বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

আওয়ামী লীগ-স্বৈরতন্ত্র সংযোগের ইতিহাস

আওয়ামী লীগ তার দলীয় বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়ার সহায়তাক্রমে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের প্রশ্নে সর্বদা উচ্চকণ্ঠে তাদের দলের কথিত আদর্শিক অবস্খান দাবি করতে অভ্যস্ত। দীর্ঘ তিন দশক ধরে বাংলাদেশের অপর প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট এবং মৌলবাদের সহায়তাকারী হিসেবে প্রচার করে দলটি জনমতকে প্রভাবিত করে যথেষ্ট রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে যে পেরেছে, সেটি অস্বীকারের উপায় নেই। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ক্ষমতাসীন দলটির মানসিকতায় নীতি কিংবা আদর্শের কোনো বালাই কখনো ছিল না এবং এখনো নেই। ১৯৯৬ সালে তারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে জয় লাভ করেছিল এবং ২০০৭ সালের স্খগিত নির্বাচনের আগে শায়খুল হাদিসের দলের সাথে বাংলাদেশে ফতোয়াকে বৈধতাদানসহ একপ্রকার ইসলামি শাসনব্যবস্খা প্রবর্তনের পাঁচ দফা চুক্তিও সই করেছিল। তদুপরি ঐতিহ্যগতভাবেই স্বৈরাচারী মানসিকতার দলটির মধ্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের লেশমাত্র নেই। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার ঘোষক, জেড ফোর্সের অধিনায়ক, সেক্টর কমান্ডার, বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও অন্য নেতৃবৃন্দ যেসব অশালীন বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন তাতে তাদের পুরনো ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই প্রতিফলন ঘটছে। ইসলাম ধর্ম মানলে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় অভব্য বাক্য ব্যবহার পরিহার করাই কাঙ্খিত। কিন্তু সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং তার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতার মৃতদেহ নিয়ে দিনের পর দিন যা করে যাচ্ছেন তার যথোপযুক্ত নিন্দা জানাতে হলে যে ভাষা প্রয়োগ করা আবশ্যক সে রকম ভাষা ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত নই। আজ কলম হাতে নেয়ার উদ্দেশ্যও সেটি নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের যে যোগাযোগ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই কাহিনী প্রাসঙ্গিক দালিলিক প্রমাণসহ নতুন প্রজন্মকে জানানোই এই কলাম লেখার মূল উদ্দেশ্য।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করেন। দেশবাসী তাকে বরণ করে নেয় পরম মমতা এবং উজাড় করা ভালোবাসার উপঢৌকন নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বন্দিশালায় থেকেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যের প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানের সুস্খ শরীরে স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের আনন্দ ও আবেগে আপ্লুত আমার মরহুম নানা তিনটি নফল রোজা রেখেছিলেন, সেই ঘটনা এখনো স্মৃতিপটে জাগরূক হয়ে আছে। আবার মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে সেই নানাকেই পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর এক ফোঁটা অশ্রুও যে ফেলতে দেখিনি, তা-ও বা ভুলি কী করে? যা হোক, ইসলামাবাদের শৃঙ্খলমুক্ত সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশী শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে তারই নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখেছিল। দরিদ্র বাংলাদেশে কৃচ্ছন্সসাধনের অংশ হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মুজিব সরকার কর্তৃক রাতারাতি কমিয়ে দেয়া হলে তারা সহাস্যে দেশের জন্য সেই ত্যাগ স্বীকারে সম্মত হয়েছিলেন। বছর না পেরোতেই অবশ্য স্বপ্নভঙ্গের পালাও শুরু হয়েছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অত্যাচার এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ, অর্ধভুক্ত জনগণের ক্রমেই ফুঁসে ওঠা রুদ্ররোষকে নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হিসেবে একদা গণতন্ত্রমনস্ক শেখ মুজিব ক্রমেই একনায়কে রূপান্তরিত হতে লাগলেন। রক্ষীবাহিনী গঠন করে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো, ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বñর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আনয়ন করে নিবর্তনমূলক জরুরি আইন জারির ব্যবস্খা হলো এবং সর্বশেষ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্খা ‘বাকশাল’ চেপে বসল বাংলাদেশের অসহায়, নিরন্ন জনগণের কাঁধে। চতুর্থ সংশোধনীর ১১৭ ক (১, ২, ৩ ও ৪) অনুচ্ছেদ পড়লে এত বছর পরও তৎকালীন নেতৃত্বের স্বৈরাচারী মন-মানসিকতায় আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।
‘১১৭ ক। জাতীয় দল। ১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোন একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি আদেশ দ্বারা নির্দেশ দিতে পারিবেন যে রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অত:পর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে।
২) যখন (১) দফার অধীন কোন আদেশ প্রণীত হয়, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন।
৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কার্যসূচি, সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃঙ্খলা, অর্থসংস্খান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে।
৪) (৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত আদেশ-সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যোগ্য হইবেন।’
একজনমাত্র ব্যক্তির একটি দেশের এভাবে রাতারাতি হর্তা-কর্তা-বিধাতা সেজে বসার তুলনা কেবল জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি এবং স্পেনের ফন্সাঙ্কোর সাথেই হতে পারে। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামক একটিমাত্র রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে অন্য সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর একই বছর ১৫ জুন চারটিমাত্র পত্রিকা সরকারের মুখপত্র হিসেবে রেখে দেশের বাকি সব পত্রপত্রিকার অনুমোদন বাতিল করা হয়। সংসদীয় ক্যু-দেতার এমন মন্দ উদাহরণ বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম লড়াইরত শেখ মুজিবুর রহমানের এমন ভয়ানক স্বৈরশাসকে রূপান্তর সমগ্র জাতির জন্যই চরম দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিল। আওয়ামী লীগের মননে সেই যে স্বৈরতন্ত্রের অনুপ্রবেশ, তারপর থেকে দলটি আর কোনো প্রকার গণতান্ত্রিক আচরণে প্রত্যাবর্তন করতে তো পারেইনি, বরং তৎপরবর্তী দেশের সব অসাংবিধানিক পদক্ষেপে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থেকেছে।
প্রথমেই যে সামরিক আইন ফরমানের দায়দায়িত্ব আওয়ামী প্রচারযন্ত্র মরহুম জিয়াউর রহমানের ওপর সফলভাবে চাপিয়ে তিন দশক ধরে মৃত মানুষটিকে অব্যাহত দোষারোপ করে যাচ্ছে, সে দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য ওই ফরমানের প্রথম আট লাইন উদ্ধৃত করছি­
"WHEREAS : the whole of Bangladesh has been under Martial Law since the 15th day of August, 1975; And WHEREAS Khandaker Mostaque Ahmed, who placed the country under Martial Law, has made over the Office of President of Bangladesh to me and I have entered upon that office on the 6th day of November, 1975; AND WHEREAS in the interest of peace, order, security, progress, prosperity and development of the country, I deem it necessary to keep in force the Martial Law proclaimed on the 15th August, 1975;"
(যেহেতু সমগ্র বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সামরিক আইনের অধীনে আছে :
এবং যেহেতু খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি রাষ্ট্রকে সামরিক আইনের অধীনে নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেছেন এবং আমি সেই দায়িত্বভার ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে গ্রহণ করেছি; এবং যেহেতু দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, অগ্রগতি, সাফল্য এবং উন্নয়নের স্বার্থে, আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে ঘোষিত সামরিক আইন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি;)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করেছিলেন, তিনি বাকশাল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এবং তৎকালীন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী প্রধান তিনজনই বিনা প্রতিবাদে মোশতাক সরকারের নিকট সম্পূর্ণ আনুগত্য জানিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার বর্তমান সরকারেরই পরিকল্পনামন্ত্রী। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরিয়ে বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ, যিনি ওই মাসেরই ৩ নভেম্বর সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে মাত্র ৭২ ঘন্টার জন্য রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হতে পেরেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর প্রত্যুষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়া সপরিবারে গৃহবন্দী ছিলেন। ঐতিহাসিক সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয় এবং ৮ নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম জারিকৃত উপরোল্লিখিত সামরিক ফরমানের বলে তাকে সেনাপ্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। একই ফরমানে কমোডর এম এইচ খান ও এয়ারভাইস মার্শাল এম জি তাওয়াবকেও যথাক্রমে নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। সুতরাং ১৯৭৫ সালের ঘটনাবহুল ৮৩ দিনে যে তিন দফা সামরিক আইন জারি এবং সংশোধন করা হয়, তার সাথে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থনকারী জেনারেল খালেদ মোশাররফকেই এসব ঘটনার সাথে জড়িত পাওয়া যাচ্ছে। জেনারেল জিয়া অবশ্যই পরবর্তীকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ গ্রহণ করেছিলেন, তবে সেটি ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর। অত:পর ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পঞ্চম সংশোধনী গ্রহণের মাধ্যমে দেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্খায় প্রত্যাবর্তন করে। সে দিক দিয়ে বিচার করলে পঞ্চম সংশোধনীকে দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহারের অপরিহার্য সহায়ক দলিল (instrument) হিসেবে বিবেচনা করাই অধিকতর সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ কেবল প্রচারণার জোরে বাংলাদেশের জনগণের এক বৃহৎ অংশকে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্ত করে এমন একটি ধারণা দিতে পেরেছে যে, তারা মনে করছেন পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়াই সামরিক আইন জারি করেছিলেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘ ৩১ বছর পর সম্প্রতি পঞ্চম সংশোধনীকে কিছু সংশোধন ও পর্যবেক্ষণসহ (অবশ্য এই কলাম লেখা পর্যন্ত সেই সংশোধন কিংবা পর্যবেক্ষণ কোনোটাই জাতিকে জানানো হয়নি) বাতিল করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের বহুল আলোচিত উপরিউক্ত রায় যেহেতু আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গ নয়, কাজেই এই বিষয়ে অতিরিক্ত কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম। এ দেশে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস পর্যালোচনায় ফেরা যাক।
স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘতম স্বৈরাচারী শাসনকালের শুরু হয়েছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সে দিন মসনদে আসীন হয়েছিলেন। তার এই অসাংবিধানিক পদক্ষেপকে সাথে সাথে স্বাগত জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সে দিনও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এ দেশে স্বৈরাচারের প্রতিভূ এই একনায়ক দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় যে টিকে ছিলেন সেটি সম্ভব হয়েছিল শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সরাসরি মদদে। আশির দশকের একেবারে শেষ দিকে ঢাকা বিশñবিদ্যালয়ে জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের লক্ষ্যে স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় ছাত্রমোর্চা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে সব রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। মোর্চা গঠনে উৎসাহী ভূমিকা রাখার অপরাধে তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিবের পরবর্তীকালে আর ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগে ঠাঁই হয়নি। ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই সেই স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট। গত বছর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার পতন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জেনারেল এরশাদকে ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট স্বৈরাচার বলে গাল দিয়েছেন। একদা শেখ মুজিবের কঠোর সমালোচনাকারী এই বামপন্থী নেত্রীর এরশাদ সম্পর্কিত বক্তব্যকে অবশ্য পাতানো খেলার অংশ ছাড়া মহৎ কিছু বিবেচনার সুযোগ নেই। এরপর ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথান। সেই সময়ের পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেই অভ্যুথান প্রচেষ্টার পেছনেও আওয়ামী লীগের নৈতিক, রাজনৈতিক এবং লজিস্টিক সমর্থন ছিল। জেনারেল নাসিমের অভ্যুথান ব্যর্থ করে সাংবিধানিক সরকার রক্ষায় ভূমিকা রাখার অপরাধে অন্য একটি মামলায় বর্তমানে কারারুদ্ধ সাবেক এনএসআই ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) রহিম, এক-এগারোর কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত মেজর জেনারেল (অব:) মতিন এবং তৎকালীন নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল (অব:) ইমামুজ্জামান এই জমানায় নানা রকম হয়রানি ও ব্যক্তিগত বিপদের মধ্যে রয়েছেন। এ দেশে সর্বশেষ সফল এবং নতুন কিসিমের সামরিক অভ্যুথান সংঘটিত হয়েছে জেনারেল (অব:) মইনের নেতৃত্বে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। সেই অভ্যুথান যেমন আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ছিল, একইভাবে মহাজোট সরকারও সেই অভ্যুথানেরই ফসল। এক-এগারোর সরকার এবং দিন বদলের সরকারকে একে অপরের পরিপূরক বললে আশা করি পাঠক তাকে অত্যুক্তি বিবেচনা করবেন না। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের সংযোগের যে হাইপোথিসিস নিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম তথ্য ও যুক্তি দিয়ে তা কতখানি প্রমাণ করতে পারলাম সেটি পাঠক বিচার করবেন।
বাংলাদেশের অশান্ত ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের উপাদানগুলো নিম্নরূপ :
০১. ফ্যাসিবাদী একদলীয় শাসনব্যবস্খার দর্শনে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ। ০২. এ দেশে স্বৈরাচারের সর্বজনগ্রাহ্য উদাহরণ জেনারেল এরশাদ ও তার দল। ০৩. ১৯৯৬ সালের জেনারেল নাসিমের ব্যর্থ অভ্যুথানের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। ০৪. এক-এগারোর কুশীলবরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে।
সুতরাং ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এবং ফ্যাসিবাদী মানসিকতাসম্পন্ন যে শাসক শ্রেণী প্রায় একদলীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের কাছ থেকে কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যাশা করাই মূর্খামি। এই সরকারের অধীনে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্খায় মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে অশ্রুপাত করবে, ভিন্ন মত দমন-পীড়নের শিকার হবে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবলুপ্ত হবে­ এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান অবস্খায় আমিও আর কত দিন লেখালেখি করতে পারব তা-ও অনিশ্চিত। তবে এক-এগারোর তাঁবেদার সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরার দিন থেকেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সব ধরনের নির্যাতন সইবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি। অগণিত নারী-পুরুষের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতা রক্ষায় যদি আমার দুর্বল রচনাগুলো কোনো ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। অত্যাচারী শাসক শ্রেণী জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে এক সময় পরাজিত হবে, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদের অতীত পরিণতি সুখকর হয়নি। এবারো ইনশাআল্লাহ, জনগণই জয়ী হবে।
লেখক : সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান
[সূত্রঃ নয়া দিগন্ত, ১৭/০২/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন