মঙ্গলবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১২

মিজানুর রহমান খানের কলাম: সৌদি কর্মকর্তা খালাফের খুনি কে?

মিজানুর রহমান খানের কলাম: সৌদি কর্মকর্তা খালাফের খুনি কে?: বন্ধুপ্রতিম দেশ সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ বিন মোহাম্মদ সালেম আল-আলী হত্যারহস্যের জট যে এখনো খোলেনি, সেটা অবশ্যই পরিতাপের। তদ...

মন্তব্য প্রতিবেদন : ‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত



মাহমুদুর রহমান
দ্বিতীয় পর্ব
বাংলাদেশে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী ভারত থেকে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে সারি নদী একটি। এই নদীটি মাইনথ্রু (Mainthru) নামে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে জন্মলাভ করেছে। মাইনথ্রু সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নাম নিয়েছে এবং ছাতকের কাছে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন (Goyain) নদীর পানিও সারির সঙ্গে মিশেছে। পাহাড়ি নদী সারি-গোয়াইন মেঘালয় থেকে প্রচুর পাথর, মোটা বালু এবং পলিমাটি বহন করে নিয়ে আসে। নদীতীরবর্তী বিপুলসংখ্যক মানুষ এই নদী থেকে পাথর সংগ্রহ এবং পরিবহনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সুতরাং, নদীটির বেঁচে থাকা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের অন্তত কিছু মানুষের সংসার খরচ মেটানোর জন্যও আবশ্যক।
এই মাসেই ভারত সরকার মাইনথ্রু নদীতে ৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে সেখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। এই বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আমার জানা মতে, আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভারত সরকার বাংলাদেশের অনুমতি নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি। সিলেট অঞ্চলের জনগণ ‘সারি নদী বাঁচাও’ আন্দোলন গড়ে তুললেও ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো রকম প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এই বাঁধ নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ নম্বর ধারা উল্লেখ করা আবশ্যক। সেই ধারায় বলা হয়েছে, ‘Guided by the principles of equity, fairness and no harm to either party, both the governments agree to conclude water sharing Treaties/Agreements with regard to other common rivers.’ অর্থাত্, সমঅধিকার, ন্যায্যতা এবং কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার নীতি অনুসরণ করে, উভয় পক্ষ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করছে। সুতরাং, সারি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এই নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করে গঙ্গা-চুক্তির ৯ নম্বর ধারা সুস্পষ্টভাবে ভঙ্গ করেছে। এই চুক্তিবহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকার সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ ও জনগণের জীবনধারণকে আজ যে হুমকির মুখে ফেলেছে, তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারী ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারও সমভাবে দায়ী। তারা দেশের স্বার্থ বিষয়ে নীরব থেকে ভারতকে বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা চুক্তি ভঙ্গে উত্সাহিত করেছে।
এবার টিপাইমুখ প্রসঙ্গে আসি। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাই উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদী। ভারত সেই বরাক উপত্যকার টিপাইমুখ নামক স্থানে ৩৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৬৩ মিটার উচ্চতার এক অতিকায় বাঁধ (mega-dam) নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী যে জায়গাটিকে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছে, সেটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯৮৮ সালেও এই অঞ্চলে ৬.৬ রিখটার মাত্রার একটি তীব্র ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রয়েছে যে, মণিপুর অঞ্চলে ৮ কিংবা অধিক রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়া সম্ভব। এমন এক স্থানে অতিকায় বাঁধ নির্মাণ সেই ভূমিকম্প প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ৮ রিখটার স্কেলের ঊর্ধ্বমাত্রার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় টিপাইমুখ বাঁধ ভাঙলে মণিপুর ও ঘন বসতিপূর্ণ সিলেট অঞ্চলে যে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হবে, তা সুনামি কিংবা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতিকেও হার মানাবে। অর্থাত্ এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ভয়াবহ এক টাইম বোমার সঙ্গে বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই মণিপুরের স্থানীয় অধিবাসীরাও বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। অবশ্য, এসব আন্দোলনকে দিল্লির শাসকশ্রেণী বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে চলেছে। তাছাড়া সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বিদ্রোহী মণিপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদতলে পিষ্ট একটি রাজ্য মাত্র। এ তো গেল ভূমিকম্পজনিত সর্বনাশের আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সঙ্গত কারণেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়ে গেলে সেখানে কেবল জলবিদ্যুত্ উত্পাদনই করা হবে না, ভবিষ্যতে সময়-সুযোগমত পানি প্রত্যাহার করে পদ্মা অববাহিকার মতো মেঘনা অববাহিকাকেও ধ্বংস করা হবে। সে কারণেই ক্ষমতাসীন মহাজোট এবং ভারত থেকে নিয়মিত মাসোহারাপ্রাপ্ত তথাকথিত সুশীল (?) গোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। জনমতের এই বিরূপতা উপলব্ধি করে বহুরূপী রাজনীতিক, স্বৈরাচারী এরশাদ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের লোক-দেখানো নাটক মঞ্চস্থ করতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রবিরোধী চরিত্র অনুযায়ী আমাদের মাতৃভূমি ধ্বংসকারী যাবতীয় ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেখেও সর্বপ্রকারে লজ্জাহীন দালালি অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতার গত তিন বছরের বক্তব্য এবার খানিকটা ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে।
একসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে নাকি বাংলাদেশের লাভ হবে। আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী, তিস্তাপাড়ের রমেশচন্দ্র সেন বলেছেন, আগে বাঁধ নির্মিত হোক, তারপর বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তখন দেখা হবে। পানি প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তো আর এক কাঠি সরেস। তিনি ভারতের অবস্থান সমর্থন করে বাণী দিয়েছেন, ভারত তাদের নদীতে বাঁধ দিলে আমাদের বলার কী আছে? অর্থাত্ আন্তর্জাতিক নদীর (International/Transboundary river) সংজ্ঞা সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের এই অখ্যাত, দেশবিরোধী আওয়ামী রাজনীতিবিদের কোনো ধারণাই নেই। তবু তিনি শেখ হাসিনার প্রিয় পানি প্রতিমন্ত্রী। এদের আচরণদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগ করলেই বোধহয় ভারতের দালালে রূপান্তরিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দিল্লির পদলেহনকারী বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে নিজের কাছেই ঘৃণাবোধ হয়। এক-এগারোর সামরিক জান্তার সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত এই বিচিত্র, রহস্যময় ব্যক্তিটি বিগত প্রায় চার বছর ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। কাজেই তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সমর্থন করে সভা, সেমিনার, টেলিভিশনে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন অথবা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সেগুলোকে আবর্জনা জ্ঞান করে বিবেচনার বাইরেই রাখলাম।
১৯৯৬ সালের বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক মাত্র কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা বলাটা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। তবু জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর খাতিরে তার কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ বাধ্য হয়েই দিতে হচ্ছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে, আবদুর রাজ্জাক একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে ২০০৯ সালে টিপাইমুখ পরিদর্শনের নামে ভারতে আনন্দ সফর করে এসেছিলেন। দিল্লি থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারত সরকারের পক্ষে তিনি যেভাবে সাফাই গেয়েছিলেন, তাতে দেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক স্তম্ভিত হয়েছে। বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে, সংসদের বক্তৃতায়, টেলিভিশন টকশোতে এবং বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে মরহুম আবদুর রাজ্জাক রহস্যজনক কারণে রীতিমত ওকালতি করেছেন। দিল্লি থেকে ফিরেই ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছিলেন শুধু সেটুকুই ২০০৯ সালের ৫ আগস্টের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বা হুমকির কারণ হবে। ভারতীয় দুই মন্ত্রী এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভারতে ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ভারত এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, বিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা ও কুশিয়ারাতে আগে যে পানি আসত, তা আরও বাড়বে।’
মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে অধিকতর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সর্বশেষ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযুক্ত করে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের পক্ষে যে রায় ঘোষণা করেছেন তা রীতিমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ২০০২ সালে ভারত সরকার সে দেশের আদালতেরই একটি রায়ের প্রেক্ষিতে এই বৃহত্ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ি দাবি করেছিলেন, অভিন্ন নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত বন্যা এবং খরার কবল থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী এই প্রকল্পটির পরিকল্পনার কথা ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশ পেলেও ২০০২ সাল পর্যন্ত এটা কেবল আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাদিয়ার (SH Kapadia) নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত রায়ে একটি নির্ধারিত সময়ের (Time-bound) মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘We direct the Union of India to forthwith constitute a committee for interlinking of rivers. We direct the committee to implement the project.’ (আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন অনতিবিলম্বে নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। আমরা কমিটিকেও প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিচ্ছি)। সুপ্রিমকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত গঙ্গার পানি চুক্তির ৯ নম্বর ধারার (লেখার প্রারম্ভে উদ্ধৃত) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কেবল তাই নয়, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নজিরবিহীন রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আমি এই প্রসঙ্গে কেবল Helsinki Agreement এবং UN Convention-এর আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ করব। এই দুটি ছাড়াও ভাটির দেশের অধিকার রক্ষায় আরও যেসব আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো লেখার কলেবর সীমিত রাখার লক্ষ্যে আপাতত উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ হেলসিংকিতে আন্তর্জাতিক নদীর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যে চুক্তি (Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে পরিষ্কারভাবে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চুক্তিটির নাম ‘Convention on the Protection and the Use of Transboundary Watercourses and International Lakes’। এই চুক্তিতে মোট ২৮টি ধারার মধ্যে আমার আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলিই কেবল পাঠকের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বোঝার সুবিধার্থে এখানে উদ্ধৃত করছি। পাঠকের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার হবে জেনেও বিনীতভাবে তাদের ওই ধারাগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়বার অনুরোধ করছি। আমি মনে করি, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হলে জনগণের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক।
* 2-1. The parties shall take all appropriate measures to prevent, control and reduce any transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং হ্রাস করা যায়।)
* (2-2c) The parties shall in particular take all appropriate measures to ensure that transboundary waters are used in a reasonable and equitable way, taking into particular account their transboundary character, in the case of activities which cause or are likely to cause transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার নিশ্চিত হয়, বিশেষত আন্তর্জাতিক নদীর চরিত্রের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।)* (2-6) The riparian parties shall co-operate on the basis of equality and reciprocity, in particular through bilateral and multilateral agreements, in order to develop harmonized policies, programmes and strategies covering the relevant catchment areas, or parts thereof, aimed at the prevention, control and reduction of transboundary impact and aimed at the protection of environment of transboundary waters or the environment influenced by such waters, including the marine environment. (নদীতীরবর্তী পক্ষগুলো পরস্পরের সঙ্গে ন্যায্যতা ও দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সহযোগিতা করবে, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সমন্বিত নীতিমালা প্রণীত হবে, সংশ্লিষ্ট নদীখাত এলাকা অথবা তার অংশবিশেষে এমন কর্মসূচি অথবা কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা যায় এবং নদীজ পরিবেশসহ আন্তর্জাতিক নদী অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্য অর্জিত হয়।)* ৪) The parties shall establish programmes for monitoring the conditions of transboundary waters. (পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবে)* 9-1. The riparian parties shall on the basis of equality and reciprocity enter into bilateral or multilateral agreements or other arrangements, where these do not yet exist, or adopt existing ones, where necessary to eliminate the contradictions with the basic principles of this convention, in order to define their mutual relations and conduct regarding the prevention, control and reduction of transboundary impact. The riparian parties shall specify the catchment area or parts thereof, subject to co-operation. These agreements or arrangements shall embrace relevant issues covered by this convention, as well as any other issues on which the riparian parties may deem it necessary to co-operate. (অভিন্ন নদীতীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো ন্যায্যতা ও পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যদি বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থা না থাকে, অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই কনভেনশনের সঙ্গে কোনো অসঙ্গতি থাকলে প্রয়োজন অনুসারে সেটি দূর করবে, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অথবা আচরণ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রগুলো যার যার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নদীখাতের এলাকা নির্দিষ্ট করবে। এই চুক্তি অথবা ব্যবস্থা এমনভাবে প্রণয়ন অথবা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং অন্যান্য ইস্যুতেও অভিন্ন নদীর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো তাদের মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতা করবে।)
কাজেই হেলসিংকি চুক্তির আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় যে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই বিতর্কিত, সংকীর্ণ ও একপাক্ষিক রায়ে আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা ও নদীজ পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিন্ন নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা এবং একে অপরের সঙ্গে অবশ্যকরণীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব আগামী বুধবার)
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : ‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত

মাহমুদুর রহমান
শেষ পর্ব
ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্তের দ্বিতীয় কিস্তি হেলসিঙ্কি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করে শেষ করেছিলাম। আজ একই বিষয়ে জাতিসংঘের আইনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আরম্ভ করছি। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ সংক্রান্ত বিরোধ মেটানো ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ যে কনভেনশন (UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses) তৈরি করেছে, হেলসিঙ্কি চুক্তির মতোই ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযোগের বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় তার সরাসরি লঙ্ঘন। জাতিসংঘ কনভেনশন নিম্নোক্ত পাঁচটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে :
1. Universal Participation (সর্বজনীন অংশগ্রহণ)
2. Cooperative Governance (সহযোগিতামূলক শাসন)
3. Equity (ন্যায্যতা)
4. Peaceful dispute resolution (শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি)
5. Communication and environmental protection (যোগাযোগ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ)
উপরিউক্ত নীতিমালার আলোকে যে কনভেনশন প্রণীত হয়েছে, তার ৭ এবং ১২ নম্বর ধারা ভারতের ন্যায়-নীতি বিবর্জিত সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র উপলব্ধির জন্য এখানে উদ্ধৃত করছি :
Article 7-1 : Watercourse states shall, in utilizing an international watercourse in their territories, take all appropriate measures to prevent the causing of significant harm to other watercourse states.
(আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারকারী রাষ্ট্রগুলো তাদের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকারে নিশ্চিত করবে যাতে অভিন্ন নদী তীরবর্তী অন্য রাষ্ট্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।)
Article 12 : Before a watercourse state implements or permits the implementation of planned measures which may have a significant adverse effect upon other watercourse states, it shall provide those states with timely notification thereof. Such notification shall be accompanied by available technical data and information, including the results of any environmental impact assessment, in order to enable the notified states to evaluate the possible effects of the planned measures.
(আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারকারী রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন অথবা বাস্তবায়নের অনুমতি প্রদানের আগে সেসব রাষ্ট্রকে আগাম সতর্কতা জানানো বাধ্যতামূলক। এই সতর্ক বার্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কারিগরি তথ্য-উপাত্ত এবং পরিবেশের ওপর প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়নপূর্বক প্রেরণ করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রকল্পের বিষয়ে তাদের নিজস্ব ক্ষয়-ক্ষতি মূল্যায়নে সক্ষম হয়)
ভারতের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাদিয়া আন্তর্জাতিক নদী সংযোগ প্রকল্পের নির্দেশনা দেয়ার সময় হয় এ বিষয়ে উল্লিখিত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাগুলো বিস্মৃত হয়েছিলেন অথবা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্বে তিনি ও তার দুই সহযোগী বিচারপতি বিশ্বাসই করেন না। তাদের এই রায় ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এবং এই দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য এখনই এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে থেকে আমাদের কোনো ফায়দা নেই। বিরোধী দলও আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল প্রণয়নে অতি মাত্রায় ব্যস্ত রয়েছে। তাদের কাছে পানি আগ্রাসনের বিষয়টি আপাতত অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশের জনগণকেই আপন অস্তিত্বের স্বার্থে এখনই জেগে উঠতে হবে।
ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রতিবাদের পরিবর্তে বর্তমান সরকার অভিন্ন নদীর বিষয়ে বিগত সোয়া তিন বছরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তার ফলে জীবন-জীবিকার ধ্বংসসাধনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারই ২০০০ সালের জানুয়ারিতে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির (JCE) কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রদান সত্ত্বেও মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় নতুন করে চুক্তির নামে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিস্তার পানির সঙ্গে ভারতের জন্য করিডোরকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাধায় তিস্তার পানি চুক্তি ভেস্তে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত পানি এবং করিডোরের পার্থক্য না বুঝে ঘোষণা করলেন, তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিটও দেয়া হবে না। যেন তিস্তা থেকে যত্সামান্য পানিপ্রাপ্তির বিনিময়ে আমরা দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে ভারতকে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোর দিয়ে দেব। সরকারের এই নতজানু অবস্থানের প্রতিবাদ করে ‘আমার দেশ’ পত্রিকাতেই ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমি লিখেছিলাম, তিস্তা আমাদের অধিকার, করিডোর ওদের আবদার। পরে দেখা গেল, তিস্তা নদীর পানির ব্যাপারে কোনো সুরাহা না হলেও শেখ হাসিনার মহাজোট সরকার জাতিকে অন্ধকারে রেখে ভারতকে করিডোর কিন্তু ঠিকই দিয়েছে। সে কারণেই গত বছর ১২ অক্টোবর আবারও লিখলাম, আবদার মিটেছে অধিকার মেলেনি।
ভারতের করিডোরের আবদার মেটাতে গিয়ে আমাদের তিতাস নদীর মাঝ বরাবর এপাড়-ওপাড় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে যেভাবে নদীটিকে হত্যা করা হয়েছে, তার দ্বিতীয় কোনো নজির সারা বিশ্বে কোথাও মিলবে না। এত বড় রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ কোনো দেশের সরকার করতে পারে, সেটি কল্পনাতে আনা সম্ভব না হলেও এ দেশে এরকমটিই ঘটেছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিতাস নদী তীরবর্তী মানুষদের নির্লিপ্ততা। তাদের চোখের সামনে নদী হত্যা চালানো হলেও এর প্রতিবাদে কোথাও কোনো বিক্ষোভ পর্যন্ত হয়নি। এর জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মেরুদণ্ডহীনতা এবং সীমাহীন লোভকেও দায়ী করতে হবে। তাদের লোভ দেখানো হয়েছে যে, আশুগঞ্জ-আখাউড়া রুটে করিডোর চালু হলে নানা রকম ব্যবসার সুযোগ পেয়ে তারা সব রাতারাতি সম্পদশালী হয়ে উঠবে। একটি দেশের জনগণের সম্পদের প্রতি এতখানি লোভ-লালসা থাকলে সেই জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা দুরূহ।
তিতাস নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে সরকার প্রথম থেকেই অসত্ ও রহস্যজনক আচরণ করেছে। এই ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশ সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রণয়ন ও একনেক (ECNEC) কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদন বাধ্যতামূলক হলেও তিতাসের বাঁধের ব্যাপারে এসব কিছুই মানা হয়নি। এমনকি প্রশাসনের কোনো অংশই এখন আর বাঁধ নির্মাণের কোনোরকম দায়দায়িত্ব নিতেও রাজি নয়। আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং নৌ-যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা সবাই এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে যেন রাতারাতি কোনো এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আসমান থেকে নেমে এসে তিতাস নদীর মাঝখানে বাঁধটি বানিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে! এলাকার লোকজন অবশ্য অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় কোনো এক কোম্পানি মাসাধিককাল ধরে এই বাঁধ তৈরি করেছে। এই তথ্য সঠিক হলে বলতে হবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আর অবশিষ্ট নেই। ক্ষমতাসীন মহল সবটুকু স্বাধীনতা বৃহত্ প্রতিবেশীর পদতলে নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করে বসে আছে। নদী হত্যার বিষয়ে কোথাও কোনো সুরাহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আমি বাদী হয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হলে সেখান থেকে অবশ্য সরকারের প্রতি রুল জারি করা হয়েছে। এদিকে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংসদে জোরগলায় দাবি করেছেন, তিতাস নদীর স্রোতধারা বন্ধ করে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তাতে নাকি পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি! পরিবেশ সম্পর্কে ডক্টর সাহেবের অগাধ জ্ঞান দেখে দেশবাসী চমত্কৃত হয়েছে। মন্ত্রীর জ্ঞাতার্থে বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য দু’টি আইনের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি। Bengal Canal Act 1864-এ বলা হয়েছে, “Any person who shall willfully cause ... any obstruction to any line of navigation or any damage to the banks or works of such line of navigation, or who shall willfully omit to remove such obstruction after being lawfully required to do so, shall be punished on conviction before a magistrate ...” (কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নৌপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অথবা নদীর পাড়ের কোনো ক্ষতিসাধন অথবা নৌপথের কোনো ক্ষতিসাধন করলে অথবা আইনত বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও সেই প্রতিবন্ধকতা অপসারণে ব্যর্থ হলে সেই ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হবে।)
দ্বিতীয় আইনটি আরও সাম্প্রতিক। Bengal Canal Act-এর আলোকেই নৌপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী ব্যক্তির সাজা কঠোরতর করে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে Wetland and Open Space Conservation Act, 2000। তিতাস নদীতে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে উপরে উল্লিখিত আইন ভঙ্গ করার অপরাধে বর্তমান নীতিনির্ধারকদের কবে সাজা হবে, সেই শুভক্ষণ দেখার আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক অপেক্ষা করে রয়েছেন।
ফেনী নদী নিয়ে আলোচনা করেই তিন পর্বে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনের সমাপ্তি টানব। ভারত ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের ন্যায্য অধিকারকে উপেক্ষা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিস্ময়করভাবে আমাদের নিজস্ব ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিয়েছে। ফেনী নদীর উত্পত্তি বাংলাদেশের মাটিরাঙার ভগবানটিলা হলেও ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদীটির উত্পত্তি ত্রিপুরা রাজ্যে বলে দাবি করে এসেছে। ভারতের কাছ থেকে নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কারণে বর্তমান সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিরসরাইয়ের আমলীঘাট সীমান্ত এলাকায় ভারত গত সেপ্টেম্বর থেকে নদীর পাড়ে ব্লক তৈরি করছে। এই সীমান্তে পাইপ বসিয়ে ভারতের উপেন্দ্রনগরের জন্য পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। রামগড়ের অদূরে ভারতের সাবরুম শহরের পানি সঙ্কট মেটাতে ১৭টি পাইপ বসিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অনবরত পানি প্রত্যাহার করছে।
এই আগ্রাসনের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকার সুযোগ নিয়ে সেখানে একটি পানি শোধনাগার প্রকল্প পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। তিতাস পাড়ের মানুষ যেমন নদী হত্যার সময় চোখ বন্ধ করে থেকেছে, তেমন করেই ফেনী অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও তাদের নদীর পানি রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের অধিকাংশ সংসদীয় এলাকায় ২০০৮-এর ডিজিটাল নির্বাচনে জনগণ বিএনপির পক্ষে রায় দিলেও সেসব সংসদ সদস্যও প্রতিবাদের পরিবর্তে বিস্ময়কর নীরবতা পালন করছেন। ভারতের পানি আগ্রাসন প্রতিরোধে তাদের এই ভীরু আচরণ ক্ষমার অযোগ্য।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি থেকে পানি আগ্রাসনের মাধ্যমে ভারত বিপুল ক্ষতিসাধন করে চলেছে। কিছুদিন আগে ফারাক্কা বাঁধজনিত ক্ষতি নিরূপণ বিষয়ক এক সেমিনারে দেশের প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তাতে ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সরাসরি অন্তত ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ক্ষতি হয়েছে। এর সঙ্গে পরিবেশের সার্বিক ক্ষতি যোগ করা হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হবে। গঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদী থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে এ দেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিলে টাকার অঙ্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি অনুমান করাও কঠিন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য পানি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার বিএম আব্বাস এ, টি তার ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের ইতিহাসের কথা লিখেছেন। সেই বই থেকেই ক্ষুদ্র একটি অংশ উদ্ধৃত করছি :
‘প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের বাধ্যকর কূটনীতি (Coercive Diplomacy) প্রতিবেশীর উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ নীতি ভারত বা সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। ভারতেও এ অঞ্চলের সব মানুষের মঙ্গলের জন্য নদীগুলোর শরিক দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানিসম্পদের সর্বাধিক ও বহুমুখী উন্নয়নের পক্ষে জোরালো সমর্থন রয়েছে। শুধু নদীর শুকনো মৌসুমের পানিবৃদ্ধিই দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হবে অববাহিকাভিত্তিক ও বহুমুখী এবং এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিবিদ্যুত্ উত্পাদন, সেচ, পানি নিষ্কাশন, খনিজ ও বন সম্পদ আহরণ ইত্যাদি। এ অঞ্চলের আশু প্রয়োজন তার দরিদ্র, অনাহারক্লিষ্ট ও গৃহহীন কোটি কোটি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি ও উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা। এ প্রচেষ্টায় কোনোরকম বিলম্ব করা আমাদের পক্ষে হবে কর্তব্যের গুরুতর অবহেলা।’
ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নদী সংযোগকরণ নির্দেশ প্রদানকারী রায় বাস্তবায়িত হতে দিলে বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপের অবলুপ্তি অনিবার্য হয়ে উঠবে। সেই আবহমান ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ তো গত চল্লিশ বছরে গেছেই, এবার এক সময়ের ‘সুফলার’ পরিবর্তে এই ভূখণ্ডটি ঊষর মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই আমাদের মাতৃভূমির এবং ষোল কোটি জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে যে কোনো মূল্যে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর এই অপতত্পরতা রুখতে হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিম্নোক্ত তিনটি পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করতে পারি :
১. পানি অগ্রাসনের জন্য ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি : আগেই উল্লেখ করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ এবং অন্যান্য অসংখ্য নদী থেকে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের কয়েক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এক পদ্মা সেতু প্রকল্পের ৩৫ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের জন্য আমাদের ভিক্ষাপাত্র হাতে অত্যন্ত অবমাননাকরভাবে আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। অথচ পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েই অন্তত এক ডজন এরকম সেতু নির্মাণ সম্ভব। জাতিসংঘের কনভেনশনেও উজানে আইনবিরুদ্ধভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে ভাটি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ কনভেনশনের ৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে,
“Where significant harm nevertheless is caused to another watercourse state, the states whose use causes such harm shall, in the absence of agreement to such use, take all appropriate measures, having due regard for the provisions of articles 5 and 6, in consultation with the affected state, to eliminate or mitigate such harm and, where appropriate, to discuss the question of compensation.” (যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে, সেখানে ক্ষতিসাধনকারী রাষ্ট্রগুলো কনভেনশনের ৫ এবং ৬ ধারার আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে পানি প্রত্যাহারজনিত কোনো চুক্তির অবর্তমানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ক্ষতির কারণ দূর করবে এবং যেখানে প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা করবে।) সুতরাং ১৯৯৭ সালের ২১ মে স্বাক্ষরিত UN Convention on the law of the non-navigational uses of International Watercourses-এর ৭(২) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে ভারতের পানি আগ্রাসনের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।
২. ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা : ৫৪টি অভিন্ন নদীর বিষয়ে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট গত ফেব্রুয়ারিতে যে রায় প্রদান করেছে, সেটি হেলসিঙ্কি চুক্তি এবং জাতিসংঘ কনভেনশনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী হওয়ায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে এখনই বাংলাদেশের অভিযোগ দায়ের করতে হবে।
৩. ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আন্দোলন : ভারতের সর্বাত্মক পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বিরোধী দল নির্বিশেষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের প্রতি নানা কারণে নতজানু হওয়ায় তাদের কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় কোনোরকম সহযোগিতা না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। সেক্ষেত্রে এই সরকারের বিরুদ্ধেও সমান্তরালভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে হয় তাদেরকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে হবে নতুবা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মহাজোটকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে এমন একটি দেশপ্রেমিক সরকারকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন করতে হবে যারা ব্যক্তিগত অথবা দলীয় স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেবে না।
শেষ কথা হলো, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। ভারতের ভয়ঙ্কর পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সুতরাং, আর কালক্ষেপণ না করে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী ও তার এদেশীয় তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে তিন কিস্তির মন্তব্য-প্রতিবেদন সমাপ্ত করছি।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : শেয়ারবাজারে তুঘলকি কারবার : প্রথম পর্ব


মাহমুদুর রহমান
শেখ হাসিনা তার দুই দফার শাসনামলে সাফল্যের সঙ্গে শেয়ারবাজারের লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করতে পেরেছেন। কিন্তু বিস্ময় ও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, জনগণের এত বড় ক্ষতিসাধন সত্ত্বেও তার কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনাবোধ জাগ্রত হয়েছে এর কোনো চিহ্ন এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো মূলধন হারিয়ে পথে বসে যাওয়া বিনিয়োগকারীদের দোষারোপ করে সরকারের হর্তাকর্তারা নসিহত করছেন যে, পুঁজিবাজারে লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ এটা জেনেই তাদের ওই বাজারে টাকা খাটাতে হবে। অথচ ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতা হাতে নিয়েই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত এসইসি’র (SEC) তত্কালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকলেও আবুল মাল আবদুল মুহিত পুঁজিবাজার চাঙ্গা করার বিষয়টিকে এতটা অগ্রাধিকার কেন দিয়েছিলেন? শেয়ারবাজারের চিহ্নিত খেলোয়াড়দের নানারকম কারসাজির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার দুই বছরের মধ্যে মূল্যসূচক ও লেনদেন বিপজ্জনক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হলে বিনিয়োগকারীদের আশু বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার পরিবর্তে একই অর্থমন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, ছিয়ানব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি কিছুতেই হতে দেয়া হবে না। ডিজিটাল সরকারের মিথ্যা আশ্বাসে আস্থা স্থাপন করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা চূড়ান্তভাবে ঠকেছেন। ১৯৯৬ সালে লুটপাটের পরিমাণ দশ হাজার কোটি টাকার পরিবর্তে এবার লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন করা হয়েছে।
আমি জেলে যাওয়ার দিনদুয়েক আগে মূল্যসূচক যখন ৬০০০-এর কাছাকাছি ছিল, তখনই মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে জনগণকে সাবধান করার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলাম। টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়েও অব্যাহতভাবে বলেছি, সূচক ও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির আয়তনের তুলনায় বাস্তবসম্মত নয়। আমার লেখা ও কথায় কারও সংবিত্ ফেরেনি। জেলে থাকতেই খবর পেয়েছি সূচক বাড়তে বাড়তে ৯০০০-এর চূড়া ছুঁয়েছে। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের সব সঞ্চয় নিয়ে মুগ্ধ পতঙ্গের মতো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে শেয়ারবাজারের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। কেবল সঞ্চয় ভেঙেই নয়, লোভের ফাঁদে পড়ে অনেকে সম্পত্তি বিক্রি করে এমনকি ধারদেনা করেও শেয়ারে বিনিয়োগের নামে জুয়া খেলায় মত্ত হয়েছে। জনগণের এই বেকুবি দেখে চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত শ্রেণী তাদের প্রাত্যহিক বিশেষ প্রকৃতির আমোদ-প্রমোদের আসরে দলবল নিয়ে মনের আনন্দে উল্লাস করেছে।
অর্থনীতির অবধারিত নিয়মে কৃত্রিম মূল্যসূচকের সেই অতিকায় বেলুন আমি জেলখানায় থাকতেই ফেটেছে। ২০১১ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমার মুক্তির আগেই শাসকশ্রেণীর শেয়ারবাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। দেশের সাধারণ জনগণের টাকা লুটে নেয়ার প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত ছিলেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। তারা কী পরিমাণ সম্পদশালী হয়েছেন, তার কোনো আন্দাজ আমাদের মতো নাগরিকের পক্ষে কল্পনাতে আনাও সম্ভব নয়। সংবাদমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে তাদের বিলাসবহুল জীবন-যাপনের নানারকম খবর কানে আসে। এগুলো অবশ্য এখন পর্যন্ত শোনা কথাই, কাজেই কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব না। ভবিষ্যতে কখনও কাগজপত্র হাতে পেলে আমার দেশ পত্রিকায় অবশ্যই নাম-ধামসহ তাদের কীর্তি-কাহিনী ছাপা হবে।
বাংলাদেশের বিত্তশালীদের বিদেশে বাড়ি-ঘর কেনার গল্প অনেক পুরনো হয়ে গেছে। এসব বাড়ি কেনার অর্থ হুন্ডিসহ অন্য যেসব পন্থায় তারা বিদেশে পাচার করেন, সে সম্পর্কেও পত্রপত্রিকায় অতীতে কিছু লেখালেখি হয়েছে। তবে এই সরকারের আমলে নতুন উপসর্গ জুটেছে। শেয়ারবাজার এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ইজ্জতের মাপকাঠি আগের মতো কেবল দেশ-বিদেশে প্রাসাদোপম অট্টালিকার মালিক হওয়াতে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এখন তারা নাকি কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ব্যক্তিগত জেটবিমান কিনছেন। তাদের এই বিমানগুলো এমন দেশে রাখা হয়, যেখানে ঢাকা থেকে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্যিক বিমানে চড়ে পৌঁছানো সম্ভব। সেখানে পৌঁছানোর পর ইউরোপ, আমেরিকায় তারা ব্যক্তিগত জেটেই সাধারণত উড়ে বেড়ান।
ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানি একবার তার স্ত্রীর জন্মদিনে বিশেষভাবে নির্মিত বোয়িং-৭৩৭ বিমান উপহার দিয়ে সেদেশের গণমাধ্যমে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। অথচ মুকেশ আম্বানির সেই ভারতেই পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যার এমন হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করে, যারা সপ্তাহে একদিন ভাত খেতে পেলে বর্তে যায়। বাকি ছ’দিন বন-জঙ্গল থেকে আহরিত শাক-পাতা খেয়েই এই হতভাগ্য দরিদ্র ভারতীয়রা জীবনধারণ করে থাকে। মহাশ্বেতা দেবী এবং অরুন্ধতী রায় আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের এই শোষিত শ্রেণীকে নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। একই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের এমন ভয়াবহ অসম বণ্টনের অবধারিত প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অন্ধ্র থেকে পশ্চিমবাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত কথিত ‘রেড করিডোরে’ (Red Corridor) বামধারার সশস্ত্র সংগ্রাম বিস্তার লাভ করেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল সরকারও তাদের তিন বছরের শাসনামলে বেশকিছু এ দেশি আম্বানি সৃষ্টি করে বিশেষ শ্রেণীর রাতারাতি উন্নয়নের ম্যাজিক দেখিয়েছে।
প্রকৃত আম্বানিরা তবু ভারতের শিল্পায়ন ও জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আমাদের নকল আম্বানিরা সাধারণ জনগণের টাকা লুটপাট করে নির্লজ্জ ফুটানিতে মত্ত হয়েছে। আমাদের দেশের বামধারার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারগুলোর পুঁজিবাদী অর্থনীতি অনুসরণকেই এ অবস্থার জন্য প্রধানত দোষারোপ করে থাকেন। কিন্তু জীবনের সুদীর্ঘকাল বেসরকারি খাতে মোটামুটি শীর্ষ পদগুলোতে চাকরি করার অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি, এদেশে প্রকৃত পুঁজিবাদের চর্চাও ঠিকমত হচ্ছে না। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, তাকে দেশ ও জনগণের সম্পদের নির্ভেজাল ডাকাতি ছাড়া অন্য কোনো নামে ডাকার সুযোগ নেই। পুঁজিবাদের নিয়ম-নীতি মেনে চললে দুর্বল জনগোষ্ঠীর শোষণ সত্ত্বেও কিছুটা অন্তত জাতীয় পুঁজি (National Capital) সঞ্চিত হয়। কিন্তু বিদেশে ব্যক্তিগত জেটবিমান, লন্ডনের হাইড পার্ক সংলগ্ন পার্ক লেন (Park Lane) অথবা ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসে (Beverley Hills) লুটেরাদের বাড়ি অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে কোনো হিসাবেই দেশের সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। বিদেশে সম্পত্তি ক্রয় এবং পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাহামা, কেইম্যান আইল্যান্ড (Cayman Island) ইত্যাদি রাষ্ট্রে দুর্নীতিলব্ধ বিপুল অর্থ সঞ্চয় করার জন্য বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির চিত্রও জনগণ এতদিনে দেখে ফেলেছেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে ডলারের ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি অধিক মাত্রায় অর্থ পাচারেরই (Money Laundering) অশুভ পরিণতি।
অবৈধ সঞ্চয় লুকিয়ে রাখার জন্য একসময় সুইজারল্যান্ড নিরাপদ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করলেও এখন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত আলোচনায় মিডিয়ায় বেশি করে আসতে শুরু করেছে। লোকমুখে শুনি, চৌকস বাংলাদেশী লুটেরারা নাকি সেসব স্বল্প পরিচিত দেশের সন্ধানও পেয়ে গেছেন। শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিপুল অংকের টাকাও বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিকের কাছে অপরিচিত এসব বিভিন্ন গন্তব্যে বর্তমান শাসক শ্রেণীর জ্ঞাতসারেই পৌঁছে যাওয়া বিচিত্র নয়। দিনবদলের সরকারের সম্ভবত এই মেয়াদের মতো শেয়ারবাজার লুণ্ঠন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ার পর গত প্রায় ছয় মাস ধরে দেশবাসী বাজার স্থিতিশীল করার নামে নানারকম নাটক দেখে চলেছে। সেসব বিষয় নিয়ে আগে একাধিক মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছি। সেই লেখাগুলো থেকে কোনোরকম পুনরাবৃত্তি না করে এবারের দুই পর্বের মন্তব্য প্রতিবেদনে কেবল তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করব।
বহুল আলোচিত কালোটাকা দিয়েই শুরু করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারই আন্দোলনের ফসল মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের হলেও এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ সততার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও বক্তব্য-বিবৃতিতে তিনি সর্বদা নিজেকে, তার পরিবার ও দলকে ধোয়া তুলসিপাতা রূপেই প্রচার করে থাকেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দকে অবশ্য তিনি সরাসরি চোর ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করেন না। ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে ‘দিনবদলের সনদ’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহারটি আওয়ামী লীগ মহা সাড়ম্বরে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছিল, সেখানেও দুদককে প্রকৃত স্বাধীনতা প্রদান ছাড়াও দুর্নীতি দমনের বিষয়ে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতি ছিল। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করলে কোনো সংস্থা থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না—স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এমন ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতিকে প্রকারান্তরে উত্সাহিত করেছেন। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সব সরকারের আমলেই বৈধতা পেয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত ঘোষণা এতদিন সচরাচর এনবিআর থেকেই দেয়া হতো। এবার প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এমন কথা বলায় স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সকল স্তরে বেশ খানিকটা সমালোচনারও সৃষ্টি হয়।
এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় ডিজিটাল সরকারের তুঘলকি আচরণ। বিশেষত গত সপ্তাহে মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তন নীতিনির্ধারকদের অপ্রকৃতস্থতার প্রমাণ দেয়। ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠকে ১৯৭৯ সালের একটি নীতিমালার প্রসঙ্গ টেনে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ১৭ তারিখ পড়ন্ত বাজার দ্রুততর গতিতে ডুবতে শুরু করলে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়ে সরকার সেদিনের মতো ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। ১৮ তারিখ বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনে এসইসি চেয়ারম্যান দাবি করেন যে, পূর্বসন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর স্বয়ং প্রেস সচিবের ব্রিফিংয়ে ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার খবর সঠিক নয়। মন্ত্রিসভা ওই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাকি গ্রহণ করেনি। এসইসি চেয়ারম্যানের এই আশ্বাসবাণীতে কোনো কাজ হয়নি, সারাদিনে সূচকের ১৬৭ পয়েন্ট পতন ঘটে। বিক্ষোভকারীরা ডিএসই’র সামনের রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রতিপালনকল্পে পরিপত্র জারি করে জানিয়ে দেয় যে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শেয়ারবাজারে লেনদেন করতে পারবেন না। সচিবালয় থেকে আকস্মিক পরিপত্র জারিতে মতিঝিলে বিক্ষোভের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে দুপুরে জারি করা পরিপত্র সন্ধ্যায় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। উন্মাদেরও বোধহয় অসুস্থতার একটা লেভেল থাকে। ১৮ তারিখে সারাদিন ধরে সরকারের যেসব নীতিনির্ধারক এই প্রকৃতির বিকৃত মস্তিষ্ক আচরণ করেছেন, তাদের জনস্বার্থে অনতিবিলম্বে পাবনার মানসিক হাসপাতালে ভয়ানক উন্মাদদের সঙ্গে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আটক রাখা আবশ্যক। নইলে দেশের আরও ব্যাপক সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।
পরিপত্র নাটক অন্তে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে বিস্ময়করভাবে মূল্যসূচক একদিনে ২৫০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ পূর্ববত্ আইনসিদ্ধ রাখাতেই যদি এই বৃদ্ধি হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখনও সাবালকত্ব অর্জন করতে পারেননি। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের সর্বোচ্চ প্রায় ৯০০০ সূচকের বর্তমানে অর্ধেকে নেমে আসার সময়কালে এসব সরকারি কর্মকর্তা পুঁজিবাজারে তাদের টাকা পূর্ববত্ কোনো বাধা-বিঘ্ন ছাড়াই খাটিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সূচকের ধস থামানো যায়নি। বাস্তবতা হলো, সূচকের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং শেয়ারের অবিশ্বাস্য দরপতন উভয় ক্ষেত্রেই বাজার কারসাজি (Market manipulation) ক্রিয়াশীল থেকেছে। এই কারসাজির মাধ্যমেই চিহ্নিত লুটেরারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং গত বৃহস্পতিবার একদিনে বাজারমূল্যের গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধির মধ্যে আমি অন্তত অর্থনৈতিক কার্যকারণের পরিবর্তে আবারও কারসাজির গন্ধ পাচ্ছি। এরপরও সংবিত্ না ফিরলে বিনিয়োগকারীদের কপালে আরও দুঃখ বাকি আছে। আমার সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হতে তিনদিনের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। বর্তমান সপ্তাহের প্রথম দু’দিনেই সূচক ৩০০ পয়েন্টেরও অধিক নেমে গেছে। সর্বশেষ বাজার কারসাজির প্রতিবাদে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদ মঙ্গলবার মতিঝিল এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকলে সরকার গণহারে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার শুরু করে। রিমান্ডে পিটুনির ভয়ে বিনিয়োগকারীরা শেষপর্যন্ত হরতাল প্রত্যাহার করে নেয়। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা যাক শেয়ারবাজার নিয়ে কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। আমি দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা করছি যে, শেষপর্যন্ত সূচক চার হাজারেরও নিচে নেমে আসবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমার আশঙ্কা সত্যে পরিণত না হলেই আমি আনন্দিত হবো।
এদিকে কালোটাকার সংজ্ঞা নিয়েও এনবিআর বিপুল সংশয় তৈরি করে বসে আছে। তাদের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ বৈধ করা হলেও সেখানে নিম্নোক্ত দুটি ডেমোক্লিসের তরবারি বিনিয়োগকারীদের মাথার ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে :
১. ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হলে রাজস্ব বোর্ড টাকার উত্স নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না—বলার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে যে, অন্য কোনো সংস্থা থেকে সেই টাকার খোঁজ-খবর নেয়ার নামে হয়রানি করা হলে তার দায়িত্ব এনবিআর নেবে না। অর্থাত্ আওয়ামী লীগের লোকজন অবৈধ অর্থ শেয়ারবাজারে খাটালে অন্য সংস্থা যেমন—দুদক, এনএসআই, ডিজিএফআই অন্তত এই সরকারের শাসনামলে চোখ বন্ধ করেই রাখবে। কিন্তু ভিন্নমতাবলম্বীরা একই কর্ম করিলে তাহাদের খবর আছে। নখদন্তহীন দুদক সেক্ষেত্রে হিংস্র মানুষখেকো ব্যাঘ্রে পরিণত হবে। আইনের শাসনের কী চমত্কার নমুনা!
২. উপরোক্ত শর্তে কালোটাকা বিনিয়োগ করা যাবে; কিন্তু এই টাকা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে অর্জিত হলে এনবিআর তাদের ছাড় দেবে না। সাদা চোখে দেখলে আইনটি ভালো। সত্যিই তো, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি থেকে অর্জিত টাকাকে বৈধ করার সুযোগ কেন দেয়া হবে? কিন্তু সমস্যা হলো, টাকার গায়ে তো আর উত্স লেখা থাকবে না। সুতরাং, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এখানেও আইনের প্রয়োগ লোক বুঝেই করা হবে। কালোটাকার মালিক কালো কোটধারী মুজিববাদী হলে কোনোই সমস্যা নেই, গায়ে বিএনপি কিংবা জামায়াতের গন্ধ থাকলে এনবিআর ও দুদকের ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগটি সুকৌশলে রেখে দেয়া হলো। একেই বলে আওয়ামী লীগের বুদ্ধি।
অধিকাংশ পাঠকই জানেন, আমি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে ছিলাম। তত্কালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে আমি প্রায়ই বলতাম, প্রশাসনে দুর্নীতি কমাতে হলে মন্ত্রী, সচিবদের স্বেচ্ছানুসারে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা (discretionary power) হ্রাস করা আবশ্যক। আর এই লক্ষ্য সাধন করতে হলে যথাসম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে বিধি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে। আইনের ভাষার মারপ্যাঁচ কমানো গেলেই রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্রের যোগসাজশের (nexus) মাধ্যমে জনগণের অর্থ লুটপাটের সুযোগ সংকুচিত করা সম্ভব। সরকারি দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে সুশাসন বিষয়ক এই দর্শনের প্রতি আমার আগের আস্থা আরও দৃঢ় হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকার সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাই করছে মূলত discretionary power-এর ওপর ভর করে। বিনা টেন্ডারে কার্যাদেশ দেয়ার বিধান করে বিদ্যুত্, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে অগাধ লুটপাটের যে মহোত্সব ক্ষমতাসীনরা চালাচ্ছেন, তার পেছনেও রয়েছে ওই discretionary power। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ সংক্রান্ত যে নতুন বিধিমালাটি রাজস্ব বোর্ড প্রণয়ন করেছে, তারও ছত্রে ছত্রে discretionary power প্রয়োগের সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে। যেসব রথী-মহারথী আগে সুশাসন নিয়ে প্রায় প্রতিদিন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বেড়াতেন, তাদের অধিকাংশই চিন্তা-চেতনায় কট্টর মুজিববাদী হওয়ায় হাওয়া বুঝে প্রকাশ্য দুর্নীতি দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদেরও বাংলাদেশ সংক্রান্ত নীতির দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের বায়বীয় ইসলামী সন্ত্রাস দমনের বিনিময়ে দুর্নীতিপরায়ণ সেক্যুলার শাসকশ্রেণীকে সুশাসনের বিষয়ে ছাড় দিতে তাদের এখন তেমন একটা আপত্তি নেই। পশ্চিমাদের সর্বত্র ইসলামী নবজাগরণের ভীতিটিকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে সুশাসনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানকেও ‘ধর্মান্ধ’ বিশেষণে ভূষিত করা হচ্ছে। যেন সেনাবাহিনীর সেক্যুলার অংশ অভ্যুত্থান করলে কোনো সমস্যা নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের যে সাম্প্রতিক সমস্যা চলছে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, তার পেছনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগের চাইতেও বেশি কাজ করেছে ড. ইউনূস ইস্যু। ব্যক্তিগত জিদ মেটাতে গিয়ে শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের খানিকটা সাময়িক বিরাগের কারণ হয়েছেন।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
দ্বিতীয় পর্ব আগামী বুধবার


মন্তব্য প্রতিবেদন : শেয়ারবাজারে তুঘলকি কারবার : দ্বিতীয় পর্ব

মাহমুদুর রহমান
শেয়ারবাজার পরিস্থিতি বিষয়ক মন্তব্য প্রতিবেদনের শেষ পর্ব বড় বিষণ্ন মন নিয়েই লিখতে বসেছি। গত সোমবার এক তরুণ বিনিয়োগকারী তার ৭০ লাখ টাকার পুঁজি হারানোর মনোবেদনা সইতে না পেরে অসহায় স্ত্রী এবং চার বছরের একমাত্র আদরের শিশু কন্যাটিকে কঠিন জীবন সংগ্রামে এই সংসার সমুদ্রে নিঃসঙ্গ ফেলে রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেই ট্রাজেডির সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আওয়ামী লীগ প্রতিবার ক্ষমতায় আসবে আর দেশের লাখ লাখ মানুষকে শেয়ারবাজার ব্যবসায় নানারূপে প্রলুব্ধ করে তাদের সর্বস্বান্ত করে যাবে এমন পরিস্থিতি মেনে নেয়া যায় না। এই লুটেরা শাসকশ্রেণীর প্রতি হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণা একত্রিত করে ধিক্কার জানাচ্ছি।
শেয়ারবাজার কারসাজির বিষয়ে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে ওই বাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ সুবিধা এবং এদেশের ধনিক শ্রেণীর কুিসত বিলাস-ব্যসন নিয়েই লিখেছিলাম। আজ সরকার এবং সরকার সমর্থকদের দুই দফায় শেয়ারবাজারে তারল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ তহবিলের নিষম্ফলা ঘোষণা এবং ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেই দুই পর্বের মন্তব্য প্রতিবেদন সমাপ্ত করব।
গত ছয় মাস ধরে কৃত্রিম মূল্যসূচক অন্তত ৬০০০-এর কোটায় ধরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সরকার প্রধানত কালো টাকা বিনিয়োগের সুবিধা এবং বাজারে তারল্য বৃদ্ধি করার বারংবার ঘোষণা দিয়ে একই কুমিরছানা বার বার দেখানোর ব্যর্থ কৌশল নিয়েছিল। প্রথমে ২০১১ সালের মার্চে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। তখন বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক (সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা), জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) যৌথ উদ্যোগে এই তহবিল গঠিত হবে। দেশের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় মেয়াদহীন (Open end) মিউচ্যুয়াল ফান্ড ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ সূচক ১০৮ পয়েন্ট বেড়ে ৫৫৩৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আশার বেলুনে হাওয়া দেয়ার জন্য আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নতুন এই তহবিল গঠনের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার হবে এবং বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। সেই বহুল আলোচিত ফান্ডের বর্তমান অবস্থা সার্বিক শেয়ারবাজারের মতোই করুণ। অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে ইউনিট বিক্রি শুরু হলেও আমার পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এ পর্যন্ত মাত্র ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা গেছে।
বাংলাদেশ ফান্ড এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে অপর একটি মেয়াদহীন (Open end) ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিতে রীতিমত বাধ্য করা হয়। অক্টোবর ২২, ২০১১ তারিখে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএবি ৫ হাজার কোটি টাকার মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের ঘোষণা দিলেও ফান্ডে কোনো অর্থ জমা হওয়া তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত এ ফান্ডের আনুষ্ঠানিক আবেদন পর্যন্ত এসইসিতে জমা দেয়া হয়নি। কেবল সরকারপ্রধানকে খুশি করার জন্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে পুনরায় প্রতারণায় অংশ নিয়েছেন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) নামক সংগঠনের নেতারা। গত বছর নভেম্বর থেকে বিনিয়োগ শুরু করার কথা থাকলেও বিএবি’র নেতারা এখন পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলছেন। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফান্ড গঠনের ঘোষণা দিয়ে সেদিন বিএবি’র চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার জানিয়েছিলেন, প্রাথমিকভাবে তহবিলের আকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত এর আকার আরও বাড়বে। তার কথা শুনে তখন মনে হয়েছিল, টাকা ছাপানোর দায়িত্ব এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তে বোধহয় দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। যেন তারা ইচ্ছামত টাকা ছাপাবেন এবং শেয়ারবাজারে অকাতরে ঢালতে থাকবেন।
বিএবি চেয়ারম্যান ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দ্বিগুণ আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলেন, আমানতের ১০ শতাংশের আইনি সীমা মেনে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। তিনি আরও দাবি করেন, এরই মধ্যে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ শুরু করেছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারের এসব বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই সেদিনও পুঁজিবাজারে পূর্ববত্ প্রভাব পড়েছিল। দিনের প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই মূল্যসূচক ২৯৫ পয়েন্ট বেড়ে গিয়েছিল। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ধারা অবশ্য সারাদিন অব্যাহত না থাকলেও দিনশেষে সূচক ১০৯ পয়েন্ট বেড়ে ৫৬৫৪-তে দাঁড়িয়েছিল। সূচকের সঙ্গে তাল রেখে লেনদেনের গতিও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেদিন ঢাকার পুঁজিবাজারে ৬১৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। বিএবি’র মুজিববাদী নেতৃবৃন্দও যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পথে বসাতে পুঁজিবাজারের চিহ্নিত সব মার্কেট ম্যানিপুলেটরদের মতোই আচরণ করেছেন, সেটি বিগত তিন মাসে প্রমাণিত হয়েছে। ‘স্টক মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ নামক সোনার হরিণ আজ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। বিএবি চেয়ারম্যান গত নভেম্বরে যখন শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটি টাকার গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছিলেন, তখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হিসেবে তিনি বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না—এমন কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন। অর্থাত্ জেনে-শুনেই বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। ফান্ড গঠনের কাগুজে ঘোষণা দেয়ায় বিএবি আজ জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত। ফান্ডের আলোচনা সমাপ্ত করে এবার বাজার তারল্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি, বিএবি নেতৃবৃন্দের বায়বীয় ফান্ড গঠনের ঘোষণার সময় দেশের বিপুলসংখ্যক বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। গত শুক্রবার রাতে চ্যানেল আই’র ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে সাবেক সচিব মো. আসাফ্উদ্দৌলাহ এসেছিলেন। বিদ্যমান তারল্য সঙ্কট নিয়ে আলোচনাকালে তিনি তার এক বন্ধুর ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা উত্তোলন নিয়ে হয়রানির গল্প শোনালেন। সেই ভদ্রলোককে তারই সঞ্চয়ী হিসাব থেকে নিজের টাকা পেতে পাক্কা আড়াই ঘণ্টা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অবশ্য ভদ্রলোককে চা-কফি খাইয়ে যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। সঙ্গত কারণেই সে রাতের আলোচক ব্যাংকের নামটি উল্লেখ করেননি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর শাশুড়ি জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকে মাত্র চার লাখ টাকা উত্তোলন করতে গেলে তাকে একদিনে পুরো টাকা দেয়া যায়নি।
গত শনিবার ইংরেজি দৈনিক দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ ছিল, “18 banks face acute liquidity crisis, some banks are desperate in getting cash, driving call money rate high”। সংবাদটির প্রথম প্যারাটি উদ্ধৃত করলেই পাঠক সঙ্কটের ভয়াবহতা সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। দি ইনডিপেন্ডেন্ট বলছে, “Two state owned, 14 private and two foreign banks are in such an acute liquidity crisis that they are driven to borrow from the call money market almost every working day to meet their clients demand for cash.” (দুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, ১৪টি বেসরকারি এবং দুটি বিদেশি ব্যাংক এতটাই তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে যে, গ্রাহকদের নগদ চাহিদা মেটাতে প্রায় প্রতিদিন তারা মুদ্রাবাজার থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হচ্ছে।)
শুধু তা-ই নয়, একই সংবাদে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতবহির্ভূত অন্য আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও বিপজ্জনক। দি ইনডিপেন্ডেন্ট সরকার সমর্থক পত্রিকা হিসেবেই সাংবাদিক ও পাঠকমহলে সবিশেষ পরিচিত। এই পত্রিকার মালিক সালমান রহমান কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পারিবারিকভাবে অতি ঘনিষ্ঠ বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টাই নন, তিনি এদেশের শেয়ারবাজারেরও অন্যতম নিয়ন্ত্রক। এবারের শেয়ারবাজার কারসাজির জন্য প্রধানত সালমান রহমান, লোটাস কামাল এবং ফারুক খান গংকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই মহাবিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেও উন্মাদ সরকার জনগণের অর্থ আরেকদফা লুটপাটের উদ্দেশ্যে বেসরকারি খাতে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষমতাসীন মহলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লুটেরারা নাকি মৌখিক আশ্বাসের ভিত্তিতে লাইসেন্স প্রদানের আগেই বিলাসবহুল সব অফিসও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। বিপর্যয়কর সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইতিহাসের পাতায় বিখ্যাত একসময়ের ভারতসম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে বর্তমান সরকারের অপ্রকৃতিস্থ নীতিনির্ধারকদের তুলনা করলে সেই ভারতসম্রাটকে বোধহয় অপমানই করা হবে।
দেশি-বিদেশি এবং সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বাংলাদেশের ৪৭টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ১৮টি অর্থাত্ ৩৮ শতাংশ ব্যাংকই তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। ফলে এফডিআর এবং কলমানি উভয় ক্ষেত্রেই সুদের হার বিগত তিন বছরে অনেক বেড়ে গেছে। নতুন আমানত সংগ্রহের জন্য দেউলিয়াত্বের প্রান্তসীমায় উপস্থিত ব্যাংকের আমানত সংগ্রহকারী কর্মকর্তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দোরে দোরে ঘুরছেন। ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য ১৪ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করা হচ্ছে। অর্থনীতির এই অবস্থায় কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যাদেরই কোনো সঞ্চয় রয়েছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই কারসাজির পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারানোর ঝুঁকি নেয়ার পরিবর্তে উচ্চ সুদের নিরাপদ এফডিআরের দিকেই ঝুঁকছেন। এদিকে এসইসিও বিনিয়োগকারীদের প্রতি সতর্ক বার্তা প্রকাশের মাধ্যমে শেয়ারবাজার যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেই ঘোষণাও আনুষ্ঠানিকভাবেই দিয়েছে। বাজার সূচক যখন কারসাজির মাধ্যমে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠানো হয়েছিল, তখন কিন্তু এসইসি’র জনগণকে সতর্ক করার কথা স্মরণে আসেনি। লুটপাট সাঙ্গ হওয়ার পর তারা এখন ‘সাধু’ সাজার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন।
বাস্তবতা হলো, তারল্য সঙ্কটে জর্জরিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে বিনিয়োগের কোনো সামর্থ্যই নেই। এদিকে ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীদের একাংশ মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগের দিকেও ঝুঁকে পড়ছেন। আস্থার অভাব, সার্বিক তারল্য সঙ্কট এবং সামর্থ্যবান জনগণের এফডিআর ও বিদেশি মুদ্রায় বিনিয়োগের প্রবণতার মিলিত প্রভাবে পুঁজিবাজারে লেনদেন প্রত্যাশিতভাবেই ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে চলেছে। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস অর্থাত্ বৃহস্পতিবারে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা জানুয়ারির সর্বনিম্ন লেনদেন। মাঝে-মধ্যে কৃত্রিম ঘোষণা দিয়ে লেনদেনের পরিমাণ বাড়ানোর চেষ্টা গত ছয় মাসের অধিককাল ধরে চালানো হলেও অবস্থার বিশেষ একটা হেরফের হচ্ছে না। গত বছর নভেম্বরের ৩ তারিখে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল মাত্র ১৮১ কোটি টাকা। সুতরাং কালো টাকা বিনিয়োগের পুরনো সুযোগের নতুন করে ঘোষণা এবং একাধিক ফান্ড গঠনের বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও পুঁজিবাজারে লেনদেন বাড়ানো যায়নি। পাঠককে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, বাজার কারসাজির মাধ্যমে ২০০৯-১০ সালে কৃত্রিমভাবে সূচকের রকেট গতিতে বৃদ্ধির সময় শেয়ারবাজারে দৈনিক লেনদেন অবিশ্বাস্য ৩ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল।
তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে নানারকম উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে জনগণকে ধাপ্পা দেয়ার পর সরকার শেষমেশ স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার কথিত বিনিয়োগ প্রস্তাব, প্রাইভেট পাবলিক পার্টিসিপেশন (পিপিপি)-এর মাধ্যমে বিশাল সব প্রকল্পের অর্থ জোগান, ইত্যাকার আজগুবি গল্প শোনানোর পর হতাশ ও মরিয়া প্রধানমন্ত্রী এখন বিশ্বব্যাংককে রীতিমত ধমকের সুরে বলছেন, দুর্নীতি প্রমাণ করতে না পারলে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে কোনো সহায়তাই নেব না। যেন বিশ্বব্যাংক টাকার থলি নিয়ে জোড়হস্তে আমাদের মহাপ্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমত সাধাসাধি করছে! ‘বাণীর রাজা’ খেতাবপ্রাপ্ত নতুন যোগাযোগমন্ত্রী জাতিকে শুনিয়েছেন, টাকা কোত্থেকে আসবে জিজ্ঞেস করবেন না, তবে পদ্মা সেতুর কাজ দেড় বছর পর অন্তত শুরু হবেই। ওবায়দুল কাদেরের ‘আশাবাদ’ বাস্তবে রূপ নিলেও মহাজোট সরকারের বর্তমান মেয়াদের তখন আর মাত্র তিন-চার মাস বাকি থাকবে। দেশের জনগণ আশা করি, এখনও ভুলে যাননি যে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে ভিন্ন দফতরে বদলিকৃত প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েই দাবি করেছিলেন, এই সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নির্মাণ কেবল শুরুই হবে না, সেটি সম্পন্নও হবে। খানিকটা প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে পদ্মা সেতুর বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রেক্ষিতে উল্লেখ করলাম।
গত জুনে ২০১১-১২ অর্থবছরের অবাস্তবায়নযোগ্য অতিকায় বাজেট উত্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কমপক্ষে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার কথা জোরগলায় বলেছিলেন। আমাদের মতো যত্সামান্য লেখাপড়া করা ব্যক্তিরা তো বটেই, এমনকি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি’র মতো আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই লক্ষ্যমাত্রাকে তখনই অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। আমাদের অর্থমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভাষায় সন্দেহপোষণকারীদের রাবিশ, স্টুপিড ইত্যাকার বিশেষণে ভূষিত করে প্রাণভরে গালাগাল করেছিলেন। অর্থবছরের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি থাকতে এবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই স্বীকার করা হয়েছে যে, বর্তমান অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কোনোক্রমেই ৬.৫ শতাংশের বেশি হবে না। ডিজিটাল সরকার শেয়ার কারসাজির মতো পরিসংখ্যান কারসাজিতেও সিদ্ধহস্ত বলে জনমনে বিশ্বাস রয়েছে। প্রবৃদ্ধিসহ নানারকম উন্নয়ন সূচকের যেসব দাবি তারা সচরাচর করেন, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও দেশ-বিদেশে যথেষ্ট সন্দেহও আছে। তারপরও এ বছর অন্তত প্রবৃদ্ধিকে ৭ শতাংশে টেনে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না।
যা-ই হোক, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সর্বশেষ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় জিডিপি ও বিনিয়োগ হ্রাসের সঙ্গে শেয়ারবাজারে তারল্য প্রবাহও নিশ্চিতভাবেই কমবে। শেয়ারবাজারে গত ক’দিনের ধসের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে নতুন মুদ্রানীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির এই বিপর্যস্ত অবস্থার সব দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, অর্থ-উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরসহ বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদেরই নিতে হবে। সরকারের দুই-একটি একেবারে দালাল শ্রেণীর পত্রিকা ছাড়া দেশের সব পত্র-পত্রিকায় ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণের সংবাদ ও অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন লেখা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের ঘুম ভাঙেনি। তারা তখন বিশাল সব প্রকল্প থেকে বিদেশি মুদ্রায় বিপুল অংকের কমিশন গ্রহণের সুখ-স্বপ্নে বিভোর থেকেছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণপ্রবাহে আচমকা ভাটা পড়ায় সেই সুখ-স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। মহানগরীতে মনোরেলের আর খবর নেই, পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের নামে বিমানবন্দর নির্মাণের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, পদ্মা সেতু শূন্যে ভাসমান। এ অবস্থায় বাগাড়ম্বর ছাড়া ক্ষমতাসীনদের করার আর আছেটা কী?
চারদলীয় জোট সরকারের একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিডিয়ায় দুর্নীতির প্রবল প্রচারণা সত্ত্বেও ২০০৬ সালে সেই সরকার একটি স্থিতিশীল এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির জাতীয় অর্থনীতি রেখে দায়িত্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল। অর্থনীতির সব পর্যায়ে একপ্রকার শৃঙ্খলাও প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল। তত্কালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান টেন্ডারবিহীন প্রকল্পের ছদ্মাবরণে আজকের মতো সর্বব্যাপী দুর্নীতির দরজা খুলে দিতে কোনো অবস্থাতেই যে সম্মত হতেন না, সে ব্যাপারে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি শতভাগ নিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক সময়ই সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ উঠেছে। সেই তুলনায় শেখ হাসিনা হয়তো অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্তের নামে তিন বছরের শাসনামলে অর্থনীতিসহ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রায় সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব হঠকারী কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন, তার পরিণতিতে বাংলাদেশ প্রকৃতই আজ একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের গতি সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে; কিন্তু বোধবুদ্ধিহীন হঠকারিতা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা জনগণের সম্পদ লুটপাট অন্তে যদি বাকি জীবন বিলাস-বৈভবে বিদেশের মাটিতে কাটাতে চান, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীনদের বাধ্য করা সম্ভব হলে বর্তমান সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই বহু রথী-মহারথীকে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে আর খুঁজে না পাওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি।
চারদিক থেকে গুজব শুনছি যে, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নাকি এরই মধ্যে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে অফুরন্ত টাকা-পয়সাসহ বিদেশে পাঠাতে শুরু করেছেন। সময়-সুযোগমত তারাও দেশ ছাড়বেন। আমাদের মতো সাধারণ ব্যক্তিরা যেভাবে এক-এগারো পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ সমর্থিত মহাশক্তিধর সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সরাসরি সমালোচনা দেশে থেকেই অব্যাহতভাবে করে গেছি, তারা আগামীতেও ইনশাআল্লাহ, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে একই ভূমিকা নির্ভয়ে পালন করব। সে কারণেই আমাদের মধ্যে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারভীতি কাজ করে না। যারা তিন বছরে শেয়ারবাজার এবং সরকারের অন্যত্র অপকর্মের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়েছেন, তারাই যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামটি শুনলেই কারাগারে ফিরে যাওয়ার ভয়ে লুটেরা শাসকদের হৃদকম্প শুরু হয়ে যায়। মোদ্দা কথা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেখান থেকেই ক্ষতিগ্রস্তদের যথাসম্ভব পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আন্তরিকভাবে দুর্নীতিবিরোধী একটি গণমুখী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণের আর কোনো সুযোগ নেই। সেই সময় অবধি লিয়াকত আলীর মতো আর কোনো যুবককে যেন আত্মহননের পথ বেছে নিতে না হয় মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সেই প্রার্থনা করেই এই লেখার সমাপ্তি টানছি।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : আইএসআই নাটকের কলাকুশলী ও বাংলাদেশের রাজনীতি



মাহমুদুর রহমান
গত তিন সপ্তাহ ভারতের পানি আগ্রাসন নিয়ে লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার কারণে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি নিয়ে লিখতে বেশ বিলম্ব হয়ে গেল। গণবিচ্ছিন্ন সরকারের বিপদ উদ্ধারের মহত্ দায়িত্ব মাথায় নিয়ে আমাদের মহান স্বাধীনতার মাস মার্চের জন্য যুত্সই এক হাওয়াই গল্প রচনা করে বাজারে ছেড়েছে সুশীল (?) দৈনিক প্রথম আলো। দুবাইয়ের ইংরেজি দৈনিক খালিজ টাইমসের মার্চের ৩ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদের সূত্র ধরে ৪ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকা তাদের প্রথম পাতায় তথ্য-প্রমাণ ব্যতিরেকে একটি সিঙ্গেল কলাম খবর ছাপায়। সেই সংবাদে ১৯৯১ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনী ফান্ডে পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সংবাদটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য সংস্থাটির সাবেক প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানীর পাকিস্তানের আদালতে প্রদত্ত এক জবানবন্দির সঙ্গে বিএনপিকে রুপি দেয়ার অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আইএসআই’র ভূমিকাকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত মামলায় জেনারেল আসাদ দুররানী সম্প্রতি সেখানকার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
আর যায় কোথায়! অগ্রপশ্চাত্, সত্য-মিথ্যা বিবেচনা না করেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি বধের লক্ষ্যে দিল্লিতে বিশেষভাবে তৈরি অস্ত্রটি নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রথম আলোর সংবাদের দিল্লি কানেকশনের বিষয়টি খানিক পরে খোলাসা করছি। এদিকে মিথ্যা গল্পের বেলুন কয়েকদিনের মধ্যে ফুটো হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ভোঁতা অস্ত্র দিয়েই তার স্বভাব অনুযায়ী যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। আজকের লেখার শুরুতে খালিজ টাইমস পত্রিকায় প্রকৃতপক্ষে কী ছাপা হয়েছিল, সেটি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে নেয়া যাক।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, দুবাইভিত্তিক পত্রিকাটির মালিক বিতর্কিত গালাদারি ভ্রাতৃকুল (Galadari Brothers)। এদের সঙ্গে সত্তরের দশকে তত্কালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর গভীর বন্ধুত্বের গল্প বহুল প্রচারিত ছিল। শোনা যায়, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী ভারতে গালাদারি ব্রাদার্সের সোনা চোরাচালানে সহায়তা করতেন। মহারাষ্ট্রের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী আব্দুর রহমান আনতুলে নাকি এসব ব্যবসার সহযোগী ছিলেন। যতদূর স্মরণে আছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলে ভারত সরকার বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ এনে গালাদারি ভাইদের ভারতে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল। ইন্টারনেট ঘাঁটলে পাঠকরা এ সংক্রান্ত অনেক তথ্যই পাবেন। খালিজ টাইমস’র চিফ রিপোর্টার এলেন জ্যাকব (Allen Jacob) সম্ভবত একজন ভারতীয় নাগরিক। ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী তিনি মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজে লেখাপড়া করেছেন। খালিজ টাইমস’র প্রধান সম্পাদক (Editor-in-Chief) এবং উপদেষ্টা সম্পাদকদ্বয় (Editorial Advisor) যথাক্রমে রাহুল শর্মা (Rahul Sharma) ও বিক্রম বোহরা (Vikram Bohra)। অর্থাত্ মধ্যপ্রাচ্যের এই পত্রিকাটির সঙ্গে রহস্যময় ভারতীয় সংযোগ রয়েছে। এহেন খালিজ টাইমস মার্চের ৩ তারিখে জেনারেল আসাদ দুররানীর পাকিস্তানের আদালতে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে যে সংবাদ প্রকাশ করেছে, তার একটি স্থানে খানিকটা আকস্মিকভাবেই লেখা হয়েছে,
“Another Rs. 50 million was allegedly paid to Bangladesh’s Khaleda Zia to help her in polls against Hasina Wajid’s Awami league generally perceived by Pakistan’s Security establishment as pro-India.”
(আরও পাঁচ কোটি রুপি বাংলাদেশের খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে সাহায্য করার জন্য প্রদান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যাকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ ভারতপন্থী রূপে বিবেচনা করে।)
একটু লক্ষ্য করলেই সংবাদটি প্রণয়নে চাতুর্য দৃষ্টিগোচর হবে। সংবাদে কোথাও সরাসরি বলা হয়নি যে, কথাগুলো জেনারেল দুররানী আদালতে তার এফিডেভিটে বলেছেন। কোনোরকম সূত্র উল্লেখ ছাড়াই পত্রিকাটি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কেবল রহস্যময় অভিযোগ উত্থাপন করে দায়িত্ব শেষ করেছে। মূল সংবাদের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক এবং উদ্দেশ্যমূলক এই খবর মধ্যপ্রাচ্যের একটি সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া মাত্র দিল্লির উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে। বাকি কাজটি সেখানকার জনৈক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী করে দিয়েছেন। পাঁচ কোটিকে পঞ্চাশ কোটি বানিয়ে বানোয়াট সংবাদটি দি ডেইলি মেইলের দিল্লিস্থ অনলাইন ভার্সন এবং ইন্ডিয়া টুডেকে তিনি গিলিয়েছেন। আর বাংলাদেশে প্রথম আলো’র ভূমিকার কথা আগেই বলেছি। দিল্লির এই চৌধুরী মহোদয় সম্পর্কে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন। দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী দিল্লিতে বাংলাদেশের মার্কিন ও ভারতপন্থী সুশীল (?) পত্রিকা প্রথম আলো’র প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এসব খবর গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিএনপি তার প্রতিবাদপত্রে দীপাঞ্জন চৌধুরীর প্রথম আলো সংযোগের কথা উল্লেখও করেছে। খালিজ টাইমস, প্রথম আলো, দি ডেইলি মেইল, ইন্ডিয়া টুডে এবং দীপাঞ্জন রায় চৌধুরীর নেকসাসের (nexus) স্বরূপ আশা করি, বাংলাদেশের জনগণের কাছে এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র বাসসও (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) পিছিয়ে থাকেনি। তারাও উপর মহলের নির্দেশানুযায়ী পাঁচ কোটিকে পঞ্চাশ কোটি বানানোসহ দিল্লির চৌধুরীর গাঁজাখুরি গল্প সোত্সাহে প্রচার করে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনসাপেক্ষে বেশ শক্ত একটা মামলার ঝুঁকি নিয়েছে।
পাঠক ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে, বিএনপির পক্ষ থেকে খালিজ টাইমস এবং প্রথম আলোতে প্রতিবাদ পাঠানোর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া গ্রুপ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। দি ডেইলি স্টার কোনো রাখঢাক না করেই ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের জন্য প্রথম পাতায় দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছে Daily Star’s stand corrected (ডেইলি স্টারের অবস্থান সংশোধন করা হলো)। প্রথম আলো তার অপকর্মের জন্য এখনও সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা না করলেও নানা রকম দুর্বল যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে এবং বিএনপি’র সংবাদ কয়েকদিন ধরে চোখে পড়ার মতো গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়ে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। ২০০৭ সালে আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে আপত্তিকর কার্টুন ও ব্যঙ্গাত্মক ছড়া ছাপিয়ে বিপদে পড়ার পর পুনর্বার প্রথম আলো’র সাংবাদিকতার নিগূঢ় উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনমনে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সেবার সম্পাদক মতিউর রহমান বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব উবায়দুল হকের হাঁটু স্পর্শ করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং প্রথম আলোতে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কার্টুনিস্টকে জেলে পাঠিয়ে নিজে রক্ষা পেয়েছিলেন। এখানেই আমার মতো ‘চান্স’ সম্পাদকের সঙ্গে তার মতো পেশাদার সম্পাদকের নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডের পার্থক্য।
আদালত অবমাননা মামলায় সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’ শিরোনামে আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সব দায় আপন কাঁধে নিয়ে আমি সহকর্মীদের অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলাম। সংবাদের শিরোনামটাও যে আমার দেয়া, সেটাও নিসংকোচে কবুল করেছিলাম। স্মরণে আছে বিচারপতি এমএ মতিন যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, সবার দায়িত্ব আপনি একা কেন নিচ্ছেন? প্রথম আলো’র পেশাদার সম্পাদক মতিউর রহমানের মতো বুদ্ধিমান হলে আমিও হয়তো সহকর্মী অলিউল্লাহ নোমানের ওপর সংবাদের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে লর্ডশিপদের হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে অবধারিত সাজা থেকে বাঁচার চেষ্টা করতাম। অন্যদের মতো করেই হয়তো ভাবতাম, আত্মমর্যাদা চুলোয় যাক, আগে জেল থেকে তো বাঁচি! এ রকম আচরণ করলে অবশ্য ভবিষ্যতে আর কোনোদিন আমার সহকর্মীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলতাম। তবে মিডিয়া জগতের সব নামি-দামি ব্যক্তির মানসম্মান জ্ঞান সচরাচর আমার সমতুল্য আমজনতার মতো এতটা ঠুনকো হয় না। বিপদে পড়লেই মাফ চাইতে তাদের একেবারেই বাধে না। এক এগারো’র সরকারের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার নামে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রীকে নির্বাসনে পাঠানোর পক্ষে ওকালতি করতে বাংলাদেশের সব সুশীল (?) সম্পাদকের বাধেনি। এখন একই ব্যক্তিরা আবার দেশবাসীকে অহরহ গণতন্ত্রের সবক দিয়ে যাচ্ছেন!
যাই হোক, যে কার্টুনিস্ট আমাদের মহানবীকে নিয়ে আপত্তিকর কার্টুন এঁকেছিল তার নাম আরিফুর রহমান। বর্তমানে সে নরওয়েতে প্রবাসী জীবনযাপন করছে। সম্প্রতি অন লাইন মিডিয়া বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম তার একটি সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেছে। আরিফুর রহমান সেই সাক্ষাত্কারে প্রথম আলো পত্রিকা এবং সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছে, ‘আমার কথা হচ্ছে, সম্পাদকের হাত দিয়ে অনুমতি পাওয়ার পরই তো কার্টুনটি ছাপা হয়েছে। এখানে দায়ভার যে শুধু আমার, তা নয়। আমি যা ইচ্ছে তা লিখতে ও আঁকতে পারি না। পত্রিকার সম্পাদক ছাপানোর উপযোগী মনে করেছেন বিধায় তা ছাপিয়েছেন। আমি এক নগণ্য কার্টুনিস্ট। আমি জেলে যাওয়ার পরদিন প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা আমাকে চেনে না। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রথম আলো আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নিজেদের গা বাঁচিয়ে আমাকে জেলে ঢুকিয়েছে।’
পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি পাঠকরা যাতে বুঝতে পারেন, সে কারণেই কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানের সাক্ষাত্কারের অংশবিশেষ আইএসআই সংবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত না হওয়া সত্ত্বেও উদ্ধৃত করলাম। অবশ্য, আইএসআই সম্পর্কিত সর্বৈব মিথ্যা সংবাদ ছাপানোর জন্য পত্রিকাটির কারও জেলে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, কারণ বিএনপি বর্তমানে ক্ষমতায় নেই। আর ক্ষমতায় থাকলেও প্রথম আলো’র কোনো সমস্যা হতো না বলেই আমি মনে করি। বিএনপি দলটিকে যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে, তাতে আমার ধারণা আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপিতেই বরঞ্চ প্রথম আলো সমর্থক লবি অনেক বেশি শক্তিশালী। কয়েকটা দিন প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় বিএনপি ও তার প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের খবর ভালো করে ছাপা হলেই সবকিছু ঠিকঠাক মতো ম্যানেজ হয়ে যাবে। চাই কি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান পুরস্কৃতও হতে পারেন। বিএনপি’র গত মেয়াদেও আওয়ামীপন্থী সম্পাদকদের নানারকম ন্যায্য-অন্যায্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ মার্কিন ও ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে থাকেন। এতসব বড় মুরুব্বি পাশে থাকলে বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। মতিউর রহমান এবং মাহমুদুর রহমানের ক্ষমতার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এদিকে সরকারের সোয়া তিন বছর মেয়াদ পার হয়ে গেলেও তাদের নির্বাচন-পূর্ব প্রতিশ্রুতি পূরণে পর্বতসমান ব্যর্থতার ফলে ক্ষুব্ধ জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য শেখ হাসিনার যে নতুন ইস্যুর প্রয়োজন ছিল, সেটি দুবাই-ঢাকা-দিল্লির দক্ষ কলাকুশলীরা মিলে তাকে তৈরি করে দিয়েছে। এদেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অবিরত মিথ্যাচার করে গেলেও দেশের কোনো আদালতেই তার মানহানির মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কাও নেই। কাজেই আইএসআই’র রুপি দেয়ার গল্প সত্য না মিথ্যা, সেটা তার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেখার বিষয় হলো, খালিজ টাইমস এবং প্রথম আলো তাদের গোয়েবলসীয় কারখানায় যে খবরটি উত্পাদন করেছে, সেই খবর ব্যবহার করে ক্রমেই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতখানি ফায়দা তুলতে পারেন। জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নানাবিধ বিচার ও মামলার অতি ব্যবহারে এবং যুদ্ধাপরাধের চর্বিত চর্বণে ভোটারদের বিরক্তির পারদ যে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে, সেটা সম্ভবত নীতিনির্ধারকরা ধারণা করতে পারছেন। অতএব, নতুন ইস্যুর জন্য হন্যে হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের কাছে আইএসআই সংশ্লিষ্ট কল্প-কাহিনী ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো করেই আবির্ভূত হয়েছে।
মহাজোটের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের কাছে ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, তারা অবাধ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সে কারণেই প্রশাসনকে ব্যবহার করে সরকার সর্বপ্রকার নিপীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে সম্পূর্ণ হীনবল করতে চাচ্ছে, যাতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে কোনো কার্যকর আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে না পারে। মার্চের ১২ তারিখে বিরোধী দলের ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি বানচালে সরকারের তিনদিনব্যাপী অঘোষিত কারফিউ, স্বাধীনতা দিবসে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে সাভার স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা প্রদান, ২৮ ডিসেম্বর জেনারেল জিয়ার ওপর লিখিত বইয়ের প্রকাশনা উত্সব গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি হস্তক্ষেপে বন্ধ করা, ইত্যাদি ক্ষমতাসীন নীতিনির্ধারকদের যুধ্যমান মনোভাবেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। জনসমর্থনের দিক দিয়ে পাল্লা অনেক ভারি হলেও সাংগঠনিকভাবে এখনও দুর্বল বিএনপি এসব আক্রমণের যুত্সই কোনো জবাব দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা তার দু’দফায় বিরোধী নেত্রীর ভূমিকা পালনকালে অতি ব্যবহারে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতালকে ভোঁতা করে দিয়ে গেছেন। তাছাড়া হরতাল পালনকালে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মীরা যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে, সেই সক্ষমতা বিএনপির কোনোকালেই ছিল না। দলের এই সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে সঙ্গত কারণেই হরতাল কর্মসূচির প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার যথেষ্ট অনীহা রয়েছে। ১২ই মার্চের মহাসমাবেশে কর্মসূচির নামে ১৭ দিন পরে ২৯ মার্চের হরতালের ঘোষণা দিয়ে এবং প্রথম সুযোগেই ঘোষিত হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়ে বিএনপি হরতাল পালনে তাদের অক্ষমতা আবারও প্রকাশ করেছে।
স্বাধীনতা দিবসে বেগম খালেদা জিয়ার চলাচলে বাধা প্রদান এবং জেনারেল জিয়ার ওপর লিখিত বইয়ের প্রকাশনা বন্ধ করার প্রতিবাদেও দল থেকে অতি দুর্বল কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। পুলিশের হাতে নিগৃহীত এবং জেলে যাওয়ার ভয়ে সর্বদা আতঙ্কিত নেতাকর্মী দিয়ে একদলীয় বাকশালী আদর্শে বিশ্বাসী মহাজোটের মতো চূড়ান্ত ফ্যাসিবাদী একটি সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি’র লড়াই করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আদায় করার সক্ষমতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের পাল্লাও এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার দিকেই অধিক মাত্রায় ঝুঁকে আছে বলেই মনে হচ্ছে। এই সরকারকে রক্ষায় দিল্লি কতদূর যেতে পারে, সেটা উপলব্ধির জন্য এক আইএসআই নাটক পর্যালোচনাই যথেষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব সুশীলদের সঙ্গে নিয়ে এক এগারোতে যে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় আরোহণের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল, তার থেকে নীতিগতভাবে সে সব রাষ্ট্র খুব একটা সরে গেছে এমনটি মনে করার সময় এখনও আসেনি।
পশ্চিমাদের অতি ঘনিষ্ঠ প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিরোধের সৃষ্টি না হলে আমরা হয়তো আজও বারিধারার গ্রিন জোনের সব বিদেশি বাসিন্দার সর্বক্ষণ সরকারের গুণকীর্তনে মুখর থাকতেই দেখতাম। এই সরকারের সোয়া তিন বছরে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, গণমাধ্যম এবং বিরোধী মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে, দেশের অর্থনীতি রসাতলে গেছে, সর্বব্যাপী দুর্নীতি পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়েছে, প্রশাসনে দলীয়করণের বিশ্ব রেকর্ড গড়া হয়েছে এবং সুশাসন নির্বাসনে গেছে। ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণী যে পরিমাণ অপকর্ম এ পর্যন্ত করেছে, সে তুলনায় তথাকথিত দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে তাদের সামান্যই সমালোচনা শুনতে হয়েছে। সুতরাং, ২০০৭-এর মতো কোনো একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিএনপি বিরত থাকলেও নির্বাচন প্রতিরোধে পশ্চিমাদের আগের মতো অতি উত্সাহী ভূমিকায় দেখা নাও যেতে পারে। সেই সময় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পটভূমি সৃষ্টির লক্ষ্যে একদিকে রাজপথে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি বিনা বাধায় দিনের পর দিন চালাতে দেয়া হয়েছে এবং অপরদিকে মিডিয়া ও ব্যবসায়ী সংগঠনকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দিল্লির ইঙ্গিতে দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে কীভাবে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা যেতে পারে, তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত আইএসআই নাটক। এখান থেকেই ধারণা করা যেতে পারে, নির্বাচন এগিয়ে এলে এসব পত্রপত্রিকা বিএনপি’র বিরুদ্ধে কতটা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই সম্পর্কেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির প্রথম দাবি উত্থাপিত হয়েছিল এফবিসিসিআই থেকেই। আগামী নির্বাচনের সময় আগের মতো রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে একই এফবিসিসিআই সম্পূর্ণ উল্টো সুরে গান গাইবে বলেই আমার ধারণা। গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে একতরফা নির্বাচনের পক্ষেই সংগঠনটির কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক বর্তমান সভাপতি একে আজাদ কিংবা তারই মতো অন্য কোনো ব্যবসায়ী বিবৃতি দেবেন, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর টপ ব্রাসের (Top Brass) পক্ষপাতমূলক ভূমিকার ধারাবাহিকতাতেই বেগম খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আইএসপিআর কর্তৃক চরিত্রহনন এবং মাত্র কিছুদিন আগের কথিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়ানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর লেখা বইয়ের প্রকাশনা উত্সব বন্ধ করার পেছনেও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সরাসরি সংযোগের দুর্ভাগ্যজনক খবর প্রচারিত হয়েছে। সুতরাং দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে সম্পৃক্ত করা না গেলে বাংলাদেশে অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনোরকম সম্ভাবনা আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। বিএনপি নেতৃত্বের যে অংশ রাজপথে আন্দোলন ব্যতিরেকে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর রয়েছেন, তাদের প্রতি অনুকম্পা জানানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। আইএসআই নাটককে একটি বিপদ সংকেত বিবেচনা করে দ্রুততার সঙ্গে সর্বাত্মক আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের কোনো বিকল্প বিএনপি’র সামনে খোলা নেই। একমাত্র জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছেই পূর্ব-পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদীরা পরাজিত হতে পারে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : ছিটমহলবাসীর বঞ্চনা



মাহমুদুর রহমান
গত সপ্তাহে অনশনরত ছিটমহলবাসীর দুঃখ-কষ্টের কাহিনী সরাসরি জানার জন্য অনেকটা হঠাত্ করেই পঞ্চগড়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়কের ঠিক পাশেই অনশনস্থলে গিয়ে জানলাম, ওটাই নাকি ভারতীয় ছিটমহল। বাংলাদেশের একেবারে ভেতরে ভারতীয় ছিটমহলের অবস্থান কী করে সম্ভব, সেটা জানার জন্য র্যাডক্লিফ সাহেবের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু সেটা তো এই জীবনে আর সম্ভব হচ্ছে না। মরার পর তার সঙ্গে দেখা হবে কি-না, সেটাও একমাত্র আল্লাহই জানেন।
স্যার খেতাবপ্রাপ্ত সিরিল র্যাডক্লিফ (Cyril Radcliffe) ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানা ভাগাভাগি করার কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের তত্কালীন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন (Lord Louis Mountbatten) এবং স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ বিলেতে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছিলেন। পরম বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পাক-ভারত উপমহাদেশকে দুই ভাগ করার গুরুদায়িত্ব যে ব্যক্তিটির ওপর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণী অর্পণ করেছিল, সেই সিরিল র্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালের আগে কোনোদিন এই অঞ্চলে পা রাখেননি। সে বছর ৮ জুলাই দিল্লিতে আসার পর তাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে বৈরী দু’টি প্রতিবেশী স্বাধীন দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। তিনি নিজের মতো করে সীমানা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন করে ১৫ আগস্ট বিলেতে ফিরে যান।
বিস্ময়ের আরও বাকি আছে। পাকিস্তান এবং ভারত যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করলেও সীমানা ভাগাভাগির কাগজপত্র সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। সীমান্ত নিয়ে এই সংশয়ের কারণেই ওইদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদায় পাকিস্তানি পতাকা উড্ডীন ছিল। হিন্দু-মুসলমানের হানাহানি এড়ানোর অজুহাতে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ সীমানা নির্ধারণের পুরো কাজটি অতি গোপনে সম্পন্ন করেন এবং ভারত ত্যাগের আগে তিনি এ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র রহস্যজনকভাবে পুড়িয়েও দিয়ে গেছেন।
তবে অনেক ঐতিহাসিকই এই গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, মাউন্টব্যাটেন দম্পতির সঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে ভারতীয় কংগ্রেস সব তথ্যই আগেভাগে পেয়েছিলেন। অন্ধকারে যদি প্রকৃতই কেউ থেকে থাকে, তাহলে তিনি ছিলেন মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অবশ্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন সবসময়ই দাবি করে গেছেন যে, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে বিশেষ ব্যক্তিগত সখ্য থাকলেও মুসলমানদের সঙ্গে তিনি কোনো প্রতারণা করেননি। র্যাডক্লিফ সাহেব যেহেতু প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়ে গেছেন, তাই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দাবির সত্যতা দীর্ঘ ৬৫ বছর পর নিরূপণের কোনো সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের মোট ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক লাখ অধিবাসী র্যাডক্লিফ এবং মাউন্টব্যাটেনের খেয়ালখুশির অসহায় শিকার হয়ে আজ পর্যন্ত নিজভূমে পরবাসীর জীবনযাপনে যে বাধ্য হচ্ছেন, সেটা সর্বাংশে বাস্তব। আরও বাস্তব হলো, ছিটমহলবাসীর মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের জনগণই রয়েছেন। দেশভাগ নিয়ে হানাহানি এড়ানোর যে লক্ষ্যের কথা ব্রিটিশ শাসকরা প্রচার করেছিলেন, সেটিও শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। ১৯৪৭ সালে এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিল এবং দাঙ্গায় নিহতের সংখ্যা তথ্যভেদে ২ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত দাবি করা হয়ে থাকে। এবার বর্তমানে ফিরে আসি।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পুটিমারী ছিটমহলে পৌঁছাতে বিকাল চারটা হয়ে গিয়েছিল। সেখানে তখন শ’দুয়েক নারী-পুরুষ এবং শিশু সামিয়ানার নিচে বসে আছেন। নারীদের মধ্যে শাখা-সিঁদুর পরিহিতাদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। অর্থাত্ সমস্যাটির সঙ্গে কোনোরকম সাম্প্রদায়িকতা জড়িত নেই। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে ঢাকা থেকে গেছি জেনে উপস্থিত আন্দোলনরত ছিটমহলবাসী অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। আমি কথা দিলাম, আমার দেশ পত্রিকা অন্তত এই অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশে থাকবে। গোলাম মোস্তফা তার মোবাইলের মাধ্যমে সমন্বয় কমিটির ভারতীয় ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের সঙ্গে আমাকে কথা বলিয়ে দিলেন। তিনি তখন টানা ২৪ দিনের অনশনে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। দীপ্তিমান জানালেন, ২০০৯ সালে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি টানা ২৪ দিন অনশন করেছিলেন। সেই সময় তার অনশনের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তত্কালীন বামফ্রন্ট রাজ্য সরকার আলোচনায় বসেছিল। অথচ ছিটমহলবাসী ২৪ দিন অনশন করলেও তাদের সঙ্গে সেই মমতা ব্যানার্জির সরকারের কেউ যোগাযোগ করেননি, স্বাস্থ্যের খোঁজখবরও নেননি। আমি উভয়পক্ষকে অনশন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে অন্য কোনো পন্থায় তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিলাম।
বাংলাদেশের গোলাম মোস্তফা কিংবা ভারতের দীপ্তিমান কেউই অনশন ভঙ্গ করতে সম্মত হলেন না। তাদের সম্মিলিত দাবি, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। সে পর্যন্ত তো বটেই, দুই দেশের মধ্যে চুক্তি না হলে আমৃত্যু তাদের অনশন চলবে। এই সিদ্ধান্তে কষ্ট পেলেও বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে লেখালেখির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের জনগণকে ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার চেষ্টার বাইরে কিছু করার সাধ্য আমার নেই। উভয় রাষ্ট্রের সরকার এদের প্রতি যে নির্লিপ্ততা দেখাচ্ছে, তাকে ধিক্কার জানানো আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। বিশেষত আমরা যারা মানবাধিকারের কথা বলি, তাদের পক্ষে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার সুযোগ নেই। কয়েক লাখ মানুষ ৬৫ বছর ধরে ভূমিপুত্র হয়েও নাগরিকের অধিকার পাবেন না—এমন অবিচার মেনে নেয়া যায় না। তাদের ভোটাধিকার নেই, লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, চিকিত্সার অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং কৃষি ছাড়া কর্মসংস্থানেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ কাগজে-কলমে সেই ১৯৫৮ সালেই সমস্যাটির একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধান হয়ে আছে। কেবল সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণীর মানসিক দীনতা ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার জন্যই সেই সমাধান আজও বাস্তবে রূপ নেয়নি। এই প্রসঙ্গে আবারও খানিক ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করা যাক।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুই দেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটির শিরোনাম ছিল : “Agreement between the Government of the Republic of India and Government of the People’s Republic of Bangladesh concerning the demarcation of the land boundary between India and Bangladesh and related matters.” চুক্তির এক নম্বর ধারার ১২ নম্বর উপধারায় ছিটমহল বিনিময়ের কথা এভাবে বলা হয়েছে :
“12. Enclaves
The Indian enclaves in Bangladesh and the Bangladesh enclaves in India should be exchanged expeditously, excepting the enclaves mentioned in paragraph, 14 without claim or compensation for the additional area going to Bangladesh.”
(বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় করা হবে, কেবল ১৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ছিটমহল এই বিনিময়ের বাইরে থাকবে এবং বাংলাদেশ যে অতিরিক্ত জমি পাবে তার জন্য অপরপক্ষ কোনো দাবি উত্থাপন করবে না অথবা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে না।)
উপরে উদ্ধৃত ধারায় বর্ণিত ১৪ অনুচ্ছেদ বেরুবাড়ী সম্পর্কিত, যেখানে বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতকে দেয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং ছিটমহলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ড সংযুক্ত করার জন্য তিন বিঘা জমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিষয়টি ভারতীয় লোকসভায় ১৯৭৪ সালের ২২ জুলাই এক বিবৃতির মাধ্যমে তত্কালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং অবহিত করেন। একই বিষয়ে ২৬ জুলাই লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে ভারতীয় উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরেন্দ্র পাল সিং বলেন :
“(a) Hon’ble Members will recall that under the Nehru-Noon Agreement of 1958 it was provided that, besides exchange of all Indian and Pakistani enclaves, as they then were, the four enclaves adjacent to the southern half of Berubari Union No. 12 would be transferred to the then East Pakistan, together with that portion of Berubari.
Under the recent Agreement with Bangladesh it has been agreed that these four enclaves, and the portion of Berubari that was to be transferred, will remain with India. In exchange Bangladesh will retain the enclaves of Dahagram and Angarpota.
(b) The area thus to be retained by India is estimated at approximately 7.0 square miles and the area retained by Bangladesh at 7.21 square miles.
(c) Since India and Bangladesh both thus retain areas at present in their possession, persons of these areas are not affected.”
(ক. সম্মানিত সদস্যদের স্মরণে আছে যে, ১৯৫৮ সালের নেহরু-নুন চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সব ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে, বেরুবাড়ী ইউনিয়ন ১২’র দক্ষিণ অর্ধের পার্শ্ববর্তী চারটি ছিটমহল এবং বেরুবাড়ীর ওই অংশ পাকিস্তানের অনুকূলে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
সাম্প্রতিক চুক্তিতে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে, ওই চারটি ছিটমহল এবং বেরুবাড়ীতে যে অংশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেগুলো ভারতের সঙ্গেই থাকবে। বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম ও অঙ্গরপোতা ছিটমহল পাবে।
খ. এই চুক্তির ফলে ভারত প্রায় ৭.০ বর্গমাইল এবং বাংলাদেশ প্রায় ৭.২১ বর্গমাইল এলাকা প্রাপ্ত হবে।
গ, যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশ যার যার ভোগদখলকৃত ছিটমহলগুলো নিজেদের অধিকারে রাখবে, কাজেই ছিটমহলের জনগণ এই বিনিময়ের দ্বারা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।)

চুক্তির আইনি ভাষার মারপ্যাঁচ বিবেচনার বাইরে রেখে নেহরু-নুন চুক্তির ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ছিটমহল হস্তান্তর বিষয়ে যে চুক্তি করেছিলেন, সহজ বাংলায় তার মূল কথা আমার কাছে অন্তত নিম্নরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে :
১। বেরুবাড়ী ছাড়া বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সব ছিটমহল যত দ্রুত সম্ভব বিনিময় করা হবে।
২। ছিটমহলের অধিবাসীরা যার যার বর্তমান অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।
৩। নুন-নেহরু চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী পাকিস্তানের অংশ হলেও মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে সেই ছিটমহলটি ভারতের অংশরূপে রেখে দিয়ে তার বিনিময়ে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং তিনবিঘা করিডোর চিরস্থায়ীভাবে বাংলাদেশকে দেয়া হবে।
১৯৭৪ সালে চুক্তি প্রণয়নের পর ৩৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার অংশটুকু বাস্তবায়ন করলেও ভারত নানা অজুহাতে অদ্যাবধি সময়ক্ষেপণ করে চলেছে। ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের সংসদে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী গৃহীত হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ বেরুবাড়ীর ওপর থেকে তার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী তার বিনিময়ে দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহল পাওয়া গেলেও তিনবিঘা করিডোরের মালিকানা আমরা আজ পর্যন্ত পাইনি। প্রায় ৩৭ বছর পর ২০১১ সালে ছিটমহলবাসীকে মূল ভূখণ্ডে সার্বক্ষণিক যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ করিডোরটি ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে সম্মত হলেও তিনবিঘার মালিকানা কিন্তু পাওয়া যায়নি। বিস্ময়করভাবে তিনবিঘা করিডোর সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ প্রাপ্তিকেই বর্তমান সরকার তাদের রাজনীতির বিপুল বিজয়রূপে অভিহিত করে চলেছে।
কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক দলীয় সভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যঙ্গ করে বলতে শুনেছি, আমরা ভারতের কাছ থেকে তিনবিঘা আনতে পেরেছি, আপনি ক্ষমতায় গেলে কি সেটা ফিরিয়ে দেবেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তিনবিঘা আনতে পারেননি, ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছেন মাত্র। দেশের জনগণকে অর্ধসত্য বলে বিভ্রান্ত করা হলে আন্তর্জাতিক চুক্তি পালনে সবসময় উদাসীন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকেই প্রকারান্তরে সহায়তা করা হবে। অবশ্য ভারতপ্রেমে অন্ধ আওয়ামী-জাতীয় পার্টি জোট সরকারকে এসব কথা বলা আর উলু বনে মুক্তা ছড়ানোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
মোদ্দা কথা, ভারত সরকারের অসহযোগিতার কারণেই ছিটমহলবাসী ৬৫ বছর ধরে ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকার মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সর্বতোভাবে বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে বার বার অনুরোধ করলেও আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশী নির্বিকার থেকেছে। তাই বাধ্য হয়েই আজ ছিটমহলবাসী আমরণ অনশন করার মতো চূড়ান্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি ভারত সরকারের উপেক্ষার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ভারত-তোষণনীতি যুক্ত হয়ে ছিটমহলবাসীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে অধিকতর কঠিন করে তুলেছে। ক’দিন আগে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ছিটমহলবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে দাবি করেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নাকি ভারতীয় লোকসভা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুমোদন করবে। এ দেশের জনগণের প্রতি এই শেকড়বিহীন লোকটির যে ন্যূনতম মমত্ববোধ নেই, তার প্রমাণ দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে অবহেলিত, নির্যাতিত ছিটমহলবাসীকে আরও ধৈর্যধারণের উপদেশ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছেন। তিনি ভুলে গেছেন, একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া আর কোথাও বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলবাসীর মতো নিজভূমে পরবাসী হওয়ার নজির নেই। গত সপ্তাহে পঞ্চগড়ে ছিটমহলবাসীকে কথা দিয়ে এসেছিলাম আমার দেশ তাদের সংগ্রামের সাথী হবে, আমিও পরবর্তী মন্তব্য প্রতিবেদনে তাদের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরব। বাংলাদেশের গোলাম মোস্তফা এবং ভারতের দীপ্তিমান সেনগুপ্তকে উদ্দেশ করে বলছি, আমার এই লেখায় সেই কথা রাখার চেষ্টা করেছি। আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন পড়ে দেশের সচেতন নাগরিক অধিক সংখ্যায় যদি ছিটমহলবাসীর দাবির প্রতি একাত্মতা জানান, তাহলে আমার বিশ্বাস ভারত এবং বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে অবশ্যই বাধ্য হবে।
ই-মেইল- admahmudrahman@gmail.com

মন্তব্য প্রতিবেদন : রাষ্ট্রপতির নৈতিকতার পরীক্ষা



মাহমুদুর রহমান
আজ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক সংলাপের কথা রয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্ভবত নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এটাই বিএনপির সঙ্গে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান জানুয়ারির ১১ তারিখ এই সংলাপের দিন কেন নির্ধারণ করলেন, সেটি আমার কাছে অন্তত রহস্যময় মনে হয়েছে। ২০০৭ সালে এই দিনটিতেই মইন-মাসুদ গং বন্দুকের নলের মুখে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে জরুরি আইন জারিতে বাধ্য করেছিল। হয়তো তারিখটির সংবেদনশীলতার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সেই সময়ের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আজকের রাষ্ট্রপতি অনুধাবন করতে পারেননি। আবার এটাও হতে পারে বিশেষ তারিখটি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে সৌভাগ্যের বারতাবাহী।
যে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে সংলাপ অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক এবং ইতিবাচক প্রক্রিয়া। তবে সেই সংলাপ সফল হওয়ার জন্য এজেন্ডা নিয়ে আলোচনারত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আগে থেকেই মতৈক্য অত্যাবশ্যক। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে তার সর্বশেষ রোডমার্চ সমাপনী বক্তৃতায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তন বিষয়ক আলোচনাকেই তাদের পক্ষের প্রধান এজেন্ডা রূপে ঘোষণা করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এটি নতুন অথবা অপ্রত্যাশিত কোনো বক্তব্য নয়। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল বিষয়ক পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বাইরের কোনো বিষয়ে আলোচনায় তার সম্মতি জ্ঞাপন করেননি। উল্লেখ্য, এজেন্ডায় না থাকলেও দেশের অনেকগুলো রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ইতিমধ্যে জানিয়ে এসেছেন। এমতাবস্থায় সরকার গোঁ-ধরে বসে থাকলে আজকের আলোচনার পরিণতিও ২০০৬ সালের মান্নান ভূঁইয়া-আবদুল জলিলের ব্যর্থ সংলাপের অনুরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক দেখতে পাচ্ছি।
দেশের কোনো শান্তিপ্রিয় নাগরিকই ২০০৬-এর আওয়ামী লীগ পরিচালিত লগি-বৈঠার অমার্জনীয় বর্বরতার সময়ে প্রত্যাবর্তন করতে চাইবে না বলেই ধারণা করছি। বেগম খালেদা জিয়াও তার একাধিক বক্তব্যে বলেছেন যে, তিনি আওয়ামী লীগের সেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি অনুসরণ করবেন না। তবে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ সফল করার গুরুদায়িত্ব সঠিকভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রতিপালন এবং নৈতিকতার স্বার্থে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকেই গ্রহণ করতে হবে। ১৯৯৫ সালে আজকের রাষ্ট্রপতি যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণয়নের দাবিতে চলমান সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকালে তার নিজের দেয়া বক্তব্য-বিবৃতি থেকে কয়েকটি মাত্র তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং দেশবাসীকে অবহিত করা একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দায়িত্ব বিবেচনা করে এই লেখায় উদ্ধৃত করছি :
১. “প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকার মানসিকতার কারণে দেশ আজ গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিপতিত। বেগম জিয়ার দায়িত্বহীনতা ও গণবিরোধী ভূমিকার কারণে বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যগণ পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের মাধ্যমে সংসদ ও সরকার বৈধতা হারাইয়াছে। কাজেই বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নাই। তিনি শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানান।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ২ জানুয়ারি ১৯৯৫

২. “আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা একযোগে পদত্যাগের পরও সরকারের বোধোদয় ঘটিতেছে না। এখনও সংলাপের নামে টালবাহানা করা হইতেছে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদকে পদত্যাগ করিতে হইবে এবং সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে নির্বাচন দিতে হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জানুয়ারি ১৯৯৫

৩. “প্রধানমন্ত্রীকে ৯০ দিন আগে পদত্যাগ করিয়া ও সংসদ ভাঙিয়া দিয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হইবে। অন্য কোনো পথ পন্থা মানিয়া নেওয়া হইবে না। খালেদা জিয়ার অধীনে কোনো নির্বাচনে বাংলার জনগণ অংশ নেবে না।”—
১৯৯৫ সালের ১২ নভেম্বর ৬ দিনব্যাপী হরতালের প্রথম দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে দেয়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের বক্তব্য।

৪. “ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের পদত্যাগ, অবৈধ সংসদ বাতিল ও সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে এবং লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদে আহূত ৬ দিনের হরতালের দ্বিতীয় দিনেও ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হইয়াছে। আগামী দিনের হরতালও একইভাবে পালন করিয়া সরকারকে গণদাবি মানিয়া নিতে বাধ্য করা হইবে।” —
১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত জনসভায় জিল্লুর রহমান

৫. “আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বলেন, জনগণের আন্দোলনে বাধ্য হইয়া বেগম খালেদা জিয়া উপনির্বাচন বাতিল করিতে এবং অবৈধ সংসদ ভাঙিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন। ইনশাআল্লাহ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে পদত্যাগে বাধ্য করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করা হইবে।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ ডিসেম্বর ১৯৯৫

৬. “জিল্লুর রহমান বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় ’৮৮ স্টাইলের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করিয়াছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগে বলিয়াছেন, ‘তামাশা করার জন্য নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করি নাই’ এখন আবার বলিতেছেন, ‘নির্বাচন পিছানো যাইতে পারে।’ বস্তুত সবকিছুই হইতেছে গণদাবীকে উপেক্ষা করার গভীর ষড়যন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ এবং প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করাইয়া নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করিবেই।”—দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৫।
বিএনপির সঙ্গে আজ সংলাপের আগে রাষ্ট্রপতি আমার লেখাটি পড়বেন কিনা, অথবা আমার কোনো লেখা তিনি আদৌ পঠনযোগ্য বিবেচনা করেন কিনা, সেই তথ্য আমার কাছে নেই। তবে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সামরিক-বেসামরিক হর্তা-কর্তারা লেখাটির সারসংক্ষেপ সংলাপ শুরুর আগেই তার গোচরে নিলে এই জীবন সায়াহ্নে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের বিবেকবোধ জাগ্রত হতেও পারে।
১৯৯৫ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মহাজোটভুক্ত দলসমূহ ছাড়াও বিস্ময়করভাবে সেদিনের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। কেবল তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিও সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামীর তত্কালীন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমই উত্থাপন করেছিলেন। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের সেই দাবিটিকেই পরবর্তীকালে নিজেদের করে নিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে আজই অধ্যাপক গোলাম আযমকে কথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জবাব দিতে হবে। ইতিমধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে এক সময় পাশে বসিয়ে তত্কালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্বও করেছিলেন। আওয়ামী বন্ধুত্বের প্রতিদান স্বরূপ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ভোটব্যাংকে বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল। তখন অবশ্য আওয়ামী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, কলামিস্টরা জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকদের যুদ্ধাপরাধী নামে অভিহিত করে তাদের অস্পৃশ্য বিবেচনা করতেন না। আওয়ামী লীগের এ জাতীয় দ্বৈতনীতি বাংলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার দলটির নীতিনির্ধারকদের অন্যতম সমস্যা হলো যে, তারা বাংলাদেশের জনগণের স্মৃতিশক্তিকে বড়ই দুর্বল ভাবতে অভ্যস্ত। যাই হোক, আমি আজ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নৈতিকতার প্রশ্নে কলম ধরেছি। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ১৯৯৫ এবং ৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের নামে কতটা নৃশংসতা ও সহিংসতা প্রদর্শন করেছিলেন কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তাদের সেদিনের অবস্থান কী ছিল, সেগুলো আলোচনাবহির্ভূত রাখছি।
আমার বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে এখন চারটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমটি, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’, এই বহুল ব্যবহৃত সুবিধাবাদী বক্তব্য দিয়ে ১৯৯৫ সালের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার দেয়া বক্তৃতাকে আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাসঙ্গিক নয় বলে সংলাপে এড়িয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে তিনি কেবল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে পরামর্শের জন্যে সংলাপে ডেকেছেন দাবি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে তার এজেন্ডা-বহির্ভূত ঘোষণা করা। তৃতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আলোচনা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অধিকারবহির্ভূত দাবি করে বিতর্কটিকে সংসদের ঘাড়ে ফিরিয়ে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত রাষ্ট্রপতিকে উপরিউক্ত তিন কৌশলের যে কোনো একটি অবলম্বনের পরামর্শ দেবেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, ক্ষমতাসীন জোটের বাইরের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে কর্নেল অলি আহমদের এলডিপি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা রাষ্ট্রপতির আহূত সংলাপে যোগদান করে ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনের জোর দাবি জানিয়েছেন। তাদের এই ন্যায্য দাবির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে জনগণ এ পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারেনি। যে তিনটি রাজনৈতিক কৌশলের কথা বর্ণনা করেছি, তার সবগুলোই প্রবীণ রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানকে জীবনের এই প্রান্তসীমায় একজন চরম বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করবে। সেই রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নিশ্চিতভাবে ব্যর্থ হবে এবং দেশ অবধারিত সংঘাতের দিকে ধাবিত হবে। রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ধিকৃত হবেন। সুতরাং দেশকে সংকটমুক্ত করতে হলে এবং তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সম্মানজনক পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান চতুর্থ পথটিই কেবল অনুসরণ করতে পারেন। আমার ধারণা, চতুর্থ পথটি তার জন্য অবশ্যই কণ্টকাকীর্ণ হবে। পৃথিবীতে সত্যের পথ কোনোদিনই সহজ হয়নি। চার নম্বর পথটি বর্ণনার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক।
শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির উপর কেন এত বিরাগ, তার বিশ্লেষণ আমার গ্রেফতারের আগে এবং পরে বহুবার দিয়েছি। একই বিষয় নিয়ে এতবার লিখতে আমার কাছে যেমন ক্লান্তিকর বোধ হয়, একইভাবে আমি নিশ্চিত যে পাঠকরাও পড়তে বিরক্ত হন। তবে ৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের এক অনুুষ্ঠানে শেখ হাসিনা একটি রুচিবহির্ভূত বক্তব্য দেয়াতে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই পুরনো কাসুন্দি আবার ঘাঁটতে হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক এলেই যে বিরোধীদলীয় নেতাকে চ্যাংদোলা করে ক্ষমতায় বসাবে তার গ্যারান্টি কী?” শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তাকে চ্যাংদোলার পরিবর্তে এক সময়ের গ্রামবাংলার পর্দানশীন বধূদের মতো পাল্কিতে চড়িয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছেন কিনা, সেটা তারই ভালো জানার কথা।
তবে, শেখ হাসিনার বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, তিনি এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আতংকে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন। সেই আতংক কতটা ক্ষমতা হারানোর ভয়তাড়িত এবং কতটা বর্তমান প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে পুনরায় অসৌজন্যমূলকভাবে গ্রেফতার হয়ে সাবজেলে যাওয়ার আশংকায়, সেটাও একমাত্র তিনিই জানেন। মোদ্দা কথা, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার চরম অসন্তুষ্টির ঝুঁকি নিয়ে হলেও বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে এজেন্ডাভুক্ত করতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে জনমনে তার প্রতি হারানো শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সংসদীয় দলের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর দুর্নীতির দায়ে ১২ বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক পুত্রকে মার্জনা, নাটোরের কুড়িজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দলীয় ক্যাডারকে মার্জনাসহ একেবারে কারাগার থেকে মুক্তিদান এবং সর্বশেষ লক্ষ্মীপুরের অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের চিহ্নিত খুনি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী আওয়ামী লীগ নেতা ও মেয়র তাহেরের পুত্রের সাজা মওকুফ করে তিনি আওয়ামী লীগের একেবারে নীতিবিবর্জিত নেতা-কর্মী ছাড়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ চিরস্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে মহান আল্লাহ্ রাষ্ট্রপতিকে তার অতীত কর্মকাণ্ড থেকে ক্ষমা পাওয়ার সম্ভবত একটি শেষ সুযোগ দিয়েছেন। সেই সুযোগ গ্রহণ করে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহস নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবে তারই।
এক এগারোর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জিল্লুর রহমান সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করে তার দল এবং নেত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততা ও দায়বদ্ধতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করব, আজ দেশের জন্য এক এগারোর চেয়েও সংকটময় পরিস্থিতিতে তিনি এবার দলের পরিবর্তে রাষ্ট্র, জনগণ এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার দায়বদ্ধতার প্রমাণ রাখবেন। পরিণামে তাকে হয়তো রাষ্ট্রপতির পদ হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে। চারদলীয় জোট সরকার তাদেরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ২০০২ সালে বঙ্গভবন থেকে অত্যন্ত অসম্মানের সঙ্গে পত্রপাঠ বিদায় করে একটি মন্দ নজির স্থাপন করে গেছে। তারও আগে ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার সঙ্গেই তত্কালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহকে সরিয়ে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে এক লাফে রাষ্ট্রপতির আসনে বসে পড়েছিলেন। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ তত্কালীন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন বশংবদ সাবেক বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। তবে, সবগুলো ঘটনারই প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল।
আজকের সংলাপে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার বিনিময়ে তাকে বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হলেও ইতিহাসে তার অবস্থান উজ্জ্বল হবে। তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেন যে, বাংলাদেশের জনগণ একটি পক্ষপাতশূন্য নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করছে। দেশ-বিদেশে সর্বজনগ্রাহ্য সেই নির্বাচন করতে হলে স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাটাও আবশ্যক। এতক্ষণ আশাবাদের কথা শোনালেও বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নিরাশা দিয়েই লেখার সমাপ্তি টানব। ১৯৯৬ সালের সরকারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সংসদের এক বক্তৃতায় জিল্লুর রহমান তার নেত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করার লক্ষ্যে সম্ভবত অতিরিক্ত আবেগের বসে প্রধানমন্ত্রীকে সক্রেটিসের মত কালজয়ী মনীষীর সঙ্গে তুলনা করে ফেলেছিলেন। এ ধরনের চাটুকারিতা সংসদে প্রথমবারের মত নির্বাচিত ব্যাক বেঞ্চারদেরই (Back-bencher) কেবল মানায়। সেই জিল্লুর রহমান আজ মহামান্য রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করছেন। তিনি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় মানসিকতা কতখানি বর্জন করতে পেরেছেন, এই প্রশ্নের জবাব পেতে দেশের জনগণকে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com