বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

বেরুবাড়ী ফেরত আনুন

আর ক’দিন পর দিন বদলের সনদ পাওয়া সরকারের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এ সময়ের মধ্যে কতখানি পূরণ হয়েছে তার কোনো হিসাব আমার কাছে না থাকায়, সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয়। গত বছরের নির্বাচনী প্রচারের সময় আওয়ামী লীগের বেশুমার প্রতিশ্রুতিতে যারা মুগ্ধচিত্তে আস্থা স্থাপন করেছিলেন, চাওয়া-পাওয়ার হিসাব তাদেরই মিলিয়ে দেখা উচিত। তবে সরকারের এক বছরের শাসনকার্য পরিচালনার ধারা দেখে আমার কাছে অন্তত মনে হয়েছে, সঙ্কীর্ণ দলীয় ও পারিবারিক অ্যাজেন্ডার বাইরে ক্ষমতাসীনরা একটি পা-ও ফেলেননি। এই এক বছরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে পেরেছেন, ‘জাতির পিতার পরিবার নিরাপত্তা আইন, ২০০৯’-এর নামে প্রকৃতপক্ষে মরহুম ওয়াজেদ মিঞা ও শফিক সিদ্দিকীর পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অন্যান্য বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, শেখ মুজিব হত্যা মামলার শুনানি সর্বোচ্চ আদালতে সমাপ্ত করে আজ রায় প্রদান এবং পরে সেই রায় বাস্তবায়নের অপেক্ষা এবং সভানেত্রীসহ আওয়ামী লীগের তাবৎ নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে জরুরি সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। বিপরীত দিকে বেগম খালেদা জিয়াসহ মরহুম জিয়াউর রহমানের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে আগের সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের পরিবর্তে সচল করা তো হয়েছেই, উপরন্তু নতুন করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে। কোনো রাখঢাক না করেই আইন প্রতিমন্ত্রী দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য তিনি প্রতিমন্ত্রীর চেয়ারে বসেননি। বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত বাসগৃহ থেকে উচ্ছেদের সব রকম চেষ্টা হাইকোর্টে আটকে যাওয়ার পর কিছু দিনের জন্য কৌশলগত পিছু টান দেয়া হয়েছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের যে ফিরিস্তি দিলাম, তার সাথে জনগণের স্বার্থ কোথায় জড়িত এটা আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। পুরনো বছর না হয় বাদই দিলাম। আগামী এক বছরে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায়ও জনস্বার্থ বলতে গেলে উপেক্ষিতই থাকছে। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড মামলার সুরাহা হওয়ার পর ২১ আগস্ট, ২০০৪ আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রাম ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিডিআর বিদ্রোহের একাধিক বিচার নিয়েই সম্ভবত প্রশাসনযন্ত্র ব্যস্ত থাকবে। সম্প্রতি আবার রাষ্ট্রকে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরিয়ে নেয়ার নতুন লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিন নিত্যনতুন দেশী-বিদেশী ‘জঙ্গি’ আবিষ্কারের লোমহর্ষক কল্পকাহিনী প্রচারের ব্যস্ততা তো রয়েছেই। তথাকথিত দিন বদলের সনদে গণ-মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সে সংক্রান্ত কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের কোনো গরজ সরকারের আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
যা হোক, আজকের কলামে মূলত সরকারের বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের অ্যাজেন্ডা নিয়েই আলোচনা সীমিত রাখব। আওয়ামী লীগ নেতাদের কণ্ঠে বাহাত্তরের সংবিধানের গুণকীর্তন শুনলে যে কারো মনে হতে পারে, বাংলাদেশের তাবৎ সমস্যা সমাধানের মোক্ষম দাওয়াই বুঝি ওই এক সংবিধান সংশোধনের মধ্যেই রয়েছে। আর ভাগ্যের বরপুত্র রাজনৈতিক দলটির পোঁ ধরা সংবাদমাধ্যম তো রয়েছেই যেকোনো বিষয়ে তাদের যেকোনো বক্তব্যকেই বেদবাক্য হিসেবে জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবী, কলাম লেখকরা হরহামেশাই ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে হা-হুতাশ করে থাকেন। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই কর্মটিতে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাই সর্বাপেক্ষা পারদর্শী। ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই জানা যাবে, পাকিস্তান জামানায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান পূর্ব এবং পরবর্তী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক উচ্চতায় আসমান-জমিন ফারাক।

আন্দোলনকালীন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব কারারুদ্ধ ছিলেন এবং তাকে কারামুক্ত করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রায় নব্বই বছরের মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের প্রকৃত নায়কের নাম যে মওলানা ভাসানী, সেই সত্য চল্লিশ বছর ধরে চলমান আওয়ামী প্রচারের তোড়ে প্রায় ভেসে গেছে। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালে প্রথমবার স্বাধীনতা পাওয়ার পর পাকিস্তানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগের বিরোধিতা করে পূর্বাঞ্চলে আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটির জন্মও হয়েছিল একই মওলানা ভাসানীর হাত ধরেই। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিব নিজ বাসগৃহ থেকেই পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা দিয়েছিলেন। অপর দিকে ৯১ বছরের মওলানা ভাসানী তার সহকর্মীদের নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার মহান যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই বয়োবৃদ্ধ জননেতাকে যুদ্ধে অংশ নিতে না দিয়ে দেরাদুনে অন্তরীণ করে রেখেছিলেন তার সাম্রাজ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ভাসানী নভোথিয়েটার নামটি নাকি একেবারেই অসহ্য ঠেকে। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে আপসহীন মওলানা ভাসানীর নামের স্থানে তার পিতার নাম প্রতিস্থাপন করে তৃপ্তি লাভ করতে পারেন, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস শেষ অবধি পাল্টাতে সক্ষম হবেন না। মওলানা ভাসানীর অনেকগুলো সম্পাদকের মধ্যে যৌবনের শেখ মুজিব একজন মাত্র ছিলেন এই ইতিহাস মুছে ফেলা কঠিন। লিখতে চেয়েছিলাম কেবলই সংবিধান নিয়ে। বোধহয় যেদিন লিখছি সেই দিনটি মজলুম জননেতার ৩৩তম মৃত্যুদিবস বলেই আবেগতাড়িত হয়ে লেখাটি খানিকটা দিক পরিবর্তন করে ফেলেছে। তবে ইতিহাস বিকৃতির যে ধারা মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রে ঘটেছে, সেই একই পরম্পরা আমরা বাহাত্তরের সংবিধান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ করব।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর বিগত ৩৭ বছরে ১৪টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি আনা হয়েছিল প্রথম তিন বছরে শেখ মুজিবের শাসনকালীন। চারটি সংশোধনীর সময় এবং বিষয়াবলি সম্পর্কে জানা পাঠকের জন্য আবশ্যক বিবেচনা করছিঃ
০১. প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩ সালের ১৫ নম্বর আইন) ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংসদে গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের সুবিধার্থে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত সংবিধানের ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদে এই সংশোধনী আনা হয়।

০২. দ্বিতীয় সংশোধনী (১৯৭৩ সালের ২৪ নম্বর আইন) ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সংসদে গৃহীত হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ব্যর্থ হয়ে মরহুম শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার চরম নিবর্তনমূলক এই বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রবর্তন করে। যেহেতু এটি একটি জনগণের মৌলিক অধিকারবিরোধী আইন সে কারণে সংবিধানে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অর্থাৎ মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত মূল অনুচ্ছেদটি এই আইনের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়। এই আইনের বলেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়ে থাকে যার সর্বশেষ অপপ্রয়োগ আমরা তথাকথিত এক-এগারো সরকারের শাসনামলে দেখেছি।

০৩. তৃতীয় সংশোধনী (১৯৭৪ সালের ৭৪ নম্বর আইন) ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর সংসদে অনুমোদিত হয়। এই আইনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন করে বেরুবাড়ী ভারতকে দেয়া হয় এবং মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী এই ছিটমহলের বিনিময়েই মাত্র তিন বিঘা আয়তনের একটি করিডোর বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল যাতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অবরুদ্ধ জনগণ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। মূল চুক্তিটি একই বছর ১৬ মে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত হয়।

০৪. চতুর্থ সংশোধনী (১৯৭৫ সালের ২ নম্বর আইন) ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে গৃহীত হওয়ার ফলে বাংলাদেশে একদলীয় ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিচার বিভাগের অধিকার বিশেষত উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিপ্রায়ে মূল সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। ফ্যাসিবাদী একদলীয় শাসনব্যবস্থাকে আবার ‘মুজিববাদ’ নাম দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার নতুন তত্ত্ব হিসেবে হাজির করার হাস্যকর এবং ব্যর্থ প্রচেষ্টা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের প্রজন্মকে দেখতে হয়েছে। সৌভাগ্যবশ্যত চতুর্থ সংশোধনীর ক্ষমতাবলে গঠিত সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছয় মাস ২০ দিন। বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং গণবিরোধী আইন হিসেবে চতুর্থ সংশোধনী ধিকৃত হয়ে আছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে মুজিববাদও বিলুপ্ত হয়েছে।

লক্ষ করার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অথবা এর সমর্থক বুদ্ধিজীবীকুল এই চার সংশোধনী নিয়ে আলোচনায় কোনো উৎসাহ বোধ করেন না। নতুন প্রজন্মকে সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনের পরম্পরা পঞ্চম সংশোধনী থেকেই আরম্ভ করা হয়েছিল। এমন প্রক্রিয়ায় সারা দেশে প্রচার চলছে যাতে তরুণ প্রজন্মের কাছে মনে হবে বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাইকোর্টের দুই সদস্যবিশিষ্ট বেঞ্চ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে যেন সংবিধানকে পূত-পবিত্র করেছেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখে গণপরিষদে যে অবস্থায় সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে ফিরে যাওয়া যেনো স্বয়ংক্রিয় ব্যাপার। জটিল বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের স্বার্থে এভাবে সরলীকরণ করা যায় কি না, সেটি বোঝার জন্য সংবিধানের ২ ও ৩ নম্বর সংশোধনী নিয়ে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

আগেই উল্লেখ করেছি, দ্বিতীয় সংশোধনী একটি নিবর্তনমূলক আইন এবং মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বিরুদ্ধ মত দমনের উদ্দেশ্যেই প্রধানত বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করেছিলেন। বাংলাদেশের উভয় প্রধান দল বিগত দুই দশকে বহুবার এই আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিবার নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কেউই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে পুনর্বার বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও আওয়ামী লীগের দিন বদলের সনদ এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে যত্রতত্র ইসলামি জঙ্গি আবিষ্কার করে বেড়াচ্ছে এবং বিগত দশ মাসে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মৌলিক অধিকারবিরোধী ধারাবলেই অসংখ্য মানুষকে আটক করেছে। আটক ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পরে কথিত অভিযোগে আদালতে হয় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছে অথবা তাদের এখনো বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। শেখ মুজিব হত্যা মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব প্রভাবশালী মন্ত্রীরা গত সপ্তাহখানেক ধরে যেভাবে দেশব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছেন, তার তুলনা মেলা ভার। এমতাবস্থায়, সরকারের হৃদয়ের যদি পরিবর্তন হয়ে থাকে এবং তারা বিবেচনা করে থাকেন দেশে বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে এবং বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কখনো জরুরি আইন ঘোষণা করতে হবে না, তাহলে দ্বিতীয় সংশোধনী বাতিল হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি না থাকা সত্ত্বেও একটি কালো আইন বাতিল করার জন্য শেখ হাসিনা এবং তার সরকার অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার হবেন।

এবার তৃতীয় সংশোধনী প্রসঙ্গ। সরকার দেশের মানচিত্র বদলের অপচেষ্টা করছে, এমন একটি মন্তব্য করে মাত্র কয়েক দিন আগেই বেগম খালেদা জিয়া সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দের তোপের মুখে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তো বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে রীতিমতো দেশদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন। মামলা এবং রিমান্ডপ্রিয় সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছ থেকে এই গুরুতর অভিযোগ শুনে অনেকেই ধারণা করছিল এবার বোধ হয় বেগম খালেদা জিয়াকে আরো একটি মামলার ধাক্কা সামলাতে হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয় জানেন না নয়তো ভুলে গেছেন, প্রকৃতপক্ষেই সংসদে আইন করে বাংলাদেশের মানচিত্র একবার পরিবর্তন করা হয়েছে এবং এই কর্মটি তার দলের প্রাণপুরুষ মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালেই ঘটেছিল। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জ্ঞাতার্থে সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর ৪ নম্বর অনুচ্ছেদটি উদ্ধৃত করছিঃ

‘‘এলাকা অন্তর্ভুক্ত ও বহির্ভূতকরণের বিজ্ঞপ্তি। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী ভূ-সীমানা নির্ধারণের পর সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা সরকার যে তারিখ বর্ণনা করেন সেই তারিখ হইতে উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণিত ‘অন্তর্ভুক্ত এলাকা’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার অংশ হইবে এবং ‘বহির্ভূত এলাকা’ উহার অংশ হইবে না।”
আর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির যে অংশবলে সংবিধান সংশোধনক্রমে মানচিত্রের এই পরিবর্তন করা হয়েছিল সেটিও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের জানা আবশ্যক।

"১৪. Berubari.-India will retain the southern half of South Berubari Union No. 12 and the adjacent enclaves, measuring an area of 2.64 square miles approximately, and in exchange Bangladesh will retain the Dahagram and Angarpota enclaves. India will lease in perpetuity to Bangladesh an area of 178 meters x 85 meters near `Tin Bigha to connect Dahagram with Panbari Mouza (P.S. Patgram) of Bangladesh”
একবার যে গোষ্ঠী দেশের মানচিত্র বদল করতে পেরেছে সেই একই গোষ্ঠী প্রায় একদলীয় সংসদের সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয়বার মানচিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারে এমন সন্দেহ পোষণ করা হলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আখ্যা দেয়ার যুক্তি কোথায়? আর বাংলাদেশ যে তিন বিঘা করিডোরের আশায় বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছে বেরুবাড়ী ছিটমহল হস্তান্তর করেছিল সেই করিডোরও তো lease in perpetuityÕk (চুক্তি থেকে উদ্ধৃত) ভিত্তিতে অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। চুক্তি ভঙ্গ করার কারণ হিসেবে আমাদের জানানো হয়েছে, ভারতের উচ্চ আদালত সাব্যস্ত করেছে এই তিন বিঘা করিডোর বাংলাদেশকে দেয়া হলে নাকি সে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে। অথচ একই আধিপত্যকামী বৃহৎ দেশটি এখন বাংলাদেশকে চার ভাগে বিভক্ত করে শত শত কিলোমিটারব্যাপী করিডোর চাচ্ছে এবং ভারতের এ দেশীয় দালাল গোষ্ঠী তাদের প্রভু রাষ্ট্রের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বে্‌ আমরা যারা বিশ্বাস করি তারা যখন এই ভারতীয় করিডোরের বিরুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলেই অবস্থান নিয়েছি, তখন নানা রকম হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভারতের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে সরকারপক্ষীয়দের যথেষ্ট সমবেদনা। অপরাধ কেবল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুললেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের বিজয়ের মাসে ভারত সফরে যাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছি এই সফরে নাকি নানা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। আশা করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার সফররের সময় অপর পক্ষের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়ন না করতে পারার জন্য তাদের কাছ থেকে বেরুবাড়ী ফেরত চাওয়ার হিম্মত দেখাবেন। তা ছাড়া শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই বোঝেন, বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরতে হলেও তো আমাদের তৃতীয় সংশোধনী বাতিল করতে হবে। সেই কাজটি সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিংহের অনুমতিসাপেক্ষে আমরা যত দিন না করতে পারছি তত দিন বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং বুদ্ধিজীবীদের মায়াকান্না বন্ধ রাখাটাই শ্রেয়। মাত্র দশ মাসের মধ্যে অনেক নাটকের মঞ্চায়নই তো দেখলাম। জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আগেই নতুন নতুন নাটক রচনা বাদ দিয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে মনোযোগী হলেই সরকারের জন্য আখেরে কাজ দেবে।

লেখকঃ সাবেক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান
(সুত্র, নয়া দিগন্ত, ১৯/১১/২০০৯)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন