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে প্রাক্কলিত ঘাটতি ৪৫২০২ কোটি টাকা অতিক্রম করে প্রকৃত ব্যয় ৪৬৩২৪ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট দেশজ উত্পাদনের ৫.১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫২০৫৮ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত দেশজ উত্পাদনের ৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরকে বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বছর বলা চলে। কারণ সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনী (পঞ্চদশ সংশোধনী) অনুযায়ী আগামী সাধারণ নির্বাচন ২৫ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ মধ্যবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি, সরকারের শেষ বছরেই ক্ষমতাসীনরা সর্বাধিক লুটপাটে ব্যস্ত থাকবে। সেই লুটপাটে সহায়তা করার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগও রেখেছেন। সুতরাং, অধিক হারে দুর্নীতিজনিত ঘাটতি যে এবারও প্রাক্কলিত বরাদ্দকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার সংক্ষেপে রফতানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যাক। এ বছর মার্চ থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসে রফতানিতে ধারাবাহিক পতনের ধারা অব্যাহত আছে। গত অর্থবছরে রফতানিতে রেকর্ড ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬.৭-এ উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল। এ বছর প্রথম এগারো মাসে সেই রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থবছরের সর্বশেষ মাস অর্থাত্ জুনের রফতানি হিসাব পাওয়া গেলে বছর শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী বর্তমান অর্থবছরে ৪৪টি পণ্যের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দীর্ঘায়িত হওয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের রফতানি খাতে। তদুপরি বিদ্যুত্সহ অন্যান্য অবকাঠামোজনিত দুর্বলতা শিল্প খাতে উত্পাদন সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা কাটার কোনোরকম আশু সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলে আগামী অর্থবছরেও রফতানি খাতে সুসময় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। রফতানি হ্রাস পেলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশের জিডিপিও নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে।
আজকের সর্বশেষ আলোচনা জাতীয় সঞ্চয় নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরে (২০০৭-০৮) জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ৩০.২ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে সেই সঞ্চয় ২৯.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাত্ গত চার বছরে আমাদের জাতীয় সঞ্চয় ০.৮ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে দিনবদলের সরকার। একদিকে ভর্তুকি এবং বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি এবং অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার অর্থই হলো সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিজনিত অপচয় দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর অন্তে শেখ হাসিনার সরকার যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নরূপ :
১. জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
২. জাতীয় সঞ্চয় বিপজ্জনক হারে কমেছে;
৩. বেসরকারি খাতে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে;
৪. রফতানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
৫. বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ অতিক্রম করায় আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে;
৬. ভর্তুকি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে;
৭. সুশাসন নির্বাসনে; এবং
৮. প্রশাসনে সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার ধারণা, দেশের দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করবেন, তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা এনেছিলেন। বাজেট ঘাটতি এবং ভর্তুকির বিষয়ে তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজেও সমর্থন করতেন। ফলে মন্ত্রিসভায় সহকর্মীদের চাপকে সাইফুর রহমান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণ জাতীয় আয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে শুরু করেছিল। ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে বিএনপির সর্বশেষ বছর ২০০৫-০৬ পর্যন্ত জিডিপি টানা ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে থেকে মূল্যস্ফীতি এক অংকে ৩ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে জিডিপিতে তুলনামূলক বৃদ্ধি না হলেও মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে দুই অংক অতিক্রম করেছে। ফলে জনগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি খাতে তাদের জীবনযাপনের ব্যয়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে। লোডশেডিং না কমলেও এক বিদ্যুত্ বিলেই ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ২০০ শতাংশের অধিক। তুলনামূলকভাবে কম মূল্যের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ডিম ও ডালের মূল্য বেড়েছে যথাক্রমে ৩০০ ও ২০০ শতাংশ। বাড়িভাড়া, যানবাহনের খরচ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির ফলে নির্ধারিত আয়ের জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য মন্ত্রী, সরকারি দলের এমপি এবং মহাজোটের নেতাকর্মীদের রাতারাতি আয় বৃদ্ধি আলাদিনের চেরাগ দ্বারা প্রাপ্ত সম্পদকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মহাজোটের নব্য সম্পদশালীদের কাহিনী প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যকার ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ’ এবং ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ সম্পর্কে কী প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি :
১.১ দ্রব্যমূল্য : দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মত আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা : দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।
আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার যে আসমান-জমিন ফারাক, সে বিষয়ে অধিক লেখার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের যে নজির বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে, জনগণের কাছে তার জবাবদিহি করার সময় আগতপ্রায়। ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল বিধায় যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করেই বলছি, কোনো দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী শাসকের পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে গণআকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ইনশাআল্লাহ্ এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : আগ্রাসী দলীয়করণের অশুভ পরিণতি



মাহমুদুর রহমান
দিন বদলের সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে বিতর্কিত করতে সক্ষম হয়েছে। দলবাজ প্রশাসন নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, গত সপ্তাহে পুলিশের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে আমি নিজেও লিখেছি। আজ বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যকার সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত বাদানুবাদের মধ্যেই আমার মন্তব্য-প্রতিবেদন সীমিত রাখব। এই আমলের বিচার বিভাগের সঙ্গে আমার বৈরী সম্পর্কের কথা শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাও অবগত আছেন। আদালতে সরকারি দলের নজিরবিহীন দলীয়করণের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ‘অপরাধে’ আমি আদালত অবমাননার দুটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলও খেটে এসেছি। সরকার ও বিচার বিভাগের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত হলেও আমার জন্য সন্তোষের বিষয় হলো, যে কথাগুলো আমি আড়াই বছর আগে লিখেছিলাম, সেগুলোই আজ দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। আদালত শুদ্ধিকরণের লড়াইয়ে তখন একাকী হলেও আজ মনে হচ্ছে, আমি আর নিঃসঙ্গ নই। কোটারি সর্বস্ব বাংলাদেশে আমরা যার যার সুবিধামত ইতিহাস তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সুবিধাবাদীদের ইতিহাস তৈরি প্রসঙ্গে এক-এগারোর সরকারের সময়কালীন একটা উদাহরণ দিয়ে আজকের মূল বিষয়ে ফিরব।
এক-এগারো সরকারের একেবারে প্রথমদিকের সমালোচনাকারীদের মধ্যে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্যু দেতার প্রথম দিনে ওই সরকারের গঠন প্রণালী এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিবিসিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রথম যে বিবৃতিটি ছাপা হয়েছিল, সেটিরও এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন সামাদ ভাই। সেই সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকারের মুখোশ উন্মোচনের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছিলাম আমি এবং কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ঔরসে জন্মলাভকারী সরকারটি ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, আর আমি সেই সরকারের সমালোচনা করে প্রথম কলামটি লিখেছিলাম একই মাসের ২৭ জানুয়ারি। ‘অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার বিপদ সংকেত’ শিরোনামে লেখা কলামের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি;
“তবে দেশের ভালো চাইলে, অর্থনীতির উন্নয়ন চাইলে, যত তাড়াতাড়ি জনগণের নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, ততই মঙ্গল। স্বদেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের চেয়ে উত্তম এবং বৈধ কোনো সরকারব্যবস্থা এ যাবত আবিষ্কার হয়নি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই আমরা দ্রুততার সঙ্গে সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবো। আশির দশকের এক পতিত, দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসককে সব দল মিলে মহা তারকারূপে পুনর্বাসিত করে সেই অগ্রস্ত্যযাত্রার প্রথম পদক্ষেপটা আমরা বোধহয় নিয়েই ফেলেছি।”
গণতন্ত্রের সপক্ষে আমার কলম ধরার মুহূর্তে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদরা হয় গা-ঢাকা দিয়েছেন, নয়তো বোবার শত্রু নাই নীতি গ্রহণ করে আত্মরক্ষার চেষ্টায় রত ছিলেন। সেই কঠিন সময়ে দেশের তাবত্ বুদ্ধিজীবীকুল এবং সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ওই একই কলামে এক-এগারোর সরকার যে আইনসিদ্ধ নয়, সেই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলাম—‘বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এ নিশ্চয়তা বোধ হয় কেউ দিতে চাইবেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল প্রজ্ঞাপন এবং সেই বাতিল করা নির্বাচনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ১৭ জন সংসদ সদস্য সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ ভবিষ্যতে উত্থাপিত হবে না।’ উল্লিখিত কলামটি কাশবন প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘জাতির পিতা ও অন্যান্য’তে সঙ্কলিত হয়েছে। লেখালেখির বাইরে টেলিভিশন টকশো’তে দেশবাসীকে বিশেষ সরকারের স্বরূপ চেনানোর বিপজ্জনক দায়িত্ব নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং সাবেক সচিব মো. আসাফউদ্দৌলাহ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। আমিও দুই-একটি চ্যানেল থেকে কখনও সখনও ডাক পেলে ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করতাম। টেলিভিশনে আমার কালো তালিকাভুক্তির সূচনাও তখনই ঘটে। আর এই আমলে তো কোনো চ্যানেলে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে সেই চ্যানেল বন্ধের সরাসরি হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে। আজকাল টক শো’তে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক-এগারো সরকারের বিরোধিতা করার অসত্য দাবি করে থাকেন, তাদের অধিকাংশই তখন হয় নীরব থেকেছেন অথবা সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। ইতিহাস বিকৃতি সম্ভবত আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। একইভাবে বিচার বিভাগ আজ চারদিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক ব্যক্তিই হয়তো দাবি করবেন যে তারাই মামলার ঝুঁকি নিয়েও আদালত পাড়ার অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। হাওয়া বুঝে পাল খাটানোতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির অভাব এ দেশে কোনোদিনই হয়নি। তবে এক্ষেত্রে জেল খাটা আসামি হওয়ার কারণে আমার অন্তত খানিকটা অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। ধারণা করছি, আমার দুটি আদালত অবমাননা মামলার সব নথিপত্র এবং রায় ডিএলআর (DLR)-এ স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং, ইচ্ছে থাকলেও অন্য কারও পক্ষে সেই ইতিহাসে ভাগ বসানো সম্ভব হবে না।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। বর্তমান সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতে রেকর্ড সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। সেসব নিয়োগের পেছনেও মূলত দলীয় বিবেচনাই কাজ করেছে। এই বিচারপতিদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত বিশেষ একজনকে নরসিংদীর জেলা জজ থেকে কয়েক ডজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজে পদোন্নতি দিয়ে পরে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া খুনের মামলার আসামি এবং সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীও বিচারপতি হয়েছেন। বাদবাকি নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অতীতে সরকারদলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের ইতোপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশনার কোনোরকম তোয়াক্কা বর্তমান সরকার করেনি। গত সাড়ে তিন বছরে আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও নির্বিচারে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। আদালতকে অপব্যবহার করে ভিন্নমত দলনের এক চরম নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে দিন বদলের সরকার। হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন নিয়েও আদালত পাড়ায় নানারকম বিতর্ক রয়েছে। সিনিয়র বিচারপতিদের সমন্বয়ে রিট বেঞ্চ গঠন না করে দলীয় বিবেচনায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এক সময় উচ্চ আদালতে অধিক সংখ্যায় বিব্রত হওয়ার নজিরের সঙ্গে হাল আমলে বিভক্ত রায়ের রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে পর্যন্ত হত্যা করার ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য আজ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকেও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লন্ডনে টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে পুলিশের এত বড় নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। একই বিচারপতি মো. আসাফউদ্দৌলাহ, সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং শফিক রেহমানসহ দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের তার এজলাসে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য প্রণীত আচরণবিধিও তিনি প্রতি পদে লঙ্ঘন করেছেন। প্রধান বিচারপতি এই অসঙ্গত আচরণের রাশ টেনে ধরার কোনোরকম চেষ্টা করেননি। অবশেষে সংসদের সঙ্গে আদালতের অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ সৃষ্টিতেও একই বিচারপতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন।
সরকারের অতিমাত্রায় দলীয়করণের নীতি এবং আদালত নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি অবধারিত ছিল। এই আশঙ্কা থেকেই ২০১০ সালের ১০ মে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছিলাম—
“একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্য এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ, সর্বত্র অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে অন্যায়-অবিচারের ভয়াবহ বিস্তৃতি এক সময় দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন ক্যালদীয়রা পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছিল, সেই সময়ের নবী যেরেমিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতির সঞ্চিত পাপ সমস্ত জাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় (অভিশপ্ত নগরী, সত্যেন সেন)।”
এই লেখালিখিতে সংশ্লিষ্টদের সংবিত্ ফেরার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আমাকে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে সুপ্রিমকোর্ট ভবিষ্যতের সব সমালোচকের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ৫ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের তার বিরুদ্ধে দল বেঁধে সমালোচনা আমার উপরিউক্ত লেখার যৌক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নতুন করে প্রমাণ করেছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বোধ করছি।
দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাও সংসদ এবং আদালতের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রের এই দুই স্তম্ভের মধ্যকার তিক্ততা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়বে। তারা দুই পক্ষের মন্তব্যকেই অনভিপ্রেত উল্লেখ করে ব্যাপারটির আশু সমাধান কামনা করেছেন। আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়েই সংসদের ওপর আদালতের এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছে। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন অবশ্য বলেছেন, দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদই সুপিরিয়র। যে ব্রিটিশ সিস্টেমের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, সেখানেও সংসদের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সে কারণে যুক্তরাজ্যে সব বিষয়কে আদালতে টেনে নেয়ার রেওয়াজ নেই। আদালতও Justiciability (আদালতের এখতিয়ার)-এর আলোকে সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়টি তাদের বিচারিক আওতার মধ্যে পড়ে। সাধারণত সংসদ দ্বারা প্রণীত আইন বিষয়ে তারা বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম মানবাধিকার বিষয়ক পর্যালোচনা। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে Human Rights Act প্রণীত হওয়ার পর থেকে আদালত কোনো আইন পর্যালোচনা করে যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ওই আইনের কোনো অংশ Human Rights Act, 1998-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাহলেই কেবল ওই অংশ সংশোধনের জন্য আইনটি সংসদে ফেরত পাঠানো হয়। এর বাইরে অবশ্য Judicial review (বিচারিক পর্যালোচনা) করার রেওয়াজ রয়েছে। আইন নিয়ে পড়াশোনা না করলেও আইন সংক্রান্ত কিছু বই-পত্র উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছে। সংসদে গৃহীত পঞ্চম, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালত কর্তৃক যেভাবে বাংলাদেশে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, আমার ধারণা, তার তুল্য নজির যুক্তরাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে প্রণীত আইনের উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড রিড (Lord Reid) তার এক রায়ে বলেছেন :
“In earlier times many learned lawyers seem to have believed that an Act of Parliament could be disregarded in so far as it was contrary to the law of God or law of nature or natural justice, but since the supremacy of Parliament was finally demonstrated by the revolution of 1688 any such idea has become obsolete.”
(অতীতে অনেক আইনজীবীর মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে, সংসদে প্রণীত আইন উপেক্ষণীয় হতে পারে যদি সেটি স্রষ্টার আইন কিংবা প্রকৃতির আইন অথবা স্বাভাবিক আইনের পরিপন্থী হয়; কিন্তু ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে এ জাতীয় ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে।)
বাংলাদেশে এর আগে কখনও বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়নি। আগের বিচারপতিরা সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে আচরণবিধি সুচারুরূপে পালন করার কারণে সমাজের সব অংশের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধাভাজন থাকতেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কথায় কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে নেয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এক বাদী পবিত্র কোরআন শরীফ পর্যন্ত সংশোধনের আবদার নিয়ে রিট বেঞ্চে হাজির হওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অধঃপতনের দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকেই সর্বতোভাবে বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রাথমিক কাজটি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন (Impeach) করার ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংবিধানের বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী অভিশংসনের জন্য একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে Supreme Judicial Council গঠনের নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ৯৬(৩) ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া নিম্নোক্তভাবে নির্দেশিত হয়েছে :
‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে কাউন্সিল বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুই জন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে।’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিচার বিভাগই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে রায় দিয়ে দেশে অনভিপ্রেত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালে প্রকৃতপক্ষে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান আদৌ আদালতের এখতিয়ারের (Justiciable) মধ্যে পড়ে কি-না, এই প্রশ্ন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যেই রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে জনগণ অবশ্যই সে প্রশ্নের জবাব খুঁজবে। ইতিহাস রচনার দায়িত্ব যে ইতিহাসবিদদের কাছেই থাকা উচিত, আমার এই মন্তব্যের সঙ্গে আশা করি দেশের অধিকাংশ নাগরিকই সহমত পোষণ করবেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে উপলক্ষ করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আবারও সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছেন। তবে হুমকি বাস্তবায়নের ক্ষমতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ক্ষমতাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে ঢাকায় ও লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের তথাকথিত রাজ পরিবারের সদস্যদের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি আদালত পাড়ায় বহুল প্রচারিত। সুতরাং, পুরো বিতর্কটি ধামাচাপা পড়লে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না। এদিকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে আনার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসনের (Impeachment)-এর ক্ষমতা সংসদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সেই সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারাটি পূর্ববত্ রেখে দিয়েছেন। অর্থাত্ রায় লেখার সময় তিনি বিচার বিভাগের কোটারি সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়ে যেহেতু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, কাজেই ভবিষ্যতে এই লক্ষ্যে আবারও সংবিধান সংশোধনের দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।
৪১ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকশ্রেণী জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সংবিধানকে কেবল নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে যার যার সুবিধামত ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সাড়ে তিন বছরে এই গর্হিত কাজটি এতটাই নগ্নভাবে করা হয়েছে যে, জনগণের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কেই এক ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সংবিধানে বারবার কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে এবার দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নই সম্ভবত ষোল কোটি মানুষের মুক্তির পথ হতে পারে। ১৯৭২ সালে যে সংসদ সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, সেই সংসদের সব সদস্য ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসনাধীন লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক (Legal Frame work)-এর অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্রীয় (MNA) ও প্রাদেশিক (MPA) সংসদের সব সদস্যকে একত্রিত করে বাংলাদেশের গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠিত হয়েছিল। নির্বাচিতদের মধ্যে পাকিস্তানের কয়েকজন দালালকে কেবল গণপরিষদের বাইরে রাখা হয়েছিল। এ সবই ইতিহাসের অংশ। কাজেই চার দশকের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের গণআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবার দ্বিতীয় সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া উচিত। নতুন সংবিধান প্রণয়নে সমাজের সব শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করলে সেই দলিলে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করা যায়। এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদসহ দেশের সব বিজ্ঞজন ভেবে দেখতে পারেন।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ



মাহমুদুর রহমান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দীর্ঘদিন মেঠো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে এবং একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন মাঠকর্মী হিসেবে প্রবীণ বয়সে এমপি হওয়াটাই তার জন্য পরম গৌরবের বিষয় ছিল। কিন্তু বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকায় তিনি প্রথম সুযোগেই কেবল ফুল মন্ত্রী নন, মহাশক্তিধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও দখল করতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি-নৈতিকতা শিকেয় তুলে অতিমাত্রায় দল এবং দলীয় প্রধানের প্রতি অনুগত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
সাহারা খাতুন তার বিভিন্ন বক্তব্যে প্রসঙ্গ থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনে এনে তার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের বয়ান দেন, সেটার কারণও জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতে আমজনতার হয়তো তেমন কোনো সমস্যাও হতো না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হাতে পেয়ে তিনি প্রজাতন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে যে নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং দলীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন, সেখানেই যত সমস্যা। গত সাড়ে তিন বছরে তার কণ্ঠে ‘আমার পুলিশ’ কথাটি যে কতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার হিসাব রাখাই কঠিন।
পুলিশ যে প্রজাতন্ত্রের, সাহারা খাতুনের নয়—এটা বোঝানোর মতো কেউ সম্ভবত তার পাশে নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, তদীয় কন্যা শেখ হাসিনা এবং সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনীতিবিদ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো করে রাষ্ট্রকে একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি বিবেচনা করেননি। একজন মন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয়কে পৈতৃক অথবা দলীয় জমিদারি ভাবতে শুরু করেন, তখনই সুশাসনের বারোটা বেজে যায়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আইন ও মানবাধিকারের প্রতি যে চূড়ান্ত অবজ্ঞা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার প্রধান দায়-দায়িত্ব তাই বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই বহন করতে হবে।
সাহারা খাতুনের পুলিশ গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যে অমার্জনীয় কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্তসার এবার প্রস্তুত করা যাক। গত মাসের ২৬ তারিখে রোকেয়া সরণিতে পলিটেকনিকের ছাত্রীদের অবরোধের ছবি তোলার সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিককে বেধড়ক লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পেটানোর সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার চিত্কার করে বলেছে, পেটা সাংবাদিকদের, ওরাই যত নষ্টের গোড়া, এদেশে সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। পুলিশ কর্মকর্তার দাবির পেছনে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, ঘরে ঢুকে সাংবাদিক খুন করলে যে দেশে কিছু হয় না, সেখানে যত্সামান্য পিটুনি তো নস্যি! একই মাসের ২৯ তারিখে পুরনো ঢাকার আদালতপাড়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে পুলিশ ক্লাবে ধরে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে আওয়ামী-বাকশালী পুলিশ। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন তিন সাংবাদিক, দুই আইনজীবীসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারী জনতা। আহত তিন সাংবাদিক যথাক্রমে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে কর্মরত আছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য নির্যাতিত তরুণীকেই উল্টো কোতোয়ালি থানায় ধরে নিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অতি ঘনিষ্ঠ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী খবর পেয়ে থানায় ছুটে না গেলে তরুণীটির কপালে আরও দুঃখ ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের সামনেই কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনের উদ্ধত ব্যবহারের খানিকটা নমুনা আমরা টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছি। কোতোয়ালি থানার এই ওসির সঙ্গে আমার রিমান্ড চলাকালীন সাক্ষাত্ হয়েছিল।
‘পবিত্র ভূমি’ গোপালগঞ্জের অধিবাসী পুলিশ কর্মকর্তাটি আমাকে সারা রাত থানা গারদে জনা পনেরো মাদকাসক্ত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেই অসহনীয় পরিবেশে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালে এক গ্লাস পানি পানেরও প্রবৃত্তি হয়নি। মিনিট তিরিশের কথাবার্তায় আমার কাছে ওসি সালাহউদ্দিনকে পুলিশের পোশাকে ছাত্রলীগের একজন পাণ্ডার মতোই লেগেছিল। সে বার বার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিল, গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার অপরাধে বিএনপি জমানায় তার ভালো কোনো জায়গায় পোস্টিং হয়নি। ভাবখানা ছিল আমিই যেন সেজন্য দায়ী।
ওসি সালাহউদ্দিন ছাড়াও ওই এলাকার বর্তমান ডিসি হারুন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ডিসি হারুন সংসদ এলাকায় বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেশব্যাপী বিশেষ ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছে। তার সেই ‘বীরত্বপূর্ণ’ কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবেই সাহারা খাতুন হারুন-উর রশীদকে তেজগাঁও জোনের এডিসি থেকে পদোন্নতি দিয়ে লালবাগ জোনের ডিসি বানিয়েছেন। হারুন-উর রশীদ এর আগে লালবাগ জোনে এসির দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১০ সালে লালবাগ জোনে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ হয়েছিল। ছাত্রলীগ সংযোগের জোরে সে যাত্রায় তার চাকরি রক্ষা পেয়েছিল। হারুন-সালাহউদ্দিনের যৌথ তাণ্ডবে লালবাগ-কোতোয়ালি এলাকার জনগণের কী হাল হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যা-ই হোক, অনেক টালবাহানা শেষে ৩০ তারিখ রাত দুটায় নির্যাতিত তরুণীর মামলা কোতোয়ালি থানা গ্রহণ করেছে। গত মাসের ৩০ তারিখে গাজীপুরের পুলিশ মামুন ভূঁইয়া নামে একজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে খুনিদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে অসহায় মামুনকে হত্যা করে। হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ নিহতের হাতকড়া খুলে অকুস্থলে ফেলে রাখে। পুলিশ হেফাজতে আসামি খুনের এ এক লোমহর্ষক কলঙ্কজনক ঘটনা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একই সপ্তাহের অন্যান্য খবর পর্যালোচনা করলে থানা হেফাজতে অভিযুক্তদের পুলিশি নির্যাতনের আরও অনেক নৃশংস ঘটনা চোখে পড়বে।
নজিরবিহীন পুলিশি নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি সত্ত্বেও সাহারা খাতুন অব্যাহতভাবে দাবি করে চলেছেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি দশ বছরের মধ্যে সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি আরও দাবি করছেন, পুলিশও নাকি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই দাবির পেছনে তার যুক্তি হলো, বিরোধী দলে থাকাকালীন রাস্তায় আন্দোলনের সময় পুলিশ পিটিয়ে তার একটি পা ভেঙে দিয়েছিল। এখন সেই পুলিশ জাতীয় সংসদের সামনে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা এবং মাথা ভেঙে দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সেটাকে যথেষ্ট বিবেচনা করছেন না। বরং যে পুলিশ কর্মকর্তা এই গর্হিত কাজটি দিনদুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে করেছিল, তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন দিনবদলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি যেদিন তার প্রিয় পুলিশের সাফাই গাইছিলেন, তার আগের দিনেই আদালত চত্বরে এক বিচারপ্রার্থী তরুণী পুলিশের শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও অর্ধডজন নারী বর্তমান মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করলেও তাদের কাছ থেকে ধর্ষকামী পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণের কোনো নিন্দা এ যাবত জাতির শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও দুটি তাকলাগানো মন্তব্য করেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পর তিনি দাবি করছেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কথা তিনি বলেননি। তিনি শুধু পুলিশকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি শুনে সেই ‘তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল’ বিতর্কের কথা মনে পড়ে গেল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রতিপালিত না হওয়ার অপরাধে পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয়ে অবশ্য সাহারা খাতুন মুখ খোলেননি। একই অনুষ্ঠানে চমত্কৃত হওয়ার মতো তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার কথা বলেননি। মিডিয়াই নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহা শক্তিধরের কথা বিকৃত করে ছেপেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের পর্বতসম ব্যর্থতা ঢাকতে মিডিয়াকে দোষারোপ করা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের রীতিমত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী-বিএনপি-সুশীল-বাম — সবপন্থী পত্রিকাতেই সাহারা খাতুন এবং শামসুল হক টুকুর বক্তব্য অভিন্নভাবে ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি সত্য হলে মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের তাবত গণমাধ্যম একসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পেছনে লেগেছে। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুযায়ী উভয়েরই এবার পদত্যাগ অথবা পদচ্যুতির সময় এসেছে। পদত্যাগের সংস্কৃতি আমাদের দেশে তেমন একটা নেই। বিশেষ করে, কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি উজিরে খামাখার চেয়ারে বসে কিছুকাল নিশ্চুপ থেকে এখন আবার যেভাবে প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে এসে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে জনগণ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় না করা পর্যন্ত মহাজোটের কেউ আর মন্ত্রিত্বের চেয়ার ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেও যেহেতু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের মতো এতগুলো মেরুদণ্ডহীন চাটুকার একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও কঠিন হবে, কাজেই পদচ্যুতিরও প্রশ্ন ওঠে না। অতএব পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সার্টিফিকেটের পর বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে অপেক্ষমাণ, সে আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে অন্য ধরনের একটি তথ্য দিয়ে আজকের মতো মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করব। বাংলাদেশ পুলিশের PRP (Police Reform Programme) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পটি ইউএনডিপি (UNDP) এবং ডিএফআইডি (DFID)’র যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউএনডিপি প্রণীত প্রকল্পটির একটি সারসংক্ষেপ (Summary) পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই নথিতে Outcome এবং Output নামে দু’টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। Outcome-এ বলা হয়েছে, “The human rights of children, women and vulnerable groups are progressively fulfilled within the foundations of strengthened democratic governance.” অর্থাত্ শিশু, নারী এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সংরক্ষিত হবে যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর Output অংশে বলা হয়েছে, “Strengthened capacity of the justice system to ensure democratic governance, protect human rights and human security, improve participation in governance, and access to public services among poor communities.” অর্থাত্ গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহজ প্রবেশাধিকার। পিআরপি প্রকল্পের প্রাক্কলিত বাজেটের পরিমাণও বিশাল। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল, এই পাঁচ বছরে ২৯.০১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (২৪৫ কোটি টাকা) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ইউএনডিপি ৮ মিলিয়ন ডলার এবং ডিএফআইডি ১৬.৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (PRP-Phase I) শুরু হয় ২০০৫ সালে এবং বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের (PRP-Phase II) বাস্তবায়ন চলছে। প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকলে সেটি পরিশোধের দায় বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের। কাজেই জনগণের অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর যদি পুলিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর বর্বর আচরণে অভ্যস্ত হয় এবং মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে, তাহলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকই এই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে এ-জাতীয় প্রশিক্ষণে যে আসলে কোনো কাজ হয় না, সেটা আমরা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখেছি। বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকল্প নিয়ে বিচারপতিদের বিদেশ যাত্রার সুযোগ বেড়েছে বটে; কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের আদালতগুলোতে সাধারণ নাগরিকের বিচার পাওয়ার সুযোগও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রণীত পিআরপি-তেও Justice system-এর দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন ও উচ্চ উভয় আদালতেই দলীয়করণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বিচারপতিগণ আগের মতো সাহসিকতার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারছেন না। গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে কোনো রাখঢাক না রেখেই মন্তব্য করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত, আদালতে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আদালত ও পুলিশ উভয়ই তীব্র বেগে রসাতলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত এ-জাতীয় যাবতীয় প্রকল্পের মূল্যায়ন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার সরকার মূলত পুলিশ এবং আদালতের ওপর ভর করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট দেয়ার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে মহাজোট সরকার। এরশাদ পতনের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। একটি নির্যাতক পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা তাদের মসনদে টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। আড়িয়ল বিল এবং বিল কপালিয়ার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখেও তাদের সংবিত্ ফিরছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দেশেই নির্যাতনকারীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদের দুঃখজনক পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক’দিন আগে গণহত্যার অভিযোগে মিসরের এক সময়ের লৌহমানব হোসনি মোবারকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ছোটখাটো লৌহমানবীরা সেখান থেকে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
বি. দ্র. : গত সপ্তাহে ওসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এই সোমবার মামলা দায়ের করেছেন নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী। বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মারপিট, জখম ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com