বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

টাকার পাহাড় যাচ্ছে কোথায়

টাকার পাহাড় যাচ্ছে কোথায়

মাহমুদুর রহমান

  
বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রণয়নের ধারা শুরু হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আগাম সংবাদ অনুযায়ী বর্তমান অর্থবছরের ১ লাখ ১৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকার বিশাল বাজেট অতিক্রম করে ২০১০-১১ সালে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার পর্বতসম বাজেট প্রস্তাব করা হবে জুনের ১০ তারিখে। বোঝাই যাচ্ছে, বিশ্বমন্দার মধ্যেও সরকারের কাছে অর্থ কোনো সমস্যাই নয়। অবশ্য মাত্র কিছুদিন আগেই মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা থেকেই বাংলাদেশে একশ্রেণীর মানুষের প্রাচুর্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা গেছে। অথচ ব্রিটেনের মতো ধনী দেশেও বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাটি আমলে নিয়ে সেদেশে মন্ত্রীরা তাদের বেতন পাঁচ শতাংশ কমিয়েছেন। জনগণের জেনে রাখা দরকার, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে গড় মাথাপিছু আয় যথাক্রমে ২৪ হাজার ৫০০ এবং ৬৫০ মার্কিন ডলার। রাষ্ট্র পরিচালনায় বৈপরীত্য আর কাকে বলে? যা হোক, বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটের যে অঙ্ক উল্লেখ করেছি তার মধ্যে রাজস্ব ও উন্নয়ন, উভয় খাতই রয়েছে। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এই বিপুল অঙ্কের টাকা খরচের বিনিময়ে জনগণের জীবনযাত্রার মানের উন্নতিসাধন হয়েছে কিনা? জাতীয় আয়ের বিবেচনায় এককথায় বলা যায়, হয়নি। গত অর্থবছরের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৫.৭ এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৫ শতাংশে, যা কিনা বিগত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বশেষ ২০০২-০৩ অর্থবছরে আমরা ৫.২৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নামেনি, যার মধ্যে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬.৭ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের জাতীয় আয় নিম্নগামী হয়েছে কাকতালীয়ভাবে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই। এর দায় কতটা বিশ্বমন্দার আর কতটা প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত রসগোল্লাসদৃশ মন্ত্রিসভার, সেই হিসাব কষার দায়িত্ব অর্থনীতিবিদদের। মোটকথা হলো, একদিকে সরকারের খরচের হাত বাড়ছে, অন্যদিকে জাতীয় আয় যে কমছে—সেই সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। অবশ্য, বাংলাদেশের আওয়ামী-বান্ধব মিডিয়া পারে না হেন কাজ নেই। এর মধ্যেও তারা হয়তো জনগণের জন্য বিশেষ কোনো উপকার খুঁজে বের করতেও পারে?

বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে রাজস্ব ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করে প্রাপ্ত সম্পদ যতটা সম্ভব উন্নয়ন খাতে ব্যবহার করা আবশ্যক। এদেশে অবকাঠামোগত দুর্বলতা উন্নয়নের পথে অন্যতম বাধা। বিদ্যুত্ ও জ্বালানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হলে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে পরিবহন দ্রুততর করা গেলে জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতো। এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। সেখানেও অবশ্য সক্ষমতার প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিটি সরকারের আমলেই ফি-বছর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির জন্য বছরের মাঝখানে এসে উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতে হয়। তার ওপর দুর্নীতি ও অপচয় তো রয়েছেই। বছরের প্রথম এগারো মাসে উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৫০/৬০ শতাংশ ব্যয় করার পর শেষ মাস অর্থাত্ জুনে বাকি টাকা খরচ করার রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে। ফলে সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা হয়তোবা পূরণ হয়, কিন্তু জনগণের এত পরিশ্রমের অর্থ ঠিক কার পকেটে যায়, এ নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট সুযোগ থাকে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হলেও আমাদের অর্থ এবং পরিকল্পনামন্ত্রী মহোদয়রা এই সমস্যার কোনো সমাধান অদ্যাবধি খুঁজে পাননি। কোনো আমলেই শত ভাগ ঐকান্তিকতা নিয়ে খোঁজার চেষ্টা হয়েছে, এমন দাবিও জোর দিয়ে করা যাচ্ছে না। তবে বর্তমান সরকারের আমলে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির যে অশুভ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য কল্যাণকর নয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট ছিল মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। আর মহাজোট সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমে দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে। তারপরও কথা আছে। বছরের প্রারম্ভে এডিপির আকার ঘোষণা করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা। আগেই বলেছি, বড় আকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে আমাদের বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের প্রারম্ভে ৩০ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা করা হলেও বছরের অর্ধেক না যেতেই সেই অঙ্ক কমিয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু, অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৪৮ শতাংশ। সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাকি দু’মাসে পূরণ করতে হলে সর্বব্যাপী লুটপাট ভিন্ন গত্যন্তর নেই। এই অভিজ্ঞতার পর একমাত্র উন্মাদ প্রকৃতির নীতিনির্ধারকরাই ৩৮ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার কল্পনাবিলাসী এডিপির ঘোষণা দিয়ে বড়াই করতে পারে। সুতরাং এই ধরনের অসম, বাস্তবায়ন-অযোগ্য বাজেটে লুটপাটের সুযোগ বৃদ্ধি পেলেও দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধিত হতে পারে না।

বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা যে দারিদ্র্য, এ নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। সব সরকারই দারিদ্র্যবিমোচনের স্লোগান দিয়েই মসনদে বসে থাকে। দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং প্রাপ্ত সম্পদের সুষম বণ্টন অপরিহার্য। পাঁচ বছরে রাজস্ব ব্যয় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করে আর যাই হোক সম্পদের সুষম বণ্টন কিংবা দারিদ্র্যবিমোচন—কোনোটাই সাধিত হতে পারে না। জনগণের অর্থের এই অপচয় দেশে বিরাজমান আয়-বৈষম্যকে অধিকতর বিস্তৃত করবে। জরুরি সরকারের দুই এবং বর্তমান সরকারের দেড় বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার যে বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছরে দেশে ২৭ লাখ বেকার বেড়েছে। শতকরা হিসাবে এই বৃদ্ধি ২৮ ভাগ। কৃষি, শিল্প, নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট খাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার কারণেই বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব খাতে বেকার বেড়েছে ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানিও কমেছে ৩৪ শতাংশ। দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ এভাবে সঙ্কুচিত হতে থাকলে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া তো দূরের কথা, বরঞ্চ তীব্রতর দারিদ্র্যের মাঝে অধিকাংশ মানুষের তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেশজ উত্পাদন সংক্রান্ত পরিসংখ্যান সেই অশনি সঙ্কেতই দিয়েছে। বিবিএস জরিপে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল সময়কালে জিডিপি গড়ে ০.২৭ শতাংশ হারে হ্রাস পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে কোনোরকম উদ্বেগের প্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় ভিন্নমত দমন, সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ এবং নীতিনৈতিকতার কোনোরকম বালাই না রেখে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ-জাতীয় বিষয়ই এখনও শীর্ষে রয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরও একটি বৈপরীত্য এখন ক্রিয়াশীল রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ থেকেই শিল্পখাতে মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে শেয়ার মার্কেটে দর এবং মূলধন বৃদ্ধির এক অবিশ্বাস্য প্রতিযোগিতা চলছে। ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির সময় মূল্যসূচক সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্ট স্পর্শ করেছিল। আর এখন সেটি ৬ হাজার অতিক্রম করেছে। প্রতিদিনের লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। বছরে ২২৫ দিন শেয়ার মার্কেট খোলা থাকলে কেবল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেই বার্ষিক লেনদেন এখন ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। শেয়ার কেনাবেচায় বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো এ বছরের মধ্যেই টাকার অঙ্কে শেয়ার কেনাবেচার পরিমাণ আমাদের মোট জাতীয় আয়কে অতিক্রম করবে, যা বর্তমানে ৬ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় ঢাকা এবং চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে এখন যা চলছে তাকে স্রেফ জুয়া ছাড়া আর কোনো নামে ডাকার উপায় নেই। ফটকাবাজ গোষ্ঠীর কারসাজিতে সৃষ্ট এই বিশালাকায় বেলুন ফুটো হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্ভবত বর্তমান সরকারের মেয়াদের বছরখানেক বাকি থাকতে এই বেলুনটি ফাটবে এবং পরিণামে এদেশে অসংখ্য দেউলিয়া মানুষের সঙ্গে আমরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেউলিয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দেখতে পাব। চোখের সামনে অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটা অগ্রহণযোগ্য কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, অথচ আমাদের সব ধীমান অর্থনীতিবিদরা নীরব।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তত্কালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কট্টর সমালোচক প্রতিষ্ঠান সিপিডি তাদের পছন্দের সরকারের সময়ে মিতবাক হওয়ার নীতিগ্রহণ করেছে। বিদেশি প্রভু এবং দেশি মিডিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠনটির একসময়ের নির্বাহী পরিচালক তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সুবাদে প্রথমে এদেশে অবৈধ, জরুরি সরকারের এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি বাগিয়ে নিজের আখের ভালোমতই গুছিয়ে নিয়েছেন। বাজেট ঘোষণা হলেই একসময় তার মুখ থেকে শোনা যেত, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কখনও সরু রাস্তায় বড় গাড়ি চালাচ্ছেন, আবার কখনওবা দ্রুতবেগে চালাচ্ছেন। তার বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রাস্তা সম্ভবত এখন এতটাই প্রশস্ত ও মসৃণ হয়েছে যে এখানে বিদ্যুেবগে বিলাসবহুল ফেরারি গাড়ি চালাতেও কোনো সমস্যা নেই। বিবিএস পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ২০০৭-উত্তর বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির দায়দায়িত্ব এই চৌকস, বাকচতুর অর্থনীতিবিদকেও গ্রহণ করতে হবে। জেনারেল মইনের ক্যু-দেতা’র পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার পর এই অর্থনীতিবিদ কেবল জেনেভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতই ছিলেন না, সেইসঙ্গে তত্কালীন সামরিক জান্তার অর্থনীতি বিষয়ক অন্যতম নীতিনির্ধারকও ছিলেন।

সাম্প্রতিক বাজেটের বিশালত্বের আলোচনায় ফেরা যাক। লক্ষ-কোটি টাকার রাজস্ব বাজেট প্রণয়নের পেছনে মন্ত্রী, এমপি, আমলা শ্রেণীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলাসিতার ব্যয়ভার, অপচয়, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সরকার বিনা টেন্ডারে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কেনার যেসব আত্মঘাতী চুক্তি করছে তার ফলে রাজস্ব খাতে ভর্তুকির বরাদ্দ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। অন্যথায় পিডিবি দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। প্রায় দেড় বছর ঘুমিয়ে থাকার পর দেশের তীব্র বিদ্যুত্ সমস্যার রাতারাতি সমাধানের নামে সরকার রেন্টাল বিদ্যুত্ ক্রয়ের যে নীতি গ্রহণ করেছে, তা জনগণের অর্থের অপচয় ব্যতীত আর কিছু নয়। বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিদ্যুতের মূল্য ১৪ টাকা ইউনিটপ্রতি প্রচার করা হলেও চুক্তির মারপ্যাঁচে লুকানো খরচসহ ক্রয়মূল্য অন্তত ২০ টাকায় পৌঁছবে। বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বর্তমান সরকারের দেড় বছরে বিদ্যুতের দামের তৃতীয় দফা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছে। অর্থাত্ একদিকে রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকির টাকা প্রদান করে জনগণের অর্জিত অর্থের অপচয় করা হবে, অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সরাসরি ভোক্তার পকেট কাটারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ ক্ষমতাসীনদের মদতপুষ্ট গোষ্ঠীর জন্য বিপুল বিত্তবৈভব অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জনগণ। গোড়ায় গলদ থাকলে এক লাখ কোটি কেন, কয়েক লাখ কোটি টাকার বাজেটও যে দারিদ্র্যবিমোচনে কোনো ভূমিকা রাখে না তার প্রমাণ বিগত কয়েক বছরের বাংলাদেশ। যে অর্থনৈতিক দর্শনের ওপর ভর করে বাংলাদেশ বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে তার মৌলিক পরিবর্তন করা না হলে বাজেট ঘোষণা কেবল একটি বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতা হয়েই থাকবে। প্রতিবছর বাজেটের অঙ্ক বাড়িয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকুল অবশ্যই আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু, তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির অধোগতির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত এক বছরে ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশের সব সূচকে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

দুর্নীতি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা এবং ক্রয় নীতিমালায় অস্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারে জবাবদিহিতার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ধনী-গরিবের আয়ের বৈষম্য এবং উচ্চবিত্তের বিলাসিতা যেভাবে বাড়ছে তাতে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। পার্শ্ববর্তী পরাশক্তি ভারতের মাওবাদী বিস্ফোরণ থেকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষা গ্রহণ করলে উপকৃত হবেন। সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকল্পে জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে সুশাসন জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল পকেট ভর্তির সুযোগ খুঁজে বেড়ালে নিয়তির লিখন পাল্টানো যাবে না। জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ গ্রহণ করে অবাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটিয়ে রাজসিংহাসনে উপবেশন করা হয়তো যায়, তবে বিপুল জনগোষ্ঠীর আশাভঙ্গজনিত রুদ্ররোষ থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যে যায় না, এটাই ইতিহাসের লিখন।
(সুত্র, আমার দেশ, ৩০/০৫/২০১০)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন