বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

মার্কিন এজেন্ডায় আর সুশাসন নেই

মার্কিন এজেন্ডায় আর সুশাসন নেই

মাহমুদুর রহমান

  
আমার গত সপ্তাহের মন্তব্য-প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সুশাসনহীনতা এবং শৃঙ্খলিত বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছিলাম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থায়নে সুশাসন বিষয়ক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনে যে ভাটার টান চলছে, তাও উল্লেখ করেছিলাম। লেখাটি প্রকাশের পর চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. জেমস্ মরিয়ার্টি মার্কিন নীতি পরিবর্তনের বিষয়টি স্বয়ং খোলাসা করে দিয়েছেন। ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দানকালে তিনি বলেছেন, এখন থেকে গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং মৌলবাদহীনতাই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। মার্কিন অভিধান থেকে কত সহজেই না এতদিনের বহুল ব্যবহৃত সুশাসন, দুর্নীতি, স্বাধীন বিচার ইত্যাদি শব্দ উধাও হয়ে গেল। চারদলীয় জোট সরকারও যে ২০০১ সালে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল, সেটি বোধ হয় মরিয়ার্টি সাহেব অস্বীকার করবেন না। আওয়ামী লীগপন্থী অর্থনীতিবিদদের মন খারাপ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে বাংলাদেশে উন্নয়নের গতিধারাও যথেষ্ট বেগবান হয়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের জবানে তখন আমাদের গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের এজেন্ডার গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়নি। বরং এক-এগারোর ক্যু দেতার আয়োজনে এই দেশটি অন্য আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। একটি অবৈধ, অগণতান্ত্রিক সরকারের ক্ষমতাগ্রহণকে জায়েজ করার জন্য তত্কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে তাবত্ পশ্চিমা কূটনীতিক তখন দুর্নীতির মূলোত্পাটন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচারণা চালিয়েছেন।

বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলে বেড়িয়েছে—দুর্নীতির কারণেই বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে না। দুর্নীতি দূর করা গেলেই রাতারাতি এদেশে দুই অংকের অর্থাত্ ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়ে যাবে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছরে জাতীয় আয় ক্রমেই নিম্নগামী হয়েছে। বর্তমান বছরে অংকের মারপ্যাঁচে অন্তত ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এবছর ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানোই এক দুরূহ কাজ। যাই হোক, আসল কথা হলো মার্কিন নীতি এবং মার্কিন বন্ধুত্ব দুটোই পদ্মপাতায় জলের মতো। এই আছে, এই নেই। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে কারাগারে বন্দি বিএনপি

নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের বিশেষ সম্পর্কের গুজব আমরা কান পাতলেই এক সময় শুনতে পেতাম। মানবাধিকারের কোনো রকম তোয়াক্কা না করে বর্তমান সরকার জনাব বাবরের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা সভ্য রাষ্ট্রে না থাকলেও তার এক সময়ের বন্ধু, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ধ্বজাধারী মার্কিনিরা কিন্তু এ প্রসঙ্গে একেবারেই নীরব। কাজের বেলা কাজী, কাজ ফুরালেই পাজি প্রবচনটি সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের বেলায়ই বেশি প্রযোজ্য। এ জাতীয় মন্তব্যের কারণে অনেকেই আমাকে ঘোরতর মার্কিন-বিদ্বেষী ভাবতে আরম্ভ করেছেন। এর আগের দু-একটি লেখাতে পাঠকদের জানিয়েছি যে জাতীয়তাবাদী ঘরানার লোকজন আমার এই লেখালেখির জন্য ক্রমেই বিব্রত থেকে এখন রীতিমত বিরক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। তাদের কথা হলো ভারতের সমালোচনা করছেন ভালো কথা, আবার আমেরিকাকে চটাচ্ছেন কেন? তাদের ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্নের বাড়া ভাতে এমন করে ছাই দেয়া ক্রমেই সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। বোঝাই কী করে, আমি কাউকেই খুশি করা বা চটানোর জন্য লিখি না। তাছাড়া লেখালেখি কস্মিনকালেও আমার পেশা বা নেশা কোনোটাই ছিল না। দেশের এক মহাদুর্যোগকালে উপায়ান্তর না দেখে অনেকটা আকস্মিকভাবে কলমকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছি। সেই জাতীয় দুর্যোগের দেশি-বিদেশি হোতাদের তোষামোদ করে দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা কেমন করে লেখা যায় সে বিদ্যা এখনও রপ্ত করতে পারিনি। ওরা বিভিন্ন ছলছুতোয় আমার মাতৃভূমির স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায় বলেই তো আমি প্রতিবাদ করি। নইলে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের সঙ্গে আমাদের বিরোধ কোথায়? কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হলে দেশ দুটির শাসকশ্রেণীর দ্বৈত চরিত্রের মুখোশ উন্মোচন করাটাও তো কম জরুরি নয়। তাছাড়া, ক্ষমতাবানদের খুশি করার কৌশলই যদি জানতাম তাহলে কি আর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ওপর এতটা কুপিত হন! জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে যারা একসময় মিডিয়া মালিক হয়েছেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই তো বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বেজায় খাতির রয়েছে। তারা আমার মতো নির্বোধ নন বলেই বাংলাদেশের রাজনীতির উভয় মূলধারার সঙ্গেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারছেন। সবার দ্বারা সব কিছু হয় না। আমি না হয় ব্যতিক্রমই রইলাম।

একটি দেশের জনগণ সচেতন না হলে সে দেশের সরকার ক্ষমতায় আরোহণ কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্রমেই আপসকামিতায় আক্রান্ত হয়ে বিদেশিদের ডেকে নিয়ে আসে। এ দেশে ২০০৮-এর নির্বাচনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত উভয় রাষ্ট্রের কাছে দাসখত লিখে দিয়ে এসেছিলেন। প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাথী হয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন; ভারতের সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। আঞ্চলিক পরাশক্তিকে ট্রানজিট, বন্দর সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশকে প্রকৃতপক্ষে একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে—দেশের এমন স্বার্থবিরোধী ঘোষণা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। তারপরও তাকে দেশের মানুষের কাছ থেকে কোনোরকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। বরঞ্চ তার দল নির্বাচনে বিস্ময়কর বিজয় লাভ করেছে। নির্বাচনের মাত্র ক’দিন আগে অতি সম্প্রতি সরকার কর্তৃক বন্ধ ঘোষিত একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক লাইভ টকশোতে অংশ নিয়েছিলাম। কাকতালীয়ভাবে সুন্দরবন উপকূল দিয়ে ওই দিনই ভারতীয় নৌবাহিনীর একাধিক জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা অতিক্রম করে আমাদের অংশে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল। আমি স্বভাবসুলভ ভাষায় ওই আগ্রাসী তত্পরতার শক্ত প্রতিবাদ করে বক্তব্য রাখছিলাম। এমন সময় এক প্রশ্নকর্তা টেলিফোনে আমাকে ভারতবিরোধী, প্রাচীনপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল ইত্যাদি বলে একেবারে তুলোধুনো করে দিলেন। তিনি আরও বলছিলেন—ভারতীয় জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় আসাতে কী এমন ক্ষতি হয়েছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, টেলিফোনের ওপারের ভদ্রলোক আসলেই কি বাংলাদেশের নাগরিক নাকি ভারতীয় দূতাবাসের কোনো কর্মকর্তা নাম ভাঁড়িয়ে ফোন করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে চলমান সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে আমাদের স্বাধীনতার চেতনার কতখানি অবক্ষয় ঘটেছে, তার একটি বড় প্রমাণ হয়ে আছে আমার ওই দিনের টকশো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার যে আয়োজন চলছে, তাকে প্রতিহত করার জন্যই সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন।

ইরাক এবং আফগানিস্তানের টাটকা অভিজ্ঞতা চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও আমাদের উটের মতো বালির মধ্যে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই। গণতন্ত্র কায়েম এবং ইসলামী মৌলবাদ উচ্ছেদের বাহানায় দেশ দুটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। ইরাকে এত সংখ্যায় বিকৃত ও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মাচ্ছে এবং শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রকোপ এতটাই বেড়ে গেছে যে, বিশেষজ্ঞরা ইরাকি দম্পতিদের আগামী পঁচিশ বছর সন্তান জন্ম দিতে নিষেধ করছেন। এ সবই হয়েছে সে দেশে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীর নির্বিচার রাসায়নিক বোমা বর্ষণ এবং অন্যান্য মারণাস্ত্রের খণ্ডিত অংশ থেকে ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়ায়। পশ্চিমা মিডিয়াতে একসময় সাদ্দাম হোসেনকে মধ্যপ্রাচ্যে পাশ্চাত্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একজন সেক্যুলার রাষ্ট্রনায়করূপে বর্ণনা করা হতো। একই মিডিয়া পরে তাকে একজন খুনি, একনায়ক এবং পশ্চিমা স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে প্রচার করেছে। সাদ্দাম হোসেন অবশ্যই একজন অত্যাচারী শাসক ছিলেন এবং তার বাথ পার্টিকে সাধারণভাবে ইসলামবিরোধী হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ইরাকের এই নেতা যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশ অনুযায়ী সফল ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন দ্বিমুখী চরিত্রের মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে তিনি একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ইরাকি হত্যার অভিযোগ আনা হয়। অথচ প্রেসিডেন্ট বুশের (জুনিয়র) নেতৃত্বে তথাকথিত ইচ্ছুকদের মোর্চা (ঈড়ধষরঃরড়হ ড়ভ ডরষষরহম) হাজার হাজার নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত দশ লক্ষাধিক ইরাকিকে হত্যা করেছে। সাদ্দাম হোসেনকে তো সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হয়ে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিচার করবে কে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে। জর্জ বুশের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বাংলাদেশের অনেক নাগরিককে দেখেছি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইসলামিক শিকড় সন্ধান করে যথেষ্ট পুলকিত বোধ করতে। তারা হয় জানেন না নইলে ভুলে গেছেন যে বারাক ওবামা কোরআন নয়, বাইবেল স্পর্শ করেই প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েছেন। তার পিতার নামের হোসেন অংশ এখন আর কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়। তদুপরি, সরকার পাল্টালেই আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির বাংলাদেশের মতো পরিবর্তন ঘটে না। আর দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় বুশ অনুসৃত বাংলাদেশ সংক্রান্ত মার্কিন নীতির পরিবর্তনের কোনো রকম সম্ভাবনা আমি অন্তত অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাচ্ছি না। ক’দিন আগে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত টিমোথি জে রোমারের (ঞরসড়ঃযু ঔ জড়বসবত্) ঢাকায় উপস্থিতি বিশেষ তাত্পর্য বহন করে। পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য সব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একমাত্র ভারতের মতামতই যে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রাধান্য পাবে, সেটি রাষ্ট্রদূত রোমারের ঢাকা সফরের পর না বোঝার কোনো কারণ নেই। এই সহজ সমীকরণটি যারা এতদিন বুঝতে চাচ্ছিলেন না, সম্ভবত তাদের প্রতি করুণাবশতই ঢাকায় মার্কিন প্রতিনিধি মি. জেমস্ মরিয়ার্টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণে তার দেশের নীতি এতটা খোলাখুলিভাবে বললেন। এই ভাষণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোত্সাহে তার সরকারের দমন-নিপীড়নের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে। সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ, বিরোধী মতাবলম্বীদের বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা, নারী-শিশু নির্বিশেষে অভিযুক্তদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, ক্রসফায়ারের রেকর্ড সৃষ্টি, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে মার্কিনিদের তরফ থেকে অন্তত আর কোনো বাধা রইল না। রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি তিনটি শর্তের কথা মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে তার একটিই শর্ত। জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামপন্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের এমন হীনবল করে দিতে হবে যাতে আগামী অন্তত কয়েক দশকের মধ্যে তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে। মৌলবাদহীনতা বলতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের এমন একটি পরিস্থিতিই সম্ভবত বুঝিয়েছেন। আমাদের দেশে রাজনীতির ঠিক যে অবস্থাটি ভারত দীর্ঘদিন ধরে দেখতে আগ্রহী, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কণ্ঠে সেটিই উচ্চারিত হয়েছে মাত্র। বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশের এক সময়ের বামপন্থীদের জন্য বড় করুণা হয়। চীন কিংবা সাবেক সোভিয়েত যে ব্লকেরই হোক না কেন, সব বামপন্থীর মুখের একসময় অভিন্ন বুলি ছিল—সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। এদের মধ্যকার অধিকাংশই ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের প্রতি অনুরক্ত হলেও মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন ও মার্কিন বিরোধিতা না করলে তাদের আবার জাত থাকে না। বর্তমানে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতম মিত্রে পরিণত হয়েছে। চুপি চুপি ভাব-ভালোবাসা হলেও না হয় একটা কথা ছিল। না দেখার ভাণ করলেই হতো। কিন্তু ভারত-মার্কিন মৈত্রীর কাবিননামা কেবল সই করাই হয়নি, বিশ্ববাসীকে সেটি দেখানোও হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মুখে কুলুপ এঁটে থাকাটাই বোধ হয় ভারতপন্থী বামদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। মহাজোটে সওয়ার হয়ে সততার মুখোশ তো গেছেই, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার মুখোশটি তো অন্তত ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবে ধরে রাখতে হতো।

সেই ষাটের দশকে আমরা যখন স্কুলের ছাত্র, সেই সময় প্রগতিশীল বড় ভাইদের দেখতাম চে-গুয়েভারার ছবি সংবলিত গেঞ্জি গায়ে দিয়ে মাকর্্স-লেনিনের তত্ত্ব আওড়াতে। কলকাতার আদলে পুরনো ঢাকার দেয়ালেও ‘চীনের চেয়ারম্যান মাও আমাদেরও চেয়ারম্যান’ জাতীয় চিকা মারা দেখেছি। নাস্তিকতার ফ্যাশন তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজেও স্বল্প সংখ্যায় হলেও ছিল। তবে সরাসরি ইসলাম-বিদ্বেষ দেখতে পাইনি কখনও। দীর্ঘ, সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত পাড়ার মুরব্বিদের দেখলে সালাম দিতাম। তারাও মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দোয়া করতেন। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনে নাস্তিক বড় ভাইদেরও কোনোদিন ইতস্তত করতে দেখিনি। এখন প্রগতিশীলতার রূপ পাল্টে গেছে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতো চরম ইসলাম-বিদ্বেষ হালের প্রগতিশীলদের প্রধান তত্ত্ব। বাংলাদেশে এখন ইসলাম ছাড়া সব ধর্ম পালনের নাম প্রগতিশীলতা। আর টুপি-দাড়ি প্রতিক্রিয়াশীলদের আভরণ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। মিষ্টির প্যাকেট হাতে বরসহ বরযাত্রীদের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শুধু টুপি-দাড়ি থাকার অপরাধে গ্রেফতার করে তাদের জঙ্গি নাম দেয়া হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে পিটিয়ে হাড়-গোড় ভেঙে দেয়া হচ্ছে। আর সরকারের মার্কিন ও ইউরোপীয় বন্ধুরা পাশ থেকে হাততালি দিচ্ছেন। এটাই তো জেমস্ মরিয়ার্টি বর্ণিত মৌলবাদহীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঠিক কর্মসূচি। কী বললেন, মানবাধিকার? সেটি আবার কী পদার্থ? গুয়ান্তানামো বে আর আবু গ্রাইব কারাগারে বন্দিদের প্রতি যে আচরণ বিগত এক দশক ধরে করা হচ্ছে, তারই কিয়দংশ বাংলাদেশ থেকে ইসলামী মৌলবাদ হঠানোর মহত্ উদ্দেশ্যে সেক্যুলার সরকার এস্তেমাল করলে এতে দোষের কিছু নেই। সাম্রাজ্যবাদীদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিছুসংখ্যক কালো গাত্রবর্ণের মুসলমানের মৌলিক অধিকারের তোয়াক্কা করা মার্কিন নীতির মধ্যে পড়ে না। এই সরকারের আমলে আহমদিয়ারা নিরাপদে আছে, এটাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে বড় কথা। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গজিয়ে ওঠা খতমে নবুয়ত মার্কা সংগঠন এখন বিদেশি প্রভুদের ইঙ্গিতে মৌনব্রত পালন করছে। আহমদিয়াবিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থকড়ি সরবরাহে হয়তো টানও পড়েছে। অবশ্য সংখ্যালঘু হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের পরম্পরা আওয়ামী নেতাকর্মীরা তাদের চিরায়ত স্বভাব অনুযায়ী মাঝে মধ্যে চালিয়ে গেলেও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তো এখনও চুপচাপই রয়েছে। তাদের আওয়ামীপ্রীতিতেও কোনো ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
[সূত্রঃ আমার দেশ, ১৭/০৫/১০]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন