বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

এক-এগারোর গরল অমৃতসমান

সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী জরুরি সরকারের বিরুদ্ধে তার নেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাবন্দি অবস্হায় খাদ্যে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আবারও আনলেন। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা, কিছুদিন আগেও এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ সংসদে দাঁড়িয়ে একই অভিযোগ তুলে সারাদেশে একেবারে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। সে সময় তার সঙ্গে পালাগানের দোহারের মতো পোঁ ধরেছিলেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং বর্তমান সরকারের কথিত নবরত্মের অন্যতম ডা. াদাচ্ছের আলী। ডাক্তার সাহেব দাবি করেছেন যে, এই বিষপ্রয়োগের ঘটনাটি শেখ হাসিনা কারাবন্দি থাকা অবস্হায় তিনিও নাকি টের পেয়েছিলেন। বিশেষ কারাগার থেকে সরবরাহকৃত বিষমিশ্রিত খাদ্যগ্রহণের ফলে শেখ হাসিনার চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, ইত্যাকার উপসর্গ তখন দেখা দিয়েছিল। আওয়ামী সমর্থক মিডিয়া তাদের চরিত্রানুযায়ী দিনকয়েকের জন্য শেখ হাসিনাকে জরুরি সরকারের কথিত হত্যাচেষ্টা নিয়ে মাঠ বেশ গরমও করে ফেলেছিল।

সুযোগ বুঝে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বেগম খালেদা জিয়ার খাদ্যেও বিষ মেশানোর মৃদু অভিযোগ তুলেছিলেন; কিন্তু তার সমর্থনে দলের অন্য প্রভাবশালী নেতারা এগিয়ে না আসায় বিষয়টি তেমন একটা জমেনি। তাছাড়া মরে গেলাম, মেরে ফেলল জাতীয় সস্তা বক্তব্য দিয়ে নাটক করার বাতিক রাশভারী এবং কঠোর আত্মসম্মান বোধের অধিকারিণী বিএনপি চেয়ারপার্সনের যে নেই, সে বিষয়ে দেশবাসী ভালো রকম অবহিত। জনসভায় একজনের বুলেটপ্রুফ কাচের পেছনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস এবং অপরজনের সে ধরনের যে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জনগণের মুখোমুখি হওয়ার আত্মবিশ্বাসের মধ্যেই দুই নেত্রীর আচরণের পার্থক্য প্রকাশমান। দেশবাসীর এটাও জানা যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল বরাবরই আবেগনির্ভর। কাজেই আগামী সাধারণ নির্বাচনের প্রচারণাকালে আওয়ামী সমর্থকদের অশ্রুসজল করে তোলার জন্য বিষপ্রয়োগের গল্পটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারত। নির্বাচনী সভাগুলোতে দলীয় নেত্রী চোখ মুছতে মুছতে বলতে পারতেন, গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতো তিনিও একদা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জেনে-শুনে বিষ পান করেছিলেন। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য যে, এমন একটা সুবর্ণ সুযোগ এখন প্রধানমন্ত্রী তনয়ের প্রকাশ্যে এক-এগারো সরকারের প্রশস্তির জন্য হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আকৃষ্ট করার জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার মায়ের উপস্হিতিতেই সজীব ওয়াজেদ জয় মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। যে নরাধমরা শেখ হাসিনার মতো নেত্রীকে হত্যা করার হীন উদ্দেশ্যে বন্দি অবস্হায় খাদ্যে বিষ পর্যন্ত নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করতে পেরেছে, তাদের প্রশংসা তারই আত্মজের কণ্ঠে! সাজেদা চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন নাকি শেখ হাসিনার বিষের যাতনায় কাতর চেহারা দেখে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এসব তোষামোদি বক্তব্যে বিশ্বাস করলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর প্রতি তার সহকর্মীদের ভালোবাসা আপন একমাত্র পুত্রের তুলনায় অনেক বেশি। রাজপরিবারের মা-ছেলের পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়ে আমজনতার জানার কোনো উপায় নেই। বড়লোকের বড় ব্যাপার, এমন আজব কান্ড ঘটলেও ঘটতে পারে। তবে রহস্য ভেদের চেষ্টা হিসেবে এক-এগারো সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের পুরনো যোগাযোগের কাহিনী ভুলো বাঙালির বিবেচনার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে।

জেনারেল মইন আন্তর্জাতিক মহলের সরাসরি নির্দেশেই যে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, সে ইতিহাস এখন সবারই জানা। কিন্তু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের মধ্যে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ই বাংলাদেশে একটি সেক্যুলার সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ধারণা করা গেলেও প্রমাণ করা আপাতত কঠিন। দেরিতে হলেও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ জলিল নানারকম সমঝোতার কাহিনী সম্প্রতি প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। অবশ্য আওয়ামী চাপের মুখে নিজেকে এক অর্থে মস্তিষ্ক-বিকৃত ঘোষণা করে নিজ অবস্হান থেকে সরে আসারও চেষ্টা করছেন তিনি। এক-এগারো পুর্ববর্তী টালমাটাল পরিস্হিতিতে জেনারেল মইন সম্ভবত সেনাবাহিনীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তিনি একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি এবং যুধ্যমান দুই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কোনো পক্ষের প্রতিই তার কোনো বিশেষ দুর্বলতা নেই। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য প্রমাণ করেছে যে, মইন সেক্যুলার ক্যাম্পেরই সদস্য ছিলেন এবং ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে কোন পক্ষকে ক্ষমতাসীন করা হবে- সেটি তিনি ক্ষমতা দখলের আগে থেকেই জানতেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ পরিচালনায় ডিজিএফআইর তৎকালীন তিন কর্তা- মেজর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ, মেজর জেনারেল (অব.) আমিন এবং ব্রি. জেনারেল (পলাতক) বারীর ভুমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সিংহভাগই অবগত আছেন। ডিজিএফআইর উল্লিখিত ত্রিমুর্তি, সেনাপ্রধান জেনারেল মইন এবং নবম ডিভিশনের সাবেক প্রধান ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার পদে কর্মরত জেনারেল মাসুদের মধ্যে বিদেশি সুতোর টানে বাংলাদেশের বারোটা বাজানোর কাজে কে কাকে ব্যবহার করেছেন, তা তারাই ভালো জানেন। তবে সে সময় জেনারেল মইনের সঙ্গে সজীব ওয়াজেদ জয়ের যে বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল, সেটি কোনো পক্ষই লুকানোর চেষ্টা করেননি। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা কারাবন্দি থাকা অবস্হায় যখন সাজেদা চৌধুরীর দাবি অনুযায়ী বিষমিশ্রিত খাবার গলাধঃকরণ করছিলেন, মনে পড়ছে তখনও সজীব জয় জেনারেল মইনকে একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দু’জনের সাক্ষাতের আয়োজন করার জন্য শোনা যায় বাংলাদেশ থেকে গুরুত্বপুর্ণ সামরিক কর্তারাও জেনারেল মইনের সেদেশে সফরে যাওয়ার আগেই ঘুরপথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপস্হিত হয়েছিলেন। শোনা কথার প্রমাণ নেই এটা ঠিক হলেও আশির দশক থেকে বাংলাদেশে যত সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে, তার সবক’টির সরাসরি সুবিধাভোগী যে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা- এই সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিএনপি প্রশাসন কতৃêক নিযুক্ত প্রতিজন সেনাপ্রধান পরবর্তী সময়ে অবধারিতভাবে বিএনপিকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছেন। জেনারেল এরশাদ, জেনারেল নাসিম এবং জেনারেল মইনের আচরণে বাহ্যিক তফাত থাকলেও তাদের মুল লক্ষ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি ২০০৬-এর শেষার্ধে যে সাবেক সেনাপ্রধানকে বিএনপির স্হায়ী কমিটির সদস্যপদে সর্বশেষ নিয়োগ দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে, তিনিও সময়মত বিশ্বাসঘাতকের চেহারা দেখাতে কিছুমাত্র সঙ্কোচ করেননি। লোকমুখে শুনেছি, জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান মরহুম সাইফুর রহমানের বাসগৃহে সংঘটিত মধ্যরাতের ক্যু দেতা সফল করানোর জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা আমাকে বলেছেন, জেনারেল মাহবুব নাকি সেই বহুল আলোচিত তথাকথিত চায়ের দাওয়াতে অংশগ্রহণ করার জন্য তৎকালীন সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে তাদের প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়েছিলেন।

সাবেক সেনাপ্রধানদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মধুর সম্পর্কের একটা পরম্পরা দৃশ্যমান হলেও নীতিগতভাবে সেনাবাহিনীর প্রতি আওয়ামী নেতৃত্বের ঐতিহাসিক বিতৃষ্ণার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। অ্যান্হনি মাসকারেনহাস তার ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ গ্রন্হে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সেনাবাহিনী-বিদ্বেষের কথা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। সে সময় সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে রক্ষীবাহিনী নাম দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক একটি রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা সর্বক্ষণ জপলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবদীপ্ত ভুমিকার প্রসঙ্গ উঠলেই যে মারমুখী হয়ে ওঠেন, তার প্রমাণ আমরা মাত্র ক’দিন আগেই জাতীয় সংসদে দেখতে পেয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভুমিকা রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) তাজ সংসদে তৎকালীন সেনাসদস্যদের প্রশংসা করে তার নিজ দলের সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছিলেন। ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ রাইফেলসের নাম পাল্টে বর্ডার গার্ড করার আজগুবি প্রস্তাব যাদের মস্তিষ্ক থেকে আসে, তারা দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীকে কী নজরে দেখে থাকেন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট দল হিসেবে অভিহিত করে হেয় করার অপচেষ্টাও সেনাবাহিনীবিরোধী মানসিকতা থেকেই উদ্ভুত। যে সজীব ওয়াজেদ জয় তার মাকে হত্যার প্রচেষ্টায় অভিযুক্ত একই সেনাপ্রধানকে বিস্ময়করভাবে একজন ভদ্রলোক হিসেবে প্রত্যয়ন করেছেন, সেই একই ব্যক্তি ইরাকে মুসলমান নিধনে অংশগ্রহণকারী ইসলামবিদ্বেষী বিদেশির সঙ্গে যৌথভাবে যখন লেখালেখি করেন, তখন তার ভেতরের সেনাবাহিনী-বিদ্বেষী মনোভাব মুখব্যাদান করে ঠিকই প্রকাশিত হয়। সুতরাং, সেনাপ্রধানদের সঙ্গে বিগত তিরিশ বছর ধরে আওয়ামী লীগের যে প্রেম-ভালোবাসা আমরা বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ করছি, তা যে কেবলই লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত, সে বিষয়টি দেশের জনগণ দ্রুত উপলব্ধি করলেই দেশের স্বাধীনতা রক্ষার দীর্ঘমেয়াদি লড়াই-সংগ্রামে আমাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আল্লাহর রহমতে বৃদ্ধি পাবে। এই বিশেষ সম্পর্ক তৈরির অনুঘটক হিসেবে বিশেষ রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্হাগুলোর ভুমিকা পালনের সুযোগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভালোভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে এক-এগারো সমর্থনকারী একাধিক রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্হার কর্তাব্যক্তিদের ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর এবং তৎকালীন সরকারে মুখ্য ভুমিকা পালনকারীদের সঙ্গে সেই গোয়েন্দাদের গোপন আলাপ-আলোচনার গুঞ্জন বাতাসে ভাসমান ছিল ও আছে। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এসব আঁতাতের ঘটনাই এখন প্রকাশ করে ফেঁসে গেছেন।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই অবশেষে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, এক-এগারোর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলো এবং এদেশের সুশীল (?) সমাজের প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল। দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমে এই ভুমিকার জন্য সেসব রাষ্ট্রের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদুতদের বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হয়েছে। ভিনদেশি দুতদের মধ্যে অতিউৎসাহী দুই-একজন থাকলেও আমার ধারণা, তারা সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের আঞ্চলিক ক্ষমতাধর বন্ধুরাষ্ট্রের যৌথ নীতি বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র। এক-এগারোর সময়কার দৃশ্যত সবচেয়ে কর্মব্যস্ত রাষ্ট্রদুত আনোয়ার চৌধুরীও তার সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে এসে মোটামুটি এ কথাটিই বলার চেষ্টা করেছেন। আঁতাতের মাধ্যমে জরুরি অবস্হা জারি এবং পরবর্তী দু’বছরে যত ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমঝোতা হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ সংস্হার পাশাপাশি ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং দিল্লির সরকারি মহলের যে প্রত্যক্ষ ভুমিকা ছিল, সেটাই আনোয়ার চৌধুরী, এমএ জলিল এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে এবার প্রমাণ হলো। রাজনৈতিক লক্ষ্য পুরণের কৌশল হিসেবে বিদেশের রাজধানীতে সম্পর্ক তৈরিতে আওয়ামী লীগ দেশে তার প্রতিপক্ষ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় যোজন যোজন এগিয়ে রয়েছে, এই বাস্তবতার সঙ্গে সম্ভবত রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মোটেও দ্বিমত করবেন না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মারপ্যাঁচ ছাড়াও কাকতালীয়ভাবে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের পরিবারে আত্মীয়তা সুত্রে বিদেশি সংযোগ হয়তো ওয়াশিংটন, লন্ডন কিংবা দিল্লিতে প্রয়োজনীয় প্রভাব বলয় তৈরিতে সহায়তা করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতির আজকের বাস্তবতা হলো, ক্ষমতায় আরোহণ কিংবা টিকে থাকা উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর রাজধানীর আনুকুল্য প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই অসংখ্যবার দাবি করেছেন, গ্যাস রফতানি করতে রাজি না হওয়ার কারণে তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি। একই যুক্তিতে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগেই বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক লবির প্রয়োজনীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বৃহত্তর স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দেয়ার পুরনো কৌশল অবলম্বন করেই শেখ হাসিনা এবং তার দল ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সভানেত্রীর স্বল্পসময়ের জন্য বিষমিশ্রিত খাদ্য গলাধঃকরণ হয়তো এমন কোনো বৃহৎ আত্মত্যাগ নয়। সজীব ওয়াজেদ জয় এক-এগারোর সরকারের প্রশংসার মাধ্যমে তার মায়ের নেতৃত্বাধীন দলের নেতাকর্মীদের এই বার্তাটিই সম্ভবত পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু চাটুকাররা যে কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র নন, তার প্রমাণ দেয়ার জন্য কুলীন সৈয়দ বংশজাত সাজেদা চৌধুরী মাত্র একটি সপ্তাহ অপেক্ষা করারও ধৈর্য দেখাতে পারেননি। এক-এগারোর গরল যে আওয়ামী লীগের জন্য অমৃতসমান ছিল, সেটি না বুঝেই দলীয় নেতাকর্মীদের সভায় বিষপ্রয়োগের ভাঙা রেকর্ড বাজাতে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ কিছুমাত্র লজ্জাবোধ করেননি। জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী জমানায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মহাজোট বানিয়েছে স্বৈরাচারের প্রতিভু সেই এরশাদকে সঙ্গী করেই। কাজেই বর্তমান সরকারের আমলে আমাদের স্বদেশ যে পুরনো উদ্ভট উটের পিঠেই পুনর্বার সওয়ার হয়েছে, তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে

(সুত্র, আমার দেশ, ০১/১০/২০০৯)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন