মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : দুর্নীতিসহায়ক অপচয়ের বাজেট



মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনপূর্ব ইশতেহারে মন্ত্রিসভার সব সদস্যের সম্পদের বিবরণী বার্ষিক ভিত্তিতে জনগণকে জানানোর অঙ্গীকার করেছিল। মন্ত্রীর আসনে বসার আগে সেই হিসাব জনগণকে দিয়ে প্রতি বছর তার হ্রাস-বৃদ্ধি প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি সে সময় জনগণকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উত্সাহিতও করেছিল। সরকারের সাড়ে তিন বছর অতিক্রান্ত প্রায়। দেশের কোনো নাগরিক আজ পর্যন্ত মন্ত্রীদের সম্পদের পরিমাণ জানতে পারেনি। কথিত দিনবদলের সনদে প্রদত্ত অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মতো সম্পদের হিসাব দেয়ার প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করতে কোনোরকম লজ্জাবোধ করেনি ক্ষমতাসীন মহল। উল্টো মন্ত্রীদের মধ্যে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।
এরা এতটাই দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে যে, ঘুষের টাকা বমাল ধরা পড়ার পরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখনও মন্ত্রী পদে রয়েছেন, দিলীপ বড়ুয়া সাড়ে তিন বছরে ছয় ছয়টি সরকারি প্লট বাগানোর পরও দাবি করছেন, প্রভাব খাটালে তিনি নাকি এতদিনে বারোটি প্লটের মালিক হতে পারতেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক দুর্নীতিবাজ সরকারের সব কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে মন্তব্য প্রতিবেদনের নির্ধারিত জায়গা শেষ হয়ে যাবে, বাজেট নিয়ে আর লেখার সুযোগ হবে না। কাজেই ওই চেষ্টা অন্য কোনো দিনের জন্য রেখে দিয়ে আজ বাজেটের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
এবারের বাজেট পরিষ্কারভাবে দুর্নীতিকে উত্সাহিত করার জন্যই প্রণীত হয়েছে। গত তিন বাজেটে সরকার কালো টাকা নিয়ে নানারকম টালবাহানা করার পর শেষপর্যন্ত বিশেষ কয়েকটি খাতে সেই টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছিল। এবার অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার পূর্বপর্যন্ত এ প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থেকে তাদের এবারের শাসনামলে কালোটাকা সাদা করার সবচেয়ে ঢালাও সুযোগটি এ বছরের বাজেটে করে দিয়েছেন। আগের মতো বিশেষ খাত-টাতের আর বালাই রাখেননি। দশ শতাংশ হারে জরিমানা দিয়ে যে কোনো পরিমাণ অর্থ প্রায় সব খাতেই বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছেন। জনগণের পক্ষে এই ‘বদান্যতার’ কারণ বোঝা কঠিন নয়। আগামী বছর জুনে সরকারের সাড়ে চার বছর অতিক্রান্ত হবে। সেই সময়ের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, দলীয় পাণ্ডা নির্বিশেষে যারাই অবৈধ অর্থের মালিক হবেন, তাদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যেই বাজেটে এই আয়োজন রেখেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
তাছাড়া পরবর্তী নির্বাচনের খরচ জোগানো এবং ডজন খানেক নতুন ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা মূলধন দেখাতেও পর্বতপ্রমাণ কালো টাকার প্রয়োজন পড়বে। অতএব ঢালাও দুর্নীতি জায়েজ না করে উপায় নেই। অথচ বিরোধী দলে থাকার সময় কালোটাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার থেকেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি বলতেন, লুটপাট জায়েজ করার জন্যই বিএনপি বাজেটে এই সুযোগটি রেখে দেয়। সেসব কথা প্রধানমন্ত্রীর হয়তো এখন মনেই পড়ে না। বোকা জনগণের হাতে কাঁচকলা ধরিয়ে তাদের মাথায় মুন্সিয়ানার সঙ্গে কাঁঠাল ভেঙে চলেছেন মহাজোটের কর্তাব্যক্তিরা। ২০০১ থেকে ২০০৬ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের কিছু ব্যক্তি নেহাতই চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করেছে, এরা একেবারে ডাকাতি করে ছাড়লো। আগামী এক বছরে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ পেয়ে সরকারঘনিষ্ঠরা অতিকায় বাজেট থেকে যে লুটপাটের নিত্যনতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবেন, সেটি সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা তার আগের আমলে বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করে ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রথম তিন বছর চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখতে পারলেও পরের দুই বছরে সেটি আমাদের হাতছাড়া হয়। প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তার দেখে মনে হচ্ছে, এই মেয়াদেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই হারানো চ্যাম্পিয়নশিপ পুনরুদ্ধার করে তবেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবেন। তার সরকারের প্রতি আগাম অভিনন্দন রইল।
এবার অপচয়ের আলোচনায় আসি। রাজস্ব খাত অর্থাত্ অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় দিয়ে শুরু করা যাক। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছর ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এই খাতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৩৮০৭০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে সেই খরচ বৃদ্ধি পেয়ে ১০৪২৩৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৬৭৩৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো ৭ বছরে দেশের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৯৮৬৬৮ কোটি টাকা অথবা ২.৬ গুণ। একই হিসাব আরেক রকম করেও দেখানো যেতে পারে। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার-পরবর্তী ৭ বছরে গড়ে প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করি সব অর্থনীতিবিদই স্বীকার করবেন, অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি দেশের জাতীয় আয়ে (জিডিপি) কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান তো রাখেই না; বরং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। সে কারণেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১২ থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বর্তমান অর্থবছরে দুই অংকের (১০.৯৯) মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অথচ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কাছাকাছি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও জনগণের জীবনযাত্রার মান বর্তমানের মতো নিচে নেমে যেত না, যদি রাজস্ব ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের মাথাপিছু আয়ও প্রতি বছর ৩৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেত। জনগণের নিট আয় না বেড়ে কেবল রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির অর্থই হলো রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বব্যাপী অপচয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি রাষ্ট্রে প্রতি বছর এত উচ্চ হারে অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবে আত্মহত্যার শামিল। মহাজোট সরকার তাদের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছে যে, ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে অপচয় যে বাড়ছে, তার আরও একটি প্রমাণ হলো শতকরা হিসাবে উন্নয়ন বাজেটের ক্রমাবনতি।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে এডিপির পরিমাণ ছিল অনুন্নয়ন খাতে ব্যয়ের ৫১ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয়ের বিপরীতে এডিপির অংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। উন্নয়ন বাজেট এবং অনুন্নয়ন বাজেটের ভারসাম্যহীনতার ফলেই জিডিপি এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ০.৩৯ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ০.৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বেসরকারি বিনিয়োগের ধারাবাহিক চিত্র আরও ভয়াবহ। জেনারেল মইনউদ্দিন ও ড. ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকার যে অর্থবছরে বিদায় নিয়েছিল, সে বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ১৯.৭ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র জিডিপির ১৯.০ শতাংশ। অর্থাত্ বর্তমান সরকারের আমলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অব্যাহতভাবে নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে এবং সাড়ে তিন বছরে জিডিপি’র ০.৭ শতাংশ কমেছে। বর্তমান অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগেও একই রকম ধস নেমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মে মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত কাহিনী মনে পড়লো। ২০১০ সালে বন্দী অবস্থায় আমার রিমান্ড চলাকালীন টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে একজন প্রশ্নকর্তা বলেছিল, আমার বিরুদ্ধে নাকি বিনিয়োগ বোর্ডে নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালীন বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জবাবে আমি বলেছিলাম, প্রথম কথা অভিযোগটি সর্বৈব মিথ্যা। কারণ ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সেই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল। আর দ্বিতীয়ত বিনিয়োগ হ্রাস পেলে যদি নির্বাহী চেয়ারম্যানকে টিএফআই সেলে ধরে এনে নির্যাতন করার রীতি চালু হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তিই এই দায়িত্বটি আর নিতে চাইবেন না। জানি না ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে আমার মতো করে বিনিয়োগ বোর্ডের বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যানকেও টিএফআই সেলে ধরে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার জন্য কৈফিয়ত তলব করা হবে কি-না।
বাজেট বিষয়ে লিখিত আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন ভর্তুকি, বাজেট ঘাটতি, জাতীয় সঞ্চয় এবং রফতানির অবস্থা বর্ণনা করে শেষ করব। বিএনপি আমলের শেষ বছর (২০০৫-০৬) বাজেটে মোট ভর্তুকি ও চলতি স্থানান্তর খাতে অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১১০৭৩ কোটি টাকা। আর সেই একই খাতে বর্তমান অর্থবছরে সরকার ৩৪৬৪২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ছয় বছরে তিন গুণেরও অধিক ভর্তুকি দেয়ার ধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে অব্যাহত রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার এই যে অপচয়ের মহোত্সবের সূচনা করেছে, তার ফলে ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়বে। ভর্তুকির মতো বাজেট ঘাটতিতেও সরকার রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে একটি রাষ্ট্রে বাজেট ঘাটতি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদের আগে এই ঘাটতি সর্বদাই ৫ শতাংশের অনেক নিচে অবস্থান করেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটে প্রাক্কলিত ঘাটতি ৪৫২০২ কোটি টাকা অতিক্রম করে প্রকৃত ব্যয় ৪৬৩২৪ কোটি টাকা হয়েছে, যা মোট দেশজ উত্পাদনের ৫.১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫২০৫৮ কোটি টাকা, যা প্রাক্কলিত দেশজ উত্পাদনের ৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরকে বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ বছর বলা চলে। কারণ সর্বশেষ সংবিধান সংশোধনী (পঞ্চদশ সংশোধনী) অনুযায়ী আগামী সাধারণ নির্বাচন ২৫ অক্টোবর ২০১৩ থেকে ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ মধ্যবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা সহজেই ধারণা করতে পারি, সরকারের শেষ বছরেই ক্ষমতাসীনরা সর্বাধিক লুটপাটে ব্যস্ত থাকবে। সেই লুটপাটে সহায়তা করার লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার অবাধ সুযোগও রেখেছেন। সুতরাং, অধিক হারে দুর্নীতিজনিত ঘাটতি যে এবারও প্রাক্কলিত বরাদ্দকে ছাড়িয়ে যাবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার সংক্ষেপে রফতানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যাক। এ বছর মার্চ থেকে শুরু করে মে মাস পর্যন্ত তিন মাসে রফতানিতে ধারাবাহিক পতনের ধারা অব্যাহত আছে। গত অর্থবছরে রফতানিতে রেকর্ড ৪১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করায় আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬.৭-এ উন্নীত করা সম্ভব হয়েছিল। এ বছর প্রথম এগারো মাসে সেই রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে মাত্র ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থবছরের সর্বশেষ মাস অর্থাত্ জুনের রফতানি হিসাব পাওয়া গেলে বছর শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী বর্তমান অর্থবছরে ৪৪টি পণ্যের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দীর্ঘায়িত হওয়ায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের রফতানি খাতে। তদুপরি বিদ্যুত্সহ অন্যান্য অবকাঠামোজনিত দুর্বলতা শিল্প খাতে উত্পাদন সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা কাটার কোনোরকম আশু সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলে আগামী অর্থবছরেও রফতানি খাতে সুসময় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। রফতানি হ্রাস পেলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশের জিডিপিও নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে।
আজকের সর্বশেষ আলোচনা জাতীয় সঞ্চয় নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ বছরে (২০০৭-০৮) জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ৩০.২ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে সেই সঞ্চয় ২৯.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাত্ গত চার বছরে আমাদের জাতীয় সঞ্চয় ০.৮ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে দিনবদলের সরকার। একদিকে ভর্তুকি এবং বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি এবং অপরদিকে জাতীয় সঞ্চয় ভেঙে খাওয়ার অর্থই হলো সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিজনিত অপচয় দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর অন্তে শেখ হাসিনার সরকার যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নরূপ :
১. জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
২. জাতীয় সঞ্চয় বিপজ্জনক হারে কমেছে;
৩. বেসরকারি খাতে দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে;
৪. রফতানি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী;
৫. বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশ অতিক্রম করায় আর্থিক খাতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে;
৬. ভর্তুকি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে;
৭. সুশাসন নির্বাসনে; এবং
৮. প্রশাসনে সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও আমার ধারণা, দেশের দলনিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করবেন, তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা এনেছিলেন। বাজেট ঘাটতি এবং ভর্তুকির বিষয়ে তার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজেও সমর্থন করতেন। ফলে মন্ত্রিসভায় সহকর্মীদের চাপকে সাইফুর রহমান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সময় জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণ জাতীয় আয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুফল পেতে শুরু করেছিল। ২০০৩-০৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে বিএনপির সর্বশেষ বছর ২০০৫-০৬ পর্যন্ত জিডিপি টানা ৬ শতাংশের ঊর্ধ্বে থেকে মূল্যস্ফীতি এক অংকে ৩ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে জিডিপিতে তুলনামূলক বৃদ্ধি না হলেও মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে দুই অংক অতিক্রম করেছে। ফলে জনগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি খাতে তাদের জীবনযাপনের ব্যয়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে। লোডশেডিং না কমলেও এক বিদ্যুত্ বিলেই ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ ২০০ শতাংশের অধিক। তুলনামূলকভাবে কম মূল্যের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ডিম ও ডালের মূল্য বেড়েছে যথাক্রমে ৩০০ ও ২০০ শতাংশ। বাড়িভাড়া, যানবাহনের খরচ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির ফলে নির্ধারিত আয়ের জনসাধারণের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য মন্ত্রী, সরকারি দলের এমপি এবং মহাজোটের নেতাকর্মীদের রাতারাতি আয় বৃদ্ধি আলাদিনের চেরাগ দ্বারা প্রাপ্ত সম্পদকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মহাজোটের নব্য সম্পদশালীদের কাহিনী প্রায় প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে। মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয়ের মধ্যকার ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ’ এবং ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ সম্পর্কে কী প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি :
১.১ দ্রব্যমূল্য : দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মত আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা : দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রতি দফতরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন করা হবে। সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপকভাবে কম্পিউটারায়ন করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে।
আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার যে আসমান-জমিন ফারাক, সে বিষয়ে অধিক লেখার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনের যে নজির বর্তমান সরকার সৃষ্টি করেছে, জনগণের কাছে তার জবাবদিহি করার সময় আগতপ্রায়। ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল বিধায় যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করেই বলছি, কোনো দুর্নীতিপরায়ণ, অত্যাচারী শাসকের পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরে গণআকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ইনশাআল্লাহ্ এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : আগ্রাসী দলীয়করণের অশুভ পরিণতি



মাহমুদুর রহমান
দিন বদলের সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে বিতর্কিত করতে সক্ষম হয়েছে। দলবাজ প্রশাসন নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে, গত সপ্তাহে পুলিশের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে আমি নিজেও লিখেছি। আজ বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যকার সাম্প্রতিক বহুল আলোচিত বাদানুবাদের মধ্যেই আমার মন্তব্য-প্রতিবেদন সীমিত রাখব। এই আমলের বিচার বিভাগের সঙ্গে আমার বৈরী সম্পর্কের কথা শুধু দেশবাসী নয়, বিদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাও অবগত আছেন। আদালতে সরকারি দলের নজিরবিহীন দলীয়করণের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ এবং মন্তব্য-প্রতিবেদন লেখার ‘অপরাধে’ আমি আদালত অবমাননার দুটি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলও খেটে এসেছি। সরকার ও বিচার বিভাগের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত হলেও আমার জন্য সন্তোষের বিষয় হলো, যে কথাগুলো আমি আড়াই বছর আগে লিখেছিলাম, সেগুলোই আজ দেশে-বিদেশে সবাই বলছেন। আদালত শুদ্ধিকরণের লড়াইয়ে তখন একাকী হলেও আজ মনে হচ্ছে, আমি আর নিঃসঙ্গ নই। কোটারি সর্বস্ব বাংলাদেশে আমরা যার যার সুবিধামত ইতিহাস তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সুবিধাবাদীদের ইতিহাস তৈরি প্রসঙ্গে এক-এগারোর সরকারের সময়কালীন একটা উদাহরণ দিয়ে আজকের মূল বিষয়ে ফিরব।
এক-এগারো সরকারের একেবারে প্রথমদিকের সমালোচনাকারীদের মধ্যে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্যু দেতার প্রথম দিনে ওই সরকারের গঠন প্রণালী এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বিবিসিতে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রথম যে বিবৃতিটি ছাপা হয়েছিল, সেটিরও এক নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন সামাদ ভাই। সেই সময় নয়া দিগন্ত পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে জেনারেল মইন ও ফখরুদ্দীনের যৌথ সরকারের মুখোশ উন্মোচনের যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়েছিলাম আমি এবং কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের ঔরসে জন্মলাভকারী সরকারটি ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, আর আমি সেই সরকারের সমালোচনা করে প্রথম কলামটি লিখেছিলাম একই মাসের ২৭ জানুয়ারি। ‘অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার বিপদ সংকেত’ শিরোনামে লেখা কলামের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি;
“তবে দেশের ভালো চাইলে, অর্থনীতির উন্নয়ন চাইলে, যত তাড়াতাড়ি জনগণের নির্বাচিত একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়, ততই মঙ্গল। স্বদেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকারের চেয়ে উত্তম এবং বৈধ কোনো সরকারব্যবস্থা এ যাবত আবিষ্কার হয়নি। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই আমরা দ্রুততার সঙ্গে সর্বনাশের দিকে ধাবিত হবো। আশির দশকের এক পতিত, দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরশাসককে সব দল মিলে মহা তারকারূপে পুনর্বাসিত করে সেই অগ্রস্ত্যযাত্রার প্রথম পদক্ষেপটা আমরা বোধহয় নিয়েই ফেলেছি।”
গণতন্ত্রের সপক্ষে আমার কলম ধরার মুহূর্তে ডাকসাইটে রাজনীতিবিদরা হয় গা-ঢাকা দিয়েছেন, নয়তো বোবার শত্রু নাই নীতি গ্রহণ করে আত্মরক্ষার চেষ্টায় রত ছিলেন। সেই কঠিন সময়ে দেশের তাবত্ বুদ্ধিজীবীকুল এবং সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ওই একই কলামে এক-এগারোর সরকার যে আইনসিদ্ধ নয়, সেই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলাম—‘বাস্তবতা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে। বর্তমান অবস্থায় এ নিশ্চয়তা বোধ হয় কেউ দিতে চাইবেন না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল প্রজ্ঞাপন এবং সেই বাতিল করা নির্বাচনের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন ১৭ জন সংসদ সদস্য সংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করার অভিযোগ ভবিষ্যতে উত্থাপিত হবে না।’ উল্লিখিত কলামটি কাশবন প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘জাতির পিতা ও অন্যান্য’তে সঙ্কলিত হয়েছে। লেখালেখির বাইরে টেলিভিশন টকশো’তে দেশবাসীকে বিশেষ সরকারের স্বরূপ চেনানোর বিপজ্জনক দায়িত্ব নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির এবং সাবেক সচিব মো. আসাফউদ্দৌলাহ সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেছেন। আমিও দুই-একটি চ্যানেল থেকে কখনও সখনও ডাক পেলে ছদ্মবেশী সামরিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করতাম। টেলিভিশনে আমার কালো তালিকাভুক্তির সূচনাও তখনই ঘটে। আর এই আমলে তো কোনো চ্যানেলে আমাকে আমন্ত্রণ জানালে সেই চ্যানেল বন্ধের সরাসরি হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে। আজকাল টক শো’তে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক-এগারো সরকারের বিরোধিতা করার অসত্য দাবি করে থাকেন, তাদের অধিকাংশই তখন হয় নীরব থেকেছেন অথবা সামরিক সরকারের পক্ষাবলম্বন করেছেন। ইতিহাস বিকৃতি সম্ভবত আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। একইভাবে বিচার বিভাগ আজ চারদিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেক ব্যক্তিই হয়তো দাবি করবেন যে তারাই মামলার ঝুঁকি নিয়েও আদালত পাড়ার অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। হাওয়া বুঝে পাল খাটানোতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তির অভাব এ দেশে কোনোদিনই হয়নি। তবে এক্ষেত্রে জেল খাটা আসামি হওয়ার কারণে আমার অন্তত খানিকটা অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। ধারণা করছি, আমার দুটি আদালত অবমাননা মামলার সব নথিপত্র এবং রায় ডিএলআর (DLR)-এ স্থান করে নিয়েছে। সুতরাং, ইচ্ছে থাকলেও অন্য কারও পক্ষে সেই ইতিহাসে ভাগ বসানো সম্ভব হবে না।
মূল আলোচনায় ফিরে আসি। বর্তমান সরকার তাদের সাড়ে তিন বছরে উচ্চ আদালতে রেকর্ড সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে। সেসব নিয়োগের পেছনেও মূলত দলীয় বিবেচনাই কাজ করেছে। এই বিচারপতিদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় হিসেবে পরিচিত বিশেষ একজনকে নরসিংদীর জেলা জজ থেকে কয়েক ডজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে ঢাকার জেলা জজে পদোন্নতি দিয়ে পরে হাইকোর্টের বিচারপতি পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া খুনের মামলার আসামি এবং সুপ্রিমকোর্টে ভাংচুরে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীও বিচারপতি হয়েছেন। বাদবাকি নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অতীতে সরকারদলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের ইতোপূর্বে প্রদত্ত নির্দেশনার কোনোরকম তোয়াক্কা বর্তমান সরকার করেনি। গত সাড়ে তিন বছরে আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগেও নির্বিচারে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। আদালতকে অপব্যবহার করে ভিন্নমত দলনের এক চরম নিন্দনীয় নজির স্থাপন করেছে দিন বদলের সরকার। হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন নিয়েও আদালত পাড়ায় নানারকম বিতর্ক রয়েছে। সিনিয়র বিচারপতিদের সমন্বয়ে রিট বেঞ্চ গঠন না করে দলীয় বিবেচনায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এক সময় উচ্চ আদালতে অধিক সংখ্যায় বিব্রত হওয়ার নজিরের সঙ্গে হাল আমলে বিভক্ত রায়ের রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় নিম্ন আদালতে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুরের রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে পর্যন্ত হত্যা করার ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে মহাজোট সরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার জন্য আজ পর্যন্ত একজন বিচারপতিকেও দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাধিক বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী লন্ডনে টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে পুলিশের এত বড় নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। একই বিচারপতি মো. আসাফউদ্দৌলাহ, সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং শফিক রেহমানসহ দেশের সম্মানিত ব্যক্তিদের তার এজলাসে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য প্রণীত আচরণবিধিও তিনি প্রতি পদে লঙ্ঘন করেছেন। প্রধান বিচারপতি এই অসঙ্গত আচরণের রাশ টেনে ধরার কোনোরকম চেষ্টা করেননি। অবশেষে সংসদের সঙ্গে আদালতের অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধ সৃষ্টিতেও একই বিচারপতি মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন।
সরকারের অতিমাত্রায় দলীয়করণের নীতি এবং আদালত নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি অবধারিত ছিল। এই আশঙ্কা থেকেই ২০১০ সালের ১০ মে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে লিখেছিলাম—
“একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে মাননীয় বিচারকদের সঙ্কীর্ণ দলীয় চিন্তাধারা অতিক্রম করে কেবল সংবিধান ও দেশের আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়। আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিচার বিভাগকে দলীয়করণের যে মন্দ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে তারা নিবৃত্ত না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাব। আমাদের দেশের দুর্গতির জন্য এক সময় ব্যবসায়ীদের দায়ী করা হতো। তারপর আমলা এবং রাজনীতিকদের। একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শেষ ভরসার স্থল বিচার বিভাগ এবার কলঙ্কিত হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে বিচারকদের আচার-আচরণ, সর্বত্র অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট চিহ্ন দৃশ্যমান। এই অনাচারের পরিণামে জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে শেষ পর্যন্ত হয়তো চরম মূল্যই আমাদের দিতে হবে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে অন্যায়-অবিচারের ভয়াবহ বিস্তৃতি এক সময় দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে যখন ক্যালদীয়রা পবিত্র নগরী জেরুজালেম আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছিল, সেই সময়ের নবী যেরেমিয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতির সঞ্চিত পাপ সমস্ত জাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় (অভিশপ্ত নগরী, সত্যেন সেন)।”
এই লেখালিখিতে সংশ্লিষ্টদের সংবিত্ ফেরার পরিবর্তে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। আমাকে সাজা দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে সুপ্রিমকোর্ট ভবিষ্যতের সব সমালোচকের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ৫ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের তার বিরুদ্ধে দল বেঁধে সমালোচনা আমার উপরিউক্ত লেখার যৌক্তিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নতুন করে প্রমাণ করেছে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন বোধ করছি।
দেশের শীর্ষ আইনজীবীরাও সংসদ এবং আদালতের মুখোমুখি অবস্থানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রের এই দুই স্তম্ভের মধ্যকার তিক্ততা অব্যাহত থাকলে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রই হুমকির মুখে পড়বে। তারা দুই পক্ষের মন্তব্যকেই অনভিপ্রেত উল্লেখ করে ব্যাপারটির আশু সমাধান কামনা করেছেন। আমাদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়েই সংসদের ওপর আদালতের এক ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছে। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম ড. কামাল হোসেন অবশ্য বলেছেন, দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় সংসদই সুপিরিয়র। যে ব্রিটিশ সিস্টেমের আদলে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হয়, সেখানেও সংসদের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সে কারণে যুক্তরাজ্যে সব বিষয়কে আদালতে টেনে নেয়ার রেওয়াজ নেই। আদালতও Justiciability (আদালতের এখতিয়ার)-এর আলোকে সিদ্ধান্ত নেন কোন বিষয়টি তাদের বিচারিক আওতার মধ্যে পড়ে। সাধারণত সংসদ দ্বারা প্রণীত আইন বিষয়ে তারা বিচার করতে অপারগতা প্রকাশ করে থাকেন। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম মানবাধিকার বিষয়ক পর্যালোচনা। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেনে Human Rights Act প্রণীত হওয়ার পর থেকে আদালত কোনো আইন পর্যালোচনা করে যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ওই আইনের কোনো অংশ Human Rights Act, 1998-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাহলেই কেবল ওই অংশ সংশোধনের জন্য আইনটি সংসদে ফেরত পাঠানো হয়। এর বাইরে অবশ্য Judicial review (বিচারিক পর্যালোচনা) করার রেওয়াজ রয়েছে। আইন নিয়ে পড়াশোনা না করলেও আইন সংক্রান্ত কিছু বই-পত্র উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছে। সংসদে গৃহীত পঞ্চম, সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী আদালত কর্তৃক যেভাবে বাংলাদেশে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, আমার ধারণা, তার তুল্য নজির যুক্তরাজ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে প্রণীত আইনের উচ্চতর অবস্থান সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য বিচারপতি লর্ড রিড (Lord Reid) তার এক রায়ে বলেছেন :
“In earlier times many learned lawyers seem to have believed that an Act of Parliament could be disregarded in so far as it was contrary to the law of God or law of nature or natural justice, but since the supremacy of Parliament was finally demonstrated by the revolution of 1688 any such idea has become obsolete.”
(অতীতে অনেক আইনজীবীর মধ্যে এমন ধারণা ছিল যে, সংসদে প্রণীত আইন উপেক্ষণীয় হতে পারে যদি সেটি স্রষ্টার আইন কিংবা প্রকৃতির আইন অথবা স্বাভাবিক আইনের পরিপন্থী হয়; কিন্তু ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে এ জাতীয় ধারণা সেকেলে হয়ে গেছে।)
বাংলাদেশে এর আগে কখনও বিচার বিভাগ এবং সংসদের মধ্যে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়নি। আগের বিচারপতিরা সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে আচরণবিধি সুচারুরূপে পালন করার কারণে সমাজের সব অংশের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধাভাজন থাকতেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কথায় কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে নেয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থার এতটাই অবনতি হয়েছে যে, এক বাদী পবিত্র কোরআন শরীফ পর্যন্ত সংশোধনের আবদার নিয়ে রিট বেঞ্চে হাজির হওয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই অধঃপতনের দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকেই সর্বতোভাবে বহন করতে হবে।
বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রাথমিক কাজটি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসন (Impeach) করার ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সংবিধানের বর্তমান নির্দেশনা অনুযায়ী অভিশংসনের জন্য একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে Supreme Judicial Council গঠনের নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ৯৬(৩) ধারায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া নিম্নোক্তভাবে নির্দেশিত হয়েছে :
‘একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে যাহা এই অনুচ্ছেদে কাউন্সিল বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকের মধ্যে পরবর্তী যে দুই জন কর্মে প্রবীণ তাহাদের লইয়া গঠিত হইবে।’
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সেই বিচার বিভাগই মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়ে রায় দিয়ে দেশে অনভিপ্রেত বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ১৯৭১ সালে প্রকৃতপক্ষে কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান আদৌ আদালতের এখতিয়ারের (Justiciable) মধ্যে পড়ে কি-না, এই প্রশ্ন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যেই রয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে জনগণ অবশ্যই সে প্রশ্নের জবাব খুঁজবে। ইতিহাস রচনার দায়িত্ব যে ইতিহাসবিদদের কাছেই থাকা উচিত, আমার এই মন্তব্যের সঙ্গে আশা করি দেশের অধিকাংশ নাগরিকই সহমত পোষণ করবেন।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে উপলক্ষ করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা আবারও সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দিয়েছেন। তবে হুমকি বাস্তবায়নের ক্ষমতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র আছে কিনা, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর ক্ষমতাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তার সঙ্গে ঢাকায় ও লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশের তথাকথিত রাজ পরিবারের সদস্যদের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি আদালত পাড়ায় বহুল প্রচারিত। সুতরাং, পুরো বিতর্কটি ধামাচাপা পড়লে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না। এদিকে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদে ফিরিয়ে আনার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসনের (Impeachment)-এর ক্ষমতা সংসদের ওপরই ন্যস্ত ছিল। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সেই সংশোধনীর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ধারাটি পূর্ববত্ রেখে দিয়েছেন। অর্থাত্ রায় লেখার সময় তিনি বিচার বিভাগের কোটারি সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়ে যেহেতু আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, কাজেই ভবিষ্যতে এই লক্ষ্যে আবারও সংবিধান সংশোধনের দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।
৪১ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে শাসকশ্রেণী জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সংবিধানকে কেবল নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসেবে যার যার সুবিধামত ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের সাড়ে তিন বছরে এই গর্হিত কাজটি এতটাই নগ্নভাবে করা হয়েছে যে, জনগণের মধ্যে সংবিধান সম্পর্কেই এক ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সংবিধানে বারবার কাটাছেঁড়ার পরিবর্তে এবার দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নই সম্ভবত ষোল কোটি মানুষের মুক্তির পথ হতে পারে। ১৯৭২ সালে যে সংসদ সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, সেই সংসদের সব সদস্য ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসনাধীন লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক (Legal Frame work)-এর অধীনে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশে নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কেন্দ্রীয় (MNA) ও প্রাদেশিক (MPA) সংসদের সব সদস্যকে একত্রিত করে বাংলাদেশের গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠিত হয়েছিল। নির্বাচিতদের মধ্যে পাকিস্তানের কয়েকজন দালালকে কেবল গণপরিষদের বাইরে রাখা হয়েছিল। এ সবই ইতিহাসের অংশ। কাজেই চার দশকের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের গণআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবার দ্বিতীয় সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া উচিত। নতুন সংবিধান প্রণয়নে সমাজের সব শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করলে সেই দলিলে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করা যায়। এই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদসহ দেশের সব বিজ্ঞজন ভেবে দেখতে পারেন।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচ্ছৃঙ্খল পুলিশ



মাহমুদুর রহমান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দীর্ঘদিন মেঠো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থেকে এবং একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন মাঠকর্মী হিসেবে প্রবীণ বয়সে এমপি হওয়াটাই তার জন্য পরম গৌরবের বিষয় ছিল। কিন্তু বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকায় তিনি প্রথম সুযোগেই কেবল ফুল মন্ত্রী নন, মহাশক্তিধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদও দখল করতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি-নৈতিকতা শিকেয় তুলে অতিমাত্রায় দল এবং দলীয় প্রধানের প্রতি অনুগত থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
সাহারা খাতুন তার বিভিন্ন বক্তব্যে প্রসঙ্গ থাকুক আর না-ই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেনে এনে তার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের বয়ান দেন, সেটার কারণও জনগণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এতে আমজনতার হয়তো তেমন কোনো সমস্যাও হতো না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হাতে পেয়ে তিনি প্রজাতন্ত্রের পুলিশ বাহিনীকে যে নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং দলীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন, সেখানেই যত সমস্যা। গত সাড়ে তিন বছরে তার কণ্ঠে ‘আমার পুলিশ’ কথাটি যে কতবার উচ্চারিত হয়েছে, তার হিসাব রাখাই কঠিন।
পুলিশ যে প্রজাতন্ত্রের, সাহারা খাতুনের নয়—এটা বোঝানোর মতো কেউ সম্ভবত তার পাশে নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান, তদীয় কন্যা শেখ হাসিনা এবং সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনীতিবিদ বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো করে রাষ্ট্রকে একেবারে নিজস্ব সম্পত্তি বিবেচনা করেননি। একজন মন্ত্রী যখন তার মন্ত্রণালয়কে পৈতৃক অথবা দলীয় জমিদারি ভাবতে শুরু করেন, তখনই সুশাসনের বারোটা বেজে যায়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আইন ও মানবাধিকারের প্রতি যে চূড়ান্ত অবজ্ঞা আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার প্রধান দায়-দায়িত্ব তাই বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই বহন করতে হবে।
সাহারা খাতুনের পুলিশ গত সপ্তাহ খানেকের মধ্যে যে অমার্জনীয় কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্তসার এবার প্রস্তুত করা যাক। গত মাসের ২৬ তারিখে রোকেয়া সরণিতে পলিটেকনিকের ছাত্রীদের অবরোধের ছবি তোলার সময় একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ প্রথম আলোর তিন ফটো সাংবাদিককে বেধড়ক লাঠিপেটা করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পেটানোর সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার চিত্কার করে বলেছে, পেটা সাংবাদিকদের, ওরাই যত নষ্টের গোড়া, এদেশে সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। পুলিশ কর্মকর্তার দাবির পেছনে যুক্তি আছে। সত্যিই তো, ঘরে ঢুকে সাংবাদিক খুন করলে যে দেশে কিছু হয় না, সেখানে যত্সামান্য পিটুনি তো নস্যি! একই মাসের ২৯ তারিখে পুরনো ঢাকার আদালতপাড়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা বিচারপ্রার্থী এক তরুণীকে পুলিশ ক্লাবে ধরে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেছে আওয়ামী-বাকশালী পুলিশ। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন তিন সাংবাদিক, দুই আইনজীবীসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারী জনতা। আহত তিন সাংবাদিক যথাক্রমে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনে কর্মরত আছেন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার জন্য নির্যাতিত তরুণীকেই উল্টো কোতোয়ালি থানায় ধরে নিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অতি ঘনিষ্ঠ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল চক্রবর্তী খবর পেয়ে থানায় ছুটে না গেলে তরুণীটির কপালে আরও দুঃখ ছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালকের সামনেই কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিনের উদ্ধত ব্যবহারের খানিকটা নমুনা আমরা টেলিভিশনে দেখতে পেয়েছি। কোতোয়ালি থানার এই ওসির সঙ্গে আমার রিমান্ড চলাকালীন সাক্ষাত্ হয়েছিল।
‘পবিত্র ভূমি’ গোপালগঞ্জের অধিবাসী পুলিশ কর্মকর্তাটি আমাকে সারা রাত থানা গারদে জনা পনেরো মাদকাসক্ত ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। সেই অসহনীয় পরিবেশে সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত অবস্থানকালে এক গ্লাস পানি পানেরও প্রবৃত্তি হয়নি। মিনিট তিরিশের কথাবার্তায় আমার কাছে ওসি সালাহউদ্দিনকে পুলিশের পোশাকে ছাত্রলীগের একজন পাণ্ডার মতোই লেগেছিল। সে বার বার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলছিল, গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার অপরাধে বিএনপি জমানায় তার ভালো কোনো জায়গায় পোস্টিং হয়নি। ভাবখানা ছিল আমিই যেন সেজন্য দায়ী।
ওসি সালাহউদ্দিন ছাড়াও ওই এলাকার বর্তমান ডিসি হারুন ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ডিসি হারুন সংসদ এলাকায় বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেশব্যাপী বিশেষ ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছে। তার সেই ‘বীরত্বপূর্ণ’ কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবেই সাহারা খাতুন হারুন-উর রশীদকে তেজগাঁও জোনের এডিসি থেকে পদোন্নতি দিয়ে লালবাগ জোনের ডিসি বানিয়েছেন। হারুন-উর রশীদ এর আগে লালবাগ জোনে এসির দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১০ সালে লালবাগ জোনে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণ হয়েছিল। ছাত্রলীগ সংযোগের জোরে সে যাত্রায় তার চাকরি রক্ষা পেয়েছিল। হারুন-সালাহউদ্দিনের যৌথ তাণ্ডবে লালবাগ-কোতোয়ালি এলাকার জনগণের কী হাল হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যা-ই হোক, অনেক টালবাহানা শেষে ৩০ তারিখ রাত দুটায় নির্যাতিত তরুণীর মামলা কোতোয়ালি থানা গ্রহণ করেছে। গত মাসের ৩০ তারিখে গাজীপুরের পুলিশ মামুন ভূঁইয়া নামে একজন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে খুনিদের হাতে তুলে দেয়। পুলিশের উপস্থিতিতেই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে অসহায় মামুনকে হত্যা করে। হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ নিহতের হাতকড়া খুলে অকুস্থলে ফেলে রাখে। পুলিশ হেফাজতে আসামি খুনের এ এক লোমহর্ষক কলঙ্কজনক ঘটনা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত একই সপ্তাহের অন্যান্য খবর পর্যালোচনা করলে থানা হেফাজতে অভিযুক্তদের পুলিশি নির্যাতনের আরও অনেক নৃশংস ঘটনা চোখে পড়বে।
নজিরবিহীন পুলিশি নির্যাতন এবং আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি সত্ত্বেও সাহারা খাতুন অব্যাহতভাবে দাবি করে চলেছেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি দশ বছরের মধ্যে সর্বোত্তম অবস্থায় রয়েছে। লজ্জার মাথা খেয়ে তিনি আরও দাবি করছেন, পুলিশও নাকি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এই দাবির পেছনে তার যুক্তি হলো, বিরোধী দলে থাকাকালীন রাস্তায় আন্দোলনের সময় পুলিশ পিটিয়ে তার একটি পা ভেঙে দিয়েছিল। এখন সেই পুলিশ জাতীয় সংসদের সামনে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পা এবং মাথা ভেঙে দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সেটাকে যথেষ্ট বিবেচনা করছেন না। বরং যে পুলিশ কর্মকর্তা এই গর্হিত কাজটি দিনদুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে করেছিল, তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন দিনবদলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তিনি যেদিন তার প্রিয় পুলিশের সাফাই গাইছিলেন, তার আগের দিনেই আদালত চত্বরে এক বিচারপ্রার্থী তরুণী পুলিশের শ্লীলতাহানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও অর্ধডজন নারী বর্তমান মন্ত্রিসভার শোভাবর্ধন করলেও তাদের কাছ থেকে ধর্ষকামী পুলিশের ন্যক্কারজনক আচরণের কোনো নিন্দা এ যাবত জাতির শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
গত শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও দুটি তাকলাগানো মন্তব্য করেছেন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পর তিনি দাবি করছেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকারীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কথা তিনি বলেননি। তিনি শুধু পুলিশকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যুক্তি শুনে সেই ‘তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল’ বিতর্কের কথা মনে পড়ে গেল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের নির্দেশ প্রতিপালিত না হওয়ার অপরাধে পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয়ে অবশ্য সাহারা খাতুন মুখ খোলেননি। একই অনুষ্ঠানে চমত্কৃত হওয়ার মতো তার দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুও সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার কথা বলেননি। মিডিয়াই নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই মহা শক্তিধরের কথা বিকৃত করে ছেপেছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের পর্বতসম ব্যর্থতা ঢাকতে মিডিয়াকে দোষারোপ করা প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীদের রীতিমত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী-বিএনপি-সুশীল-বাম — সবপন্থী পত্রিকাতেই সাহারা খাতুন এবং শামসুল হক টুকুর বক্তব্য অভিন্নভাবে ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি সত্য হলে মেনে নিতে হবে বাংলাদেশের তাবত গণমাধ্যম একসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পেছনে লেগেছে। সেক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুযায়ী উভয়েরই এবার পদত্যাগ অথবা পদচ্যুতির সময় এসেছে। পদত্যাগের সংস্কৃতি আমাদের দেশে তেমন একটা নেই। বিশেষ করে, কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি উজিরে খামাখার চেয়ারে বসে কিছুকাল নিশ্চুপ থেকে এখন আবার যেভাবে প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনে এসে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন, তাতে ভবিষ্যতে জনগণ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় না করা পর্যন্ত মহাজোটের কেউ আর মন্ত্রিত্বের চেয়ার ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষেও যেহেতু বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যদের মতো এতগুলো মেরুদণ্ডহীন চাটুকার একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও কঠিন হবে, কাজেই পদচ্যুতিরও প্রশ্ন ওঠে না। অতএব পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সার্টিফিকেটের পর বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য ভবিষ্যতে আরও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যে অপেক্ষমাণ, সে আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে অন্য ধরনের একটি তথ্য দিয়ে আজকের মতো মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করব। বাংলাদেশ পুলিশের PRP (Police Reform Programme) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পটি ইউএনডিপি (UNDP) এবং ডিএফআইডি (DFID)’র যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউএনডিপি প্রণীত প্রকল্পটির একটি সারসংক্ষেপ (Summary) পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই নথিতে Outcome এবং Output নামে দু’টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। Outcome-এ বলা হয়েছে, “The human rights of children, women and vulnerable groups are progressively fulfilled within the foundations of strengthened democratic governance.” অর্থাত্ শিশু, নারী এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর মানবাধিকার ক্রমান্বয়ে সংরক্ষিত হবে যার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর Output অংশে বলা হয়েছে, “Strengthened capacity of the justice system to ensure democratic governance, protect human rights and human security, improve participation in governance, and access to public services among poor communities.” অর্থাত্ গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শাসন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং রাষ্ট্রীয় সেবা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহজ প্রবেশাধিকার। পিআরপি প্রকল্পের প্রাক্কলিত বাজেটের পরিমাণও বিশাল। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল, এই পাঁচ বছরে ২৯.০১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (২৪৫ কোটি টাকা) প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ইউএনডিপি ৮ মিলিয়ন ডলার এবং ডিএফআইডি ১৬.৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (PRP-Phase I) শুরু হয় ২০০৫ সালে এবং বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ের (PRP-Phase II) বাস্তবায়ন চলছে। প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকলে সেটি পরিশোধের দায় বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের। কাজেই জনগণের অর্থ ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর যদি পুলিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর বর্বর আচরণে অভ্যস্ত হয় এবং মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে, তাহলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকই এই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে এ-জাতীয় প্রশিক্ষণে যে আসলে কোনো কাজ হয় না, সেটা আমরা বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও দেখেছি। বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকল্প নিয়ে বিচারপতিদের বিদেশ যাত্রার সুযোগ বেড়েছে বটে; কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের আদালতগুলোতে সাধারণ নাগরিকের বিচার পাওয়ার সুযোগও ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রণীত পিআরপি-তেও Justice system-এর দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে নিম্ন ও উচ্চ উভয় আদালতেই দলীয়করণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে বিচারপতিগণ আগের মতো সাহসিকতার সঙ্গে ন্যায়বিচার করতে পারছেন না। গত মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে কোনো রাখঢাক না রেখেই মন্তব্য করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত, আদালতে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আদালত ও পুলিশ উভয়ই তীব্র বেগে রসাতলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং বৈদেশিক অর্থায়নে গৃহীত এ-জাতীয় যাবতীয় প্রকল্পের মূল্যায়ন জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন।
শেখ হাসিনার সরকার মূলত পুলিশ এবং আদালতের ওপর ভর করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট দেয়ার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে মহাজোট সরকার। এরশাদ পতনের পর দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। একটি নির্যাতক পুলিশি রাষ্ট্র তৈরির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা তাদের মসনদে টিকে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। আড়িয়ল বিল এবং বিল কপালিয়ার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখেও তাদের সংবিত্ ফিরছে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দেশেই নির্যাতনকারীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদের দুঃখজনক পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক’দিন আগে গণহত্যার অভিযোগে মিসরের এক সময়ের লৌহমানব হোসনি মোবারকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ছোটখাটো লৌহমানবীরা সেখান থেকে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
বি. দ্র. : গত সপ্তাহে ওসির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এই সোমবার মামলা দায়ের করেছেন নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী। বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মারপিট, জখম ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

শনিবার, ১৯ মে, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : বেপরোয়া ফ্যাসিবাদের পুলিশি অ্যাকশন



মাহমুদুর রহমান
বুধবারের নিয়মিত মন্তব্য প্রতিবেদন গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে মহাজোট সরকারের নজিরবিহীন চণ্ডনীতির প্রেক্ষিতে এগিয়ে আনতে হলো। এ দেশে প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। পুলিশের লাঠি শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সব প্রতিবাদকারীর মাথায় বেধড়কভাবে বৃষ্টির মতো পড়ছে। ক্ষমতাসীনদের আচরণে পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, তারা দেশে কিংবা বিদেশে কোনো সমালোচনারই পরোয়া করেন না।
বিরোধী দলের চেয়ারপার্সন ব্যতীত সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকে জেলে পোরা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে এক বিরাট অংশকে আবার কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি প্রিজনে বন্দি রাখা হয়েছে। আমি কাশিমপুর-২ জেলখানায় বন্দি থাকার সময় ওই কারাগারটি সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। ওটা নাকি দুর্ধর্ষ সব জঙ্গি, টপটেরর ও ফাঁসির আসামিদের জন্য তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রতিটি সেলে সার্বক্ষণিক সিসিটিভির ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে বন্দিরা ২৪ ঘণ্টা অর্থাত্ টয়লেট সম্পাদনের সময়ও কর্তৃপক্ষের নজরে থাকে। এমন একটি কারাগারে রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি রেখে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হিটলারীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করছেন। ভেবে অবাক হতে হয় একটি সরকার কতখানি বর্বর হলে একজন রাজনীতিবিদকে গুম করেই ক্ষান্ত হয় না, তার অসহায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে অধিকতর আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে গভীর রাতে নির্লজ্জভাবে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকা পালনকারী পুলিশ তার বাসস্থানে পাঠাতে পারে! বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে আওয়ামীপন্থী ও শেখ হাসিনার চাটুকার ছাড়া অন্যান্য নাগরিকের বসবাস করা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

বিরোধী দলকে সরকারের গুমের হুমকি
মেয়াদের সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে গণতন্ত্রের শতছিন্ন নেকাবটিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার। ক্ষমতার হোয়াইট ওয়াইন (সৈয়দ আশরাফের প্রিয় সোমরস) পানে মত্ত আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বিরোধী দলকে এবার ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছেন। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ১৮ দলীয় জোটভুক্ত ৩৩ নেতার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সিএমএম আদালত তাদের কারাগারে প্রেরণের দিনেই এক এগারোর আগে দেশবাসীর কাছে অপরিচিত এই আওয়ামী নেতা হুঙ্কার ছেড়েছেন। মন্ত্রীর চেয়ারে বসে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যায় কীনা, সেই প্রশ্ন কোনো আওয়ামী লীগারকে করে একেবারেই ফায়দা নেই। অন্যদের কথাবার্তা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে কেবল দলটির সভানেত্রীর সংসদের ভেতরে-বাইরে বচন শুনলেই কানে আঙুল দিতে হয়।
তাই শালীনতার প্রসঙ্গ টেনে না এনে আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি। আইন প্রতিমন্ত্রীর হুমকি প্রদানের দিনেই সাহারা খাতুনের পুলিশ উচ্চ আদালতের এক রুলের জবাবে সোজা বলে দিয়েছে দেশপ্রেমিক, লড়াকু বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী তাদের হেফাজতে নেই। অর্থাত্ ইলিয়াস আলীর পরিণতিও চৌধুরী আলমের মতোই হতে চলেছে। কামরুল ইসলামের হুমকির সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই জবাব গভীরভাবে সম্পর্কিত। ঔদ্ধত্যএবং অশালীন আচরণ ও কথাবার্তার জন্য দেশবাসীর কাছে সবিশেষ পরিচিত আইন (!) প্রতিমন্ত্রী তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন মতের সব নাগরিকের ইলিয়াস আলীর ভাগ্য বরণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে তিনি অবশ্যই জানেন র্যাব ও বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক একমাস আগে অপহৃত ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে এতদিনে কী ঘটেছে। আইন প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলকে গুমের হুমকি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক আইনে (Rome Statute of the International Criminal Court) গুম (enforced disappearance) একটি গুরুতর অপরাধ। ২০০২ সালের ১ জুলাই এই আইনটি গৃহীত হয়েছে। তাছাড়া ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রে গুম প্রতিরোধে International Convention for the Protection of all Persons from Enforced Disappearance শিরোনামে কঠোর নীতিমালা গ্রহণ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহতার বিষয়ে এ বছর ২০ এপ্রিল বিবিসি “Enforced disappearances haunt Bangladesh” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (Human Rights Watch)’র ২০১২ সালের রিপোর্টের নিম্নোক্ত লাইনগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে,
Although the numbers of RAB killings has dropped following domestic and international criticism, there was a sharp increase in enforced disappearances, leading to concerns that security agencies have replaced one form of abuse with another.
(অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে র্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা হ্রাস পেলেও, গুমের ঘটনার লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ এক ধরনের গর্হিত আচরণকে অন্য প্রকার গুরুতর অন্যায় দ্বারা বদল করেছে।)
আইন প্রতিমন্ত্রীর সর্বশেষ হুমকি বাংলাদেশের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ রূপে এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতসমূহে তুলে ধরা যেতে পারে। নানারকম আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসীন মহাজোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নজিরবিহীন অত্যাচার, নির্যাতনের মধ্যে বসবাস করেও আমি আশাবাদী যে ইন্শাআল্লাহ্, একদিন ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। গুম হয়ে যাওয়া যে কোনো নাগরিকের পরিবারের সদস্য এই মামলা দায়ের করতে পারেন এবং পারবেন। এটা কখনও তামাদি হবে না। ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভয়াবহ পরিণতির হুমকিদাতারা বিষয়টি স্মরণে রাখলে উপকৃত হবেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনে আদালতের দায়
বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশে চরম নিবর্তনমূলক একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ চালু করেছিলেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে তার হত্যার সঙ্গেই সেই চরমভাবে গণধিকৃত শাসন ব্যবস্থার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। একজন স্বৈরশাসকের মতোই ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের তাবত্ সংবাদপত্র আইন করে তিনি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে একটি বিষয়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশংসা করতে হবে। তিনি আদালতের কার্যক্রমের ওপর হস্তক্ষেপ করেননি। ফলে রক্ষীবাহিনী অধ্যুষিত বাংলাদেশের জরুরি আইনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও উচ্চআদালত অনেক সাহসী রায় দিয়ে খানিকটা হলেও ফ্যাসিবাদের রাশ টানার চেষ্টাটা অন্তত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য সেই সময়ের সম্মানিত বিচারপতিরা উচ্চ মানবিকতাবোধ ও বিবেকসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও তত্কালীন দুর্বিনীত শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।
মাজদার হোসেন মামলা নিয়ে এদেশে এক সময় প্রচুর গলাবাজি শুনেছি। সেই মামলার রায়ের আলোকে ভারতপন্থী ও আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং সেনাবাহিনী সমর্থিত মইন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ প্রশাসন থেকে পৃথকীকরণের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণা নিয়ে সেই সময়ের সুশীল (?) পত্রিকাসমূহের প্রচারণা চোখে পড়ার মতো ছিল। তাদের প্রচারণায় মনে হচ্ছিল, আইনের শাসন কায়েম হয়ে বাংলাদেশ যেন পুরাণের ‘সত্যযুগে’ ফিরে গেছে। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একাধিক প্রকল্পও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে আজকের বিচার বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাসের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিক মাত্রায় দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ। দেশের বিবেকসম্পন্ন সব বিশিষ্ট আইনজীবী একবাক্যে বলছেন, এদেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালার বালাই নেই। কেবল দলীয় বিবেচনায় গত সাড়ে তিন বছরে উচ্চআদালতে রেকর্ডসংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন। সব বেঞ্চেই সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে একজন করে সম্প্রতি নিয়াগপ্রাপ্ত জুনিয়র বিচারককে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিভক্ত রায় দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড করে বাংলাদেশের নাম গিনেস বুকে ওঠানোর বন্দোবস্ত সম্পন্ন প্রায়। অধিকাংশ রাজনৈতিক মামলায় পূর্বেকার রীতিনীতি (Convention) ভঙ্গ করে জুনিয়র বিচারপতিরা যাদের চাকরি এখনও ‘কনফার্মড্’ (Confirmed) হয়নি, তারাও অম্লান বদনে সিনিয়র বিচারপতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে চলেছেন। কোর্ট রিপোর্টারদের কাছ থেকে শুনেছি, এসব মামলায় বিশেষ চিরকুট পকেটে নিয়েই নাকি এ নবীন বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। শুনানি শেষে সিনিয়র বিচারপতির রায় প্রদান সমাপ্ত হলে সেই চিরকুট দেখে বিভক্ত রায় ঘোষণা করা হয়।
গত সপ্তাহে সিএমএম আদালতে যে কাণ্ড ঘটল, তার মাধ্যমেও বিচার বিভাগের তথাকথিত স্বাধীনতার স্বরূপ পুনর্বার উন্মোচিত হয়েছে। যে মামলায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী, বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে সিএমএম কোর্ট আগেই জামিন দিয়েছে, সেই একই মামলায় বিস্ময়করভাবে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ ৩৩ জন অভিযুক্তের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মধ্যরাতের টক শো’তে নিয়মিত অতিথি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা সংক্রান্ত এক মন্তব্য করায় তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে হাইকোর্টে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সুশীলরা (?) মোটামুটি তার পক্ষে থাকায় এখনও জেলে যেতে না হলেও নিয়মিত উচ্চআদালতে হাজির হয়ে নানা রকম অবমাননাকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন জনপ্রিয় এই অধ্যাপক, কলামিস্ট ও টেলিভিশন স্টার। অথচ মহাজোট সরকারের নেতা ও মন্ত্রীরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অহরহ এই অভিযোগ আনছেন যে, তারা নাকি ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে অসাংবিধানিক কোনো তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার চক্রান্ত করছে।
মাত্র দু’দিন আগে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো দেশে এক এগারোর চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু, সেসব মহাশক্তিধরের বিরুদ্ধে কোনো আদালত এখন পর্যন্ত সুয়োমোটো রুল জারি করেননি। আইন সব নাগরিকের জন্য সমান, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখন শুধু কল্পকথাই। এদেশে চেহারা দেখে যে আইনের প্রয়োগ হয়, সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমি আদালত অবমাননা মামলাতেই প্রত্যক্ষ করেছি। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিনের ‘below contempt’ তত্ত্ব এখনও কানে বাজে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির দায় তাই বিচার বিভাগ এড়িয়ে যেতে পারে না। বিচার বিভাগের দায়িত্বহীনতার কারণেই শ্রমিক নেতা বাকির হোসেন অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী অবস্থায় বিনা চিকিত্সায় মৃত্যুবরণ করেছেন, সুুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমেদকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে, রিমান্ডের নামে দলবাজ র্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা নির্যাতনের লাইসেন্স পেয়েছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শত শত বানোয়াট মামলায় একচেটিয়া জামিন নামঞ্জুর করা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকেও এসব কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ভবিষ্যতে করতে হবে।

মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ডিজিটাল কায়দা
যাই হোক, পিতা ও কন্যার শাসন পদ্ধতির তুলনায় ফিরে যাই। কন্যা বুঝতে পেরেছেন, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সব সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি তাই উদাহরণ সৃষ্টি করে অন্যদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে বেশুমার পত্রিকা ও চ্যানেলের মধ্য থেকে মাত্র একটি-দুটি পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলকে বেছে নিয়েছেন। আমার দেশ বন্ধ করেছিলেন, শীর্ষ কাগজ ও চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দিয়েছেন, যমুনা টিভিকে লাইসেন্স দেননি, একুশে টিভির ওপর নানা পদ্ধতিতে আক্রমণ এখনও চলছে। আমিসহ মাত্র চারজন ভিন্ন মতাবলম্বী সম্পাদককে জেল ও রিমান্ডে নিয়েছেন। তাতেই দেখুন, কাজের কাজটি হয়ে গেছে। বিটিআরসি কর্তৃক সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কয়েকটি টকশো ব্যতীত প্রবলভাবে সরকারের তোষামোদ করে চলেছে। সেই টকশোগুলোতে আবার অতিথি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বিনা প্রতিবাদে পালন করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাভিশনের এক মজার গল্প বলি। সেই চ্যানেলে মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ফ্রন্ট লাইন নামে এক আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাভিশনের একজন প্রযোজক মাস তিনেক আগে আমাকে টেলিফোনে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। সঙ্গে আরও বললেন, আমার বিপরীতে থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং নব্য ব্যাংকার ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর। নির্ধারিত রেকর্ডিংয়ের দিন সকালে আকস্মিকভাবে আমাকে জানানো হলো উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ থাকায় রেকর্ডিং করা যাচ্ছে না। প্রচুর বিনয় সহকারে ভদ্রলোক আমাকে জানালেন, পরের সপ্তাহেই অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করা হবে। বলাই বাহুল্য সেই পরের সপ্তাহ আজ পর্যন্ত আসেনি। আরও তাজ্জবের বিষয় হলো ‘অসুস্থ’ উপস্থাপককে আমি কিন্তু নির্ধারিত দিনে অন্য দুই অতিথি নিয়ে যথারীতি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখেছি।
সরকারিভাবে ঘোষণা দিয়ে মিডিয়া বন্ধ না করেও কতটা কার্যকরভাবে সেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এই মেয়াদে তার চমত্কার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রেও আদালত তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে চলেছে। টেলিভিশনে সরকারকে সমালোচনা করতে গেলেই কথা বলার সময় মাথার ওপর সুয়োমোটো রুলের ঝুলন্ত তরবারির কথা স্মরণ করে অতিথিবৃন্দকে কথা গিলে ফেলতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ড. আসিফ নজরুলের উদাহরণ খানিক আগেই দিয়েছি। একুশের উপস্থাপক অঞ্জন রায় এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খানও উচ্চ আদালতে অনুরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছেন। সম্প্রতি সরকারের সঙ্গে নিজ, পৈতৃক ও শ্বশুরের পরিবারসহ অতিঘনিষ্ঠ, দেশের জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তার উপন্যাসে কী লিখবেন, সে বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদপত্রে রিপোর্টিংয়ের বিষয়েও একই স্থান থেকে নির্দেশনা এলেও সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে নির্দেশ প্রদানকারীরা শেষ পর্যন্ত পিছু হটেছিলেন। অর্থাত্ তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চিন্তা, লেখা, কথা বলা এবং গণমাধ্যমের আর কোনো স্বাধীনতা অবশিষ্ট নেই।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের এমন নগ্ন ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটি এখন পর্যন্ত হয়নি। সুশীল (?) সমাজের আপসকামিতা ও জনগণের ভীরুতার পাশাপাশি বিরোধী দলের বিভ্রান্তিকর রাজনীতিও এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেই আজকের লেখায় ইতি টানব।

বিরোধী নেতৃবৃন্দের পলায়ন কৌশল
যে বানোয়াট মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে গেছেন, সেই মামলাটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মাত্র চারদিন আগে দায়ের করা হয়েছিল। ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় সার্বিক পরিস্থিতি তখন ক্রমেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে তিন বছরের অপশাসনে পিষ্ট জনগণ ঊনসত্তরের মতো গণআন্দোলনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা এমন সময় বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে হিলারি ক্লিনটনের সফরকালে আন্দোলন স্থগিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। বিরোধী দলীয় নেত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দও মার্কিন সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাকে আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধের পরামর্শ দেন।
বিএনপি’র তখন শাঁখের করাত অবস্থা। নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতারের আশঙ্কা। আর গ্রেফতার হলে হরতাল না দিলে ইজ্জত থাকে না। ওদিকে আবার আন্দোলন বন্ধের বিদেশি চাপ। সুতরাং, দল থেকে সিদ্ধান্ত হলো দলবেঁধে পলায়নই উত্তম। বাঘা বাঘা আইনজীবীরা ভরসা দিলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তি এক-দু’দিনের ব্যাপার মাত্র। আর উচ্চ আদালত একবার জামিন দিলে কি নিম্ন আদালত সেটা কাটার সাহস দেখাবে? এসব বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানী আইনজীবী এখনও বোধহয় শেখ হাসিনাকে ঠিকমত চিনে উঠতে পারেননি। রিজভী আহমেদ ব্যতীত সব নেতা পালালেন এবং বিএনপি আন্দোলনে বিরতি দিল।
হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব মুখার্জী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে বিরোধী দলের পুলকিত হওয়ার মতো প্রকাশ্যেই অনেক কিছু বললেন। চেয়ারপার্সনের পরামর্শদাতারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ভাবতে লাগলেন, নাগালের মধ্যেই রাষ্ট্র ক্ষমতা। হাইকোর্টে কয়েকদিনের জন্য আগাম জামিন প্রাপ্তি তাদের সন্তুষ্টির পারদ আরও ওপরে তুলল। শেষ হাসি অবশ্য হাসলেন মাহবুবুল আলম হানিফ, কামরুল ইসলাম, সাহারা খাতুন, শামসুল হক টুকু এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পলায়নের রাজনৈতিক কৌশল সরকারের আদালতি কৌশলের কাছে চরমভাবে মার খেল। বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ঠিকই শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে ভাত খেতে হচ্ছে। উপরি হিসেবে কপালে জুটছে নানা মহলের কটাক্ষ ও নিন্দাবাদ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করার পরিণতিতে বিএনপিকে আবার গোড়া থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। মাঝখান থেকে দেশ-বিদেশে প্রবল সমর্থনপ্রাপ্ত ইলিয়াস গুম ইস্যুকে পেছনে ঠেলে সামনে আনতে হচ্ছে দলীয় নেতা-কর্মীদের জামিন ও মামলা থেকে অব্যাহতির দাবি। কত নির্যাতন, কত জেল-জুলুম, কত প্রাণ বিসর্জন, কত রক্ত ক্ষয়ের বিনিময়ে ইলিয়াসকে ফিরিয়ে দেয়ার ন্যায্য আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠার পর কেবল বিদেশিদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সেই আন্দোলনের গতি শ্লথ করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বিএনপি’র জন্য শেষ পর্যন্ত কতটা বিপর্যয়কর হয়, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে। মামলা দায়েরের পর যদি বিএনপি নেতৃবৃন্দ দলের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করে তাদের গণগ্রেফতারের জন্য সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন, তাহলে ক্ষমতাসীনদের গদি নড়ে ওঠার সম্ভাবনাই অধিক ছিল বলে আমার ধারণা। হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় দেশের অবস্থা স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব সরকারের ছিল, বিরোধী দলের নয়। এ কথাটা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলে বিএনপির তাতে কোনো ক্ষতি হতো না। আজকের ক্ষমতাসীনরা বিএনপি জোট সরকারের আমলে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েলের সফরের দিনে হরতাল পালন করেছিল। তাতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একতরফা মার্কিন সমর্থন পেতে আওয়ামী লীগের কোনো অসুবিধা হয়নি। যে বিদেশিরা আন্দোলন স্থগিত করার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে চাপ দিয়েছিলেন, তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তির জন্য পর্দার আড়াল থেকে কোনোরকম কার্যকর ভূমিকা রাখছেন কীনা, তা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বারিধারার দূতাবাসসমূহে ধর্না দেয়ার চেয়ে জনগণ ও আল্লাহ্র শক্তির ওপর নির্ভর করতেই পছন্দ করি।
সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যেও আমি দীর্ঘ মেয়াদে চূড়ান্ত বিজয়ের আশা ছাড়তে রাজি নই। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, সব স্বৈরশাসককে তার অপকর্মের জন্য এক সময় মূল্য দিতে হয়। তারা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের ট্র্যাজেডির জন্য দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জনসমক্ষে অবিরত অশ্রুপাত করে চলেছেন। সেই ট্র্যাজেডির সঙ্গে সম্পৃক্তদের ফাঁসি দেয়ার পরও তার অশ্রুর বন্যা শেষ হয়নি। এই সেদিনও তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩১তম বার্ষিকীতে নিহত পিতা-মাতা, ভাইদের কথা স্মরণ করে তাকে কাঁদতে দেখলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মধ্যেও অনেককেই চোখ মুছতে দেখা গেল। অথচ এই একই শেখ হাসিনা সাগর-রুনির হত্যা এবং ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তখন রবাট লুই স্টিভেনসনের লেখা কালজয়ী ইংরেজি উপন্যাস ড. জেকিল অ্যান্ড মি. হাইড (Dr. Jekyll and Mr. Hyde)-এর কথা স্মরণে এসে যায়। তিনি সাগর-রুনির এতিম পুত্র, ছয় বছরের মেঘ এবং ইলিয়াসের সাত বছরের কন্যা সাইয়ারা নাওয়ারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চান, অথচ খুনিকে খোঁজার ব্যাপারে তার কোনো উত্সাহ নেই কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি ইলিয়াসকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো নির্দেশও তার কাছ থেকে আসে না। উল্টো ইলিয়াসের পরিবারকেই এখন মধ্যরাতে পুলিশ পাঠিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের বিশেষ খুনেবাহিনী একের পর এক গুম করবে, আর দয়াশীল প্রধানমন্ত্রী এতিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে থাকবেন, এমন বীভত্স রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা বসবাস করতে চাই না। মাত্র দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রী দম্ভোক্তি করেছেন, বিরোধী দলকে কীভাবে সোজা করতে হয় আমি জানি। তিনি আরও বলেছেন, তার সহ্য করার ক্ষমতাকে যেন দুর্বলতা মনে করা না হয়। বিগত সাড়ে তিন বছরের গুম, হত্যা, নির্যাতনের শাসনকাল যদি সহ্যের নমুনা হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে কি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করার আয়োজন চলছে? আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় সন্ত্রাসী হামলা কি প্রধানমন্ত্রীর হুমকির বাস্তবায়ন? শেকসিপয়রের নাটক রিচার্ড-থ্রি (Richard-III) থেকে একটি ক্ষুদ্র অথচ অসাধারণ বাক্য উদ্ধৃত করে দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে হৃদয়ভরা বেদনা নিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি। শেকসিপয়র লিখেছেন— “Bloody thou art, bloody will be thy end.”
(যত তুমি রক্ত ঝরাবে
অন্ত তোমার ততই রক্তাক্ত হবে)।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বব্যাপী নৈরাজ্য



মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে মেধাশূন্য, আওয়ামীপন্থী ভিসি, শিক্ষকদের দুর্নীতি ও দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আমি বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম। বুয়েটের কথাই আগে বলি—কারণ সেখানে শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদের আগে কখনও রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেনি। আমাদের ছাত্রাবস্থায় বুয়েটের শিক্ষকরা কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, এই খোঁজ-খবর নেয়ার চিন্তা কস্মিনকালেও মনে ঠাঁই পায়নি। সেই পাকিস্তানি আমল থেকে সেখানে ভিসি নিয়োগ সর্বদাই যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে হওয়াটাই প্রথা ছিল। ড. রশীদ, ড. নাসের, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. মতিন পাটওয়ারী, ড. ইকবাল মাহমুদ, ড. মো. শাহজাহান এবং সর্বশেষ ড. সফিউল্লাহর মতো অসাধারণ বিদ্বান শিক্ষকরা যে চেয়ারে বসেছেন, সেখানে শেখ হাসিনা কেবল দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন ড. নজরুল ইসলামকে। এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত এবং তিনি সরকারপন্থী পেশাজীবী সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠনটির সভাপতি পদে আছেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
অনেক পাঠকই অবগত আছেন, আমি নিজেও এ ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাবিশিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী প্রকৌশলীদের সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (AEB) এবং জাতীয়তাবাদী পেশাজীবীদের শীর্ষ সংগঠন, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, উভয়ের আহ্বায়কের দায়িত্ব দীর্ঘদিন ধরে পালন করছি। কিন্তু আমার মতো একজন বেসরকারি নাগরিক এবং বুয়েটের ভিসির অবস্থান ও সম্মান কোনোক্রমেই তুলনীয় নয়। তাকে অবশ্যই দলীয় চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে থেকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে কারণেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দসহ দেশের সচেতন নাগরিকরা আশা করেছিলেন যে, ভিসি নিযুক্ত হওয়ার পর অন্তত ড. নজরুল ইসলাম সরকারদলীয় পেশাজীবী সংগঠন থেকে পদত্যাগ করবেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষার চেয়ে বর্তমান ভিসি দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। আওয়ামীপন্থী বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের পদ রক্ষা করে তিনি কেবল দলীয় সভায় উপস্থিত থাকেননি—উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেছেন। বুয়েটের ইতিহাসে কোনো ভিসির এ ধরনের দলীয় সভায় অংশগ্রহণের নজির নেই। এহেন ভিসির আমলে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের যে হাল হওয়ার কথা ছিল, তাই হয়েছে। তিনি কয়েক ডজন সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে নজিরবিহীনভাবে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সভাপতি ড. হাবিবুর রহমানকে বুয়েটের প্রো-ভিসি পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটা ও নিয়োগে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র টেণ্ডারবাজি কায়েম করেছেন। এমন দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগও শুনতে পাচ্ছি—শিক্ষক নিয়োগ ও পরীক্ষায় নম্বর দেয়া নিয়েও নাকি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের অব্যাহত প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই অনাচার অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত তারা ধর্মঘটে যেতেও বাধ্য হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ধর্মঘটী শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে সমস্যা সমাধানে আশ্বাস প্রদান করায় শিক্ষকরা ক্লাস রুমে ফিরে গেলেও ভিসি ড. নজরুল ইসলামের প্রশাসনে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বুয়েটের মহান ঐতিহ্য রক্ষায় দলনিরপেক্ষ আদর্শবান শিক্ষকদের আবারও হয়তো আন্দোলনে ফিরে যেতে হবে। ড. নজরুল দীর্ঘদিন ধরে আইইবি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। তিনি আইইবি ঢাকা সেন্টার এবং কেন্দ্রের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত বছর সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে একসঙ্গে পবিত্র হজও পালন করেছি। তার চরিত্রানুযায়ী দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে ওঠার শক্তি ড. নজরুল ইসলাম কোনোদিনই অর্জন করতে সক্ষম হবেন না বলেই আমার ধারণা। সুতরাং বুয়েটের অধঃপতনের জন্য তার তুলনায় তাকে যারা ভিসির অত্যন্ত উচ্চ ও সম্মানিত পদে নিয়োগ প্রদান করেছেন, তাদেরকেই অধিকতর দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। বুয়েটের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুয়েটকে দলীয়করণের উদগ্র ও অসুস্থ আকাঙ্ক্ষাকেই সার্বিক বিপর্যয়কর অবস্থার জন্য দায়ী করে নিন্দা জানাচ্ছি।
ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর একজন দলবাজ উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল কবির ছাত্রলীগের পাণ্ডাদের একাংশকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনই ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যে, অন্যান্য ছাত্র-শিক্ষক তো বটেই এমনকি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দীর্ঘদিন ঘেরাও, বিক্ষোভ, গণঅনশন, ভাংচুর, হাতাহাতি ইত্যাদি চলার পর আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নাকি ভিসিকে শিগগিরই তার পদ থেকে সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে আর একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। সেখানকার আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনশন ভাঙিয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগের ফতুল্লা আসনের সংসদ সদস্য, এ দেশের চলচ্চিত্রে এক সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী। এই প্রবীণ অভিনেত্রীর লেখাপড়া কতদূর এবং তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, এই তথ্য আমার জানা নেই। লোকমুখে শুনেছি, তিনি নাকি স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। কেবল নায়িকা হওয়ার সুবাদে দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠে তার আগমন যথেষ্ট কৌতুকের সৃষ্টি করেছে।
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দলবাজিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদ্বয়ের সঙ্গে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মন্তব্য করেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা বুয়েট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও খারাপ। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক আন্দোলনে সেখানে কর্মবিরতি চললেও ভিসি ড. মুহাম্মদ আলমগীর বহাল তবিয়তে আছেন। কুয়েটে শিক্ষক-ছাত্ররা একবাক্যে বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আগে কখনও রাজনীতি না থাকলেও ড. আলমগীর সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি আমদানি করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে কলুষিত করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছরে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রলীগের বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ছাত্র হত্যা, গণগ্রেফতার, নিয়োগ বাণিজ্য, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নির্যাতন, ভিন্নমত হয়রানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা এই সময়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি।
বাংলাদেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই প্রকার নোংরা রাজনীতিকরণের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আদালতকে ব্যবহার করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮২১ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে ক্ষমতাসীনরা আক্রোশ মিটিয়েছে। একই রকম দলীয়করণের মহোত্সব চলছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও যে কোনো মুহূর্তে শিক্ষক আন্দোলন বেগবান হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত দমনে ফ্যাসিবাদী কায়দায় প্রশাসন চালানো হচ্ছে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের আর কোনো জায়গা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি পদ না থাকলেও ছাত্রলীগ কর্মীদের চাকরি দেয়ার উত্সাহে দ্বিগুণ শিক্ষক নিয়োগ দিতেও সরকারের বাধছে না। গত আড়াই বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০টি বিভাগের বিজ্ঞাপিত ১১৭টি পদের বিপরীতে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় ২০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরও শ’খানেক শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি এবং ভিসি আবদুস সোবহান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ-রসায়ন বিভাগে ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে যোগ্যতায় সর্বনিম্ন দুটি স্থান অধিকারী অর্থাত্ ৪১ ও ৪২ নম্বরের আবদুর রাকিব ও রওশানুল হাবিবকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফার্মেসি বিভাগে ১৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ১১তম অবস্থানে থাকা আবদুল মুহিত চাকরি পেয়েছেন। ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যায় চাকরি পেয়েছেন একই বিভাগের আওয়ামীপন্থী প্রভাবশালী শিক্ষক জহুরুল ইসলামের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী জেবুননেছা ইসলাম। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা প্রদানে তার অযোগ্যতার গল্প বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসির খোরাক জোগাচ্ছে।
এছাড়া একই বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগধারী মনোজ কুমারকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই চরম অনিয়মের বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্সে যথাক্রমে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভকারী শারমীন লীনা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনে (ইউজিসি) লিখিত অভিযোগ করলেও আজ পর্যন্ত তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। রসায়ন, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ও বিচার, ফোকলোর, সমাজ বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, মার্কেটিং এবং পদার্থ বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিভাগেও শিক্ষক নিয়োগে একইভাবে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চস্থান অধিকারীদের বঞ্চিত করে দলীয় বিবেচনায় মেধাতালিকার তলানিতে অবস্থানকারী চূড়ান্ত অযোগ্যদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। অবশ্য শিক্ষক নিয়োগে এই অনিয়ম যে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে, তা নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে পাঠকের বিরক্তি উত্পাদন করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি উদাহরণ টেনেই শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানব।
চারুকলা বিভাগে সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তকে বঞ্চিত করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগপ্রাপ্ত এবং পাসকোর্সে ডিগ্রি ও প্রিলিমিনারি মাস্টার্স পাস নাসিমুল কবির ও নাসিমা হককে। ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগে তালিকার ১ থেকে ৬ পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের পরিবর্তে শিক্ষক হয়েছেন তিনটি দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের সাবেক অনুষদ সভাপতি দুলাল চন্দ্র গাইন। দুলাল বাবু সিলেকশন কমিটির তালিকার ৩৫ জনের মধ্যে ৩৩ নম্বর প্রার্থী ছিলেন। ইসলামের ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩২তম স্থান পাওয়া আবদুল রহীমকে, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজে নিয়োগ পেয়েছেন অনার্সে মাত্র ৪৬ শতাংশ নম্বর পাওয়া নীরু বড়ুয়া। অবশ্য তার প্রধান যোগ্যতা হলো তিনি একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়ার স্ত্রী। পদার্থ বিজ্ঞানে বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্বপন কুমার ঘোষকে।
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের হটিয়ে চাকরি পেয়েছেন অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত তাপস কুমার বিশ্বাস ও দেবদাস হালদার। এই ইন্সটিটিউটে ১১ জনকেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জের আশরাফ সাদেক, কুমিল্লার এক কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার হায়দার, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে ইন্সটিটিউট থেকে একদা বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মাহবুব রহমান এবং প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আত্মীয় পরিচয়ে সুমেরা আহসান পুরোপুরি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের নির্লজ্জভাবে বঞ্চিত রেখে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে মেধা তালিকায় অনেক নিচের স্থান অধিকারীদের। এসব নিয়োগের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিবেকসম্পন্ন সিনিয়র অধ্যাপক আপত্তি জানিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেও সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অবশ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজেই প্রায় সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত, তার মেধাবীদের প্রতি এক প্রকার ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্বেষ থাকাটাই স্বাভাবিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি টেলিভিশনের অতি চেনা মুখ, বিশিষ্ট আওয়ামী ‘বুদ্ধিজীবী’ ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বাইরে বিটিভিসহ সব টিভি চ্যানেলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে তিনি অহরহ জাতিকে জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন। এই বিশিষ্ট সুশীল (?) বুদ্ধিজীবীর শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে খানিক দৃষ্টিপাত করা যাক। ভদ্রলোক ১৯৬৯ সালে অর্থাত্ আমাদের সঙ্গেই এসএসসি পাস করেছিলেন। সেই পরীক্ষায় খুলনার এক স্কুল থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশ্যে বই খুলে গণটোকাটুকির এইচএসসি পরীক্ষায় অবশ্য তার একটি প্রথম বিভাগ রয়েছে। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজ থেকে পাসকোর্সে বিএসসি পাস করেন ১৯৭৫ সালে। রেজাল্ট সেই দ্বিতীয় বিভাগ। ১৯৭৬ সালে প্রিলিমিনারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ থেকে আবারও দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত হন এবং শেষাবধি ওই দ্বিতীয় শ্রেণীতেই মাস্টার্স শেষ করেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮৫ সালে পিএইচডি করেছেন সব আওয়ামীর তীর্থভূমি ভারতের মহিশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এহেন দিকপাল চাকরি জীবন আরম্ভ করেছিলেন বুয়েটে PIO (Publication Information Officer) পদে। বঙ্গবন্ধুর ‘একনিষ্ঠ সৈনিক’ বিস্ময়করভাবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ পান। সেই সময় তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা কোন দিকে ছিল, সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আশা করি, ভিসি মহোদয় মনে কষ্ট পাবেন না। ১৯৭২ সালে গণটোকাটুকির সুযোগ না পেলে যে ব্যক্তির জীবনে কোনো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাওয়ার সৌভাগ্য হতো না, তাকে শেখ হাসিনা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানিয়েছেন। ভাগাভাগি সংক্রান্ত বিবাদে সম্প্রতি আওয়ামী শিক্ষক ক্যাডার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, অধ্যাপক ওহিদুজ্জামান চাঁন ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে রুলও ইস্যু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলনিরপেক্ষ ও বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকরাসহ দেশের আমজনতা সরকারি দলের এই গৃহবিবাদ ভালোই উপভোগ করছেন।
দেশের তাবত্ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে শিক্ষায় দুর্বল করে সক্ষমতায় পিছিয়ে দেয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের দায়ভার বর্তমান সরকার বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকেই বহন করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী কেবল উচ্চ শিক্ষাতেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করছেন না, বিগত তিন বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাতেও আজগুবি ফলাফল বানিয়ে দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
বর্তমান মন্ত্রিসভার গুটিকয়েক সত্ ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর নামও বিভিন্ন স্থানে উচ্চারিত হয়ে থাকে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদের মন্ত্রিসভা ব্যতীত স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অসংখ্য মন্ত্রীর মধ্যে সত্ ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত ছিল সাবেক বামনেতা নূরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সততা কি কেবল টাকা-পয়সা না খাওয়া, নাকি নৈতিক সততা বলেও একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে? শিক্ষামন্ত্রীর চোখের সামনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলবাজ অযোগ্য ভিসিরা উচ্চ শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে চলেছেন, অথচ তিনি চোখ বুজে আছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইঙ্গিতে ও সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষক নিয়োগের নামে সর্বত্র অর্ধশিক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর জন্য চাকরির বাজার খুলে দেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে। এদিকে এসএসসি ও এইচএসসিতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার বাগাড়ম্বরে জিপিএ-৫ ও পাসের হারের উত্তরোত্তর যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে, তাতে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সরকারের আমলে এ পর্যন্ত এসএসসির চারটি এবং এইচএসসির তিনটি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করলেই যে কোনো সচেতন নাগরিক বুঝতে পারবেন আমাদের দেশপ্রেমবিবর্জিত বর্তমান সরকার জাতির জন্য কী ভয়ঙ্কর মরণ খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে।

পরীক্ষা পাসের হার
২০০৯ ২০১০ ২০১১ ২০১২
এসএসসি ৭০.৮৯ ৭৯.৯৮ ৮২.৩১ ৮৬.৩৭
এইচএসসি ৭২.৭৮ ৭৪.২৮ ৭৫.০৮ ——

এসএসসি পরীক্ষার সর্বশেষ ফলাফলে মন্ত্রীর নিজ বিভাগ সিলেটে ৯১ শতাংশ পাস করার যে রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেক সাংবাদিকই বৃহত্তর সিলেট জেলার অধিবাসী। সেই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের এই হঠাত্ মেধার বিস্ফোরণে তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। পরীক্ষায় নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে যে ডিজিটাল কারচুপির গুজব চারদিকে উত্থাপিত হচ্ছে, তাতে জনগণ অবস্থাদৃষ্টে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি আমি এসএসসি পাস করেছিলাম ১৯৬৯ সালে। যতদূর স্মরণে আছে সেই বছর ঢাকা বোর্ডে মাত্র ৬৪ জন স্টার এবং ১৪০০ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। আমাদের সবার মেধা বর্তমানের তুলনায় এতটাই নিম্নস্তরের ছিল মনে করলে লজ্জায় অধোবদন হয়ে পড়ি। সেই সময়কার স্টারকে যদি বর্তমান সময়ের জিপিএ-৫ প্রাপ্তি সমতুল্য মনে করি, তাহলে ঢাকা বোর্ডে এবারের পরীক্ষায় স্টারপ্রাপ্তদের সংখ্যা ২৫০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের সময় ঢাকা কলেজ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯৬৯ সালের এসএসসিতে যারা ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল, তারাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিল। আজকে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের বিপুল সংখ্যা বিচার করলে তাদের মধ্যে কতজন এখনকার ভালো কলেজগুলোতে ভর্তি হতে পারবেন সে প্রশ্ন এসেই যায়। জিপিএ-৫ প্রাপ্তরাও যদি তাদের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে না পারেন, তাহলে আর এই বিপুল নম্বর প্রাপ্তির সফলতা কোথায় রইল? নূরুল ইসলাম নাহিদের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই তারা এসএসসিতে শতভাগ পাসের রেকর্ড গড়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিতে চান! এসএসসিতে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা প্রতি বছর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নূরুল ইসলাম নাহিদ এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছেন। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কার স্বার্থে, সেটা শিক্ষামন্ত্রীই ভালো জানেন। তথাকথিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি যে প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছে, তারা তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আন্তর্জাতিক সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কীনা, সেই আলোচনা আজ সর্বত্র। শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন, সেটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপর্যয়কর হিসেবেই বিবেচনা করি। আমি শিক্ষাবিদ নই, একজন কলামিস্ট ও সম্পাদক মাত্র। এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। বাংলাদেশের সব প্রবীণ, স্বনামধন্য শিক্ষাবিদরা এত বড় তুঘলকীকাণ্ড দেখেও বিস্ময়কর নীরবতা অবলম্বন করায় কিছুটা হতাশাও বোধ করছি। বিরোধী দল থেকেও এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না। কেবল অর্থকড়ির বিষয়ে সততা অবলম্বন না করে নূরুল ইসলাম নাহিদের প্রতি নৈতিক সততাও বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে এ সপ্তাহের লেখার ইতি টানছি। দেশের একজন নাগরিকের কর্তব্য বিবেচনা করেই আমার এই আহ্বান। আশা করি, শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর পরিণতিও সিলেট বিভাগেরই অপর সাবেক বাম নেতা, কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত বাবুর মতো হবে না।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : গুমরাজ্যে প্রত্যাবর্তন



মাহমুদুর রহমান
চব্বিশটি দিন লন্ডনে চিকিত্সা শেষে গত শুক্রবার দেশে ফিরেছি। ডান চোয়ালের একটা হাড়ে ক্ষয় দেখা দিয়েছিল, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম osteoarthritis। আমার শরীরে হাড়ের বিভিন্ন স্থানে সমস্যা রয়েছে। কোমরে osteoporosis, কাঁধে spondilitis এবং চোয়ালে osteoarthritis। ২০১০ এবং ২০১১ সালে দশ মাসের জেল জীবনের কষ্ট ও চিকিত্সার অভাবে এই সমস্যাগুলো জটিলতর হয়েছে।
মুক্তি পাওয়ার মাস তিনেক বাদেই লক্ষ্য করলাম মুখের ডান দিক দিয়ে খাদ্য চিবুতে কষ্ট হচ্ছে, আনুষঙ্গিক উপসর্গ হিসেবে ডান কানে তীব্র ব্যথা। ঢাকা, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ঘোরাঘুরি করে রোগটা ধরা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত লন্ডন যেতেই মনস্থ করলাম। দুর্ভাবনা ছিল শেখ হাসিনার ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার যেতে দেয় কীনা। সংশয় নিয়েই ১০ এপ্রিল বিমানবন্দরে পৌঁছে সোজা চলে গেলাম ওসি’র কক্ষে। সঙ্গের কাগজপত্র ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললাম, ওপর খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে। সস্ত্রীক অপেক্ষা করতে লাগলাম ওসি’র অফিসকক্ষের বাইরে আম যাত্রীদের আসনে বসে। এবার অবশ্য আমার অতিরিক্ত একটা সুবিধা ছিল। যুক্তরাজ্যে যাওয়া এবং সেখান থেকে আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সম্ভবত সেই কাগজের জোরে আধঘণ্টার মধ্যেই ছাড়পত্র মিলল। অবশ্য এ মাসের ৪ তারিখে ফেরার পথে বিমানবন্দরে নতুন বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তবে সে ঘটনা লেখার শেষে বর্ণনা করব।
১৩ তারিখে ডাক্তার পরীক্ষা করে হাড়ের অতিরিক্ত ক্ষয়ের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে অধিকতর পরীক্ষার জন্য CT scan করতে পাঠালেন। পরীক্ষায় ধরা পড়ল, হাড় অনেকটাই ক্ষয়ে গেছে। অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় নেই। ২৩ এপ্রিল অস্ত্রোপচারের আগেই লন্ডনে বসে দুর্মুখ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত বাবুর ঘুষ খাওয়া আর অনুজপ্রতিম রাজনীতিক ইলিয়াস আলীর গুমের দুঃসংবাদ পেলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের রেলমন্ত্রীর ঘুষ নেয়ার সংবাদে মোটেও অবাক হইনি। বরঞ্চ ঘটনাটি আমার কাছে ক্ষমতাসীনদের সাড়ে তিন বছরব্যাপী দুর্নীতির বিশাল হিমশৈলের সামান্য দৃশ্যমান চূড়ার (tip of the iceberg) মতোই ঠেকেছে। সাতসমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে আমি কেবল মন্ত্রীর গাড়ি চালক আলী আজমকে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়েছি। সেই গভীর রাতে সে সাহস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পিলখানার বিডিআর সদর দফতরের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে চোর মন্ত্রীর সহযোগীদেরসহ বমাল ধরা পড়ার ব্যবস্থা করেছে। কোনো সভ্য রাষ্ট্র হলে আলী আজমকে নিয়ে এতদিনে হৈচৈ পড়ে যেত। রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করত।
কিন্তু, আমাদের হতভাগ্য মাতৃভূমি বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার ঘুণপোকার মতো প্রবেশ করেছে। তাই এই রাষ্ট্রে ক্ষমতাধর প্রতিবেশীর চাপে দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী বহাল তবিয়তে থাকেন। জনগণের করের টাকায় নির্লজ্জের মতো বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন। মন্ত্রীর দুর্নীতিলব্ধ অর্থ দিয়ে তার পুত্র বুক ফুলিয়ে টেলিকম লাইসেন্স ক্রয় করে। আর অসীম সাহসী, দরিদ্র গাড়ি চালক গুম হয়ে যায়। এমন নির্যাতক রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। তাই আমি এই ব্যবস্থার অবধারিত ধ্বংস এবং অন্যায় সহ্যকারী, ভীরু জনগণের অনাগত দুঃখ-কষ্টের পানে চেয়ে থাকি। সুরঞ্জিত বাবুদের মতো বহুরূপী, চাপাসর্বস্ব, বিবেক বিবর্জিত রাজনীতিবিদদের নিয়ে লিখে সময় এবং কাগজ নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। এই অসুস্থ শরীরে আমি প্রধানত ইলিয়াস আলীর গুম এবং গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অপকর্মের প্রতিবাদ করতেই কষ্ট করে লেখার টেবিলে বসেছি।
এপ্রিলের ১০ তারিখে লন্ডন রওনা হয়েছিলাম। তার মাত্র দিন দুয়েক আগেই ইলিয়াস আমার দেশ কার্যালয়ে গল্প করতে এসেছিল। সময়-সুযোগ পেলেই ইলিয়াস আমার কাছে আসত। বিএনপি’র দলীয় রাজনীতি, ভারতীয় আগ্রাসন, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সেদিনও আমরা দীর্ঘক্ষণ আলাপ করেছিলাম। এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতাটিকে যারা কাছ থেকে চেনেন তাদেরই ওর খানিকটা বেপরোয়া, শিশুসুলভ স্বভাবটিকে জানার কথা। নানা বিষয় নিয়ে হৈচৈ করত, জিয়া পরিবার ব্যতীত দলের অন্যান্য সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে বড় একটা তোয়াজ করতে চাইত না। কিন্তু মনটা বড় ভালো, জাতীয়তাবাদী আদর্শের একজন নিখাদ সৈনিক। আমাদের গল্পের মাঝখানে হঠাত্ করে প্রবীণ প্রকৌশলী, পেশাজীবী আন্দোলনে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী আনহ আখতার হোসেনও যোগ দিয়েছিলেন। ইলিয়াস তার নানারকম বিপদের আশঙ্কার কথা আমাকে বলেছিল। সাম্রাজ্যবাদী ভারত এবং তাদের পদলেহী ক্ষমতাসীন মহল ইলিয়াস আলীর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে তার বিপুল জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত ছিল। সাইফুর রহমানের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর সিলেটের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, ইলিয়াস তা ধীরে ধীরে পূর্ণ করে আনছিল।
বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ ও সিলেটবাসীর ব্যানারে ভারতীয় ভূমি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিলেট থেকে জৈন্তাপুর সহস্রাধিক যানবাহন নিয়ে আমরা গত বছর যে বিশাল লংমার্চ করেছিলাম, তার সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছিল ইলিয়াস। আজ ওর অন্তর্ধান নিয়ে লিখতে বসে সেদিনের একটা ঘটনার কথা বড় মনে পড়ছে। আমাদের গাড়িবহর সীমান্তের একেবারে পাশ ঘেঁষে জৈন্তাপুরের দিকে এগিয়ে চলেছে, সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফের ক্যাম্পগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গাড়িবহরের একেবারে মাথায় আমি এবং ইলিয়াস হুড খোলা জিপে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বেশ ধীরেই এগোচ্ছি। এমন সময় ইলিয়াস স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে উঠল—মাহমুদ ভাই, ভারতীয় শাসকশ্রেণীর কাছে আপনি এবং আমি অন্যতম শত্রু। সম্ভবতঃ এই মুহূর্তে ওদের বন্দুকের সীমানার মধ্যে আমরা দু’জনা রয়েছি। এই সুযোগে আমাদের গুলি করে মেরেও তো দিতে পারে। জবাবে আমি বলেছিলাম, এমন প্রকাশ্যে ওরা আমাদের মারবে না। শেখ হাসিনার death squad আমার রিমান্ডকালে ক্যান্টনমেন্ট থানায় গভীর রাতে প্রবেশ করেও আমাকে একেবারে শেষ করে দেয়নি। ওরা নীরব ঘাতক। সুযোগ বুঝে এমনভাবে মারবে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। অর্থাত্ মারবে, তবে প্রমাণ রাখবে না। একই গাড়িতে চলতে চলতে সহযাত্রী ড্যাব নেতা ডা. জাহিদ হোসেন এবং কবি আবদুল হাই শিকদার আমাদের কথা শুনে যথেষ্ট উদ্বেগ সহকারে মন্তব্য করেছিলেন, আপনাদের সাবধানে চলাচল করা দরকার।
দেশ ও জাতির শত্রুরা কেমন করে ঢাকার রাজপথ থেকে ইলিয়াসকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, জানি না। ও এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে তাও সম্ভবত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং বিশেষ বাহিনীতে তার বিশ্বস্ত গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে ওপর থেকে অবশ্যই শেষ বিচারের মালিক মহান আল্লাহ্ সবকিছু দেখছেন। ইলিয়াসের মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাসহ আপনজন এবং আমাদের মতো শুভানুধ্যায়ীরা আজও তার পথচেয়ে আছে। আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি, এই সরকারের সুমতি হোক, ইলিয়াসসহ সব গুম করা ব্যক্তিকে আপনজনের কাছে সত্বর জীবিত ফিরিয়ে দিক।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বিনীত শাসকশ্রেণী বর্তমানে দেশটি শাসন করছে। এই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে লেশমাত্র বিবেক, নীতি অথবা লজ্জাবোধ আর অবশিষ্ট নেই। ইলিয়াস আলীকে গুম করার পর থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকবৃন্দ যে ধরনের উদ্ধত পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, তার মধ্য থেকেই এদের সার্বিক দেউলিয়াপনা প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিসেবীরা দেশের ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে নিম্নশ্রেণীর চাটুকারিতার স্বাক্ষর রেখে প্রধানমন্ত্রীকে তথাকথিত সমুদ্র বিজয়ের জন্য গণসংবর্ধনা দিয়ে টাকা ও রুচির শ্রাদ্ধ করেছেন। সেই অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হক মানপত্র পাঠ করেছেন। এই ভদ্রলোকের কবিতা যে অতি উচ্চমানের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় তার লেখা ‘ঢাকায় প্রথম বসতি’ কবিতাটা যে কতবার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। আমি পুরনো ঢাকায় বড় হয়েছি। এই কবিতায় চেনা সব জায়গার অসাধারণ কাব্যিক বর্ণনা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মনটাকে বড় উদাস করে দিত। চোখে পানি চলে আসত। তবে উন্নত সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ হকের ব্যক্তি চরিত্র কতখানি নিম্নমানের, সেটা জানার জন্য চিন্তা-চেতনায় তারই স্বগোত্রীয়, দীর্ঘদিন ধরে ভারতমাতার কোলে ঠাঁই নেয়া তসলিমা নাসরিনের বই পাঠ করলেই চলবে। কাজেই আবদুল হাই শিকদারের ভাষায় তার কদমবুসি আচরণে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ নেই। তবে শেখ হাসিনার সেই সংবর্ধনায় অশীতিপর শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং প্রবীণ দক্ষ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের নিম্নরুচির চাটুকারিতা আমাদের প্রচণ্ড রকম বেদনাহত করেছে। সেই ছাত্রজীবন থেকে এদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বড়াই শুনতে শুনতে আমরাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে গেছি। বুঝতে পারি না এই ব্যক্তিদের আর কী চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে যে এতটা নিচে নামতে হবে। সারাদেশ যখন গুম-খুনের আতঙ্কে ম্রিয়মাণ হয়ে রয়েছে, তখন তাদের আয়োজিত সংবর্ধনায় শাসকদের প্রতি তোষামোদি বাক্য শুনে বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি নাগরিকের মনে ঘৃণাপ্রসূত বমনেচ্ছার উদ্রেক হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে তারা ভুলেও ইলিয়াসের নামটাও উচ্চারণ করেননি। বিদ্বানের চাটুকারিতা প্রসঙ্গে আমাদের মহানবীর একটি সুবিখ্যাত হাদিস রয়েছে, যেটি পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ইরানি সুফি জালালউদ্দিন রুমি তার লেখায় ব্যাখ্যা করেছেন। হাদিসটি আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু অনূদিত মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী’র সংলাপ থেকে উদ্ধৃত করছি : রুমী উল্লেখ করেছেন, ‘‘মহানবী মুহাম্মদ (সা.) একবার বলেছেন, ওইসব বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সবচেয়ে অধঃপতিত, যারা বাদশাহদের সাথে সাক্ষাত্ করতে যায় আর সর্বোত্তম বাদশাহ তারাই, যারা বিজ্ঞজনের সাথে সাক্ষাত্ করে। জ্ঞানী বাদশাহ তিনিই, যিনি দরিদ্রের দ্বারে গিয়ে দাঁড়ান, আর অধঃপতিত দরিদ্র তারাই যারা বাদশাহর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।”
মেঘে মেঘে তো বেলা কম হলো না। এবার ইহজাগতিকতা বাদ রেখে একটু পরকালের কথা ভাবলে হতো না! অবশ্য এ দেশের আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ক’জন প্রকৃতই পরকালে বিশ্বাস রাখেন, সেটা নিয়ে আমার মনে অন্তত যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। যারা ইহজগতকেই একমাত্র মোক্ষ বিবেচনা করেন, তারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট খোঁজার কাজে ব্যাপৃত থাকবেন এতে আর আশ্চর্য কী? ক্ষোভে-দুঃখে বিষয়ের খানিক পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচণ্ড অহমিকা ও বলদর্পী ফ্যাসিবাদী আচরণের কথা লিখতে গিয়ে বশংবদ বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে চলে গেছিলাম।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা এবং তার মহাজোট মার্কিন ও ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কী কারণে এই আশীর্বাদ তার পায়ের তলায় তখন গড়াগড়ি খেয়েছিল, সে সম্পর্কে গত সাড়ে তিন বছরের লেখালেখিতে যথাসম্ভব বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। আজ আর পুরনো কাসুন্দি না ঘেঁটে বর্তমান পরিস্থিতির ওপরই কেবল দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছি। কাছের ও দূরের সাম্রাজ্যবাদের আশকারায় ক্ষমতাসীন মহল তাদের এবারের মেয়াদে একদিকে যেমন সুশাসন নির্বাসনে পাঠিয়ে দুর্নীতির মহোত্সব বসিয়েছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখিয়ে সকল প্রকার ভিন্নমত দমনের উদ্দেশ্যে সরাসরি ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা-গুম চলছে, এমনকি পশ্চিমাদের অতি কাছের সুশীলদের (?) পর্যন্ত এরা ছেড়ে কথা কয়নি। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস গ্রেফতার ও রিমান্ড থেকে বেঁচেছেন বটে, কিন্তু তাকে যে প্রক্রিয়ায় ও পরিমাণে হেনস্থা করা হয়েছে, তা নিয়ে রীতিমত একখানা মহাভারত রচনা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অতি প্রভাবশালী ক্লিনটন পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধুকে চূড়ান্ত অপমান করার স্পর্ধা গণতন্ত্রের কথিত মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে কাকতালীয়ভাবে মার্কিনিরাই সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশে এক বায়বীয় ইসলামী জঙ্গি জুজুর ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন, তার তাবত্ অপকর্ম তিনি জায়েজ করতে সক্ষম হবেন। বছর তিনেক পর্যন্ত তার কৌশল যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর, হালে মনে হচ্ছে তিনি লক্ষণরেখা অবশেষে অতিক্রম করেই ফেলেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর অতি সাম্প্রতিক যৌথ সফর তার জন্য অশনি সঙ্কেতই বহন করে এনেছে। বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের স্বৈরশাসন বিনাবাক্যে সহ্য করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র, দুর্নীতি, সুশাসন, মানবাধিকার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। একই সময়ে প্রণব মুখার্জির বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং সেই সাক্ষাতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব ও আগামী নির্বাচন বিষয়ে তার বক্তব্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ভারতের অর্থমন্ত্রীর এটা তৃতীয় বাংলাদেশ সফর। আগের দু’বারে তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতেরও সময় করে উঠতে পারেননি। এবার তিনি কেবল সাক্ষাত্ই করেননি, অনেকটা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন ঘটিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ভারত বাংলাদেশে কোনোরকম একতরফা নির্বাচন চায় না।
তাছাড়া, প্রথম বারের মতো তিনি এ দেশের কোনো একটি বিশেষ দলের পরিবর্তে জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর অবস্থানের প্রকৃতই যদি পরিবর্তন ঘটে থাকে, তাহলে উপমহাদেশে পারস্পরিক বিশ্বাস ও শান্তি স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাসমূহের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ভারতীয় হাইকমিশন আমার দেশসহ ছয়টি বিশেষ পত্রিকার সম্পাদককে আমন্ত্রণ তালিকার বাইরে রেখে তাদের আধিপত্যবাদী, অসহিষ্ণু চরিত্রকেই পুনর্বার উন্মোচিত করেছে। হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দীপু মনি এবং শেখ হাসিনার বৈঠকের সময়ও আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিককে খবর সংগ্রহের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আশা করি, এটুকু মানবেন যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো হলেও সর্বাধিক আলোচিত কিন্তু আমার দেশই। যাই হোক, প্রণব মুখার্জীর কথা ও কাজে মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাদের বেশকিছু কাল আরও অপেক্ষা করতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও ভারতীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের নতুন সুর এ দেশের জনগণকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে। সব মিলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলের জন্য হিলারি ক্লিনটন এবং প্রণব মুখার্জীর সফর যে আনন্দদায়ক হয়নি, সেটি বাগাড়ম্বর প্রিয় মহাজোট মন্ত্রীদের আপাত নীরবতা থেকে কিছুটা বোধগম্য হচ্ছে।
ইলিয়াস আলীকে গুম এবং বিরোধীদলের প্রায় তিন ডজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের করে শেখ হাসিনার সরকার ভিন্ন মতকে আতঙ্কগ্রস্ত করে কোণঠাসা করার যে আয়োজন করেছিল, সেটাও বুমেরাং হয়ে তাদেরই আঘাত করেছে। হিলারি ক্লিনটন গুমের পর নিহত আশুলিয়া অঞ্চলের শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং ইলিয়াস আলীর নাম তার বিভিন্ন বক্তব্যে বারংবার উল্লেখ করে সম্ভবত সরকারকে এক প্রকার সতর্ক বার্তা দিতে চেয়েছেন। গণতন্ত্রের নামে এভাবে গুম-খুনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর প্রশ্রয় দেবে না বলেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশবাসীর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এমতাবস্থায়, শেখ হাসিনার উচিত হবে আর সময় ক্ষেপণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজে বের করার জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আন্তরিক সংলাপে বসা। প্রধানমন্ত্রীর তিন দশকের রাজনীতি এবং দুই দফায় সাড়ে আট বছরের শাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের পর লিখতে বসে শেক্সিপয়রের অসাধারণ এক উক্তির কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে—
“Vengeance is in my heart,
death in my hand,
blood and revenge are hammering in my head”.
শেক্সিপয়র বর্ণিত সেই অসুস্থ রাজনীতি অব্যাহত রাখার উদগ্র আকাঙ্ক্ষায় ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ইচ্ছা পূরণ বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্ভব হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
২০০৭ সালে বিএনপির পক্ষে একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এবার পেশিশক্তি ও মার্কিন-ভারত একতরফা সমর্থনের জোরে শেখ হাসিনা সেই গর্হিত কাজটি করে ফেলতে পারবেন, এমন বিকৃত চিন্তা দেশে অবধারিত রক্তক্ষয়ী বিবাদের সূচনা করবে। সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কারও জন্যই সুখকর হবে না। প্রতিহিংসা কেবল প্রতিহিংসারই জন্ম দেবে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সুশীল (?) সমাজের প্রতিনিধিরা একবাক্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রীও প্রকারান্তরে একই বারতা দিয়ে গেলেন। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনেক আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপিরা অবশ্য জনরোষের ভয়ে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধিতা করে চলেছেন। এবার অহমিকা ত্যাগ করে শেখ হাসিনার বাস্তবতা উপলব্ধির পালা। অন্যথায় দেশে মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করার সকল দায় তাকেই নিতে হবে।
লেখার শুরুতে ঢাকা বিমানবন্দরে বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেই ঘটনা বিবৃত করেই আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনে সমাপ্তি টানব। ৪ তারিখ সকালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের বিমানে দেশে ফিরে ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছি, এমন সময় এসবির একজন কর্মকর্তা এসে আমার পাসপোর্ট নিয়ে আগমন হলের এক কোণে বসতে দিলেন। শুরু হলো প্রতীক্ষা। একে একে সব যাত্রী চলে যাচ্ছে। আমার স্ত্রীও ইমিগ্রেশনের বাধা পার হয়ে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল। আধ ঘণ্টাখানেক পরে খবর পেলাম তিনি লাগেজ সংগ্রহ করে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। কানাঘুষায় শুনলাম আমার নামে নতুন মামলা হয়েছে কিনা, কিংবা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হবে কিনা, এসব নিয়ে বিভিন্ন এজেন্সিতে খোঁজ-খবর নেয়া চলছে। একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললাম, গ্রেফতারের ভয় পেলে তো বিদেশেই থেকে যেতে পারতাম! বেচারা নিম্নস্তরের কর্মকর্তা। সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। শেষ পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক বাদে স্বদেশে ঢোকার ছাড়পত্র মিলল। এতদিন সরকারের আমাকে বাইরে যেতে দিতে আপত্তি ছিল। এবার মনে হলো ক্ষমতাসীন মহল আমাকে দেশে ফিরতে দিতে অনিচ্ছুক। পরবর্তী অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় রইলাম।
ই মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মিজানুর রহমান খানের কলাম: সৌদি কর্মকর্তা খালাফের খুনি কে?

মিজানুর রহমান খানের কলাম: সৌদি কর্মকর্তা খালাফের খুনি কে?: বন্ধুপ্রতিম দেশ সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ বিন মোহাম্মদ সালেম আল-আলী হত্যারহস্যের জট যে এখনো খোলেনি, সেটা অবশ্যই পরিতাপের। তদ...